মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

নিউইয়র্ক টাইমসের চোখে আমিনুল হত্যাকাণ্ড : এবার কী ব্যাখ্যা দেবে সরকার



শ্রমিকদের সংগঠিত করার কারণেই কি শ্রমিক নেতা আমিনুলকে হত্যা করা হয়েছে? এই প্রশ্নটি আমিনুল হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে দেশে ও বিদেশে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের কোনো শ্রমিক নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে এর আগে কখনও এত আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। অথচ সরকার অনেক হত্যাকাণ্ডের মতো এরও কোনো কিনারা করতে পারেনি। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হত্যাকারীরা কি এতই ক্ষমতাধর যে সরকার তাদের হদিস পাচ্ছে না? সম্প্রতি এসব প্রশ্ন সামনে রেখে এক সাড়াজাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। আমিনুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী এই প্রধান প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে আলোচ্য পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে। যার সারকথা হচ্ছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী বিশেষ করে এনএসআই আমিনুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমসে ‘ফাইটিং ফর বাংলাদেশ লেবার, অ্যান্ড এন্ডিং আপ ইনপপার’স গ্রেভ’ (বাংলাদেশ শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের পরিণতি বেওয়ারিশ লাশে পরিণত হওয়া) শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পত্রিকাটি আমিনুল হত্যায় কেন জড়িত থাকবে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী—তারও জবাব খুঁজেছে। বলা হয়েছে, পেশাদার বাহিনী বর্বর নির্যাতন করে আমিনুলকে হত্যা করেছে। তার ফোনে আড়িপাতা হতো। পুলিশ নিয়মিত তাকে হেনস্তা করত। তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, একবার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা তাকে অপহরণ করে বেদম প্রহার করে। আমিনুলকে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, তার আন্দোলন দেশের ক্ষতি করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলনের কারণে আমিনুল বাংলাদেশের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অত্যাবশ্যকীয় ফর্মুলা হচ্ছে সস্তা ও অসংগঠিত শ্রম। এখানে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক মাসে বেতন পান ৩৭ মার্কিন ডলার (মাত্র তিন হাজার টাকা)। পোশাক কারখানাগুলোয় শ্রমিক ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অবিশ্বাস। প্রসঙ্গত আমিনুল হত্যাকাণ্ডসহ শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশকে দেয়া বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করে দিতে ওয়াশিংটনের প্রতি আবেদন করেছে এএফএল-সিআইও। এসব তথ্য পরিবেশন করে নিউইয়র্ক টাইমস আরও জানিয়েছে, আমিনুলের কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়। ২০১০ সালে গার্মেন্টে তীব্র আন্দোলন শুরু হলে আমিনুল ও তার দু’জন বসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতার অভিযোগ আনা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলে আসছে। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়—বর্বরতা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার জন্য কুখ্যাত বাংলাদেশের পুলিশ। ক্ষমতাধরদের হয়ে পুলিশ প্রায়ই কাজ করে। নিজেদের লাভের জন্য সম্পদশালী ব্যবসায়ীদের পুলিশের সমর্থন কিনে নেয়ার ইতিহাস আছে। সময়মত বেতন না দেয়ায় শ্রমিকদের আন্দোলন দমনেও গার্মেন্ট মালিকরা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর মতে, ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে চার বছর পেরিয়ে গেলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত জানুয়ারি মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। উপরন্তু গুমের মতো নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মত দিয়েছে সংগঠনটি। অপহরণের পর অনেক লোকের আর হদিস মিলছে না। আমিনুলের সহকর্মীরা বিশ্বাস করেন তার ঘটনাটিও একই রকমের। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করছে সরকার। আমিনুলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাইরের বিশ্বের উদ্বেগে গত জুলাই মাসে হতাশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার কথা অসত্য। আমিনুল গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা ছিলেন বলে যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে তাও বিভ্রান্তিকর। উল্লেখ প্রাসঙ্গিক যে, নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর দৈনিক আমার দেশ-এ টাঙ্গাইলে পাওয়া একটি অজ্ঞাত লাশের ছবি ছাপা হয়। আমিনুলের পরিবার টাঙ্গাইল পৌঁছানোর আগেই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আমিনুলকে দাফন করে পুলিশ। পরে চিকিত্সকরা বলেছেন, তাকে রক্তাক্ত করে হত্যা করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত আলোচ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ঈষত্ সংক্ষেপিত আকারে ‘শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যায় সরকার জড়িত’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ ১১ সেপ্টেম্বর। এ ব্যাপারে সরকার কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা এখন দেখার বিষয়।
আমরা বরাবর বলে আসছি, একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। যে কোনো মূল্যে এ ধরনের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে ব্যর্থতার দায় কাঁধে নেয়ার অর্থ হচ্ছে, অপরাধপ্রবণতাকে উসকে দেয়া, পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে চূড়ান্তভাবে কালিমাযুক্ত করা। সে কাজটি অনেকক্ষেত্রেই হয়েছে। নিজেদের দায় এড়াতে বা অন্য কোনো কারণে সরকার এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। আমরা আবার আমিনুলসহ সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads