পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরিব-দুস্থ মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ১ কোটি ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) কার্ডের বেশিরভাগই হাতিয়ে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যথেচ্ছভাবে এসব কার্ড বিতরণ করছেন তারা। ক্ষমতার জোরে কার্ড প্রার্থীদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও পছন্দের কর্মীদের নাম। বঞ্চিত হচ্ছেন গরিব-দুঃখী, নিঃস্ব মানুষ। এ নিয়ে অসহায় মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। কার্ড না পাওয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে ভিজিএফ কার্ড নিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের (এএইচআরসি) প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিজিএফ কার্ডের ৮০ শতাংশই প্রকৃত গরিব মানুষ পান না। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ভিজিএফ কার্ড গরিব মানুষের পরিবর্তে দলীয় নেতাকর্মীদের পকেটে চলে যাচ্ছে।
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ঈদে গরিব ও দুস্থ মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য ১ কোটি ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতি কার্ডের বিপরীতে জনপ্রতি ১০ কেজি চাল দেয়া হবে। এ জন্য ১ লাখ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাদ্য বিভাগ এ চালের জোগান দেবে। এরই মধ্যে চালের ছাড় দেয়া শুরু হয়েছে। এ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাদের মতে, মূলত দলীয় নেতাকর্মীদের ঈদ খরচের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। বেশিরভাগ সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ দলীয় হওয়ায় তারাই ভিজিএফ কার্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। যেসব সংসদীয় আসনে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন, সেসব স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কার্ড ও চাল ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের ঠিক রাখতে সচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ বিভাগে বিস্তর অভিযোগ আসছে। একই অভিযোগ করলেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ। বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য অভিযোগ করে বলেন, ভিজিএফ কার্ড কারা পাবেন তার তালিকা আওয়ামী লীগ নেতারা করছেন। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের মতামত আমলে নেয়া হয় না।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ভিজিএফ কার্ড কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) দিচ্ছেন। ওই তালিকা ধরেই কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও কার্ডের জন্য টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতারা মোট কার্ডের ৩০ শতাংশ নিজেরা বিতরণ করবেন বলে প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছেন। একইভাবে সারাদেশ থেকে ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর ঈদের আগে গরিব দুস্থদের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ১ কোটি কার্ড বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের পকেটে। কোথাও কোথাও ৩০-৬০ ভাগ পর্যন্ত দলীয় কর্মীরা পাচ্ছেন। তারা এটাকে ঈদের খোরাক হিসেবে দেখছেন। এছাড়া তালিকা তৈরিতে ব্যাপক দলীয়করণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সচ্ছল ব্যক্তিদের দুস্থ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে কার্ড। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেই বিরোধ দেখা দিয়েছে। কোথাও মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন তারা। হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি ইউনুস বাহাদুর ওই ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ১৭২টি ভিজিএফ কার্ডের অর্ধেক দলীয় নেতাকর্মীদের নামে ইস্যু করার দাবি জানান। তার চাহিদা অনুযায়ী দলীয় নেতাকর্মীদের ভিজিএফ কার্ড না দেয়ায় গত শনিবার ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে যুবলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ সময় গরিবের কার্ড ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় তারা। এতে ইউপি চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন, ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার আমজাদ হোসেন, ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার বেলাল হোসেনসহ ৮ জন আহত হন। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ভাংচুর চালানো হয়। বগুড়ার ধুনটে ভিজিএফ কার্ডের ৩০ শতাংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বণ্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উপজেলায় ২২ হাজার ২৩টি কার্ডের জন্য ২২০ দশমিক ২৩০ টন এবং পৌরসভায় এক হাজার ৫৪০টি কার্ডের জন্য ১৫ দশমিক ৪০০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত ৩০ জুলাই উপজেলা মিলনায়তনে ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিষদের চেয়ারম্যান টিআইএম নুরুন্নবী তারেক দলের নেতাকর্মীর নামে ৩০ শতাংশ কোটা রেখে চেয়ারম্যানদের ভিজিএফ কার্ডের তালিকা করার সিদ্ধান্ত দেন। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ভিজিএফ কার্ডের ৮০ শতাংশই প্রকৃত গরিব মানুষ পান না—এএইচআরসি : ভিজিএফ কার্ডের ৮০ শতাংশ প্রকৃত গরিব পায় না বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ভিজিএফ কর্মসূচির ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে সংস্থাটি বলেছে, সরকার যে খাদ্যসহায়তা দেয়, তার ৮০ শতাংশ প্রকৃত গরিবের কাছে পৌঁছায় না। কমিশন গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের ওপর সমীক্ষাটি চালায়। এতে দেখা যায়, শুধু সাতটি গ্রামের এক হাজার পরিবার ভিজিএফ কার্ড পেয়েছে। ছয়টি গ্রামের কোনো গরিব মানুষ এ কার্ড পায়নি। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৬০০ ভিজিএফ কার্ড স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে দেয়া হয়েছে। ওই ৬০০ পরিবারের নাম তালিকায় উঠলেও তাদের হাতে কখনোই খাদ্যসহায়তা পৌঁছায়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ওই চাল আত্মসাত্ করেছেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পাওয়ার যোগ্যতা আছে এমন ব্যক্তিকেও ভিজিএফ ও বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এই টাকা নেন জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পিপলস পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন (পিপিআরসি) পরিচালিত এ সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, সব সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের মধ্যে ১৬ শতাংশ অযোগ্য ব্যক্তি সহায়তা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুযোগ নিয়ে এসব অযোগ্য ব্যক্তি সহায়তা পাওয়ায় প্রকৃত গরিবরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত : সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানকে ভিজিএফ কার্ডে দুর্নীতির বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ মনিটরিং জোরদার করলে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে তিনি বলেন, ভিজিএফ কার্ড প্রকৃত গরিব মানুষ পাচ্ছেন কি না তা নিশ্চিত করতে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক পিয়াস করিম বলেন, সরকার গরিব মানুষের প্রতি যথার্থ কমিটমেন্ট দেখাতে পারছে না। কমিটমেন্টের অভাবে ভিজিএফ কার্ড সচ্ছল ও দলীয় ব্যক্তিদের কাছে চলে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় ব্যক্তিদের হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে যে, ভিজিএফ কার্ড গরিবের সম্পদ। তাদের এ সম্পদ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
ভিজিএফ কার্ড বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য গতকাল খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইলে এসএমএস করার পরও তারা ফোন রিসিভ করেননি
খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ঈদে গরিব ও দুস্থ মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য ১ কোটি ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। প্রতি কার্ডের বিপরীতে জনপ্রতি ১০ কেজি চাল দেয়া হবে। এ জন্য ১ লাখ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। খাদ্য বিভাগ এ চালের জোগান দেবে। এরই মধ্যে চালের ছাড় দেয়া শুরু হয়েছে। এ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তাদের মতে, মূলত দলীয় নেতাকর্মীদের ঈদ খরচের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। বেশিরভাগ সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ দলীয় হওয়ায় তারাই ভিজিএফ কার্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। যেসব সংসদীয় আসনে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছেন, সেসব স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কার্ড ও চাল ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের ঠিক রাখতে সচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ বিভাগে বিস্তর অভিযোগ আসছে। একই অভিযোগ করলেন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ। বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য অভিযোগ করে বলেন, ভিজিএফ কার্ড কারা পাবেন তার তালিকা আওয়ামী লীগ নেতারা করছেন। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের মতামত আমলে নেয়া হয় না।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ভিজিএফ কার্ড কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) দিচ্ছেন। ওই তালিকা ধরেই কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও কার্ডের জন্য টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতারা মোট কার্ডের ৩০ শতাংশ নিজেরা বিতরণ করবেন বলে প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছেন। একইভাবে সারাদেশ থেকে ভিজিএফ কার্ড বিতরণ নিয়ে অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর ঈদের আগে গরিব দুস্থদের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ১ কোটি কার্ড বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের পকেটে। কোথাও কোথাও ৩০-৬০ ভাগ পর্যন্ত দলীয় কর্মীরা পাচ্ছেন। তারা এটাকে ঈদের খোরাক হিসেবে দেখছেন। এছাড়া তালিকা তৈরিতে ব্যাপক দলীয়করণ করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সচ্ছল ব্যক্তিদের দুস্থ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে কার্ড। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেই বিরোধ দেখা দিয়েছে। কোথাও মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন তারা। হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের যুবলীগ সভাপতি ইউনুস বাহাদুর ওই ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ১৭২টি ভিজিএফ কার্ডের অর্ধেক দলীয় নেতাকর্মীদের নামে ইস্যু করার দাবি জানান। তার চাহিদা অনুযায়ী দলীয় নেতাকর্মীদের ভিজিএফ কার্ড না দেয়ায় গত শনিবার ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে যুবলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ সময় গরিবের কার্ড ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায় তারা। এতে ইউপি চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন, ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার আমজাদ হোসেন, ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার বেলাল হোসেনসহ ৮ জন আহত হন। এ সময় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ভাংচুর চালানো হয়। বগুড়ার ধুনটে ভিজিএফ কার্ডের ৩০ শতাংশ নিয়মবহির্ভূতভাবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বণ্টন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উপজেলায় ২২ হাজার ২৩টি কার্ডের জন্য ২২০ দশমিক ২৩০ টন এবং পৌরসভায় এক হাজার ৫৪০টি কার্ডের জন্য ১৫ দশমিক ৪০০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত ৩০ জুলাই উপজেলা মিলনায়তনে ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরিষদের চেয়ারম্যান টিআইএম নুরুন্নবী তারেক দলের নেতাকর্মীর নামে ৩০ শতাংশ কোটা রেখে চেয়ারম্যানদের ভিজিএফ কার্ডের তালিকা করার সিদ্ধান্ত দেন। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ভিজিএফ কার্ডের ৮০ শতাংশই প্রকৃত গরিব মানুষ পান না—এএইচআরসি : ভিজিএফ কার্ডের ৮০ শতাংশ প্রকৃত গরিব পায় না বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ভিজিএফ কর্মসূচির ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে সংস্থাটি বলেছে, সরকার যে খাদ্যসহায়তা দেয়, তার ৮০ শতাংশ প্রকৃত গরিবের কাছে পৌঁছায় না। কমিশন গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের ওপর সমীক্ষাটি চালায়। এতে দেখা যায়, শুধু সাতটি গ্রামের এক হাজার পরিবার ভিজিএফ কার্ড পেয়েছে। ছয়টি গ্রামের কোনো গরিব মানুষ এ কার্ড পায়নি। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৬০০ ভিজিএফ কার্ড স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে দেয়া হয়েছে। ওই ৬০০ পরিবারের নাম তালিকায় উঠলেও তাদের হাতে কখনোই খাদ্যসহায়তা পৌঁছায়নি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ওই চাল আত্মসাত্ করেছেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আরেক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পাওয়ার যোগ্যতা আছে এমন ব্যক্তিকেও ভিজিএফ ও বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এই টাকা নেন জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পিপলস পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন (পিপিআরসি) পরিচালিত এ সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, সব সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের মধ্যে ১৬ শতাংশ অযোগ্য ব্যক্তি সহায়তা পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুযোগ নিয়ে এসব অযোগ্য ব্যক্তি সহায়তা পাওয়ায় প্রকৃত গরিবরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত : সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানকে ভিজিএফ কার্ডে দুর্নীতির বিষয়ে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগ মনিটরিং জোরদার করলে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। এ ক্ষেত্রে প্রতিকার হিসেবে তিনি বলেন, ভিজিএফ কার্ড প্রকৃত গরিব মানুষ পাচ্ছেন কি না তা নিশ্চিত করতে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক পিয়াস করিম বলেন, সরকার গরিব মানুষের প্রতি যথার্থ কমিটমেন্ট দেখাতে পারছে না। কমিটমেন্টের অভাবে ভিজিএফ কার্ড সচ্ছল ও দলীয় ব্যক্তিদের কাছে চলে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দলীয় ব্যক্তিদের হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে যে, ভিজিএফ কার্ড গরিবের সম্পদ। তাদের এ সম্পদ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
ভিজিএফ কার্ড বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম প্রসঙ্গে বক্তব্য জানার জন্য গতকাল খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিভাগের সচিব ড. আসলাম আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইলে এসএমএস করার পরও তারা ফোন রিসিভ করেননি
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন