বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১২

অন্তর্বর্তী সরকারে রাজি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিতর্ক সর্বদলীয় নিয়ে


কোন পদ্ধতিতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন? তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী দেড় বছর ধরে রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ কেবল এ নিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে, দিনকে দিন জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী, কোথায় এর গন্তব্য, রাজনৈতিক সঙ্কটের ভেতর দিয়ে আবার নতুন কোনো শক্তির উত্থান হবে কি না তা নিয়ে নানামুখী আলোচনাও জট পাকাচ্ছে। যে নামেই হোক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চায় নির্দলীয় সরকার। এ দাবি আদায়ে তারা এখন আন্দোলনমুখী। ঈদের পর এই আন্দোলন আরো জোরালো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানে কট্টর। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেয়া এক সাাৎকারে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়ায় নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকলেও তার প্রস্তাব আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। এর মাধ্যমে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দাবি প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন। এখন সেই অন্তর্বর্তী সরকার দলীয় না নির্দলীয় হবে তা নিয়েই এখন বিরোধ থেকে গেল। 
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দিয়ে সংবিধানে নির্বাচিত দলীয় সরকারের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে দফা ৩-এ বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে।’ 
নতুন এই সংশোধনী আনার পর থেকেই রাজনীতিতে উত্তাপ বিরাজ করছে। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। তারা ফের সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকার বহালের দাবিতে অনড়। বিএনপি হাইকমান্ডের ভাবনা অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকারের নাম নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। সরকার হতে হবে নির্দলীয়। সেটা অন্তর্বর্তী সরকার হোক কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারই হোক। প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন কোনো নির্বাচনেও তারা অংশ নেবে না। সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব সম্প্রতি এসেছে তা-ও নাকচ করে দিয়েছেন দলটির প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, সরকার হতে হবে নির্দলীয়। অন্তর্বর্তী কোনো সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ দাবিতে তিনি ঈদ-পরবর্তী আন্দোলনে নামারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সাংবাদিকদের কাছে দলের সর্বশেষ অবস্থান আরো স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলুন না কেন আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হবে। ভিন্ন পন্থায় কিছু করার চেষ্টা করলে সরকার ভুল করবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপি আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। 
প্রধানমন্ত্রী অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে যোগ দেয়ার আহ্বানের পর আওয়ামী লীগ নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, নির্বাচনের সময় যে তিন মাস সংসদ কার্যকর থাকবে না, ওই সময় সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন হলে তা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বিএনপিকে এই সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। 
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফও নির্বাচনকালীন সরকারে বিরোধী দলকে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা মেনে নিতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিরপেভাবে করতে সরকার যে আন্তরিক, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। 
তিনি বিএনপির উদ্দেশে আরো বলেন, দেশের উন্নয়নকাজে বাধা না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রস্তাব অনুসারে কিভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে সংসদে গিয়ে কথা বলুন।
বিএনপির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো রূপরেখা দেবে না দলটি। সরকার নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বহালের ঘোষণা দিলেই তারা আলোচনায় বসতে রাজি আছে। অন্যথায় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তারা এই দাবি আদায় করবে। 
প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই : রফিক-উল-হক
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এ প্রস্তাব নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবকে আমি স্বাগত জানাই। এখন এ সরকার কিভাবে গঠন হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিল। কিন্তু তারা এখন সেই অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়েছে। এখন বিরোধী দল বিএনপিকেও এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য মঙ্গল হবে। 
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে বরফ গলবে না : এমাজউদ্দীন আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ এ মতের বিরোধিতা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবে বরফ গলবে না। কারণ বিএনপি তো বারবার বলে আসছে তারা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এর বাইরে অন্য কিছু নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী এ দাবি বাদ দিয়ে কী বললেন-না-বললেন সেটি কোনো ব্যাপার নয়। আসলে মহাজোটের অন্যতম প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ তো বলেই দিয়েছেন, এ সরকারের জনপ্রিয়তা ৫ শতাংশও নেই। সরকার বুঝতে পেরেছে, তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। সে জন্য তারা নির্দলীয় সরকারের চিন্তা বাদ নিয়ে এখন নতুন পদ্ধতির কথা বলছে, যা আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক। 
এ ধরনের সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় : বদিউল আলম
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও প্রায় একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, এ ধরনের সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এর প্রধান বাধা। আর নির্বাচন কমিশন যে এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়মুক্ত করা এবং ইসিকে শক্তিশালী করতে আরো কিছু বিষয় ঠিকমতো আসতে হবে। 
তিনি বলেন, সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব আমাদের সংসদীয় রীতিনীতিরও পরিপন্থী। কারণ এ পদ্ধতিতে সংসদ সদস্যরা তাদের স্বপদে বহাল থাকবেন। আর তারা যদি পদে বহাল থাকেন, তবে নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু হবে? স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পুরো রাজনীতিই তো তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ সময় তারা স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারেন। আর প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবটি দেশের বাইরে গিয়ে না দিয়ে দেশে দিলেই ভালো হতো। এতে আলোচনার সূত্রপাত হতো। এ ছাড়া তিনি নিজ দলে বিষয়টি আলোচনা করেছেন কি না সেটিও প্রশ্ন রয়ে গেছে।
বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব ভালোভাবে নেয়নি : মান্না
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব ভালোভাবে নেয়নি। এ প্রস্তাবের পর তারা কয়েকটি প্রশ্নও তুলেছে। এ সরকারের প্রধান কে হবেন, সরকার নির্দলীয় হবে কি না সেসব বিষয়ও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আর প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব বিরোধী দলের বরফ গলাতে পারবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads