শেরে এম এ সাত্তার
১.
২০০৪ সালের গোড়ার দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবনে বিএনপির তত্কালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইন্টারনেট এবং ফোনের মাধ্যমে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। যদিও সে সময় দেশে কথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে কোনো স্লোগান ছিল না। তবে তথ্য-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে একটি আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কার্যকর পদক্ষেপ ছিল, ছিল বাংলাদেশকে ই-গভার্নেন্সের আওতায় আনার বাস্তবমুখী উদ্যোগ।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালে। নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবনে বসেই জনতার রায়ে বিএনপিকে বিজয়ী করার সব পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল জয় পায় বিএনপি। এর মাধ্যমে একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক হিসেবে দল ও জনগণের কাছে নিজেকে সফলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করা তারেক রহমান।
সঙ্গত কারণেই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারেক রহমান এবং হাওয়া ভবন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। হাওয়া ভবন এবং তারেক রহমানের কার্যক্রম সম্পর্কে দেশে-বিদেশে অনেকের মনেই ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। জন্ম নেয় অনেক ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রশ্নেরও। ফলে সব কার্যক্রমে সদা সতর্ক ছিলেন তারেক রহমান।
কেউ যেন তার কিংবা হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে সরকারে কিংবা প্রশাসনে অন্যায় সুবিধা নেয়ার চেষ্টা না করতে পারেন, সে ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সরকার গঠনের মাত্র এক বছরের মাথায়ই ২০০২ সালের জুন মাসে হাওয়া ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি তার ফোন এবং ফ্যাক্স নম্বর মিডিয়ায় সরবরাহ করে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তার নাম ভাঙিয়ে কেউ কোথাও কোনো দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের আশ্রয় নিলে তাকে জানাতে। স্পষ্ট করেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, হাওয়া ভবন কোনো তদবির কিংবা কারও ওপর খবরদারির জায়গা নয়। এটি স্রেফ দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বর্তমানে দেশে-বিদেশে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের। পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্ষমতায় থাকার প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা তার ফোন এবং ই-মেইল নম্বর দেশের জনগণকে জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, কেউ তার ও তার পরিবারের নামে দুর্নীতি কিংবা অবৈধ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করলে তাকে যেন জানানো হয়। জনগণের উদ্দেশ্যে নিজের ফোন ও ফ্যাক্স নাম্বার জানিয়ে দেয়ার এই কাজটি এখন থেকে ঠিক ১০ বছর আগে ২০০২ সালেই হাওয়া ভবনে বসে করেছিলেন তারেক রহমান।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর তারেক রহমান বাংলাদেশের উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তার কাজের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। সারাদেশ ঘুরে বেরিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের চাহিদা এবং জনপদের মৌলিক সমস্যাগুলোর চিহ্নিত করেছিলেন। এরপর হাওয়া ভবনের কার্যালয়ে বসে একটি ডাটাবেইস তৈরি করে ওইসব সমস্যা প্রায়োধিকার ভিত্তিতে সমাধানের জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দলের পক্ষ থেকে তুলে দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে সহায়তা করার জন্য দেশের প্রতিটি জেলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চালচিত্র, সমস্যা ও সম্ভাবনা, দলের সর্বস্তরের নেতার নাম-ঠিকানা—সবকিছুই তিনি কম্পিউটারে সংরক্ষণ করেছিলেন। প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বকে কীভাবে দেশ ও জনগণের উন্নয়নে কাজে লাগানো যায় সেই পলিসি নির্ধারণ করেছিলেন। সারাদেশে নিজ দলের রাজনৈতিক শক্তিকে সামাজিক বিপ্লবের হাতিয়ারে পরিণত করে কীভাবে প্রতিটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যায় সেই পথ বাতলে দিয়েছেন। যৌতুকের অভিযোগ থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়া, জন্ম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখা, অযথা রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় করার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সেই কাজগুলো সারাদেশে দলের নেতাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সারাদেশে দলের নেতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়ে বলেছেন, শুধু কথা নয় কাজ, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, প্রয়োজন স্বপ্নের বাস্তবায়ন, রাজনীতিই একমাত্র পেশা হতে পারে না বরং প্রত্যেকেরই বৈধ আয়ের একটি উত্স থাকা চাই। বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইলের সীমানায়ই তার রাজনৈতিক চিন্তার গণ্ডি সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন, যৌক্তিক ও আইনগতভাবেই বাংলাদেশের সীমানা আরও বাড়ার সুযোগ রয়েছে। তার দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্বে না থেকেও তিনি তার কাজকর্মে একজন ভিশনারী রাজনৈতিক নেতার পরিচয় রেখেছেন। তার দল ক্ষমতায় থাকার সময় স্বল্প কয়েকটি বিদেশ যাত্রায় বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি তার প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি একবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সেই সফরকে প্রমোদভ্রমণে রূপান্তরিত না করে বরং কথা বলেছেন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। একান্ত বৈঠক করেছেন মাইক্রোসফটের রাজা বিল গেটসের সঙ্গে। এখানেই তিনি প্রমাণ করেছেন, অন্য অনেক রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তিনি ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির গুণগত সংস্কার এবং তৃণমূল জনগণের জীবনমান উন্নয়নে তার ইতিবাচক চিন্তা দেশে-বিদেশে তাকে তৃতীয় বিশ্বের ভিন্নধর্মী একজন রাজনৈতিক নেতার ইমেজ এনে দিয়েছিল। ফলে দেশে-বিদেশে তার কার্যক্রম মানুষের মধ্যে যেমন আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, একই সঙ্গে নিন্দুকের নিন্দাবাণেও জর্জরিত হয়েছেন তিনি। এমনই এক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান ২০০৪ সালে হাওয়া ভবনে বসেই মুখোমুখি হন প্রবাসী বাংলাদেশীদের।
প্রবাসীদের সঙ্গে তারেক রহমানের সেই বৈঠকটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যতিক্রম এবং নানা বৈশিষ্ট্যের কারণেই অনন্য। বরং বলা যেতে পারে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বাস্তব মহড়া ছিল হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওই বৈঠকটি। এ কারণেই ওই বৈঠকটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত উল্লেখ করা প্রয়োজন বলেই মনে করি।
হাওয়া ভবনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈঠকটি ছিল অনলাইনে। প্রত্যেক প্রবাসীই যিনি যার নিজ নিজ দেশ থেকে তারেক রহমানকে ফোনে কিংবা ইন্টারনেটে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন নিঃসংকোচে। অনলাইনেই তাত্ক্ষণিক জবাবও পেয়েছেন প্রতিটি প্রশ্নের। দু’একটি প্রশ্ন শুনতে খানিকটা অপ্রিয় মনে হলেও তারেক রহমান জবাব দিয়েছেন সাবলীলভাবে। ২০০১ সালে বিএনপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর একপর্যায়ে তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হয়। এ নিয়ে বিরোধী মহলে কানাঘুষা ছিল। অনলাইনে একজন প্রশ্নকর্তা সরাসরি তারেক রহমানকে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তিনি হঠাত্ করেই দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তারেক রহমান জবাব দেন, তিনি হঠাত্ করেই দলের যুগ্ম মহাসচিব হননি। তিনি প্রথমে নিজ জেলা বগুড়ায় বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। তারপর একজন কর্মী হিসেবে দলের জন্য বছরের পর বছর কাজ করেন। এরপর ২০০২ সালে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের এক বৈঠকে তাকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পরে এই প্রস্তাব যথানিয়মে দলের চেয়ারপার্সনের অনুমোদন পায়।
‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামে ওয়েব-ভিত্তিক একটি সংগঠন তারেক রহমানের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওই অনলাইন বৈঠকটির আয়োজন করেছিল। নিউইয়র্কে বসে ‘কবিতা ও গান ডটকম’ সংগঠনটির অধিকর্তা প্রবাসী সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। একই সময় হাওয়া ভবনে বসে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন ‘কবিতা ও গান ডটকম’-এর অপর সংগঠক বিশিষ্ট গীতিকার জুলফিকার রাসেল। প্রবাসী প্রশ্নকর্তারা ছাড়াও হাওয়া ভবনে তিনজন সাংবাদিকের একটি প্যানেল ছিল। সাংবাদিক প্যানেলে ছিলেন সেই সময় এনটিভির বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার, অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের চিফ রিপোর্টার মেসবাহ আহমেদ এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ও বার্তা সংস্থা ইউএনবি’র সিনিয়র করেসপনডেন্ট সালেহ শিবলী। সাংবাদিকরাও প্রশ্ন করেন তারেক রহমানকে। হাওয়া ভবনে সকাল পৌনে ১১টায় শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই অনলাইন বৈঠকটি চলে। ওই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইউক্রেইন, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা তারেক রহমানকে প্রশ্ন করেন। সব মিলিয়ে তারেক রহমান কমপক্ষে ২৫টি প্রশ্নের জবাব দেন। এর মধ্যে ছিল তারেক রহমানের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা, তার বিরুদ্ধে কেন দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ, প্রবাসীদের জন্য সরকারের উদ্যোগসহ প্রিয়-অপ্রিয় অনেক প্রশ্ন।
তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা তার (তারেক রহমানের) বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন, অভিযোগটি কীভাবে খণ্ডাবেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, শেখ হাসিনা একবার বলেন আমি বিদেশে ১১ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছি, আবার বলেন ১৭শ’ হাজার কোটি টাকা, আবার বলেন ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ সেই সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটই ছিল মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, নিজের পদমর্যাদার কারণেই বিরোধীদলীয় নেতার অভিযোগের মধ্যেও দায়িত্বশীলতা থাকা দরকার। তারপরও শেখ হাসিনা যেহেতু অভিযোগ করেছেন, প্রমাণ করার দায়িত্বও তার। তবে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, জিয়া পরিবারের কেউ বিদেশে থাকেন না, তারা সবাই বাংলাদেশেই থাকেন। বাংলাদেশই তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বিদেশে তাদের বাড়ি নেই। অতএব তাদের টাকা বিদেশে পাচারেরও প্রয়োজন নেই। অনলাইনে প্রবাসীদের সঙ্গে তারেক রহমানের এই ব্যতিক্রমধর্মী সওয়াল জওয়াব সেই সময় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল।
ওয়েব-ভিত্তিক সংগঠন ‘কবিতা ও গান ডটকম’ কোনো সংবিধিবদ্ধ নিউজ মিডিয়া কিংবা বার্তা সংস্থা নয়। তবুও কেন ওই সংগঠনের মাধ্যমে অনলাইনে প্রবাসীদের মুখোমুখি হলেন তারেক রহমান—এমন প্রশ্নেরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই সময় হাওয়া ভবনের মুখপাত্র আশিক ইসলাম। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা এবং সাংবাদিক গীতিকার জুলফিকার রাসেলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তারা তারেক রহমানকে প্রবাসীদের মুখোমুখি করতে চান। তবে সেটি সামনাসামনি নয়। অনলাইনে, ‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামক সংগঠনের মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে আলাপ করলে প্রথমেই আলোচনায় আসে ‘কবিতা ও গান ডটকম’ কোনো সংবাদ সংস্থা নয় কিংবা কোনো প্রথাগত নিউজ মিডিয়া নয়। অতএব এই সংগঠনের মাধ্যমে তারেক রহমান প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হলে জনগণ বিষয়টি কীভাবে নেবে? তারপরও ‘কবিতা ও গান ডটকম’ সংগঠনটির মাধ্যমেই তারেক রহমান প্রবাসীদের মুখোমুখি বসতে রাজি হন বিশেষত দু‘টি কারণে। এক. বিএনপি সরকার বাংলাদেশকে একটি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছিল, গঠন করেছিল পৃথক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে কম্পিউটার দিয়ে শিক্ষার্থীদের তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করানোর পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসনকেও তথ্য-প্রযুক্তির আওতায় আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইন্টারনেট সুবিধা সর্বস্তরের মানুষের কাছে সহজলভ্য করতেও গ্রহণ করেছিল বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘কবিতা ও গান ডটকম’র মাধ্যমে অনলাইনে বিশ্বের প্রবাসীদের মুখোমুখি হওয়া মানে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশীদের কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেয়াই নয় বরং এ উদ্যোগটির মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির বার্তাটিও প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ ঘটবে। দুই. প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সঙ্গত কারণেই মাতৃভূমি ছেড়ে দূর দেশে থাকা প্রবাসীদের মনে নিজ দেশ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, ওইসব প্রশ্নের জবাব তারা অনেক সময়ই সহজে পায় না। সুতরাং তাদের সব প্রশ্নেরও জবাব দেয়া যাবে।
এই চিন্তা থেকেই ‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামক সংগঠনটির মাধ্যমে তারেক রহমান অনলাইনে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই যোগে বিশ্বের কমপক্ষে ১৯টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের বিপরীতে বরং এখন থেকে আরও অর্ধযুগ আগেই ২০০৪ সালে নিজের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দিয়ে অধুনালুপ্ত হাওয়া ভবনে বসেই তারেক রহমান কবিতা ও গান ডটকম নামক ওয়েব-ভিত্তিক সংগঠনটির মাধ্যমে কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বাস্তব নমুনা দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু তারেক রহমানের কোনো সাফল্য মানেই যেন আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা। এ কারণে ২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের দিনই প্রধান বিরোধী দল হুমকি দেয়, একদিনের জন্যও বিএনপিকে শান্তিতে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে না। গোড়া থেকেই বিএনপি সরকারের প্রতি অসহযোগিতা শুরু করে আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়ার সরকার তো বটেই, একই সঙ্গে বিএনপি তথা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির আগামী দিনের কাণ্ডারি তারেক রহমান আওয়ামী লীগ এবং এর সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুপরিকল্পিত প্রতিহিংসার টার্গেটে পরিণত হন। কীভাবে দেশে-বিদেশে তারেক রহমানের ইমেজ নষ্ট করা যায় সেই মিশন নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকেন শেখ হাসিনা এবং তার দল। এমনও লক্ষ্য করা গেছে, বিএনপি সরকারের সমালোচনার চাইতেও কখনও কখনও ব্যক্তি তারেক রহমানই মনে হয়েছে শেখ হাসিনার সমালোচনার প্রধান শিকার। সেই শুরু থেকেই শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারা তারেক রহমান সম্পর্কে দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের কল্পিত অভিযোগ করতে থাকেন। তারেক রহমান বরাবরই এসব অভিযোগের সঠিক তথ্য-প্রমাণ চাইলেও সেই পথে কখনোই হাঁটেননি শেখ হাসিনা কিংবা তার দলের নেতারা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখন থেকে কমপক্ষে আট বছর আগে ২০০৪ সালেই যেখানে তারেক রহমান তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা উত্থাপিত টাকা পাচারের অভিযোগের জবাব প্রমাণের জন্য শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আজও সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি তারেক রহমানের ওপর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন করলেও ২০০৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করা উদ্দিন চক্রের দুই বছরের অনিয়মতান্ত্রিক সরকারও তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
২.
কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। পুরো পাঁচ বছর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও অনেক অশান্তি সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা ও তার দল। ইতিহাস সাক্ষী, সেই সুপরিকল্পিত অশান্তির পথ ধরেই উদ্দিন চক্র ২০০৭ সালে ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশে আমদানি হয় ঘোড়া। সেই ঘোড়ায় চড়ে তথাকথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতার দখল নেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে কী বোঝায় এটি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। ‘সাপোর্ট টু ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে সরকারের একটি প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ইনফো সেন্টার খোলার নামে সরকারের ভাণ্ডার থেকে শত শত কোটি টাকা হরিরলুট হয়েছে কিনা ভবিষ্যতে দুদকের নতুন কোনো চেয়ারম্যানের সময় হয়তো এ বিষয়ে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। তথ্য বেরিয়ে আসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘ইনোভেশন ফেয়ারের’ নামে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে ‘ইনোভেট’ করা হয়েছে নাকি আসলেই আইটি সেক্টরে কাজের কাজ কিছু হয়েছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর অগ্রগতি প্রমাণ করতে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি কম্পিউটার প্রকল্প উদ্বোধন করে জানিয়েছেন, এখন থেকে নাকি স্বল্পমূল্যে মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কম্পিউটার পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিক খবর হলো, ওই প্রকল্পটি এখন চলছে না।
অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল’ গণনার গোড়ায়ই গলদ। ২০০৮ সালে ঘোড়া মইন পরিচালিত হুদার নেতৃত্বে বেহুদা নির্বাচনে এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো কেন্দ্রের মোট ভোটারের চেয়ে ভোটের সংখ্যা বেশি। নির্বাচনে নাটের গুরু মইন উ এমনভাবে ডিজিটাল ক্যু করেছেন, যাতে নির্বাচনের পর সুযোগমত নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। তবে গোড়ায় গলদ থাকার কারণে সরকারের ডিজিটাল অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকমত কাজ করছে না। চারদিকেই হযবরল অবস্থা। তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সরকার। শেখ হাসিনা ক্রমেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন নিজের দল, দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকে। তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সিলেটের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলা এখন চলছে হালাকু কিংবা চেঙ্গিস খাঁদের আদর্শে। ছাত্রলীগের অত্যাচার-নির্যাতনে বিরক্ত, বিব্রত ও অসহায় শেখ হাসিনা ক্ষমতারোহণের বছর খানেকের মধ্যেই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ অবস্থা বেগতিক দেখে এবার ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় নিজেকে পরিবারের নিকটজন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তিনি এবং তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের সন্তানরা ছাড়া আর কেউ তার পরিবারের সদস্য নয়। শেখ হাসিনা এখন আর ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ, মাশরুর হোসেন, ব্যারিস্টার তাপস কিংবা শেখ সেলিমসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের দায়িত্ব নিতেও রাজি নন বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের হাতে সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পড়ার পর সরকারের এখন ত্রাহি অবস্থা। শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মুখে স্বভাবসুলভ বিষ ছড়ালেও তাদের রাগ ভাঙাতে আবুল মন্ত্রীকে কোরবানি দিয়েও রেহাই মিলছে না। আর নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ইস্যুটি এখন সরকারের গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এই সরকারের জন্য এখন কোথাও কোনো সুখবর নেই। এ অবস্থায় অমুক কিংবা তমুককে দোষ দেয়া বা ষড়যন্ত্র খোঁজা অথবা গলাবাজি করে দম নেয়া ছাড়া সরকারের কাছে আপাতত আর কোনো পথ খোলা নেই বলেই মনে হয়। অতএব সরকার যখন গলাবাজি করে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এ কথা বোঝানোর চেষ্টায় লিপ্ত, ঠিক এমনি এক সময় সরকারের প্রিয় মানুষ ড. এটিএন মাহফুজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন ‘বাচাল’। তবে পত্রিকার খবর বেরিয়েছে, অপ্রিয় সত্য কথা বলার মর্ম টের পেয়ে ড. মাহফুজ আদালতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে ‘বাচাল’ বলেননি বরং তিনি নিজেকেই নিজে ‘বাচাল’ বলেছেন। যাই হোক, কে ‘বাচাল’ আপাতত এ বিতর্কে না গিয়ে একটি বিষয় দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়, গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের মাধ্যমে একটি আধুনিক ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের জন্য কাজ শুরু করার পথে বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এ ধরনের বাচালতারই নির্মম শিকার।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যুক্তরাজ্য থেকে
২০০৪ সালের গোড়ার দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবনে বিএনপির তত্কালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান বিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইন্টারনেট এবং ফোনের মাধ্যমে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। যদিও সে সময় দেশে কথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে কোনো স্লোগান ছিল না। তবে তথ্য-প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে একটি আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কার্যকর পদক্ষেপ ছিল, ছিল বাংলাদেশকে ই-গভার্নেন্সের আওতায় আনার বাস্তবমুখী উদ্যোগ।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালে। নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয় বনানীর হাওয়া ভবনে বসেই জনতার রায়ে বিএনপিকে বিজয়ী করার সব পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল জয় পায় বিএনপি। এর মাধ্যমে একজন দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিক হিসেবে দল ও জনগণের কাছে নিজেকে সফলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করা তারেক রহমান।
সঙ্গত কারণেই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারেক রহমান এবং হাওয়া ভবন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। হাওয়া ভবন এবং তারেক রহমানের কার্যক্রম সম্পর্কে দেশে-বিদেশে অনেকের মনেই ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। জন্ম নেয় অনেক ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রশ্নেরও। ফলে সব কার্যক্রমে সদা সতর্ক ছিলেন তারেক রহমান।
কেউ যেন তার কিংবা হাওয়া ভবনের নাম ভাঙিয়ে সরকারে কিংবা প্রশাসনে অন্যায় সুবিধা নেয়ার চেষ্টা না করতে পারেন, সে ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সরকার গঠনের মাত্র এক বছরের মাথায়ই ২০০২ সালের জুন মাসে হাওয়া ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি তার ফোন এবং ফ্যাক্স নম্বর মিডিয়ায় সরবরাহ করে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তার নাম ভাঙিয়ে কেউ কোথাও কোনো দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের আশ্রয় নিলে তাকে জানাতে। স্পষ্ট করেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, হাওয়া ভবন কোনো তদবির কিংবা কারও ওপর খবরদারির জায়গা নয়। এটি স্রেফ দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বর্তমানে দেশে-বিদেশে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের। পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্ষমতায় থাকার প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় ২০১২ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা তার ফোন এবং ই-মেইল নম্বর দেশের জনগণকে জানিয়ে দিয়ে বলেছেন, কেউ তার ও তার পরিবারের নামে দুর্নীতি কিংবা অবৈধ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করলে তাকে যেন জানানো হয়। জনগণের উদ্দেশ্যে নিজের ফোন ও ফ্যাক্স নাম্বার জানিয়ে দেয়ার এই কাজটি এখন থেকে ঠিক ১০ বছর আগে ২০০২ সালেই হাওয়া ভবনে বসে করেছিলেন তারেক রহমান।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর তারেক রহমান বাংলাদেশের উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তার কাজের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। সারাদেশ ঘুরে বেরিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের চাহিদা এবং জনপদের মৌলিক সমস্যাগুলোর চিহ্নিত করেছিলেন। এরপর হাওয়া ভবনের কার্যালয়ে বসে একটি ডাটাবেইস তৈরি করে ওইসব সমস্যা প্রায়োধিকার ভিত্তিতে সমাধানের জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন ও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দলের পক্ষ থেকে তুলে দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে সহায়তা করার জন্য দেশের প্রতিটি জেলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চালচিত্র, সমস্যা ও সম্ভাবনা, দলের সর্বস্তরের নেতার নাম-ঠিকানা—সবকিছুই তিনি কম্পিউটারে সংরক্ষণ করেছিলেন। প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে দলের সর্বস্তরের নেতৃত্বকে কীভাবে দেশ ও জনগণের উন্নয়নে কাজে লাগানো যায় সেই পলিসি নির্ধারণ করেছিলেন। সারাদেশে নিজ দলের রাজনৈতিক শক্তিকে সামাজিক বিপ্লবের হাতিয়ারে পরিণত করে কীভাবে প্রতিটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যায় সেই পথ বাতলে দিয়েছেন। যৌতুকের অভিযোগ থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়া, জন্ম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখা, অযথা রাজনৈতিক বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় করার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে সেই কাজগুলো সারাদেশে দলের নেতাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সারাদেশে দলের নেতাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়ে বলেছেন, শুধু কথা নয় কাজ, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, প্রয়োজন স্বপ্নের বাস্তবায়ন, রাজনীতিই একমাত্র পেশা হতে পারে না বরং প্রত্যেকেরই বৈধ আয়ের একটি উত্স থাকা চাই। বাংলাদেশের ৫৪ হাজার বর্গমাইলের সীমানায়ই তার রাজনৈতিক চিন্তার গণ্ডি সীমাবদ্ধ ছিল না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন, যৌক্তিক ও আইনগতভাবেই বাংলাদেশের সীমানা আরও বাড়ার সুযোগ রয়েছে। তার দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্বে না থেকেও তিনি তার কাজকর্মে একজন ভিশনারী রাজনৈতিক নেতার পরিচয় রেখেছেন। তার দল ক্ষমতায় থাকার সময় স্বল্প কয়েকটি বিদেশ যাত্রায় বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি তার প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি একবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। সেই সফরকে প্রমোদভ্রমণে রূপান্তরিত না করে বরং কথা বলেছেন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। একান্ত বৈঠক করেছেন মাইক্রোসফটের রাজা বিল গেটসের সঙ্গে। এখানেই তিনি প্রমাণ করেছেন, অন্য অনেক রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে তিনি ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির গুণগত সংস্কার এবং তৃণমূল জনগণের জীবনমান উন্নয়নে তার ইতিবাচক চিন্তা দেশে-বিদেশে তাকে তৃতীয় বিশ্বের ভিন্নধর্মী একজন রাজনৈতিক নেতার ইমেজ এনে দিয়েছিল। ফলে দেশে-বিদেশে তার কার্যক্রম মানুষের মধ্যে যেমন আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, একই সঙ্গে নিন্দুকের নিন্দাবাণেও জর্জরিত হয়েছেন তিনি। এমনই এক পরিস্থিতিতে তারেক রহমান ২০০৪ সালে হাওয়া ভবনে বসেই মুখোমুখি হন প্রবাসী বাংলাদেশীদের।
প্রবাসীদের সঙ্গে তারেক রহমানের সেই বৈঠকটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যতিক্রম এবং নানা বৈশিষ্ট্যের কারণেই অনন্য। বরং বলা যেতে পারে, বর্তমানে আওয়ামী লীগের তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বাস্তব মহড়া ছিল হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওই বৈঠকটি। এ কারণেই ওই বৈঠকটি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত উল্লেখ করা প্রয়োজন বলেই মনে করি।
হাওয়া ভবনে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বৈঠকটি ছিল অনলাইনে। প্রত্যেক প্রবাসীই যিনি যার নিজ নিজ দেশ থেকে তারেক রহমানকে ফোনে কিংবা ইন্টারনেটে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন নিঃসংকোচে। অনলাইনেই তাত্ক্ষণিক জবাবও পেয়েছেন প্রতিটি প্রশ্নের। দু’একটি প্রশ্ন শুনতে খানিকটা অপ্রিয় মনে হলেও তারেক রহমান জবাব দিয়েছেন সাবলীলভাবে। ২০০১ সালে বিএনপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর একপর্যায়ে তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব করা হয়। এ নিয়ে বিরোধী মহলে কানাঘুষা ছিল। অনলাইনে একজন প্রশ্নকর্তা সরাসরি তারেক রহমানকে জিজ্ঞেস করেন কীভাবে তিনি হঠাত্ করেই দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তারেক রহমান জবাব দেন, তিনি হঠাত্ করেই দলের যুগ্ম মহাসচিব হননি। তিনি প্রথমে নিজ জেলা বগুড়ায় বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। তারপর একজন কর্মী হিসেবে দলের জন্য বছরের পর বছর কাজ করেন। এরপর ২০০২ সালে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের এক বৈঠকে তাকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পরে এই প্রস্তাব যথানিয়মে দলের চেয়ারপার্সনের অনুমোদন পায়।
‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামে ওয়েব-ভিত্তিক একটি সংগঠন তারেক রহমানের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ওই অনলাইন বৈঠকটির আয়োজন করেছিল। নিউইয়র্কে বসে ‘কবিতা ও গান ডটকম’ সংগঠনটির অধিকর্তা প্রবাসী সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন। একই সময় হাওয়া ভবনে বসে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন ‘কবিতা ও গান ডটকম’-এর অপর সংগঠক বিশিষ্ট গীতিকার জুলফিকার রাসেল। প্রবাসী প্রশ্নকর্তারা ছাড়াও হাওয়া ভবনে তিনজন সাংবাদিকের একটি প্যানেল ছিল। সাংবাদিক প্যানেলে ছিলেন সেই সময় এনটিভির বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার, অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের চিফ রিপোর্টার মেসবাহ আহমেদ এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক ও বার্তা সংস্থা ইউএনবি’র সিনিয়র করেসপনডেন্ট সালেহ শিবলী। সাংবাদিকরাও প্রশ্ন করেন তারেক রহমানকে। হাওয়া ভবনে সকাল পৌনে ১১টায় শুরু হয়ে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই অনলাইন বৈঠকটি চলে। ওই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ইউক্রেইন, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা তারেক রহমানকে প্রশ্ন করেন। সব মিলিয়ে তারেক রহমান কমপক্ষে ২৫টি প্রশ্নের জবাব দেন। এর মধ্যে ছিল তারেক রহমানের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা, তার বিরুদ্ধে কেন দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ, প্রবাসীদের জন্য সরকারের উদ্যোগসহ প্রিয়-অপ্রিয় অনেক প্রশ্ন।
তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা তার (তারেক রহমানের) বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন, অভিযোগটি কীভাবে খণ্ডাবেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, পত্র-পত্রিকায় দেখেছি, শেখ হাসিনা একবার বলেন আমি বিদেশে ১১ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছি, আবার বলেন ১৭শ’ হাজার কোটি টাকা, আবার বলেন ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ সেই সময় বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটই ছিল মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, নিজের পদমর্যাদার কারণেই বিরোধীদলীয় নেতার অভিযোগের মধ্যেও দায়িত্বশীলতা থাকা দরকার। তারপরও শেখ হাসিনা যেহেতু অভিযোগ করেছেন, প্রমাণ করার দায়িত্বও তার। তবে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, জিয়া পরিবারের কেউ বিদেশে থাকেন না, তারা সবাই বাংলাদেশেই থাকেন। বাংলাদেশই তাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বিদেশে তাদের বাড়ি নেই। অতএব তাদের টাকা বিদেশে পাচারেরও প্রয়োজন নেই। অনলাইনে প্রবাসীদের সঙ্গে তারেক রহমানের এই ব্যতিক্রমধর্মী সওয়াল জওয়াব সেই সময় দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল।
ওয়েব-ভিত্তিক সংগঠন ‘কবিতা ও গান ডটকম’ কোনো সংবিধিবদ্ধ নিউজ মিডিয়া কিংবা বার্তা সংস্থা নয়। তবুও কেন ওই সংগঠনের মাধ্যমে অনলাইনে প্রবাসীদের মুখোমুখি হলেন তারেক রহমান—এমন প্রশ্নেরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেই সময় হাওয়া ভবনের মুখপাত্র আশিক ইসলাম। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক আমান-উদ-দৌলা এবং সাংবাদিক গীতিকার জুলফিকার রাসেলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তারা তারেক রহমানকে প্রবাসীদের মুখোমুখি করতে চান। তবে সেটি সামনাসামনি নয়। অনলাইনে, ‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামক সংগঠনের মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে আলাপ করলে প্রথমেই আলোচনায় আসে ‘কবিতা ও গান ডটকম’ কোনো সংবাদ সংস্থা নয় কিংবা কোনো প্রথাগত নিউজ মিডিয়া নয়। অতএব এই সংগঠনের মাধ্যমে তারেক রহমান প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হলে জনগণ বিষয়টি কীভাবে নেবে? তারপরও ‘কবিতা ও গান ডটকম’ সংগঠনটির মাধ্যমেই তারেক রহমান প্রবাসীদের মুখোমুখি বসতে রাজি হন বিশেষত দু‘টি কারণে। এক. বিএনপি সরকার বাংলাদেশকে একটি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপক কার্যক্রম চালাচ্ছিল, গঠন করেছিল পৃথক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে কম্পিউটার দিয়ে শিক্ষার্থীদের তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করানোর পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসনকেও তথ্য-প্রযুক্তির আওতায় আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইন্টারনেট সুবিধা সর্বস্তরের মানুষের কাছে সহজলভ্য করতেও গ্রহণ করেছিল বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘কবিতা ও গান ডটকম’র মাধ্যমে অনলাইনে বিশ্বের প্রবাসীদের মুখোমুখি হওয়া মানে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশীদের কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেয়াই নয় বরং এ উদ্যোগটির মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির বার্তাটিও প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ ঘটবে। দুই. প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সঙ্গত কারণেই মাতৃভূমি ছেড়ে দূর দেশে থাকা প্রবাসীদের মনে নিজ দেশ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, ওইসব প্রশ্নের জবাব তারা অনেক সময়ই সহজে পায় না। সুতরাং তাদের সব প্রশ্নেরও জবাব দেয়া যাবে।
এই চিন্তা থেকেই ‘কবিতা ও গান ডটকম’ নামক সংগঠনটির মাধ্যমে তারেক রহমান অনলাইনে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই যোগে বিশ্বের কমপক্ষে ১৯টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীদের মুখোমুখি হন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানের বিপরীতে বরং এখন থেকে আরও অর্ধযুগ আগেই ২০০৪ সালে নিজের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দিয়ে অধুনালুপ্ত হাওয়া ভবনে বসেই তারেক রহমান কবিতা ও গান ডটকম নামক ওয়েব-ভিত্তিক সংগঠনটির মাধ্যমে কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বাস্তব নমুনা দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু তারেক রহমানের কোনো সাফল্য মানেই যেন আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা। এ কারণে ২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের দিনই প্রধান বিরোধী দল হুমকি দেয়, একদিনের জন্যও বিএনপিকে শান্তিতে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হবে না। গোড়া থেকেই বিএনপি সরকারের প্রতি অসহযোগিতা শুরু করে আওয়ামী লীগ। খালেদা জিয়ার সরকার তো বটেই, একই সঙ্গে বিএনপি তথা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তির আগামী দিনের কাণ্ডারি তারেক রহমান আওয়ামী লীগ এবং এর সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুপরিকল্পিত প্রতিহিংসার টার্গেটে পরিণত হন। কীভাবে দেশে-বিদেশে তারেক রহমানের ইমেজ নষ্ট করা যায় সেই মিশন নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকেন শেখ হাসিনা এবং তার দল। এমনও লক্ষ্য করা গেছে, বিএনপি সরকারের সমালোচনার চাইতেও কখনও কখনও ব্যক্তি তারেক রহমানই মনে হয়েছে শেখ হাসিনার সমালোচনার প্রধান শিকার। সেই শুরু থেকেই শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারা তারেক রহমান সম্পর্কে দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের কল্পিত অভিযোগ করতে থাকেন। তারেক রহমান বরাবরই এসব অভিযোগের সঠিক তথ্য-প্রমাণ চাইলেও সেই পথে কখনোই হাঁটেননি শেখ হাসিনা কিংবা তার দলের নেতারা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখন থেকে কমপক্ষে আট বছর আগে ২০০৪ সালেই যেখানে তারেক রহমান তার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা উত্থাপিত টাকা পাচারের অভিযোগের জবাব প্রমাণের জন্য শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আজও সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি তারেক রহমানের ওপর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন করলেও ২০০৭ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করা উদ্দিন চক্রের দুই বছরের অনিয়মতান্ত্রিক সরকারও তার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
২.
কথা রেখেছেন শেখ হাসিনা। পুরো পাঁচ বছর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও অনেক অশান্তি সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা ও তার দল। ইতিহাস সাক্ষী, সেই সুপরিকল্পিত অশান্তির পথ ধরেই উদ্দিন চক্র ২০০৭ সালে ক্ষমতা দখল করে। বাংলাদেশে আমদানি হয় ঘোড়া। সেই ঘোড়ায় চড়ে তথাকথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতার দখল নেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে কী বোঝায় এটি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। ‘সাপোর্ট টু ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে সরকারের একটি প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে ইনফো সেন্টার খোলার নামে সরকারের ভাণ্ডার থেকে শত শত কোটি টাকা হরিরলুট হয়েছে কিনা ভবিষ্যতে দুদকের নতুন কোনো চেয়ারম্যানের সময় হয়তো এ বিষয়ে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। তথ্য বেরিয়ে আসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ‘ইনোভেশন ফেয়ারের’ নামে কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে ‘ইনোভেট’ করা হয়েছে নাকি আসলেই আইটি সেক্টরে কাজের কাজ কিছু হয়েছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর অগ্রগতি প্রমাণ করতে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি কম্পিউটার প্রকল্প উদ্বোধন করে জানিয়েছেন, এখন থেকে নাকি স্বল্পমূল্যে মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কম্পিউটার পাওয়া যাবে। সাম্প্রতিক খবর হলো, ওই প্রকল্পটি এখন চলছে না।
অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল’ গণনার গোড়ায়ই গলদ। ২০০৮ সালে ঘোড়া মইন পরিচালিত হুদার নেতৃত্বে বেহুদা নির্বাচনে এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো কেন্দ্রের মোট ভোটারের চেয়ে ভোটের সংখ্যা বেশি। নির্বাচনে নাটের গুরু মইন উ এমনভাবে ডিজিটাল ক্যু করেছেন, যাতে নির্বাচনের পর সুযোগমত নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে। তবে গোড়ায় গলদ থাকার কারণে সরকারের ডিজিটাল অনেক ক্ষেত্রেই ঠিকমত কাজ করছে না। চারদিকেই হযবরল অবস্থা। তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সরকার। শেখ হাসিনা ক্রমেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন নিজের দল, দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহল থেকে। তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সিলেটের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলা এখন চলছে হালাকু কিংবা চেঙ্গিস খাঁদের আদর্শে। ছাত্রলীগের অত্যাচার-নির্যাতনে বিরক্ত, বিব্রত ও অসহায় শেখ হাসিনা ক্ষমতারোহণের বছর খানেকের মধ্যেই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ অবস্থা বেগতিক দেখে এবার ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় নিজেকে পরিবারের নিকটজন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তিনি এবং তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের সন্তানরা ছাড়া আর কেউ তার পরিবারের সদস্য নয়। শেখ হাসিনা এখন আর ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ, মাশরুর হোসেন, ব্যারিস্টার তাপস কিংবা শেখ সেলিমসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের দায়িত্ব নিতেও রাজি নন বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের হাতে সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পড়ার পর সরকারের এখন ত্রাহি অবস্থা। শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মুখে স্বভাবসুলভ বিষ ছড়ালেও তাদের রাগ ভাঙাতে আবুল মন্ত্রীকে কোরবানি দিয়েও রেহাই মিলছে না। আর নোবেলজয়ী ড. ইউনূস ইস্যুটি এখন সরকারের গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এই সরকারের জন্য এখন কোথাও কোনো সুখবর নেই। এ অবস্থায় অমুক কিংবা তমুককে দোষ দেয়া বা ষড়যন্ত্র খোঁজা অথবা গলাবাজি করে দম নেয়া ছাড়া সরকারের কাছে আপাতত আর কোনো পথ খোলা নেই বলেই মনে হয়। অতএব সরকার যখন গলাবাজি করে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এ কথা বোঝানোর চেষ্টায় লিপ্ত, ঠিক এমনি এক সময় সরকারের প্রিয় মানুষ ড. এটিএন মাহফুজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন ‘বাচাল’। তবে পত্রিকার খবর বেরিয়েছে, অপ্রিয় সত্য কথা বলার মর্ম টের পেয়ে ড. মাহফুজ আদালতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে ‘বাচাল’ বলেননি বরং তিনি নিজেকেই নিজে ‘বাচাল’ বলেছেন। যাই হোক, কে ‘বাচাল’ আপাতত এ বিতর্কে না গিয়ে একটি বিষয় দৃঢ়তার সঙ্গেই বলা যায়, গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের মাধ্যমে একটি আধুনিক ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের জন্য কাজ শুরু করার পথে বিএনপির বর্তমান সিনিয়র ভাইস চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এ ধরনের বাচালতারই নির্মম শিকার।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, যুক্তরাজ্য থেকে
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন