মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ফারুকের ওপর পুলিশি হামলার মামলা খারিজ : পুলিশ সব পারে?



পুলিশ এবার হাতেকলমে প্রমাণ করে ছাড়ল যে ইচ্ছা করলে তারা সব পারে। দিনকে রাত, সাদাকে কালো—কী নয়! প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখলেন প্রকাশ্য রাজপথে সংসদ সদস্য ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পুলিশ এলোপাতাড়ি পেটাচ্ছে, মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে, গা উদোম করে বুকের ওপর বাঁশের মোটা লাঠি চেপে ধরেছে, এমনকি আত্মরক্ষার্থে দৌড়ানো অবস্থায় তাকে ধাওয়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মারমুখো পুলিশদের উত্সাহ দিচ্ছে। কেউ তা উপভোগ করছে। সাংবাদিকরা অকুস্থলে ছিলেন। সেদিন দেশের কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন একজন মানুষের ওপর একদল পুলিশের হামলার দৃশ্য। পরদিন দেশের সব পত্রপত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছে। এরপর ক্রমাগত এই অবাঞ্ছিত নৃশংস দৃশ্যের চলমান ও স্থির ছবি দেখে হামলাকারী পুলিশের কয়েকজনের মুখও মানুষের স্মৃতিতে আটকে রয়েছে। এখনও গণমাধ্যমে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসব ছবি টিভি পর্দায় ভেসে আসছে, ছাপা হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। অথচ ঘটনার প্রায় ১৪ মাস পর আহত-অপদস্থ ফারুককেই দোষী করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা। এতে বলা হয়েছে, হরতালে ফারুকের ওপর নির্যাতন করা হয়নি। অবশেষে মামলা খারিজ। অতঃপর আঁচ করা গেল, গত বছর ৬ জুলাই বিএনপির ডাকা হরতালের সময় পুলিশি হামলার ঘটনার পর ৭ জুলাই বিরোধীদলীয় এমপিরা থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ কেন মামলা নেয়নি। অবস্থাদৃষ্টে একথা মনে করার ঢের যুক্তি রয়েছে যে, ওইদিন যে কারণে মামলা নেয়া হয়নি, আদালতে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে তার একটি যোগসূত্র থাকতে পারে। ৩ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও গোয়েন্দা তথ্য বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিল করলে শুনানি হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দাখিলের জন্য সময় চান। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ের ওপর আদেশ দেবেন বলে এজলাস থেকে চলে যান এবং খাস কামরায় বসে সময়ের আবেদন নাকচ করে দেন। এতে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। অর্থাত্ আদালত মনে করেছেন, পুলিশের তদন্তটি ষোলআনা সত্য। পুলিশ নয়, বরং ঘটনার সূত্রপাত করার জন্য পুলিশের হাতে মারাত্মকভাবে জখম জয়নুল আবদিন ফারুক এবং অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতাই দায়ী। মাসের পর মাস গণমাধ্যম ফারুককে হারুন, বিপ্লব ও অন্যান্য পুলিশের পেটানোর যে দৃশ্য দেখিয়ে আসছে, তদন্ত কর্মকর্তা তার কোনোই সত্যতা খুঁজে পাননি। চিফ হুইপের মাথায় ১১টি এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে ৯টি মোট ২০টি সেলাই দিতে হয়েছিল হাসপাতালে, তদন্ত কর্মকর্তা নিশ্চয়ই তা জানেন। রাজপথে তো এদিন চিফ হুইপ ছিনতাইকারী, ডাকাত বা শত্রুর কবলে পড়েননি। এসব প্রশ্নের জবাব তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে বেশ গুছিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শাকে মাছ ঢাকলো কই? প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদিন নাকি এডিসি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চিফ হুইপকে গ্রেফতার করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। পরে দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি ও দৌড়াদৌড়ি হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ফারুকের হাতের ব্যান্ডেজ ও পরনের টি-শার্ট খুলে যায়। তখন পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের মধ্যে তাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হওয়ার সময় পুলিশ সদস্যের কোনো একজনের আঘাতে তার মাথা থেকে রক্ত বের হতে দেখা যায়। ‘এই কোনো একজন’ পুলিশ কে? পুলিশ কর্মকর্তা তার হেলমেট মাথায় থাকায় চিনতে পারেননি। যারা প্রত্যক্ষদর্শী তারা কিন্তু ঠিকই চিনেছেন। কারণ পুলিশের বুকের ওপর নেমপ্লেট থাকে। তাছাড়া দুই পুলিশের নাম দেখেই তো মোট ৩০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। ধস্তাধস্তির বিষয়টিও দ্বিপাক্ষিক। একজনের অবস্থা মরণাপন্ন, অন্যজনের গায়ে আঁচড় নেই। এই প্রথম জানা গেল, ধস্তাধস্তিতে গেঞ্জি মাথা গলিয়ে বেরিয়ে যায়। কথায় আছে, পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা। চিফ হুইপকে ছোঁয়ার পর তার সর্বাঙ্গে হয়েছে কুড়ি ঘা। এই প্রথম এও জানা গেল, পুলিশি হামলার যে শ’ শ’ ছবি প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে তা মিথ্যা, ক্যামেরার চোখ নষ্ট। আর সেসব ছবি যারা দেখেছে তারা অন্ধ। এগুলো বাংলা সিনেমার মারপিটের দৃশ্য, গোটা বিষয়টি নাটকীয়। চিফ হুইপের গা থেকে যে রক্ত বেরিয়েছে তা আসলে নকল রক্ত! আর হারুন ও বিপ্লব নামের পুলিশ এবং সেই হেলমেট পরা পুলিশকে পুলিশ কর্মকর্তা কী করে পাবেন? পেতেন যদি অভিযুক্ত পুলিশ মার খেতেন। ঘটনাটি অনেকটা এরকম দাঁড়াল—‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছো নয়নে নয়নে।’ পুলিশের গালিগালাজের ভাষা ব্রিটিশ আমল থেকে মানুষের জানা। তার মানে তো এই নয় যে, কায়দা পেলেই পুলিশ যাকে-তাকে শালা বলে বসবে, বিশেষত একজন পার্লামেন্ট সদস্য ও চিফ হুইপকে। তাহলে পুলিশ স্যালুট ঠুকবে কাকে? যা-ই হোক, মাননীয় আদালত পুলিশ তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনকে আমলে নিয়েছেন। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনো ঘটনা প্রমাণ করার জন্য আদালত জনমত, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, টেলিভিশনে প্রকাশিত-প্রচারিত দৃশ্যের ফুটেজ বিবেচনায় নিয়ে নিজ প্রজ্ঞার আলোকে মামলার নিষ্পত্তি করেন। আমাদের দেশেও তার বিস্তর দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসব হলে বাদীপক্ষ মামলা খারিজকে সন্তোষের সঙ্গে মেনে নিতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, এই প্রতিবেদন থেকে অন্তত এটা প্রমাণিত হলো যে, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন কী ভূমিকা রাখছে। এমনও তো শোনা গেছে যে, একজন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং চিফ হুইপের মতো সম্মানিত ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে, কাপড় খুলে আহত করার পরও অভিযুক্ত পুলিশের নাকি পদোন্নতি হয়েছে! গণমাধ্যমে এসব খবর বেরিয়েছে। অথচ মিডিয়ার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণকেই আমলে নিলেন না আলোচ্য তদন্ত কর্মকর্তা! এ অবস্থায় দেশবাসীর সামনে একটি প্রশ্ন আরও অনেক বড় হয়ে দেখা দিল—পুলিশ সব পারে?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads