৭৩-এর জাতীয় নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারি দলের লাগাতার ফ্যাসিস্ট আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসী এটাকে ‘সাধারণ নির্বাচন’ হিসেবে মানতে পারেননি। সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারিতা, একগুঁয়েমি, বিরোধীদলীয় কর্মী হত্যার মিলিত পটভূমিতে এ নির্বাচনকে সাধারণ মানুষ বরাবরই ‘আওয়ামী লীগের একক নির্বাচন’ হিসেবে বিবেচনায় নেয়। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর একের পর এক নির্যাতন, বিরোধী দলের জনসভা পণ্ড করা থেকে মিছিলে হামলা, অফিস তছনছ আর অগ্নিসংযোগ, বেতার-টিভির একদলীয় ব্যবহার, মনোনয়ন দাখিলে বাধাদান, এমনকি বিরোধী দলের প্রধানকে পর্যন্ত প্রকাশ্য আক্রমণ ও হত্যার চেষ্টা, প্রার্থী অপহরণ, গুপ্তহত্যা, গুম ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্কালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রহসনের আরেকটি দিক হলো তারা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত করে। বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শনের পরিবর্তে সমাজবিরোধী আখ্যায়িত করে হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ এবং নির্বিচারে হত্যা করে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিলের ওপর গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জ, সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রবের গাড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা, ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদকে ট্রাকের নিচে পিষে হত্যার চেষ্টা—এসবই হলো ক্ষমতাসীন দলের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নমুনা। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে একজন সাধারণ যুব-পাণ্ডা পর্যন্ত এ মানসিকতাই পোষণ করে যে, যে কোনো উপায়ে তা যতই অপরাধমূলক এবং অগণতান্ত্রিকই হোক না কেন, বিরোধী দলের জনপ্রিয় প্রার্থীদের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুতার মধ্যে কোথাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না। এসব বিষয়ে ওই সময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। নির্বাচনের দিন অর্থাত্ ’৭৩ সালের ৭ মার্চ দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন এবং একটি সম্পাদকীয় তুলে ধরা হলো—
বেতার টিভির একদলীয় ব্যবহার, মনোনয়ন দাখিলে বাধাদান,
প্রার্থী অপহরণ, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতির মুখে
আজ বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন
গণকণ্ঠ রিপোর্ট
৭ মার্চ, ১৯৭৩। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বুকে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে দেশটি, বিশ্বের নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে উপমহাদেশে যে তৃতীয় দেশটির জন্ম হয়েছে, সেই বাংলাদেশের আজ প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব খণ্ডের ৫৪,৫০১ বর্গমাইল ভূখণ্ডকে নিয়ে গঠিত এই দেশ আজ এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে। প্রায় ১৫ মাস আগে এই রাজধানীর সবুজ ঘাসে ভরা ইতিহাসখ্যাত রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করেছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানিদের ভাড়াটে বাহিনী। বাংলার শ্যামল পলিমাটিতে লালিত সন্তানদের চরম আত্মত্যাগের কাছে মাতৃভূমিকে বিদেশি হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করার মরণপণ সংগ্রামের কাছে, বিশ্বের স্মরণকালের অনেক তিতিক্ষার ইতিহাস, জাতিগত নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনের অনেক ইতিহাসই ম্লান হয়ে গেছে।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি পশুশক্তির আত্মসমর্পণের বিনিময়ে বাঙালিকে দিতে হয়েছে ৩০ লাখ তাজা প্রাণ, দিতে হয়েছে বাংলার কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, ইজ্জত। হারাতে হয়েছে এ দেশের অনেককিছুই। আর এই হারিয়ে যাওয়া অনেককিছুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯টি মাস যে সরকার কলকাতা প্রবাসী ছিল, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের দিনচারেক পর তা বিমানযোগে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করল।
১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের পূর্বখণ্ডে জয়ী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনের দোহাই পেড়ে যে একদলীয় সরকার গঠন করেছে, বাংলাদেশের বুকে গত সাড়ে ১৪ মাস ধরে সেই সরকার করেনি এমন কাজ নেই। বিশ্ব বিবেকের কাছে যা সবচেয়ে ঘৃণিত, নৈতিকতার কাছে যা সবচেয়ে অপরাধ, রাজনীতির ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত—এমনসব ক্রিয়াকাণ্ডের নায়ক হয়েছে আওয়ামী লীগ চালিত বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের স্বাধিকার-সচেতন বিপ্লবী জনতার দেশপ্রেমকে মূলধন করে পাকিস্তানি শাসন আর শোষণের ভাড়ারের করুণা থেকে বঞ্চিত আওয়ামী লীগ কর্তারা পাকিস্তানি শাসক আর শোষকগোষ্ঠীর অবর্তমানে নির্ঝঞ্ঝাটে, নিরুপদ্রবে পুরো দেশটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলেছে। ৮ শতাংশ বাঙালি শোষক এ দেশের মোট সম্পদের ৮৫ শতাংশের মালিক আজ। আর বাকি ৯২ শতাংশ বাঙালি শোষিতের মালিকানা আছে ১৫ শতাংশ সম্পদের ওপর।
বাংলাদেশের বুকে ’৭০-এর প্রাকৃতিক প্রলয় আর ’৭১-এর মনুষ্য সৃষ্ট মহাপ্রলয়ে বিশ্বের সহানুভূতিশীল দৃষ্টি পড়েছে এই জনপদের দিকে। তাই ’৭০-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যেমন বিশ্বের অগণিত রাষ্ট্র সাহায্যের হাতকে সম্প্রসারিত করেছিল, ১৯৭১-এর মহাপ্রলয়ের পরও বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিদেশিদের উদার হাত সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিকে ওরা পুষিয়ে দিয়ে আরও উদ্বৃত্ত করে দিয়েছে এ দেশকে।
অথচ আজকের বাংলার দিকে দৃষ্টি দিলে তো সম্পূর্ণ বিপরীত ছবিই ভেসে উঠছে। হতাশাগ্রস্ত জনগণ আজ জীবনের পর্বতপ্রমাণ বোঝা বইতে প্রাণান্ত হচ্ছে। আজ স্বাধীনতার স্বাধ তাদের কাছে তেতো ঠেকছে। দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতি, সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, আজ মেহনতী জনতাকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। আজ আওয়ামী লীগের সরকার সাড়ে ৭ কোটি জনতাকে বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের নির্বাসিত গণধিকৃত সামাজিক শত্রুদের নিয়েই মেতে উঠেছে। গণতন্ত্রের ঢালাও বুলি আওড়িয়ে, সংসদীয় গণতন্ত্রের তথাকথিত, পূজারী সেজে আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের গণতন্ত্রের নতুন নজির খাড়া করেছে। মুজিব সরকারের প্রশাসন এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে ভাতের বদলে যে ‘বাদ’কে উপহার দিয়েছে, সেই বাদের পয়লা স্তম্ভের নামই হলো এই মুজিব গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই, এ গণতন্ত্র সরকারী দল আর উপদল ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব স্বীকার করে না। নিরন্ন খেটে খাওয়া বাঙালির ট্যাক্সে চালিত সরকারি প্রচারমাধ্যম এই তথাকথিত গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। এই গণতন্ত্রে ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়ার বিরোধীদলীয় কর্মী থেকে শুরু করে নেতারা পর্যন্ত সবাই ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত হয়, তাদের জীবননাশ করা হয়, এ গণতন্ত্রে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শনের পরিবর্তে সমাজবিরোধী আখ্যায়িত করে হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এ গণতন্ত্রে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মুখে গ্রাস তুলে দেয়ার জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেয়া যানবাহন, হেলিকপ্টার পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা ও পাতিনেতাদের নির্বাচনী সফরের জন্য উলঙ্গভাবে ব্যবহৃত হয়। আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক সরকারের গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের এখানেই শেষ নয়। কিছু আওয়ামী কর্তা বড় সুচারুরূপেই ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সেই অভিনব গণতন্ত্রের আরও নজির খাড়া করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে এই ক’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগাররা এত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন, এত বেশি জনহিতৈষী ছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিরোধীদলীয় প্রার্থী নাকি মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। গোপালগঞ্জে আর বাকেরগঞ্জে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব, ভোলায় তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ, যশোরে পণ্যমন্ত্রী সোহরাব হোসেন, ফরিদপুরে ওবায়দুর রহমান, কিশোরগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নান্দাইলে রফিক ভূঁইয়া, কটিয়াদিতে মনোরঞ্জন ধর ও ভৈরবে জিল্লুর রহমান হচ্ছেন সেসব জনপ্রিয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী জননেতা। অথচ তাদের তথাকথিত নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা, সোচ্চার হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপ।
প্রার্থীদের অস্ত্রের মুখে শুধু মনোনয়নপত্র দাখিলেই বাধা দেয়া হয়নি, বহু জায়গায় তাদের একেবারে গায়েবও করা হয়েছে কিছুদিনের জন্য। বাকেরগঞ্জে জাসদ প্রার্থী ড. আজহার উদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনারের কাছে জাসদসহ সব বিরোধী দলই ওইসব এলাকার বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র ফের দাখিলের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। কিন্তু সে দাবি রক্ষিত হয়নি। ৩০০ আসনে জাসদ মনোনয়ন ঘোষণা করেও ক্ষমতাসীন চক্রের চরম সন্ত্রাসের মুখে বেশকিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র পেশ করার সুযোগ পাননি জাসদ প্রার্থীরা। এই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রের নমুনা।
এই বিচিত্র গণতন্ত্রের দেশে আজ ৭ মার্চ (বুধবার) জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৮ জন বাঙালিকে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের আর দলের পাশাপাশি বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ অথচ আদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে দৃঢ় সংগঠন—জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও অংশ নিচ্ছে এই নির্বাচনে। ৪ মাস বয়সের এ দলটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের খোলসে মুড়ে যে ঘৃণিত ধনবাদী সমাজ অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জাসদ তা হৃদয়ঙ্গম করেছে। তাই বর্তমান সামাজিক কাঠামোর এসব ‘গণরায়’ আসলে শোষণকে পোক্ত করার প্রকৃষ্ট উপায় বলেই জাসদ মনে করে। তবুও এই নির্বাচনের অসারতার কথা স্মরণে এনেও জাসদ ’৭৩-এর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জাসদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য—আমাদের লক্ষ্য শ্রেণী-শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তা সম্ভব। আর সেই বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছতে যে পথকে অতিক্রম করতে হবে, সে পথে শাশ্বত শ্রেণীদ্বন্দ্ব ধাপে ধাপে শোষকশোষিতের চরম সংঘর্ষের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করবে। এভাবেই হবে চূড়ান্ত সামাজিক বিপ্লব, যার মাধ্যমে অবসান ঘটবে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের। বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের প্রত্যক্ষ রায় নিয়ে যে দলটির সৃষ্টি, সেই দলটি কিন্তু তার বক্তব্যকে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে দিতে পারেনি, পারেনি আগামী দিনের বিপ্লবের সূর্য-সৈনিকদের সংগঠিত করার মতো প্রয়োজনীয় সংগঠন সর্বত্র খাড়া করতে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগে সারাদেশে জাসদের বক্তব্য পৌঁছিয়েছে, সর্বত্র সংগঠন খাড়া হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আঘাতকে প্রতিরোধ করার মতো সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। এ নির্বাচনে জাসদের অংশগ্রহণের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, দেশ থেকে সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদকে উত্খাত করা। সারাদেশে যেভাবে একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি কিছুসংখ্যক টাউট, সামাজিক শত্রুদের নিয়ে দাপট চালিয়ে যাচ্ছেন, তা যদি অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে, তবে এ দেশের মানুষের অধিকার বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী এবং নয়া উপনিবেশবাদী শক্তির ক্রীড়নক এই সরকার এক নদী রক্তের দামে কেনা এই দেশের সার্বভৌমত্বকে পর্যন্ত বন্ধক রাখতে চলেছে। এ নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, জনতার দরবারে তাদের চেহারাটাকে মেলে না ধরলে দেশপ্রেমিক মাত্রই নৈতিক অপরাধ করবেন। জাসদ তাই জনগণের দরবারে সেই বক্তব্য তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছে। এ নির্বাচনে জনগণের রায়ই বড় কথা। নির্বাচনে কারচুপি, জাল ভোট ইত্যাদি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবানরা চালাবেনই। এসবকে উপেক্ষা করেও বাংলার সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী জনগণের ওপর এই ফ্যাসিস্ট গণবিরোধী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে, সত্যিকার গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব বর্তিয়েছে। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ০৭ মার্চ ১৯৭৩)
নির্বাচন এবং তারপর ( সম্পাদকীয় : ৭ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক গণকণ্ঠ)
সারা বাংলাদেশে আজ সাধারণ নির্বাচন। বাংলাদেশের এ নির্বাচনে শাসক আওয়ামী লীগ সমস্ত বিরোধী সংগঠনগুলোর বিপরীতে গোড়া থেকেই যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তাতে এ নির্বাচনের ফলাফল দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে যাবে এমন আশা অতি আশা। অবশ্য যাদের চিন্তা-ভাবনা অনুক্ষণ দেশের শুভাশুভ নিয়ে আন্দোলিত হয় এ নির্বাচন তাদের সবাইকে প্রথম থেকেই নিরাশ করেছে। দেশের গণতন্ত্রকামী শক্তিসমূহ একের পর এক নির্যাতন আর পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। বিরোধী দলের জনসভা পণ্ড করা থেকে মিছিলে হামলা, অফিস তছনছ আর অগ্নিসংযোগ, গুপ্তহত্যা, গুম এমনকি বিরোধী সংগঠনের প্রধানকে পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে আক্রমণ করে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে এ হলো নিত্যকার খবর। এরি মাঝ দিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন এবং সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন, নির্বাচনের পূর্বে ক্ষমতা থেকে তাদের সরে আসবার কথা। না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ ব্যাহত হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কয়েক মাস আগে থেকেই এ মর্মে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। গণতন্ত্রকামী প্রতিটি দলই একাধিকবার এই দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু শাসক দল ক্ষমতার দর্পে সবকিছু উপেক্ষা করেছে, এমনকি গণতান্ত্রিক রীতি-নিয়মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তারা দেশের সমুদয় সম্পদকে তাদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে একটুও কুণ্ঠিত হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ত্রাণকার্যের জন্য বন্ধু-রাষ্ট্রের প্রদত্ত হেলিকপ্টার থেকে যানবাহন পর্যন্ত সবই তারা নির্বিচারে ব্যবহার করেছেন নির্বাচনী প্রচারে। অবশ্য আজকের দিনের জন্য এসবই পুরনো কথা। দেশের নির্বাচনের উপর এসবের নিশ্চিত প্রভাব পড়লেও সে কথা আমরা আজ তুলতে চাইনে। আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে যে আশংকা তা হলো, দেশের নির্বাচনোত্তর আবহাওয়া শান্ত থাকবে কি না, তাই নিয়ে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নির্বাচনী জনসভা থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীল দল এবং তাদের অন্যান্য সংগঠন একের পর এক হামলা চালিয়েছে এবং অবিরত হুমকি দিচ্ছে তাতে নির্বাচনোত্তরকালে বিরোধী দলগুলোর উপর আরো ব্যাপক আক্রমণের আশংকা করা যাচ্ছে।
৮ই মার্চ অর্থাত্ নির্বাচনের একদিন পর থেকে দেশে শুদ্ধি অভিযান চলবে বলে নানা মহল থেকে হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। বস্তুত শুদ্ধি অভিযানের নামে দেশে কী সব ঘটনা ঘটবে আমরা জানি না, তবে আমাদের আশংকা হয় বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এ শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। স্বাধীনতার পর বত্সারাধিক কাল যাবত্ দেশবাসী নানা ধরনের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উন্মত্ততা প্রত্যক্ষ করে আসছেন। ধৈর্য এবং তিতিক্ষার শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা। অভাবে অনটনে জর্জরিত হয়েও তারা ধৈর্য রক্ষা করেছেন। কিন্তু এরপরও যদি দেশবাসীর ধৈর্যের উপর আঘাত হানা হয়, দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের উপর অগণতান্ত্রিক হামলা চলতেই থাকে তবে দেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী মানুষ শান্তি এবং প্রগতির স্বার্থেই সেদিন রুখে দাঁড়াবে। অবশ্য আমরা আশা করি, কোনো ক্ষমতাদর্পীর উন্মত্ততা দেশকে সেই নিদারুণ অবস্থার মাঝে ঠেলে দেবে না। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ০৭ মার্চ ১৯৭৩)
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর জলিলের ওপর গুলিবর্ষণ ও বেয়নেট চার্জ, সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রবের গাড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা, ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদকে ট্রাকের নিচে পিষে হত্যার চেষ্টা—এসবই হলো ক্ষমতাসীন দলের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নমুনা। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে একজন সাধারণ যুব-পাণ্ডা পর্যন্ত এ মানসিকতাই পোষণ করে যে, যে কোনো উপায়ে তা যতই অপরাধমূলক এবং অগণতান্ত্রিকই হোক না কেন, বিরোধী দলের জনপ্রিয় প্রার্থীদের নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুতার মধ্যে কোথাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না। এসব বিষয়ে ওই সময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। নির্বাচনের দিন অর্থাত্ ’৭৩ সালের ৭ মার্চ দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন এবং একটি সম্পাদকীয় তুলে ধরা হলো—
বেতার টিভির একদলীয় ব্যবহার, মনোনয়ন দাখিলে বাধাদান,
প্রার্থী অপহরণ, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতির মুখে
আজ বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন
গণকণ্ঠ রিপোর্ট
৭ মার্চ, ১৯৭৩। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বুকে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে দেশটি, বিশ্বের নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে উপমহাদেশে যে তৃতীয় দেশটির জন্ম হয়েছে, সেই বাংলাদেশের আজ প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব খণ্ডের ৫৪,৫০১ বর্গমাইল ভূখণ্ডকে নিয়ে গঠিত এই দেশ আজ এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে। প্রায় ১৫ মাস আগে এই রাজধানীর সবুজ ঘাসে ভরা ইতিহাসখ্যাত রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করেছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানিদের ভাড়াটে বাহিনী। বাংলার শ্যামল পলিমাটিতে লালিত সন্তানদের চরম আত্মত্যাগের কাছে মাতৃভূমিকে বিদেশি হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করার মরণপণ সংগ্রামের কাছে, বিশ্বের স্মরণকালের অনেক তিতিক্ষার ইতিহাস, জাতিগত নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনের অনেক ইতিহাসই ম্লান হয়ে গেছে।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি পশুশক্তির আত্মসমর্পণের বিনিময়ে বাঙালিকে দিতে হয়েছে ৩০ লাখ তাজা প্রাণ, দিতে হয়েছে বাংলার কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, ইজ্জত। হারাতে হয়েছে এ দেশের অনেককিছুই। আর এই হারিয়ে যাওয়া অনেককিছুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯টি মাস যে সরকার কলকাতা প্রবাসী ছিল, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের দিনচারেক পর তা বিমানযোগে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করল।
১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তানের পূর্বখণ্ডে জয়ী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ’৭০-এর নির্বাচনের দোহাই পেড়ে যে একদলীয় সরকার গঠন করেছে, বাংলাদেশের বুকে গত সাড়ে ১৪ মাস ধরে সেই সরকার করেনি এমন কাজ নেই। বিশ্ব বিবেকের কাছে যা সবচেয়ে ঘৃণিত, নৈতিকতার কাছে যা সবচেয়ে অপরাধ, রাজনীতির ক্ষেত্রে যা সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত—এমনসব ক্রিয়াকাণ্ডের নায়ক হয়েছে আওয়ামী লীগ চালিত বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের স্বাধিকার-সচেতন বিপ্লবী জনতার দেশপ্রেমকে মূলধন করে পাকিস্তানি শাসন আর শোষণের ভাড়ারের করুণা থেকে বঞ্চিত আওয়ামী লীগ কর্তারা পাকিস্তানি শাসক আর শোষকগোষ্ঠীর অবর্তমানে নির্ঝঞ্ঝাটে, নিরুপদ্রবে পুরো দেশটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে ফেলেছে। ৮ শতাংশ বাঙালি শোষক এ দেশের মোট সম্পদের ৮৫ শতাংশের মালিক আজ। আর বাকি ৯২ শতাংশ বাঙালি শোষিতের মালিকানা আছে ১৫ শতাংশ সম্পদের ওপর।
বাংলাদেশের বুকে ’৭০-এর প্রাকৃতিক প্রলয় আর ’৭১-এর মনুষ্য সৃষ্ট মহাপ্রলয়ে বিশ্বের সহানুভূতিশীল দৃষ্টি পড়েছে এই জনপদের দিকে। তাই ’৭০-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর যেমন বিশ্বের অগণিত রাষ্ট্র সাহায্যের হাতকে সম্প্রসারিত করেছিল, ১৯৭১-এর মহাপ্রলয়ের পরও বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিদেশিদের উদার হাত সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিকে ওরা পুষিয়ে দিয়ে আরও উদ্বৃত্ত করে দিয়েছে এ দেশকে।
অথচ আজকের বাংলার দিকে দৃষ্টি দিলে তো সম্পূর্ণ বিপরীত ছবিই ভেসে উঠছে। হতাশাগ্রস্ত জনগণ আজ জীবনের পর্বতপ্রমাণ বোঝা বইতে প্রাণান্ত হচ্ছে। আজ স্বাধীনতার স্বাধ তাদের কাছে তেতো ঠেকছে। দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতি, সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, আজ মেহনতী জনতাকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। আজ আওয়ামী লীগের সরকার সাড়ে ৭ কোটি জনতাকে বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগের নির্বাসিত গণধিকৃত সামাজিক শত্রুদের নিয়েই মেতে উঠেছে। গণতন্ত্রের ঢালাও বুলি আওড়িয়ে, সংসদীয় গণতন্ত্রের তথাকথিত, পূজারী সেজে আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের গণতন্ত্রের নতুন নজির খাড়া করেছে। মুজিব সরকারের প্রশাসন এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে ভাতের বদলে যে ‘বাদ’কে উপহার দিয়েছে, সেই বাদের পয়লা স্তম্ভের নামই হলো এই মুজিব গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই, এ গণতন্ত্র সরকারী দল আর উপদল ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব স্বীকার করে না। নিরন্ন খেটে খাওয়া বাঙালির ট্যাক্সে চালিত সরকারি প্রচারমাধ্যম এই তথাকথিত গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে। এই গণতন্ত্রে ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়ার বিরোধীদলীয় কর্মী থেকে শুরু করে নেতারা পর্যন্ত সবাই ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত হয়, তাদের জীবননাশ করা হয়, এ গণতন্ত্রে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্ভ্রম প্রদর্শনের পরিবর্তে সমাজবিরোধী আখ্যায়িত করে হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এ গণতন্ত্রে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মুখে গ্রাস তুলে দেয়ার জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেয়া যানবাহন, হেলিকপ্টার পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা ও পাতিনেতাদের নির্বাচনী সফরের জন্য উলঙ্গভাবে ব্যবহৃত হয়। আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক সরকারের গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের এখানেই শেষ নয়। কিছু আওয়ামী কর্তা বড় সুচারুরূপেই ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সেই অভিনব গণতন্ত্রের আরও নজির খাড়া করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে এই ক’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগাররা এত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন, এত বেশি জনহিতৈষী ছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো বিরোধীদলীয় প্রার্থী নাকি মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। গোপালগঞ্জে আর বাকেরগঞ্জে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব, ভোলায় তার রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ, যশোরে পণ্যমন্ত্রী সোহরাব হোসেন, ফরিদপুরে ওবায়দুর রহমান, কিশোরগঞ্জে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নান্দাইলে রফিক ভূঁইয়া, কটিয়াদিতে মনোরঞ্জন ধর ও ভৈরবে জিল্লুর রহমান হচ্ছেন সেসব জনপ্রিয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী জননেতা। অথচ তাদের তথাকথিত নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা, সোচ্চার হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপ।
প্রার্থীদের অস্ত্রের মুখে শুধু মনোনয়নপত্র দাখিলেই বাধা দেয়া হয়নি, বহু জায়গায় তাদের একেবারে গায়েবও করা হয়েছে কিছুদিনের জন্য। বাকেরগঞ্জে জাসদ প্রার্থী ড. আজহার উদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনারের কাছে জাসদসহ সব বিরোধী দলই ওইসব এলাকার বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র ফের দাখিলের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। কিন্তু সে দাবি রক্ষিত হয়নি। ৩০০ আসনে জাসদ মনোনয়ন ঘোষণা করেও ক্ষমতাসীন চক্রের চরম সন্ত্রাসের মুখে বেশকিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র পেশ করার সুযোগ পাননি জাসদ প্রার্থীরা। এই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রের নমুনা।
এই বিচিত্র গণতন্ত্রের দেশে আজ ৭ মার্চ (বুধবার) জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৮ জন বাঙালিকে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের আর দলের পাশাপাশি বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ অথচ আদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে দৃঢ় সংগঠন—জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও অংশ নিচ্ছে এই নির্বাচনে। ৪ মাস বয়সের এ দলটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের খোলসে মুড়ে যে ঘৃণিত ধনবাদী সমাজ অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জাসদ তা হৃদয়ঙ্গম করেছে। তাই বর্তমান সামাজিক কাঠামোর এসব ‘গণরায়’ আসলে শোষণকে পোক্ত করার প্রকৃষ্ট উপায় বলেই জাসদ মনে করে। তবুও এই নির্বাচনের অসারতার কথা স্মরণে এনেও জাসদ ’৭৩-এর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জাসদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য—আমাদের লক্ষ্য শ্রেণী-শোষণহীন সমাজব্যবস্থা। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তা সম্ভব। আর সেই বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌঁছতে যে পথকে অতিক্রম করতে হবে, সে পথে শাশ্বত শ্রেণীদ্বন্দ্ব ধাপে ধাপে শোষকশোষিতের চরম সংঘর্ষের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করবে। এভাবেই হবে চূড়ান্ত সামাজিক বিপ্লব, যার মাধ্যমে অবসান ঘটবে শ্রেণী-দ্বন্দ্বের। বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের প্রত্যক্ষ রায় নিয়ে যে দলটির সৃষ্টি, সেই দলটি কিন্তু তার বক্তব্যকে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে দিতে পারেনি, পারেনি আগামী দিনের বিপ্লবের সূর্য-সৈনিকদের সংগঠিত করার মতো প্রয়োজনীয় সংগঠন সর্বত্র খাড়া করতে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগে সারাদেশে জাসদের বক্তব্য পৌঁছিয়েছে, সর্বত্র সংগঠন খাড়া হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আঘাতকে প্রতিরোধ করার মতো সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। এ নির্বাচনে জাসদের অংশগ্রহণের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, দেশ থেকে সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদকে উত্খাত করা। সারাদেশে যেভাবে একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি কিছুসংখ্যক টাউট, সামাজিক শত্রুদের নিয়ে দাপট চালিয়ে যাচ্ছেন, তা যদি অপ্রতিহত গতিতে চলতে থাকে, তবে এ দেশের মানুষের অধিকার বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী এবং নয়া উপনিবেশবাদী শক্তির ক্রীড়নক এই সরকার এক নদী রক্তের দামে কেনা এই দেশের সার্বভৌমত্বকে পর্যন্ত বন্ধক রাখতে চলেছে। এ নির্বাচনে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, জনতার দরবারে তাদের চেহারাটাকে মেলে না ধরলে দেশপ্রেমিক মাত্রই নৈতিক অপরাধ করবেন। জাসদ তাই জনগণের দরবারে সেই বক্তব্য তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছে। এ নির্বাচনে জনগণের রায়ই বড় কথা। নির্বাচনে কারচুপি, জাল ভোট ইত্যাদি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবানরা চালাবেনই। এসবকে উপেক্ষা করেও বাংলার সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী জনগণের ওপর এই ফ্যাসিস্ট গণবিরোধী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে, সত্যিকার গণপ্রতিনিধি নির্বাচনের গুরুদায়িত্ব বর্তিয়েছে। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ০৭ মার্চ ১৯৭৩)
নির্বাচন এবং তারপর ( সম্পাদকীয় : ৭ মার্চ ১৯৭৩, দৈনিক গণকণ্ঠ)
সারা বাংলাদেশে আজ সাধারণ নির্বাচন। বাংলাদেশের এ নির্বাচনে শাসক আওয়ামী লীগ সমস্ত বিরোধী সংগঠনগুলোর বিপরীতে গোড়া থেকেই যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তাতে এ নির্বাচনের ফলাফল দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে যাবে এমন আশা অতি আশা। অবশ্য যাদের চিন্তা-ভাবনা অনুক্ষণ দেশের শুভাশুভ নিয়ে আন্দোলিত হয় এ নির্বাচন তাদের সবাইকে প্রথম থেকেই নিরাশ করেছে। দেশের গণতন্ত্রকামী শক্তিসমূহ একের পর এক নির্যাতন আর পীড়নের সম্মুখীন হয়েছে। বিরোধী দলের জনসভা পণ্ড করা থেকে মিছিলে হামলা, অফিস তছনছ আর অগ্নিসংযোগ, গুপ্তহত্যা, গুম এমনকি বিরোধী সংগঠনের প্রধানকে পর্যন্ত প্রকাশ্যভাবে আক্রমণ করে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে এ হলো নিত্যকার খবর। এরি মাঝ দিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন এবং সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন, নির্বাচনের পূর্বে ক্ষমতা থেকে তাদের সরে আসবার কথা। না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ ব্যাহত হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কয়েক মাস আগে থেকেই এ মর্মে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। গণতন্ত্রকামী প্রতিটি দলই একাধিকবার এই দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু শাসক দল ক্ষমতার দর্পে সবকিছু উপেক্ষা করেছে, এমনকি গণতান্ত্রিক রীতি-নিয়মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তারা দেশের সমুদয় সম্পদকে তাদের নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যবহার করতে একটুও কুণ্ঠিত হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ত্রাণকার্যের জন্য বন্ধু-রাষ্ট্রের প্রদত্ত হেলিকপ্টার থেকে যানবাহন পর্যন্ত সবই তারা নির্বিচারে ব্যবহার করেছেন নির্বাচনী প্রচারে। অবশ্য আজকের দিনের জন্য এসবই পুরনো কথা। দেশের নির্বাচনের উপর এসবের নিশ্চিত প্রভাব পড়লেও সে কথা আমরা আজ তুলতে চাইনে। আমাদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে যে আশংকা তা হলো, দেশের নির্বাচনোত্তর আবহাওয়া শান্ত থাকবে কি না, তাই নিয়ে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নির্বাচনী জনসভা থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীল দল এবং তাদের অন্যান্য সংগঠন একের পর এক হামলা চালিয়েছে এবং অবিরত হুমকি দিচ্ছে তাতে নির্বাচনোত্তরকালে বিরোধী দলগুলোর উপর আরো ব্যাপক আক্রমণের আশংকা করা যাচ্ছে।
৮ই মার্চ অর্থাত্ নির্বাচনের একদিন পর থেকে দেশে শুদ্ধি অভিযান চলবে বলে নানা মহল থেকে হুমকি উচ্চারিত হচ্ছে। বস্তুত শুদ্ধি অভিযানের নামে দেশে কী সব ঘটনা ঘটবে আমরা জানি না, তবে আমাদের আশংকা হয় বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এ শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। স্বাধীনতার পর বত্সারাধিক কাল যাবত্ দেশবাসী নানা ধরনের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক উন্মত্ততা প্রত্যক্ষ করে আসছেন। ধৈর্য এবং তিতিক্ষার শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছেন তারা। অভাবে অনটনে জর্জরিত হয়েও তারা ধৈর্য রক্ষা করেছেন। কিন্তু এরপরও যদি দেশবাসীর ধৈর্যের উপর আঘাত হানা হয়, দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের উপর অগণতান্ত্রিক হামলা চলতেই থাকে তবে দেশের সাড়ে সাত কোটি শান্তিকামী মানুষ শান্তি এবং প্রগতির স্বার্থেই সেদিন রুখে দাঁড়াবে। অবশ্য আমরা আশা করি, কোনো ক্ষমতাদর্পীর উন্মত্ততা দেশকে সেই নিদারুণ অবস্থার মাঝে ঠেলে দেবে না। (দৈনিক গণকণ্ঠ : ০৭ মার্চ ১৯৭৩)
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন