বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আ.লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী ছাত্রলীগ প্রসঙ্গে



ব দ রু দ্দী ন উ ম র
১৯৭২ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার সব ধরনের বিরোধী শক্তির ওপর নিষ্ঠুর দমনপীড়নের আশ্রয় নিয়ে যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছে তার ধারাবাহিকতাই বর্তমান আওয়ামী লীগ জোট সরকারের মধ্যে আমরা দেখছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ কয়েকটি বাম ও দক্ষিণপন্থী দল নামে পরিচিত সংগঠনের সঙ্গে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে তাদের সব ধরনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বরখেলাফ করে জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এইসঙ্গে যে তাদের চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ইত্যাদি সবকিছুই জড়িত আছে এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই কোয়ালিশনের মধ্যে বামপন্থী নামে কথিত যে দুটি দল আছে তারা এক চরম সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান বজায় রেখে চলেছে। এই নীতি হলো, সরকারের অংশ হিসেবে থেকে তারা একদিকে চুরি, ঘুষখোরিসহ সব রকমের দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে সুবিধা অনুযায়ী এমনভাবে সরকারের সমালোচনা করছে যাতে মনে হবে তারা সরকারের বাইরের কোনো বিরোধী পক্ষ! বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, এই তথাকথিত বামপন্থীরা চরম সুবিধাবাদী, শাসক শ্রেণীর একটি প্রান্তিক অংশ এবং আওয়ামী লীগেরই মতো গণবিরোধী। বর্তমান সরকারের যে কোনো সমালোচনার ক্ষেত্রে এদের সম্পর্কে সতর্কতার প্রয়োজন খুব বেশি। কারণ এরা আওয়ামী লীগ জোট সরকারের অংশ হয়ে ক্ষমতার সুবিধা ভোগ করলেও নিজেদের গা বাঁচিয়ে এমন ধারণা জনগণের মধ্যে দিতে চায় যাতে মনে হতে পারে, এরা সরকারের মধ্যে থাকলেও জনগণের স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করছে! এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এখন দেশজুড়ে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে গিয়ে বা তা প্রতিরোধের জন্য দাঁড়িয়ে শুধু আওয়ামী লীগকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট করা ঠিক নয়। এই সরকারি জোটের শরিক বামপন্থী নামে পরিচিত দল ও তাদের নেতাদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জনগণের আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু করা দরকার। সংসদের ভেতরে-বাইরে তারা কী বলছে, এটা এক্ষেত্রে কোনো বিচারের ব্যাপার নয়। সংসদের ভেতরে-বাইরে এভাবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারাও একই ধরনের সমালোচনা প্রায়ই করে থাকেন বা করতে বাধ্য হন। এদিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই যতদিন এই বামপন্থী নেতারা সরকারের মধ্যে থাকবে ততদিন এদের আওয়ামী লীগের লোকদের থেকে পৃথক করে দেখা এমন এক রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা যা জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ক্ষমতায় আসার আগেই, ২০০৮-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনে তাদের জয়লাভের ঠিক পর থেকেই, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, সমাজের অন্যত্রও লুটপাট ও সন্ত্রাসের এক রাজত্ব কায়েম করে। নামে ছাত্র সংগঠন হলেও প্রথম থেকেই এরা আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকে। এইভাবে ‘শক্তির’ জোগান দিতে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের লাইসেন্স দিয়ে রাখে অর্থাত্ এসব অপকর্মের জন্য তাদের শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকে। ছাত্রলীগের ক্যাডার নামধারী ফ্যাসিস্ট গুণ্ডাদের অতিরিক্ত লুটতরাজ ও সন্ত্রাস জনগণের মধ্যে যখন তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তখন সরকারি ও দলীয় নেতার কেউ কেউ লঘু ভাষায় এদের সমালোচনা করেন। এই সমালোচনা করতে গিয়ে তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের ‘অনেক ভালো কাজ’ ছাত্রলীগের অপকর্মের দ্বারা আড়াল হয়ে যাচ্ছে! এই আক্ষেপ সত্ত্বেও এটাই সত্য যে, ছাত্রলীগ কার্যক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে প্রথম থেকেই কাজ করে এসেছে এবং এখনও করছে। গত দুই দিনে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের ছাত্রলীগের কর্মীরা নিষ্ঠুরভাবে লাঠিপেটা করার ছবি ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ঠ্যাঙ্গাড়েদের এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী দল গণফোরাম পর্যন্ত প্রেস ক্লাবের সামনে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা করেছে। কিন্তু শাসক শ্রেণীর যে বাম অংশটি সরকারের মধ্যে আছে তারা এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, কোনো প্রতিবাদ সভা করেনি। কাজেই সরকারের মধ্যে থেকে আওয়ামী লীগের দুর্নীতির কিছু প্রতিবাদ তারা করলেও ফ্যাসিস্ট দমন নীতির ক্ষেত্রে এরা নীরব! নীরব থেকেই এরা আওয়ামী লীগের এই দমন-পীড়নকে সমর্থন করছে। এদিক দিয়ে সরকারের মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং এই ধরনের বামপন্থীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বামপন্থী নাম ধারণ করে এই ধরনের বামপন্থীরা সরকারের মধ্যে ও সরকারের বাইরে থেকে জনগণকে কীভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করছে এ হলো তারই দৃষ্টান্ত।
শুধু ছাত্রলীগই নয়। যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ ইত্যাদি নানা নামে আওয়ামী লীগের যে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীগুলো আছে তারাও সরকারি পুলিশ ও র্যাবের সহযোগী বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া খোদ আওয়ামী লীগের নিজস্ব সংগঠন তো আছেই। এদের হাতে বাংলাদেশের জনগণের মান-ইজ্জত, শারীরিক নিরাপত্তা ও সম্পদ কোনোকিছুই নিরাপদ নয়। জনগণের জীবনসহ যা কিছু তাদের আছে সবকিছুই আজ সরকারি বাহিনী ও তাদের বেসরকারি ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। আগেই বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের এই অপকর্ম কোনো নতুন ব্যাপার নয়। ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বেসরকারি নানা ধরনের বাহিনীর মাধ্যমে তারা এ কাজই করে আসছে। রক্ষীবাহিনীর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের স্টাইলে বিভিন্ন ক্যাম্পে তারা পাখির মতো বামপন্থীসহ বিরোধীদের অথবা বিরোধী সন্দেহে হাজার হাজার লোককে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি করেছিল। তাছাড়া ছাত্রলীগকে দিয়েও তারা বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে বামপন্থীসহ অন্যদের হত্যা করেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে পাবনার হত্যাকাণ্ড ছিল সব থেকে বড় ও বিরাট আকারে এবং ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ড চলেছিল কোনো বিরতি ছাড়াই। এই হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল ছাত্রলীগের দ্বারা। তাদেরকেই প্রথম থেকে এ কাজে লাগানো হয়েছিল। তারা সাড়ে তিন বছরে পাবনা অঞ্চলে তিন হাজারের ওপর লোককে হত্যা করেছিল। বাংলাদেশের এই পর্যায়ে আওয়ামী-বাকশালী সরকার জনগণের ওপর যে ব্যাপক অমানুষিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তার কোনো ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের তো জানাই নেই, এমনকি যারা বয়স্ক তারাও ভুলতে বসেছে, কারণ সেইসব ঘটনার কোনো ইতিহাস নেই। সেই ইতিহাস মানুষ যাতে জানতে না পারে তার জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। ইতিহাস আড়াল করার বিস্তৃত আয়োজন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনকে ব্যবহার এবং বিশেষ করে তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগিয়ে করে এসেছে। কাজেই বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের প্রথম সাড়ে তিন বছরের সেই ফ্যাসিস্ট শাসনের সঙ্গে কোনো পরিচয় এখন জনগণের নেই। সবকিছুই বিস্মৃতির গর্ভে।
কিন্তু সেই ইতিহাস আপাতত বিস্মৃতির গর্ভে থাকলেও তার ধারাবাহিকতা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে এবং সেটা যে আছে এটা আমরা বর্তমান আওয়ামী লীগ জোট সরকারের নিয়মিত ফ্যাসিস্ট আচরণ এবং এই মুহূর্তে ছাত্রলীগের লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দেখছি।
১২.৯.২০১২

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads