সৈয়দ আবদাল আহমদ
পতিত স্বৈরশাসক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখরোচক আলোচনা চলছে। ঢাকায় এরশাদের সহাস্য অবতরণের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ এবং লীগের বহির্ভূত ভারতপন্থী রাজনৈতিক মহলেও চাপা উল্লাস লক্ষণীয়। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ভারতীয় মিডিয়ার বক্তব্য এবং জাপা চেয়ারম্যানের বিবৃতিতে এ ধারণাই তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাজনীতি চলতে থাকবে এবং ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি। বাংলাদেশের জনগণের করার কিছু নেই। সুযোগসন্ধানী এই পতিত স্বৈরশাসককে দিল্লিতে প্রায় সরকারপ্রধানের মর্যাদায় বেড়িয়ে আনাকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে অপমান করারই অপচেষ্টা। দিল্লিতে তিনি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেতারাও আজ পর্যন্ত প্রবেশ ঘটেনি। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, জাপা চেয়ারম্যান জাতীয় স্বার্থের তুলনায় তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক লাভালাভ নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং আশাও পেয়েছেন ইতিবাচক। যিনি তিস্তার পানির জন্য রংপুরে লংমার্চ করেছিলেন, তিনি দিল্লিতে গিয়ে বলে এসেছেন—পানির পরিমাণ নয়, চুক্তিই হলো গুরুত্বপূর্ণ।
প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি স্থগিতের পর বিলাতের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ‘হ্যালো দিল্লি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশবিনাশী হাসিনা সরকারের লাগাম টেনে ধরতে দিল্লিকে আহ্বান করেছিল। অনেকের মতে, দিল্লি এই অনুরোধকে পাশ কাটিয়ে উল্টো মহাজোট সরকারের অগণতান্ত্রিক যাত্রাকে দীর্ঘায়িত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া হাসিনা সরকার যে ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে চলেছে, তাতে এরশাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের গাঁটবন্ধনকে পোক্ত রাখাটাই দিল্লির কাছে এখন প্রধান এজেন্ডা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে সবকিছু আদায় করে নেয়ার পর তা রক্ষা করতে ভারতের একশ্রেণীর রাজনীতিক মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে।
ছিয়াশির মতো আরেকটি সাজানো নির্বাচনের আশঙ্কা জেগে উঠছে। ভারত-পছন্দ আরেক রাজনীতিক হাসানুল হক ইনু যখন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার কথা বলেন, তখন এরশাদের দিল্লি বেড়ানোর গোমর বুঝতে বাকি থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপক মন্তব্য করেছেন, স্বৈরশাসক এরশাদ এতই ভাগ্যবান যে, পতন হতে হতেও তার পতন হয় না। ভারতের কোচবিহারে জন্ম নেয়া সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন। অথচ তার এই অপরাধ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের কথিত চেতনাবাদীরা নীরব। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানফেরত এরশাদকে ভারতের দেরাদুনে এনডিসি কোর্সে অংশ নিতে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে থাকা অবস্থায়ই তার পদোন্নতি ঘটে। ভারতীয়দের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে সখ্য। বাংলাদেশের বেশ কতকগুলো উচ্চপর্যায়ের হত্যাকাণ্ডে যার নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে, তা উল্লেখ না করেই বলা যায়, বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলে অপসারণ করে এরশাদ যখন দায়িত্ব নেন, ভারত এবং তদানুগত আওয়ামী লীগ তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’—আমি অখুশি নই। আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী এরশাদের সামরিক শাসনকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ সরকার দেশকে ভারতমুখী করে তোলে এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের করা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি থেকে গ্যারান্টি ক্লজ তুলে নেয়। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তার ঐতিহাসিক পতন ঘটলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এরশাদ পার পেয়ে যান। অথচ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী স্বৈরাচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একমঞ্চে আসার সুযোগ ছিল না। প্রায় সবসময়ই কোচবিহারের এ সন্তান ভারতের রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট থেকেছেন, যার জন্য এখন বাংলাদেশের রাজনীতির পার্শ্বচরিত্র হিসেবে তিনি টিকে আছেন।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন ভারত প্রকাশ্যে নাক গলাতে চাইছে কয়েকটি কারণে— এক. উল্লেখযোগ্য কিছু না দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে প্রায় সব সুবিধা ভারত নিয়ে গেছে। সেসব রক্ষার জন্য ভারত আগ্রহী। মহাজোট সরকারকে ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে জেতাতে ভারত যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেছে, তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে তারা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় রাখতে চায়। ভারতের সাবেক এক সেনাপ্রধান তখন মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশকে ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। দুই. দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক মুরব্বি হিসেবে ভারত আর যোগ্য নয়—এমন ধারণা পশ্চিমা বিশ্বে তৈরি হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ভারতের ব্যর্থতা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশ চায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং দু’দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতার চুক্তিও সই হয়েছে; যার ফলে দু’দেশের সেনারা এখন যৌথ মহড়া শুরু করতে যাচ্ছেন। এসব কারণে ভারত শঙ্কিত। তিন. বাংলাদেশের রাজনৈতিক ওলট-পালট হতে পারে বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত বছর প্রকাশ্যেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের জন্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার গঠনমূলক রাজনীতি ও ইতিবাচক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের জনগণ সহাস্যেই সরকারের বিপক্ষে চলে গেছে এবং সরকারের পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। এ অবস্থায় দিল্লিতে এরশাদের গুরুত্ব বেড়েছে। চার. বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে কোনো মূল্যে নিরাপত্তা-সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে চায়। দিল্লিতে এরশাদের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠক সেজন্যই। কিন্তু এক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচারের প্রতি ভারতের নির্ভরতা ভ্রান্তিবিলাসেরই নামান্তর। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের কেন জানি ভারতের পছন্দ। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাংলাদেশের দুই নেত্রী যখন জেলে, তখন এই এরশাদের হোতা জেনারেল মইনকে ভারত দাওয়াত দিয়ে নিয়ে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। ঘোড়া উপহার দিয়েছিল। এমনকি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার পর ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশ সফরে এসে বিমানবন্দর থেকে সোজা সেনানিবাসে গিয়ে সেনাপ্রধান মইনের অফিসে চলে যান।
বাংলাদেশের জনগণের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি ফ্যাসিবাদ জারি রেখে শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানাতে চায়, তবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। এ মত একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার।
এরশাদের ভারত কানেকশন
এরশাদের ভারত কানেকশন বহু পুরনো। প্রত্যক্ষদর্শী একজন প্রবীণ সাংবাদিকের এ নিয়ে একটি মজার কাহিনী আছে। ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্টের। ওই সাংবাদিক পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করতে দেশ দুটি সফর করেছিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে লাহোর থেকে তিনি ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে ১৫ আগস্ট গিয়েছিলেন দিল্লি। সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখে তিনি দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে ফ্লাইটের অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় বিমানবন্দরের একজন শিখ কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথা বলার সুযোগ হয়। বাংলাদেশী সাংবাদিক পরিচয় জেনে ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন, আপনি দারুণ একটি বিষয় মিস করেছেন। একটু আগে এলেই আপনার দেশের প্রেসিডেন্টকে পেতেন। ওই সময় এরশাদের ভারত আসার কথা ছিল না। তার ভারত সফরের শিডিউলও ছিল না। দিল্লির কর্মকর্তাটি বললেন, খুব ভোরে এয়ারফোর্সের একটি বিমানে করে এরশাদ দিল্লি আসেন এবং ৩-৪ ঘণ্টা পর আবার চলে যান। শিখ কর্মকর্তা এটাও বললেন, এমন শিডিউলবিহীন সফরে এরশাদ প্রায়ই দিল্লি আসেন।
ক্ষমতায় থাকাকালে এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সব সময় এরশাদ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আস্থায় আছেন। প্রায় প্রতি বছরই এক বা একাধিক তিনি ভারত সফরে যান। এরশাদ তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সব সময়ই বলে থাকেন দিল্লির নেক নজর ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকা কোনোটাই সম্ভব নয়। এরশাদের রাজনৈতিক উত্থান এবং এখনও রাজনীতিতে টিকে থাকার পেছনে দিল্লির আশীর্বাদ রয়েছে।
চতুর একনায়ক, বহুরূপী রাজনীতিক
বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ‘প্রিয় দেশবাসী’ বলে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। চতুর এই সামরিক একনায়ক এরশাদ একনাগাড়ে দেশ শাসন করেন নয় বছর। দেশ পিছিয়ে যায় অনেক বছর। ক্ষমতা দখলের একপর্যায়ে রাজনীতিতেও জড়ালেন। দলছুট আদর্শহীন বিভিন্ন মতের নেতাদের নিয়ে দল গঠন করলেন, নাম দিলেন জাতীয় পার্টি। এরশাদ ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করেন, গুলি ও ট্রাক চালিয়ে। তিনি প্রকাশ্যে রাজপথে ঘটিয়েছেন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দেন। নির্বাচনকে তিনি পরিণত করেন হাস্যকর বিষয়ে। এরশাদ দুর্নীতি করেছেন সপরিবারে। তার চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ‘ফার্স্ট লেডি’ রওশন এরশাদ দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। ওই সময় বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল পারিবারিক রাষ্ট্রে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল জাতীয় পার্টির প্রতিটি নেতাকর্মী, মন্ত্রী-আমলা। দুর্নীতিকে এরশাদই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
একনায়ক এরশাদের ৯ বছরের শাসনামল বিশৃঙ্খলার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। এরশাদ নিজে যেমন দুর্নীতি করেছেন, অন্যকেও দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। তার ইঙ্গিতে একদিকে গুলি করে ট্রাক চালিয়ে যেমন ছাত্র হত্যা হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তিনি টুপি মাথায় ছুটে গেছেন মসজিদে।
রাজনীতিতে এরশাদ একেবারেই অবিশ্বস্ত। অনেকেই এরশাদকে বলেন, রাজনীতির ‘আনপ্রেডিক্ট্যাবল ক্যারেক্টার’ বা অনুমান অসম্ভব চরিত্র। এরশাদের প্রকৃত রূপ বোঝাতে প্রখ্যাত শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান একটি বিখ্যাত কার্টুন এঁকেছিলেন। সেই কার্টুনের ক্যাপশন ছিল—‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে।’
প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি স্থগিতের পর বিলাতের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট ‘হ্যালো দিল্লি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশবিনাশী হাসিনা সরকারের লাগাম টেনে ধরতে দিল্লিকে আহ্বান করেছিল। অনেকের মতে, দিল্লি এই অনুরোধকে পাশ কাটিয়ে উল্টো মহাজোট সরকারের অগণতান্ত্রিক যাত্রাকে দীর্ঘায়িত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া হাসিনা সরকার যে ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে চলেছে, তাতে এরশাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরশাদের গাঁটবন্ধনকে পোক্ত রাখাটাই দিল্লির কাছে এখন প্রধান এজেন্ডা। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে সবকিছু আদায় করে নেয়ার পর তা রক্ষা করতে ভারতের একশ্রেণীর রাজনীতিক মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে মনে হচ্ছে।
ছিয়াশির মতো আরেকটি সাজানো নির্বাচনের আশঙ্কা জেগে উঠছে। ভারত-পছন্দ আরেক রাজনীতিক হাসানুল হক ইনু যখন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার কথা বলেন, তখন এরশাদের দিল্লি বেড়ানোর গোমর বুঝতে বাকি থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ অধ্যাপক মন্তব্য করেছেন, স্বৈরশাসক এরশাদ এতই ভাগ্যবান যে, পতন হতে হতেও তার পতন হয় না। ভারতের কোচবিহারে জন্ম নেয়া সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন। অথচ তার এই অপরাধ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের কথিত চেতনাবাদীরা নীরব। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানফেরত এরশাদকে ভারতের দেরাদুনে এনডিসি কোর্সে অংশ নিতে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে থাকা অবস্থায়ই তার পদোন্নতি ঘটে। ভারতীয়দের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে সখ্য। বাংলাদেশের বেশ কতকগুলো উচ্চপর্যায়ের হত্যাকাণ্ডে যার নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে, তা উল্লেখ না করেই বলা যায়, বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের নলে অপসারণ করে এরশাদ যখন দায়িত্ব নেন, ভারত এবং তদানুগত আওয়ামী লীগ তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’—আমি অখুশি নই। আওয়ামী লীগের মুখপত্র বাংলার বাণী এরশাদের সামরিক শাসনকে সমর্থন করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ সরকার দেশকে ভারতমুখী করে তোলে এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের করা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি থেকে গ্যারান্টি ক্লজ তুলে নেয়। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তার ঐতিহাসিক পতন ঘটলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এরশাদ পার পেয়ে যান। অথচ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী স্বৈরাচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একমঞ্চে আসার সুযোগ ছিল না। প্রায় সবসময়ই কোচবিহারের এ সন্তান ভারতের রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট থেকেছেন, যার জন্য এখন বাংলাদেশের রাজনীতির পার্শ্বচরিত্র হিসেবে তিনি টিকে আছেন।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন ভারত প্রকাশ্যে নাক গলাতে চাইছে কয়েকটি কারণে— এক. উল্লেখযোগ্য কিছু না দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে প্রায় সব সুবিধা ভারত নিয়ে গেছে। সেসব রক্ষার জন্য ভারত আগ্রহী। মহাজোট সরকারকে ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে জেতাতে ভারত যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেছে, তা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে তারা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় রাখতে চায়। ভারতের সাবেক এক সেনাপ্রধান তখন মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশকে ভারতের রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। দুই. দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক মুরব্বি হিসেবে ভারত আর যোগ্য নয়—এমন ধারণা পশ্চিমা বিশ্বে তৈরি হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ভারতের ব্যর্থতা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশ চায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং দু’দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতার চুক্তিও সই হয়েছে; যার ফলে দু’দেশের সেনারা এখন যৌথ মহড়া শুরু করতে যাচ্ছেন। এসব কারণে ভারত শঙ্কিত। তিন. বাংলাদেশের রাজনৈতিক ওলট-পালট হতে পারে বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত বছর প্রকাশ্যেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের জন্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার গঠনমূলক রাজনীতি ও ইতিবাচক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের জনগণ সহাস্যেই সরকারের বিপক্ষে চলে গেছে এবং সরকারের পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। এ অবস্থায় দিল্লিতে এরশাদের গুরুত্ব বেড়েছে। চার. বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত যে কোনো মূল্যে নিরাপত্তা-সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে চায়। দিল্লিতে এরশাদের সঙ্গে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বৈঠক সেজন্যই। কিন্তু এক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচারের প্রতি ভারতের নির্ভরতা ভ্রান্তিবিলাসেরই নামান্তর। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের কেন জানি ভারতের পছন্দ। ওয়ান-ইলেভেনের পর বাংলাদেশের দুই নেত্রী যখন জেলে, তখন এই এরশাদের হোতা জেনারেল মইনকে ভারত দাওয়াত দিয়ে নিয়ে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। ঘোড়া উপহার দিয়েছিল। এমনকি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার পর ভারতের বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশ সফরে এসে বিমানবন্দর থেকে সোজা সেনানিবাসে গিয়ে সেনাপ্রধান মইনের অফিসে চলে যান।
বাংলাদেশের জনগণের দুর্বার আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করে কোনো বিদেশি রাষ্ট্র যদি ফ্যাসিবাদ জারি রেখে শেখ হাসিনাকে আবার প্রধানমন্ত্রী এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিরোধী দলের নেতা বানাতে চায়, তবে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। এ মত একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার।
এরশাদের ভারত কানেকশন
এরশাদের ভারত কানেকশন বহু পুরনো। প্রত্যক্ষদর্শী একজন প্রবীণ সাংবাদিকের এ নিয়ে একটি মজার কাহিনী আছে। ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্টের। ওই সাংবাদিক পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করতে দেশ দুটি সফর করেছিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে লাহোর থেকে তিনি ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে ১৫ আগস্ট গিয়েছিলেন দিল্লি। সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখে তিনি দিল্লি ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টে ফ্লাইটের অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় বিমানবন্দরের একজন শিখ কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথা বলার সুযোগ হয়। বাংলাদেশী সাংবাদিক পরিচয় জেনে ওই কর্মকর্তা তাকে বলেন, আপনি দারুণ একটি বিষয় মিস করেছেন। একটু আগে এলেই আপনার দেশের প্রেসিডেন্টকে পেতেন। ওই সময় এরশাদের ভারত আসার কথা ছিল না। তার ভারত সফরের শিডিউলও ছিল না। দিল্লির কর্মকর্তাটি বললেন, খুব ভোরে এয়ারফোর্সের একটি বিমানে করে এরশাদ দিল্লি আসেন এবং ৩-৪ ঘণ্টা পর আবার চলে যান। শিখ কর্মকর্তা এটাও বললেন, এমন শিডিউলবিহীন সফরে এরশাদ প্রায়ই দিল্লি আসেন।
ক্ষমতায় থাকাকালে এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সব সময় এরশাদ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আস্থায় আছেন। প্রায় প্রতি বছরই এক বা একাধিক তিনি ভারত সফরে যান। এরশাদ তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সব সময়ই বলে থাকেন দিল্লির নেক নজর ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকা কোনোটাই সম্ভব নয়। এরশাদের রাজনৈতিক উত্থান এবং এখনও রাজনীতিতে টিকে থাকার পেছনে দিল্লির আশীর্বাদ রয়েছে।
চতুর একনায়ক, বহুরূপী রাজনীতিক
বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ‘প্রিয় দেশবাসী’ বলে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। চতুর এই সামরিক একনায়ক এরশাদ একনাগাড়ে দেশ শাসন করেন নয় বছর। দেশ পিছিয়ে যায় অনেক বছর। ক্ষমতা দখলের একপর্যায়ে রাজনীতিতেও জড়ালেন। দলছুট আদর্শহীন বিভিন্ন মতের নেতাদের নিয়ে দল গঠন করলেন, নাম দিলেন জাতীয় পার্টি। এরশাদ ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করেন, গুলি ও ট্রাক চালিয়ে। তিনি প্রকাশ্যে রাজপথে ঘটিয়েছেন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দেন। নির্বাচনকে তিনি পরিণত করেন হাস্যকর বিষয়ে। এরশাদ দুর্নীতি করেছেন সপরিবারে। তার চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ‘ফার্স্ট লেডি’ রওশন এরশাদ দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। ওই সময় বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল পারিবারিক রাষ্ট্রে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল জাতীয় পার্টির প্রতিটি নেতাকর্মী, মন্ত্রী-আমলা। দুর্নীতিকে এরশাদই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
একনায়ক এরশাদের ৯ বছরের শাসনামল বিশৃঙ্খলার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। এরশাদ নিজে যেমন দুর্নীতি করেছেন, অন্যকেও দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। তার ইঙ্গিতে একদিকে গুলি করে ট্রাক চালিয়ে যেমন ছাত্র হত্যা হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে তিনি টুপি মাথায় ছুটে গেছেন মসজিদে।
রাজনীতিতে এরশাদ একেবারেই অবিশ্বস্ত। অনেকেই এরশাদকে বলেন, রাজনীতির ‘আনপ্রেডিক্ট্যাবল ক্যারেক্টার’ বা অনুমান অসম্ভব চরিত্র। এরশাদের প্রকৃত রূপ বোঝাতে প্রখ্যাত শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান একটি বিখ্যাত কার্টুন এঁকেছিলেন। সেই কার্টুনের ক্যাপশন ছিল—‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন