বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

‘তুই চোর’দের ডাকাতি ও লুটপাট



এমএ নোমান
যেখানেই মহাজোট সরকারের লোকদের পাওয়া যাবে সেখানেই ‘তুই চোর’ বলে একটি ধ্বনি ওঠাতে হবে। টিভি টকশো’তে দেয়া প্রবীণ সাংবাদিক ও সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম মূসার আবেগঘন ও গভীর তাত্পর্যপূর্ণ এই ‘তুই চোর’ উক্তিটি এখন শহর-নগর-বন্দর ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জের অলি-গলি এমনকি চায়ের দোকানেও ঝড় তুলেছে। পাবলিক বাস, ট্রেন, লঞ্চ, উড়োজাহাজ এমনকি শেয়ারে দু’জন রিকশায় উঠলেও তাদের মধ্যে এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হচ্ছে ‘তুই চোর’ প্রসঙ্গ।
সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্, শেয়ারবাজারের ত্রিশ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট, অর্থ কেলেঙ্কারির কারণে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে তিন বছরের উন্নয়ন বাজেটের টাকা লুট এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে ৩৪ হাজার কোটি টকা লোপাটসহ সরকারি দলের নানা কুকীর্তির বিবরণ তুলে ধরে সাংবাদিক সমাজের দিকপাল অগ্রজ মূসা ভাই সম্প্রতি এক টিভি টকশো’তে বলেছেন, সরকারের কোনো মন্ত্রী কিংবা সরকারি দলের কোনো লোককে যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই জনগণ তাদের দিকে ধেয়ে গিয়ে বলবে—‘তুই চোর’।
মূসা ভাইয়ের এই ‘তুই চোর’ তত্ত্বের চর্চা মোটামুটি শুরু হয়ে গেছে। বাস-গাড়িতে বিতর্কের সময় কেউ একজন খেয়ালের ভুলে সরকারের পক্ষ নিলে আর রেহাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে চারদিক থেকে সবাই ওই সরকার সমর্থককে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন—তুই চোর। যারা পাবলিক বাস কিংবা অন্যান্য গণপরিবহনে যাতায়াত করেন, তারা নিশ্চয়ই এর প্রমাণ পেয়ে গেছেন। গত কয়েকদিন ধরেই বাস-গাড়িতে ‘তুই চোর’ শব্দ দুটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে।
আমার বাসা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় আর কর্মক্ষেত্র হচ্ছে কারওয়ান বাজারে। ফলে প্রতিদিনই রাস্তায় কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে বসে পরিবহন রাজনীতির শিকার হতে হয়। তবে এখন একটা সুবিধা হচ্ছে যে, আগের মতো ঝগড়া-ঝাঁটি হচ্ছে না। যা হচ্ছে সবই একতরফা। ভাবলাম, ‘তুই চোর’ খেতাবের ভয়েই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ আর সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়ার সাহস করছে না।
কয়েকদিন আগে বাসে উঠেছি বাসার উদ্দেশে। বাসে আগে থেকেই চলছিল এসব আলোচনা। তরুণ বয়সের একজন যাত্রী বললেন, প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র থাকায় ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও বাকশালের শাসনের কথা মনে নেই। তবে রক্ষীবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বীভত্স কাহিনী, শেখ কামালের ব্যাংক লুট, বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা, সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া, লুটপাটের কারণে ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি শুনেছি। ওই সময়ের শাসন কেমন ছিল তা এখন শেখ হাসিনার শাসনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
তরুণ বয়সের এই যাত্রীকে থামিয়ে দিয়ে আরেকজন বলে উঠলেন, আরে ভাই শোনেন—বাকশালকে শুধু দেশের মানুষই ঘৃণা করেনি। শেখ সাহেবের পরিবারও ঘৃণা করেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র হত্যা করে মাত্র ১২ মিনিটের ব্যবধানে জাতীয় সংসদে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব বাসায় ফেরার পর তার স্ত্রী তাকে প্রথমে ঘরে ঢুকতে দিতে চাননি। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়েও তিনি নাকি দরজা না খুলেই চিত্কার-চেঁচামেচি করে শেখ মুজিবের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, আপনি আমাকে এই প্রতিদান দিলেন? আজীবন গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন। বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। আমি ঘর-সংসার সামলিয়েছি। অথচ আজ আপনিই নাকি বহুদলীয় গণতন্ত্র বিপন্ন করে একদলীয় বাকশাল করলেন।
ওই লোকটি আরও বললেন, শেখ হাসিনা তার নিহত বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করলেও ফের বাকশাল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এখনও প্রকাশ্যে দেননি। কাজেই বাকশাল যে একটি ঘৃণিত ব্যবস্থা ছিল তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার মরহুম মায়ের মতোই বিশ্বাস করেন।
শেয়ারবাজারের সর্বস্ব হারানোর ব্যথার কথা জানিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক বললেন, মুজিব আমলে ব্যাংক ডাকাতির কথা শুনেছি। ওই সময় হয়তো টেকনোলজি এত ডেভেলপ করেনি। ফলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে ডাকাতি করে টাকা লুট করতে হয়েছে। এখন প্রযুক্তি উন্নত হওয়ায় ডাকাতির পরিবর্তে ঘরে বসে লুটের ঘটনা ঘটছে। এই দেখেন না, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই কীভাবে যেন কারসাজি করে শেয়ারবাজারের সব টাকা লুট করে নিয়ে গেল। এবার ৩০ লাখ বিনিয়োগকারীকে পথে বসিয়ে কায়দা করে ৮০ হাজার কোটি টাকা লুট করে নিয়ে গেল। শোক সইতে না পেরে ৫ জন বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করল। এতেও কিন্তু সরকারের মন গলেনি।
ব্যাংক লুটের ঘটনা উল্লেখ করে ওই ব্যক্তি বললেন, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কীভাবে ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল সরকারের লোকেরা। এখন শুনছি সরকারি এ ব্যাংকগুলো নাকি বিক্রির চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। ব্যাংক ডাকাতি ও ব্যাংক লুট থেকে এখন ব্যাংক বিক্রি? অথচ ৪ হাজার কোটি টাকা লুটের ঘটনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটা তেমন কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের মন্ত্রীদের দিয়ে দেশের মানুষকে শাসন করছেন। এজন্য তাকে আরও একটি ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়া যেতে পারে। আগের ডজনখানেক ডিগ্রি তিনি কি কারণে পেয়েছিলেন, তা আমার মনে নেই। তবে অখ্যাত-অপরিপকস্ফ লোকদের দিয়ে দেশের মানুষকে ঠাণ্ডা রাখতে পারছেন, এজন্য তার নিশ্চয় একটি ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া উচিত। মূলত শেখ মুজিবের সেই চোরের খনি আর চাটার দলের সদস্যরা এখন রাক্ষস আর খোক্ষস হয়ে দেশের সব টাকা আর নদী-নালাসহ সরকারি জমি গ্রোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads