যে রাজনৈতিক দল দেয়ালের লিখন পড়তে পারে না, তাদের কপালে দুঃখ আছে। তারা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না এবং সফল হয় না। দেয়ালের লিখন পড়ে সে অনুযায়ী চলতে না পারলে কোনো দল ক্ষমতায় যেতে পারে না অথবা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে না। বাংলাদেশের গত সাড়ে তিন বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে যে কেউ বলবেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট, বিশেষ করে জোটের মূল শক্তি আওয়ামী লীগ বুঝি এখন আর দেয়ালের লিখন পড়তে পারছে না। দেশের সিংহভাগ পত্র-পত্রিকার লেখা ও জনমত জরিপে এবং টিভির টকশোগুলোতে এই চিত্রটাই ফুটে ওঠে। এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন মহলের অতিঘনিষ্ঠ এবং ত্রাতা বলে পরিচিত পাশের দেশের কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। সে দেশের প্রভাবশালী মিডিয়াগুলোও বলছে, আওয়ামী লীগের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে তাদের পক্ষে কিস্তি বাঁচানো কঠিন হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানেন, ভারতীয় মিডিয়ার এসব প্রতিবেদন আসলে সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণেরই প্রতিচ্ছবি। তাদের সরেজমিন বিশ্লেষণকে ভুল বলে বাতিল করে দেয়ার কোনো উপায় নেই। ভারতীয় মিডিয়াগুলো অবশ্য পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগের পরাজয় ঠেকাতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ এই দলটিই বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। এমনকি বর্তমান নাজুক অবস্থা থেকে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ধস কীভাবে ঠেকানো যায়, জনমতকে কীভাবে তার অনুকূলে আনা যায় তারও ইঙ্গিত মিডিয়াগুলো দিয়েছে। অর্থাত্ আগামী নির্বাচনেও ভারত আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় বসানোর সব চেষ্টা করবে। এরশাদও সে উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যে ইদানীং খালেদা জিয়া এবং বিএনপির সঙ্গে বাইরে বাইরে কিছুটা সখ্য দেখাতে চাচ্ছে তার আসল কারণ হলো, শত চেষ্টায়ও যদি আওয়ামী লীগের নৌকাকে বাঁচানো না-ই যায় তাহলে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি যেন তাদের আয়ত্তের পুরোপুরি বাইরে না চলে যায় তার একটা ব্যবস্থা করা।
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদের নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষমতা তাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ও অন্ধ করে দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই বিশ্লেষণ যে কতটা অভ্রান্ত, বাংলাদেশের বর্তমান ও অতীত ক্ষমতাসীনরা তার প্রমাণ। আগেরবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যতটা বেসামাল হয়েছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চর্তুথাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আরও বেশি বেসামাল হয়েছে। বেসামাল তথা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ার মাত্রা আনুপাতিক হারে না বেড়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। তাদের দুর্নীতি, অপশাসন, ভুল, দম্ভ, জনবিচ্ছিন্নতার মাত্রাও সেভাবে বেড়েছে।
অতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় অন্ধ হওয়ার কারণেই তারা বিরোধী দলের ওপর এমন দমননীতি চালাতে পারছে; দুর্নীতির এরকম সর্বগ্রাসী বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। তাদের ক্ষুধা এতই ভয়াবহ যে, পারলে তারা বিশ্বব্যাংককেই খেয়ে ফেলে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় তারা যদি অন্ধ না-ই হবে তাহলে শেয়ার কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতি-অপশাসনের জন্য আগের বার এত খেসারত দেয়ার পর এবারও কী করে শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে, কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুত্ খাত থেকে শত শত কোটি টাকা মাত্র কয়েকটি পরিবার হাতিয়ে নিয়ে যায়? খুন ও গুমের মাধ্যমে অপরাজনীতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে?
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুঃশাসন, অপশাসন, খুন, গুম, জননিরাপত্তাহীনতা, বিরোধী মতবাদ দমন, সর্বত্র দলীয়করণ, দলীয় মাস্তানদের প্রতিপালন ইত্যাদি কারণে জনমত কোথায় গেছে তা কি তারা বুঝতে পারছেন না? দেয়ালের লিখন পড়তে পারলে তো এগুলো অব্যাহত রাখার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দল, আন্দোলন ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে যার পথ চলা, তারা দেয়ালের লিখন পড়তে পারে না—এটিও তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং এটি মনে করাই স্বাভাবিক যে, দেয়ালের লিখন ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পেরেছে বলেই তারা আজ আখের গোছাতে লুটপাট বাড়িয়ে দিয়েছে এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। তাদের আমলনামায় এত পাপ জমা হয়েছে যে তারা বুঝে গেছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের আর ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই। গত নির্বাচনে বিএনপির যে বিপর্যয় ঘটেছে, সম্ভবত আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় তার চেয়েও শোচনীয় হবে। সেজন্যই তারা আদালতের রায়ের খণ্ডিত ও অপব্যাখ্যা দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ধারা পরিবর্তন করে মহাজোট তথা নিজ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ ও মরিয়া চেষ্টা করছে। অথচ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সহিংস আন্দোলন এবং ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ তার নিজের সন্তান বলে দাবি করে এসেছে। মানুষ সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়। অথচ আওয়ামী লীগ নিজে টিকে থাকার জন্য, শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তার আপন সন্তানকে বিসর্জন দিচ্ছে।
এত দুর্নীতি, অত্যাচার, অপশাসন, জনবিরোধী আমলনামা নিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার স্বপ্ন কেবল তারাই দেখতে পারে যারা কোনো শক্তিধর মহলের কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক পায়। সেই শক্তি নিজেদের স্বার্থে তাদের সাতখুন মাফ করে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের এরকম গণবিরোধী এবং বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ও আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা বুঝি কারও কাছ থেকে সেরকমই ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়ে গেছে, যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের আবার ক্ষমতায় বসাতে পারে। কে হতে পারে সেই শক্তি? মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের পরিণতির পর ওই জাতীয় কোনো তৃতীয় শক্তি আবার ঝুঁকি নিতে অনেকবার চিন্তা করবে। আর সেই জাতীয় কোনো শক্তি এবার ক্ষমতায় এলে তাদের এবারের টার্গেট যৌক্তিক কারণেই বিএনপির চেয়ে বেশি হবে আওয়ামী লীগ। কেননা, ক্ষমতাসীন ব্যর্থ দল হিসেবে গেলবার যেমন বিএনপি ছিল জনগণের মূল প্রতিপক্ষ, এবার তাদের মূল প্রতিপক্ষ হচ্ছে অপশাসক আওয়ামী লীগ। অতএব, ওইখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তেমন সাহায্য আশা করতে পারে না। বাকি থাকে বাইরের শক্তি। সবাই জানেন, গত সাধারণ নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকাশ্য না হলেও প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদটা ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। কিন্তু গত কয় বছরে পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাউকে স্থায়ী মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে যে কোনো সময় পছন্দের ব্যক্তিকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে আবার পরিস্থিতি ভিন্ন হলে তাকেই আবার শত্রু হিসেবে কালবিলম্ব না করে বর্জন করে। অতএব আওয়ামী লীগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক আশা করতে পারে না। আর এরই মধ্যে তাদের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্ক যে শুরু হয়ে গেছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। চীন আর মধ্যপ্রাচ্য থেকেও আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বাকি থাকে বৃহত্ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। স্রেফ ভৌগোলিক অবস্থার কারণেই ভারত বাংলাদেশের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং করছেও। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী চরিত্রগতভাবে আধিপত্যবাদী হওয়ায় তারা সব সময়ই আমাদের মতো ছোট এবং কম শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনুগত সরকার চায়। নইলে বিপত্তি বাধায়। এখন তো আর ভৌগোলিকভাবে কোনো দেশ দখল করা যায় না। কাজেই লেন্দুপ দরজি না খুঁজে তারা ওইসব দেশে এমন সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যারা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই যে তাদের সবচেয়ে পছন্দের দল, এটি শুধু আমাদের কথা নয়, উপরে উল্লিখিত প্রভাবশালী ভারতীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর ভাষ্যেও তা-ই বলা হচ্ছে। এমনকি তোফায়েল আহমেদের মতো আওয়ামী লীগ নেতাকেও খেদোক্তি করে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন উপদেষ্টার কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন ভারত সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। ড. গওহর রিজভী, ড. মসিউর রহমানদের ভূমিকা নিয়ে দেশবাসীর কোনো বিভ্রান্তি নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের (নামে মহাজোট হলেও আসলে আওয়ামী লীগ সরকার) সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ শুধু ভারতকে দিয়েই গেছে, পায়নি কিছুই। এমনকি ভারত যা চায়নি, বাংলাদেশ সরকার তাও তাদের দিয়ে দিয়েছে। মুজিব আমলের ভারত-বাংলাদেশ সাত দফা গোপন চুক্তির কথা অনেকেই জানেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা হয়েছিল। গেল বছর শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ যে চুক্তি হয় তার বিষয়বস্তু ও খুঁটিনাটি দেশবাসী কিছুই জানেন না। জাতীয় সংসদে পর্যন্ত তা আলোচিত হয়নি। চুক্তিটা আমাদের স্বার্থের অনুকূলে হলে নিশ্চয়ই তা গোপন রাখার প্রয়োজন হতো না। যে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের আঠার আনা স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, তাকে আগামী নির্বাচনেও যে দিল্লি বিজয়ী করার সর্বোত চেষ্টা করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেজন্যই অনেকের আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ সরকার যত দুর্নীতি, অপশাসন, অগণতান্ত্রিক কাজই করুক; ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তাদেরই সমর্থন দিয়ে যাবে। হাসিনা সরকার এটাকে এক ধরনের ব্ল্যাঙ্ক চেক হিসেবে ধরে নিয়েছে। কিন্তু এরপরও একটা বিষয় ধ্রুব সত্য। আর তা হলো, জনগণের শক্তির কাছে কিছুই টেকে না। বন্দুকের নল নয়, গণতন্ত্রের আড়ালে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন নয়, বাইরের সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্ল্যাঙ্ক চেক নয়, দেশের মানুষই হচ্ছে মূল শক্তি। দেশের জনগণ রুখলে বাইরের কোনো মিত্রই কাউকে রক্ষা করতে পারে না—এটা ঐতিহাসিক সত্য। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এত আহাম্মক নয় যে তারা এটা বোঝে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে যদি তারা দেখে যে জনসমর্থনের অভাবে তাদের আজ্ঞাবহ ও স্বার্থ রক্ষাকারীদের কিছুতেই রক্ষা করা সম্ভব নয়, তাহলে তারাও বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবে। আধিপত্যবাদী ও অধীনতামূলক মিত্রতার পথ ছেড়ে সমতামূলক মিত্রতায় দু’পক্ষের স্বার্থ রক্ষাই আধুনিক কূটনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভারত সেই বিকল্পটি খোলা রেখেছে বলেই মনে হয়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির সর্বশেষ সাক্ষাত্কার ও আলোচনা তারই ইঙ্গিত দেয়। তাছাড়া ভারত শেখ হাসিনার এই মেয়াদেই যা কিছু নেয়ার তার প্রায় সবই নিয়ে নিয়েছে। অধিকতর নেয়ার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। আর হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো খালেদা বা অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে বাতিল করতে পারবেন না। অতএব তাদের নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ যদি বুঝে যে কারও ব্ল্যাঙ্ক চেকও তাদের অপশাসনকে রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তাদেরই লাভ হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন, জনকল্যাণ এবং দেশের স্বার্থই হওয়া উচিত সব রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য।
লেখক : সুইডেন প্রবাসী সিনিয়র বাংলাদেশী সাংবাদিক
deshbidesh@hotmail.com
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদের নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এই ক্ষমতা তাদের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ও অন্ধ করে দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই বিশ্লেষণ যে কতটা অভ্রান্ত, বাংলাদেশের বর্তমান ও অতীত ক্ষমতাসীনরা তার প্রমাণ। আগেরবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যতটা বেসামাল হয়েছিল, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চর্তুথাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আরও বেশি বেসামাল হয়েছে। বেসামাল তথা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ার মাত্রা আনুপাতিক হারে না বেড়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। তাদের দুর্নীতি, অপশাসন, ভুল, দম্ভ, জনবিচ্ছিন্নতার মাত্রাও সেভাবে বেড়েছে।
অতি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় অন্ধ হওয়ার কারণেই তারা বিরোধী দলের ওপর এমন দমননীতি চালাতে পারছে; দুর্নীতির এরকম সর্বগ্রাসী বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। তাদের ক্ষুধা এতই ভয়াবহ যে, পারলে তারা বিশ্বব্যাংককেই খেয়ে ফেলে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় তারা যদি অন্ধ না-ই হবে তাহলে শেয়ার কেলেঙ্কারির মতো দুর্নীতি-অপশাসনের জন্য আগের বার এত খেসারত দেয়ার পর এবারও কী করে শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে, কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুত্ খাত থেকে শত শত কোটি টাকা মাত্র কয়েকটি পরিবার হাতিয়ে নিয়ে যায়? খুন ও গুমের মাধ্যমে অপরাজনীতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে?
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুঃশাসন, অপশাসন, খুন, গুম, জননিরাপত্তাহীনতা, বিরোধী মতবাদ দমন, সর্বত্র দলীয়করণ, দলীয় মাস্তানদের প্রতিপালন ইত্যাদি কারণে জনমত কোথায় গেছে তা কি তারা বুঝতে পারছেন না? দেয়ালের লিখন পড়তে পারলে তো এগুলো অব্যাহত রাখার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন দল, আন্দোলন ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে যার পথ চলা, তারা দেয়ালের লিখন পড়তে পারে না—এটিও তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং এটি মনে করাই স্বাভাবিক যে, দেয়ালের লিখন ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পেরেছে বলেই তারা আজ আখের গোছাতে লুটপাট বাড়িয়ে দিয়েছে এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। তাদের আমলনামায় এত পাপ জমা হয়েছে যে তারা বুঝে গেছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের আর ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই। গত নির্বাচনে বিএনপির যে বিপর্যয় ঘটেছে, সম্ভবত আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় তার চেয়েও শোচনীয় হবে। সেজন্যই তারা আদালতের রায়ের খণ্ডিত ও অপব্যাখ্যা দিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ধারা পরিবর্তন করে মহাজোট তথা নিজ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ ও মরিয়া চেষ্টা করছে। অথচ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সহিংস আন্দোলন এবং ১৭৩ দিন হরতাল পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ তার নিজের সন্তান বলে দাবি করে এসেছে। মানুষ সন্তানকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জন দেয়। অথচ আওয়ামী লীগ নিজে টিকে থাকার জন্য, শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তার আপন সন্তানকে বিসর্জন দিচ্ছে।
এত দুর্নীতি, অত্যাচার, অপশাসন, জনবিরোধী আমলনামা নিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার স্বপ্ন কেবল তারাই দেখতে পারে যারা কোনো শক্তিধর মহলের কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক পায়। সেই শক্তি নিজেদের স্বার্থে তাদের সাতখুন মাফ করে দিতে পারে। আওয়ামী লীগের এরকম গণবিরোধী এবং বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ও আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা বুঝি কারও কাছ থেকে সেরকমই ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়ে গেছে, যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের আবার ক্ষমতায় বসাতে পারে। কে হতে পারে সেই শক্তি? মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের পরিণতির পর ওই জাতীয় কোনো তৃতীয় শক্তি আবার ঝুঁকি নিতে অনেকবার চিন্তা করবে। আর সেই জাতীয় কোনো শক্তি এবার ক্ষমতায় এলে তাদের এবারের টার্গেট যৌক্তিক কারণেই বিএনপির চেয়ে বেশি হবে আওয়ামী লীগ। কেননা, ক্ষমতাসীন ব্যর্থ দল হিসেবে গেলবার যেমন বিএনপি ছিল জনগণের মূল প্রতিপক্ষ, এবার তাদের মূল প্রতিপক্ষ হচ্ছে অপশাসক আওয়ামী লীগ। অতএব, ওইখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তেমন সাহায্য আশা করতে পারে না। বাকি থাকে বাইরের শক্তি। সবাই জানেন, গত সাধারণ নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রকাশ্য না হলেও প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদটা ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। কিন্তু গত কয় বছরে পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাউকে স্থায়ী মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে যে কোনো সময় পছন্দের ব্যক্তিকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করে আবার পরিস্থিতি ভিন্ন হলে তাকেই আবার শত্রু হিসেবে কালবিলম্ব না করে বর্জন করে। অতএব আওয়ামী লীগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্ল্যাঙ্ক চেক আশা করতে পারে না। আর এরই মধ্যে তাদের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্ক যে শুরু হয়ে গেছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। চীন আর মধ্যপ্রাচ্য থেকেও আওয়ামী লীগের কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বাকি থাকে বৃহত্ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। স্রেফ ভৌগোলিক অবস্থার কারণেই ভারত বাংলাদেশের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং করছেও। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী চরিত্রগতভাবে আধিপত্যবাদী হওয়ায় তারা সব সময়ই আমাদের মতো ছোট এবং কম শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনুগত সরকার চায়। নইলে বিপত্তি বাধায়। এখন তো আর ভৌগোলিকভাবে কোনো দেশ দখল করা যায় না। কাজেই লেন্দুপ দরজি না খুঁজে তারা ওইসব দেশে এমন সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যারা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই যে তাদের সবচেয়ে পছন্দের দল, এটি শুধু আমাদের কথা নয়, উপরে উল্লিখিত প্রভাবশালী ভারতীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর ভাষ্যেও তা-ই বলা হচ্ছে। এমনকি তোফায়েল আহমেদের মতো আওয়ামী লীগ নেতাকেও খেদোক্তি করে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রীর কয়েকজন উপদেষ্টার কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন ভারত সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। ড. গওহর রিজভী, ড. মসিউর রহমানদের ভূমিকা নিয়ে দেশবাসীর কোনো বিভ্রান্তি নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের (নামে মহাজোট হলেও আসলে আওয়ামী লীগ সরকার) সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশ শুধু ভারতকে দিয়েই গেছে, পায়নি কিছুই। এমনকি ভারত যা চায়নি, বাংলাদেশ সরকার তাও তাদের দিয়ে দিয়েছে। মুজিব আমলের ভারত-বাংলাদেশ সাত দফা গোপন চুক্তির কথা অনেকেই জানেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা হয়েছিল। গেল বছর শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ যে চুক্তি হয় তার বিষয়বস্তু ও খুঁটিনাটি দেশবাসী কিছুই জানেন না। জাতীয় সংসদে পর্যন্ত তা আলোচিত হয়নি। চুক্তিটা আমাদের স্বার্থের অনুকূলে হলে নিশ্চয়ই তা গোপন রাখার প্রয়োজন হতো না। যে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের আঠার আনা স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, তাকে আগামী নির্বাচনেও যে দিল্লি বিজয়ী করার সর্বোত চেষ্টা করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেজন্যই অনেকের আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ সরকার যত দুর্নীতি, অপশাসন, অগণতান্ত্রিক কাজই করুক; ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত তাদেরই সমর্থন দিয়ে যাবে। হাসিনা সরকার এটাকে এক ধরনের ব্ল্যাঙ্ক চেক হিসেবে ধরে নিয়েছে। কিন্তু এরপরও একটা বিষয় ধ্রুব সত্য। আর তা হলো, জনগণের শক্তির কাছে কিছুই টেকে না। বন্দুকের নল নয়, গণতন্ত্রের আড়ালে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন নয়, বাইরের সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্ল্যাঙ্ক চেক নয়, দেশের মানুষই হচ্ছে মূল শক্তি। দেশের জনগণ রুখলে বাইরের কোনো মিত্রই কাউকে রক্ষা করতে পারে না—এটা ঐতিহাসিক সত্য। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এত আহাম্মক নয় যে তারা এটা বোঝে না। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে যদি তারা দেখে যে জনসমর্থনের অভাবে তাদের আজ্ঞাবহ ও স্বার্থ রক্ষাকারীদের কিছুতেই রক্ষা করা সম্ভব নয়, তাহলে তারাও বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবে। আধিপত্যবাদী ও অধীনতামূলক মিত্রতার পথ ছেড়ে সমতামূলক মিত্রতায় দু’পক্ষের স্বার্থ রক্ষাই আধুনিক কূটনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভারত সেই বিকল্পটি খোলা রেখেছে বলেই মনে হয়। খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির সর্বশেষ সাক্ষাত্কার ও আলোচনা তারই ইঙ্গিত দেয়। তাছাড়া ভারত শেখ হাসিনার এই মেয়াদেই যা কিছু নেয়ার তার প্রায় সবই নিয়ে নিয়েছে। অধিকতর নেয়ার আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। আর হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব চুক্তি করেছে, সেগুলো খালেদা বা অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে বাতিল করতে পারবেন না। অতএব তাদের নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ যদি বুঝে যে কারও ব্ল্যাঙ্ক চেকও তাদের অপশাসনকে রক্ষা করতে পারবে না, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে তাদেরই লাভ হবে। গণতন্ত্র, সুশাসন, জনকল্যাণ এবং দেশের স্বার্থই হওয়া উচিত সব রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য।
লেখক : সুইডেন প্রবাসী সিনিয়র বাংলাদেশী সাংবাদিক
deshbidesh@hotmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন