সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার জন্য ক্রমেই ভয়ঙ্কর জনপদ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলা মামলার পাশাপাশি খুন, নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। বর্তমান মহাজোট সরকারের সাড়ে ৩ বছরে ১৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসেই খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ ৪ জন। এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর খুন হয়েছেন চারজন করে সাংবাদিক। ডজনে ডজনে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ঘাড়েই ঝুলছে ৫৫টি মামলার খড়গ। ডজন ডজন হামলা মামলার শিকার আমার দেশ-এর সাংবাদিকরাও। এছাড়া দেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক, অনলাইন পত্রিকা ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরাও হামলা মামলা ও নির্যাতনের শিকার।
আমার দেশ-এর নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৩ বছর শাসনকালে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত, কমপক্ষে ৪৬০ জন সাংবাদিক আহত, ২২৫ জন লাঞ্ছিত ও ১৪২ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৯০ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। ৩ জন সম্পাদক ও একজন বার্তা প্রযোজককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অপহরণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ৫ জন সাংবাদিক। শত শত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে থানায়, আদালতে মানহানি কিংবা ফৌজদারি মামলা দেয়া হয়েছে। এমনকি নারী নির্যাতন ও মাদকদ্রব্যের সাজানো মামলাও দেয়া হয়েছে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। অব্যাহত হুমকি, হামলা-মামলার শিকার হয়ে ঢাকাসহ দেশের জেলা উপজেলার সাংবাদিকরা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা সরাসরি হুমকির শিকার হয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি চিকিত্সকরাও একজোট হয়ে সাংবাদিকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে।
চলতি বছর ৪ সাংবাদিক খুন : চলতি বছর খুন হয়েছেন ৪ সাংবাদিক। এরা হলেন গত ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ ফ্ল্যাটে খুন হওয়া বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। গত ১৬ জুন যশোরের শার্শা উপজেলায় দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন হত্যাকাণ্ড ও গত ১০ জুলাই হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ আহমদ জুনেদ হত্যাকাণ্ড।
বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড আজও রহস্যাবৃত। আগামী ১১ আগস্ট নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস অতিক্রম করবে। কিন্তু খুনিদের আজও শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো। সাংবাদিকরা রাজপথে আন্দোলন করছেন, বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। প্রথমে পুলিশ, পরে ডিবি পুলিশের তদন্ত শেষে এখন মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। র্যাবের তদন্তের চার মাসে পড়েছে। সাগর-রুনির লাশ পুনরায় কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে জনমনে তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ও ব্লগগুলোতে এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নানা তথ্য আসছে। কিন্তু আজও দেশের মানুষ জানতে পারেনি কারা নিজেদের বেডরুমে খুন করেছে ওই সাংবাদিক দম্পতিকে।
সাংবাদিক খুনের আরেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে যশোরে। গত ১৫ জুন যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজ-এর শার্শা উপজেলার কাশিপুর প্রতিনিধি জামাল উদ্দিনকে চোরাচালানির বিরুদ্ধে সংবাদ লেখায় দুর্বৃত্তরা প্রথমে হুমকি, পরে কাশিপুর বাজার থেকে অপহরণ করে কুপিয়ে জখম করে, চোখ তুলে নেয় এবং পায়ের রগ কেটে দেয়। স্থানীয়রা গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
সংবেদনশীল এ মামলাটি নিয়েও টালবাহানা করছে পুলিশ। মামলার অগ্রগতি বলতে র্যাব রাজু নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। ভারতে একজন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন গতকাল আমার দেশকে বলেন, পুলিশ বলছে আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। অথচ তাদের কাছে থাকা তথ্যমতে জামালের ঘাতকরা দেশেই আছে। জামালকে যে পুলিশ ক্যাম্পের পাশে খুন করা হয়েছে, ওই ক্যাম্প ইনচার্জ অনেক কিছু জানেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ আসামিদের ধরছে না বরং পুলিশ হত্যাকাণ্ডের মূল ইন্ধনদাতাদের শেল্টার দিচ্ছে। তিনি আরও জানান, শুধু সংবাদ প্রকাশই নয়, জামাল উদ্দিন মাদকবিরোধী অনেক ক্যাম্পেইন করেছেন, মাদক ব্যবসায় বাধা দিয়েছেন। এসব কারণে তিনি দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
গত ১০ জুলাই হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার তরুণ সাংবাদিক জুনাইদ আহমদ জুনেদকে পরিকল্পিতভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে টুকরো টুকরো লাশ শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে ফেলে দেয়া হয়েছে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল তিনি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু পরে জুনেদের ২০ টুকরো লাশ উদ্ধার করেছে জিআরপি থানা পুলিশ। কারা তাকে এরকম নৃশংসভাবে হত্যা করেছে—সে কারণ আজও উন্মোচিত হয়নি।
২০১১ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : ২০১১ সালে ৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ওই বছরের ২৮ জানুয়ারি ৭৭, নয়াপল্টনের বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁ। ফরহাদ খাঁর হত্যাকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মহানগর দায়রা জজ আদালতে গ্রেফতারকৃতদের বিচার চলছে।
গত ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুকরাইল এলাকায় গলাকেটে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল দৈনিক ভোরের ডাক-এর গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। এ মামলাটির কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
গত ৭ এপ্রিল ঢাকার উত্তরা ও চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে খুন হয়েছেন ২ সাংবাদিক। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়েছে। একইদিন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ’র সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর ১১ দিন আগ থেকে নিখোঁজ ছিলেন সাংবাদিক আলতাফ। আলতাফ সুইডেন প্রবাসী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর র্যাব বাড়ির দারোয়ান সাজুকে গ্রেফতার করে বলেছে—সাজুই হত্যা করেছে আলতাফকে। এর আগে পুলিশ বলেছিল, বাড়ি নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে খুন হয়েছেন আলতাফ। সাংবাদিক মাহবুব টুটুল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আজও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
২০১০ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : ওই বছর ৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাদের মধ্যে ওই বছরের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। যদিও পরবর্তীতে পুলিশ জানিয়েছে তিনি ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করেছে। ১০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী। সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানীকে ওই বছর ১৮ এপ্রিল কুড়াল ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করার পর চিকিত্সাধীন অবস্থায় ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। ফতেহ ওসমানী হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। ওই মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাব সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা খুন করেছিল। ওই হত্যা মামলার তদন্তেও তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি পুলিশ।
২০০৯ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : নিহত হয়েছেন ৪ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমন-এর স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী, ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। আসিফ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়েছে দাবি করে পুলিশ বলেছে, ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাকে খুন করেছে। এছাড়া সাংবাদিক আবুল হাসান আসিফ খুনের বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে—খুন নয়, তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ঢাকার ডেমরায় সাংবাদিক নূরুল ইসলাম ওরফে রানা ও গাজীপুরে আহসান হাবিব বারী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি পুলিশ।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতন ও খুন নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। বহু সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বাকশাল কায়েমের সময় চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
আমার দেশ-এর নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৩০ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ৩ বছর শাসনকালে ১৪ জন সাংবাদিক নিহত, কমপক্ষে ৪৬০ জন সাংবাদিক আহত, ২২৫ জন লাঞ্ছিত ও ১৪২ জন হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৯০ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা করা হয়েছে। ৩ জন সম্পাদক ও একজন বার্তা প্রযোজককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অপহরণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ৫ জন সাংবাদিক। শত শত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে থানায়, আদালতে মানহানি কিংবা ফৌজদারি মামলা দেয়া হয়েছে। এমনকি নারী নির্যাতন ও মাদকদ্রব্যের সাজানো মামলাও দেয়া হয়েছে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। অব্যাহত হুমকি, হামলা-মামলার শিকার হয়ে ঢাকাসহ দেশের জেলা উপজেলার সাংবাদিকরা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিকরা সরাসরি হুমকির শিকার হয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নি চিকিত্সকরাও একজোট হয়ে সাংবাদিকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে।
চলতি বছর ৪ সাংবাদিক খুন : চলতি বছর খুন হয়েছেন ৪ সাংবাদিক। এরা হলেন গত ১১ ফেব্রুয়ারি নিজ ফ্ল্যাটে খুন হওয়া বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। গত ১৬ জুন যশোরের শার্শা উপজেলায় দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন হত্যাকাণ্ড ও গত ১০ জুলাই হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ আহমদ জুনেদ হত্যাকাণ্ড।
বহুল আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড আজও রহস্যাবৃত। আগামী ১১ আগস্ট নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস অতিক্রম করবে। কিন্তু খুনিদের আজও শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো। সাংবাদিকরা রাজপথে আন্দোলন করছেন, বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। প্রথমে পুলিশ, পরে ডিবি পুলিশের তদন্ত শেষে এখন মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। র্যাবের তদন্তের চার মাসে পড়েছে। সাগর-রুনির লাশ পুনরায় কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি। এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে জনমনে তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ও ব্লগগুলোতে এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নানা তথ্য আসছে। কিন্তু আজও দেশের মানুষ জানতে পারেনি কারা নিজেদের বেডরুমে খুন করেছে ওই সাংবাদিক দম্পতিকে।
সাংবাদিক খুনের আরেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে যশোরে। গত ১৫ জুন যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজ-এর শার্শা উপজেলার কাশিপুর প্রতিনিধি জামাল উদ্দিনকে চোরাচালানির বিরুদ্ধে সংবাদ লেখায় দুর্বৃত্তরা প্রথমে হুমকি, পরে কাশিপুর বাজার থেকে অপহরণ করে কুপিয়ে জখম করে, চোখ তুলে নেয় এবং পায়ের রগ কেটে দেয়। স্থানীয়রা গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
সংবেদনশীল এ মামলাটি নিয়েও টালবাহানা করছে পুলিশ। মামলার অগ্রগতি বলতে র্যাব রাজু নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। ভারতে একজন গ্রেফতার হয়েছে বলে জানা গেছে। এর বাইরে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। গ্রামের কাগজ সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন গতকাল আমার দেশকে বলেন, পুলিশ বলছে আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। অথচ তাদের কাছে থাকা তথ্যমতে জামালের ঘাতকরা দেশেই আছে। জামালকে যে পুলিশ ক্যাম্পের পাশে খুন করা হয়েছে, ওই ক্যাম্প ইনচার্জ অনেক কিছু জানেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ আসামিদের ধরছে না বরং পুলিশ হত্যাকাণ্ডের মূল ইন্ধনদাতাদের শেল্টার দিচ্ছে। তিনি আরও জানান, শুধু সংবাদ প্রকাশই নয়, জামাল উদ্দিন মাদকবিরোধী অনেক ক্যাম্পেইন করেছেন, মাদক ব্যবসায় বাধা দিয়েছেন। এসব কারণে তিনি দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।
গত ১০ জুলাই হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার তরুণ সাংবাদিক জুনাইদ আহমদ জুনেদকে পরিকল্পিতভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করে টুকরো টুকরো লাশ শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশনে ফেলে দেয়া হয়েছে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল তিনি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু পরে জুনেদের ২০ টুকরো লাশ উদ্ধার করেছে জিআরপি থানা পুলিশ। কারা তাকে এরকম নৃশংসভাবে হত্যা করেছে—সে কারণ আজও উন্মোচিত হয়নি।
২০১১ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : ২০১১ সালে ৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ওই বছরের ২৮ জানুয়ারি ৭৭, নয়াপল্টনের বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁ। ফরহাদ খাঁর হত্যাকারীদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মহানগর দায়রা জজ আদালতে গ্রেফতারকৃতদের বিচার চলছে।
গত ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুকরাইল এলাকায় গলাকেটে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল দৈনিক ভোরের ডাক-এর গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। এ মামলাটির কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
গত ৭ এপ্রিল ঢাকার উত্তরা ও চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনিতে খুন হয়েছেন ২ সাংবাদিক। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়েছে। একইদিন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠ’র সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর ১১ দিন আগ থেকে নিখোঁজ ছিলেন সাংবাদিক আলতাফ। আলতাফ সুইডেন প্রবাসী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর র্যাব বাড়ির দারোয়ান সাজুকে গ্রেফতার করে বলেছে—সাজুই হত্যা করেছে আলতাফকে। এর আগে পুলিশ বলেছিল, বাড়ি নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে খুন হয়েছেন আলতাফ। সাংবাদিক মাহবুব টুটুল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আজও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
২০১০ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : ওই বছর ৪ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাদের মধ্যে ওই বছরের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। যদিও পরবর্তীতে পুলিশ জানিয়েছে তিনি ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন। পুলিশ ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করেছে। ১০১০ সালের ২৮ এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী। সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানীকে ওই বছর ১৮ এপ্রিল কুড়াল ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে আহত করার পর চিকিত্সাধীন অবস্থায় ঢাকায় তার মৃত্যু হয়। ফতেহ ওসমানী হত্যাকাণ্ডে পুলিশ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। ওই মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাব সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসীরা খুন করেছিল। ওই হত্যা মামলার তদন্তেও তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি পুলিশ।
২০০৯ সালে ৪ সাংবাদিক খুন : নিহত হয়েছেন ৪ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমন-এর স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী, ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। আসিফ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়েছে দাবি করে পুলিশ বলেছে, ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তাকে খুন করেছে। এছাড়া সাংবাদিক আবুল হাসান আসিফ খুনের বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে—খুন নয়, তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এছাড়া ঢাকার ডেমরায় সাংবাদিক নূরুল ইসলাম ওরফে রানা ও গাজীপুরে আহসান হাবিব বারী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি পুলিশ।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতন ও খুন নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ১০ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। বহু সাংবাদিক হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বাকশাল কায়েমের সময় চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন