শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১২

বগুড়ায় মুসাফিরদের ঠিকানা আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল



বগুড়ায় মুসাফিরদের ঠিকানা আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল


বগুড়া শহরের প্রসিদ্ধ হোটেলের একটি আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল। ব্যবসার পাশাপাশি হোটেল কর্তৃপ ১০০ বছর ধরে রাতে ফ্রি খাবার দিয়ে মুসাফির, গরিব ও দুঃখীদের মানবসেবা করে যাচ্ছে। রাতে যে কেউ খাবার খেতে হোটেলের সামনে গেলে তিনি আর না খেয়ে ফিরবেন না। তিনি পেটপুরেই এক বেলা তৃপ্তিসহকারে খেতে পারবেন। তাই এ হোটেলকে মুসাফিরদের রাতের খাবারের ঠিকানা বললেও ভুল হবে না। 
বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে ৩০০ গজ উত্তরে কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের সদর থানা ঘেঁষে এই হোটেল চালু হয় ১৯১০ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা মালিক মরহুম আলহাজ আকবর আলী মিঞা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভাগ্য অন্বেষণে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশের পাকশি, সান্তাহার ও পরে বগুড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। মানবদরদি আকবর আলী মিঞা ভাইয়ের সাথে মেকানিক হিসেবে পেশা শুরু করেন। স্বাধীনচেতা এই মানুষটির মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন জাগে। কিছু একটা করার স্পৃহা তার মধ্যে কাজ করতে থাকে। সে সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের কোনো হোটেল ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের হোটেলে আবার মুসলমানেরা যেতেন না। আর হিন্দুরা তাদের হোটেলের আসবাবপত্র মুসলমানদের ছুঁতেও দিতেন না। এখান থেকেই তিনি হোটেল করার চিন্তা করেন। অভাবী এই মানুষটার মধ্যে স্বপ্ন দেখা দিলেও স্বপ্ন পূরণের প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না, যা দিয়ে তিনি একটি হোটেল দিতে পারেন। হোটেলের পুঁজির জন্য তিনি নিজে মিষ্টি তৈরির পর ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। কিছু দিন এভাবে মিষ্টি বিক্রি করে কিছু পুঁজি হাতে নিয়ে শহরের চকযাদু রোডের মুখে মাসিক আট টাকা ভাড়া দিয়ে একটি হোটেল চালু করেন। এখান থেকেই শুরু। বগুড়া শহরে তৎকালীন সময়ে আকবর আলীর এই ছোট্ট হোটেলই ছিল মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল। খুব দ্রুত হোটেলের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে স্থান সঙ্কুলান হতো না। তাই তিনি শহরের বর্তমান জায়গায় হোটেলটি স্থানান্তর করেন, যা বর্তমানে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিত। তিনি ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে খাবারের মান সবসময় অুণœ রাখতেন। চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি তার হোটেলে মাসিক ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল এক টাকা প্লেট। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন। বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের দেশব্যাপী যে কদর তার মূলেও ছিলেন আকবর আলী। সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসত বাংলাদেশে। সেমাই তৈরির গল্প কারো জানা ছিল না। এই অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষকে অল্পদামে সেমাই খাওয়ানোর তাগিদ থেকে তিনি সেমাই তৈরি করেন এবং সফল হন। হোটেল ব্যবসায় দিন দিন ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু মানুষ আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি ও প্রসারে আল্লাহর রহমতের কথা বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি ১৯১৭ সালে আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে মুসাফিরদের খাওয়াতেন। তাদের খাওয়াতে গেলে তৎকালীন আয়কর বিভাগ তাকে আয়কর দিতে চাপ দিতে থাকে। এক সময় নিজের একটা পুকুর এক হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করে আয়কর পরিশোধ করেন। তিনি যত দিন বেঁচেছিলেন তত দিন মুসাফির, ফকির, মিসকিন ও গরিবদের খাওয়াতেন। দিন যত গড়িয়েছে তত হোটেলের রোজগার বেড়েছে। নাম ছড়িয়েছে। ১৯৭৫ সালে তিনি মৃত্যুর আগে তার ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর অসিয়ত করে গেছেন। তার ছেলেরা আজও তা পালন করে যাচ্ছেন। 
আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের শহরেই চারটি শাখা। কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়ের মিষ্টি মেলা, কোর্ট চত্বরে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শজিমেক হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। সংযোজন করা হয়েছে আবাসিক, বেকারি, চায়নিজ, থাই ও ফাস্ট ফুড, লাচ্ছা সেমাই, দই। কর্মচারী রয়েছেন সহস্রাধিক। আকবর আলীর সেই লাচ্ছা সেমাই এখন বিদেশের বাজারেও বিক্রি হয়। 
মুসাফির ও অভাবী মানুষ সারা দিনে এক মুঠো ভাত খেতে না পারলেও তাদের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয় নিয়মিত। প্রতিদিন রাত ১২টায় শহরে অবস্থানরত নাম-পরিচয়হীন এই মানুষদের এক বেলা ভালোমানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে হোটেল কর্তৃপ। হোটেলে সারা দিনের কোনো বাসি-পচা বা উচ্ছিষ্ট খাবার নয় একেবারে আলাদা খাবার। প্রতিদিন আলাদা করে রান্না করা হয়। এই খাবারের জন্য প্রতিদিন সেখানে মানুষ আসে। ভিুক আবদুল বাতেন জানান, একাত্তরের যুদ্ধ এবং যমুনা নদীর ভাঙনে সংসার চালানোর মতো তার কিছুই ছিল না। যুবক বয়সে শহরের বিভিন্ন স্থানে দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালাতেন। বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র ছেলে তার কোনো খবর নেয় না। তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আরো অসহায় হয়ে পড়েন। একটা সময় দিনমজুরির কাজ করতে পারেন না। তারপর ভিাবৃত্তি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। প্রায় ১৩-১৪ বছর ধরে তিনি রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে যাচ্ছেন। 
মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া গ্র“পের নির্বাহী পরিচালক মো: হাসান আলী আলাল বলেন, ১৯১৭ সালে তার বাবা প্রথম দিনহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার সেই নিয়ম পালন করে যাচ্ছি। এই খাবার বিতরণের জন্য প্রতিদিন এক মণেরও বেশি চাল রান্না করা হয়। এই খাবার আলাদা ও উন্নতভাবে রান্না করে শহরের মুসাফির, ভাসমান, ছিন্নমূল, অভাবী মানুষদের খাওয়ানো হয়। হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার কখনোই বিতরণ করা হয় না। তিনি জানান, প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ মানুষ এখানে এক বেলা পেটপুরে খাবার খেয়ে থাকেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads