সি রা জু র র হ মা ন
আওয়ামী লীগে এখন ‘সাজ-সাজ’ পড়ে গেছে। তারা বিএনপি এবং অন্য বিরোধীদের বাদ দিয়েই নির্বাচন করতে চায়। কেন্দ্রে ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের গরম গরম বিবৃতি, বিরোধীদের প্রতি হুমকি আর বিরোধী দলকে আলোচনায় বসতে বলার বিদ্রূপ এবং তৃণমূলে অস্বাভাবিক তত্পরতা থেকে অন্য অর্থ করা যায় না।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ বিবিসিকে বলে গেছেন, নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার গঠিত হবে। সে সরকারের দরোজা তিনি দয়া করে বিএনপির জন্য খোলা রেখেছেন, বলেছেন তারা ইচ্ছা করলে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। অবশ্যি সেটা যে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার দুর্বল প্রয়াস তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু হাসিনা আশা করছেন তাঁর নিজের এবং বন্ধুদেশ ভারতের প্রচারবিদরা তাঁর নীল-নকশার নির্বাচনটা আন্তর্জাতিক সমাজের গ্রহণযোগ্য করে দেখাতে পারবেন।
এই নীল-নকশায় হাসিনা নিজেই যে তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকবেন সেটা তিনি খুলে বলেননি, বলার প্রয়োজনও অবশ্যি ছিল না। এবং এই সরকার যে তাঁর নীল-নকশার কোনো এদিক-ওদিক করতে পারবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে ২০০১ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দৃষ্টে।
বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালনা করেন আমলারা। রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার সবাই সরকারি কর্মকর্তা। ভোট গ্রহণের আগে এবং পরে ব্যালট বাক্সগুলো রাখা হয় তাঁদের তত্ত্বাবধানে পুলিশ কিংবা সরকারি কর্মচারীদের হেফাজতে। ভোট গণনাকারীও নিয়োগ করেন তাঁরাই। বিরোধী দলের এজেন্টদের ভোট গ্রহণ এবং গণনার সময় উপস্থিত থাকতে দেয়া হবে কিনা সেসবও স্থির হয় তাঁদের নির্দেশে। উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আগে থাকতেই পুলিশ ও ডিজিএফআই বিরোধী দলগুলোর এজেন্ট ও ভোটদাতাদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুশিয়ার করে দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকার ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই নির্বাচন সংক্রান্ত সব দায়িত্বে আওয়ামী লীগের অনুগত কর্মকর্তাদের স্থাপন করেছিল। তারা নিশ্চিন্ত ছিল এসব কর্মকর্তা যে কোনো প্রকারেই হোক আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত করবে। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই মাত্র ১২ জন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বদলি করেন। তাতেই আওয়ামী লীগ মহলে ‘গেল-গেল’ বিলাপ শুরু হয়ে যায়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর থেকে হাসিনার আস্থা উঠে যায় তখন থেকে, যদিও এ পদ্ধতি চালুর দাবিতে ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে আন্দোলন করেছিল, দেশ অচল করে দিয়েছিল, বেশকিছু খুন-খারাবি ঘটিয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল। জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোরও ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জরুরি ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করেন। জুন মাসে আবার নির্বাচন দেয়া হয়। ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে হাসিনা গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে নির্বাচনে নামেন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক আসন পেলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে হাসিনাকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল।
হাসিনার নির্বাচনী নীল-নকশা
হাসিনার নতুন নীল-নকশা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। সাড়ে তিন বছর আগে থাকতেই শুরু করে তিনি আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীদুটোর সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে ফেলেছেন। এসব ব্যক্তিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে ফলাফল অবশ্যই হবে সরকারের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার হোক কি না হোক, বিএনপি সে সরকারে যোগ দিক কিংবা না দিক, তাতে কিছু এসে যাবে না। শুধু ২০০১ সালের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেই হলো। নির্বাচনী ফলাফল হবে সরকারের পূর্বনির্ধারিত।
এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, সরকার আগামী বছরের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ করে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার আগেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযোগ্য নেতা-কর্মীদের নানা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হবে। বিএনপির বহু শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বহু হাস্যকর মামলা সাজানো হয়েছে। ‘দ্রুত আদালতে বিচার’ করে তাঁদের জেলে পোরা এবং নির্বাচনে প্রার্থী হতে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। তারপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হাসিনার পূর্ব-ঘোষিত ১৭৫টি আসন ‘জয় করবে’।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক অবসরপ্রাপ্ত লে. জে. এরশাদ বহু ব্যাপারে পরস্পরের কাছে ঋণী। বিএনপি-বিহীন সংসদে তাঁকে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা করার পরিকল্পনা হাসিনা অনেক আগেই ঘোষণা করেছেন। নীল-নকশার নির্বাচনে তাঁকে কিছু আসন দিয়ে বিরোধী দলের নেতা করা হবে। তারপর সরকারের এবং ভারতের প্রচারবিদদের দিয়ে জাহির করা হবে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে বহুদলীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। প্রয়োজনবোধে লন্ডনের টাইমস এবং অন্যান্য বিদেশি পত্রিকায় লাখ পাউন্ডের বিজ্ঞাপনও দেয়া হতে পারে। বর্তমানে এই হচ্ছে প্রায়-অনিবার্য সিনেরিও।
এজন্য বিএনপির নেতৃত্ব অনেকখানি দায়ী। গত বছরের গোড়ার দিকে খালেদা জিয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা অথবা সরকার উত্খাতের’ যে আন্দোলন শুরু করেন, তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। দেশের মানুষের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আসন্ন। কিন্তু দেশবাসীকে হতাশ করে দিয়ে দেখা গেল আন্দোলনে ঢিল পড়েছে। আন্দোলন লাগাতার হবে কিনা সে নিয়ে বিএনপির শীর্ষস্তরের নেতাদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়ে যায়। হরতাল ও কর্মসূচিতে শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ অদৃশ্য থাকেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা হরতালের অপকারিতা নিয়ে নতুন নতুন থিয়োরি আওড়াতে থাকেন এবং মে মাসে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় পর্যন্ত আন্দোলন থেমে যায় বলা চলে।
বানর ও তৈলাক্ত বাঁশ
তারপর থেকে আন্দোলন চলছে পাটিগণিতের বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতো : বানর কখনও উঠছে, পরক্ষণেই পিছলে নিচে নেমে আসছে। জনসাধারণের উত্সাহে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। তৃণমূলের কর্মীরা মনে করছে সেনাপতিরা (নেতারা) তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ডেকে নিয়ে ‘যুদ্ধ-বনাম-শান্তি’ সম্বন্ধে দার্শনিক তত্ত্বালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমার প্রায়ই ১৭৫৭ সালের পলাশী রণাঙ্গনের কথা মনে হয়েছে। সৈন্যরা যুদ্ধ করতে গিয়েছিল কিন্তু কোনো কোনো সেনাপতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টাকা খেয়ে তাদের যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছিল।
এটা যে আন্দোলনের সাফল্যের ফর্মুলা নয় সে হুশিয়ারি বিএপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গত বছরই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দলীয় ঐক্য বজায় রাখা, পুরনো সহকর্মীদের প্রতি ভ্রান্ত নির্ভরতা কিংবা উপদেষ্টাদের ভ্রান্ত পরামর্শ—যে কোনো কারণেই হোক, বেগম জিয়া সময়োচিত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হননি। তিনবার দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছে, ইস্পাতদৃঢ় আন্দোলন করে তিনি সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে উত্খাত করেছেন, কিন্তু গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলনকে কেন যেন তিনি চলমান ও সক্রিয় রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার ব্যাপার।
রমজানের আগে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন যে ঈদুল ফিতরের পরে পর্যন্ত আন্দোলন মুলতবি থাকবে। সেটা সঙ্গত সিদ্ধান্ত ছিল। কেননা, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সংযমের মাসের পবিত্রতা বজায় রাখতে চায়। বিএনপি নেত্রী বিগত কয়দিন বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠানে বলেছেন যে ঈদের পরে তিনি ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণা করবেন। সেটা আশার কথা। বাংলাদেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে বিশ্বাস করে, তাঁর ওপর আস্থা রাখে। তার প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। এখনও যদি তিনি ঘোষণা করেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা অথবা বর্তমান অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলন অবিরাম চলতে থাকবে, তাহলে দেশের মানুষ আবারও দল বেঁধে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসবে। সে প্রতীতি যদি তাঁর না থাকে তাহলে আন্দোলন প্রত্যাহার করাই তাঁর উচিত হবে। দেশের মানুষ যে যেভাবে পারে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। কোনো কোনো মহল থেকে শোনা যাচ্ছে যে আন্দোলনকে আবার গতিশীল করতে ছয় মাস পর্যন্ত প্রস্তুতির সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই যদি হয় তাহলে আন্দোলন করার মতো কোনো শক্তি বিএনপির থাকবে না।
বিএনপি নেত্রীকে কিছু খাঁটি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। দলের নেতৃত্ব ছাড়াও তাঁর উপদেষ্টা বাহিনীতে বহু বিশিষ্ট এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি আছেন। কথা হচ্ছে সঠিক পরামর্শ তিনি পাচ্ছেন কি? আমার সন্দেহ হয় নেত্রীর লক্ষ্যের সঙ্গে তাঁদের সবার উদ্দেশ্যের সঙ্গতি নেই। তাঁদের কেউ কেউ কি বিদেশ থেকে সমাধান আসবে বলে আশা করে বসে আছেন? তাঁরা বিজ্ঞ ব্যক্তি, তবু তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ২০০৬-০৭ সালে দুটি বিদেশি রাষ্ট্রের দূতরা এবং বাংলাদেশের একটি পত্রিকাগোষ্ঠী একটি সমাধান ছকেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে ‘মাইনাস টু’, নিদেন ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলাই ছিল তাঁদের সমাধান। এটিএম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে ২০০৮ সালে তাঁরা খালেদা জিয়া এবং বিএনপিকে পাশ কাটিয়েই নির্বাচন করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
ভারত-মার্কিন ব্যূহ ও বাংলাদেশ
খালেদা জিয়ার সহকর্মী এবং উপদেষ্টাদের মনে রাখতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আর বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাদের স্বার্থ ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যবাদকে ব্যূহবন্দী করে তার সম্প্রসারণকে ঠেকিয়ে রাখা। সে ব্যূহের মূল ভিত্তি তারা করেছিল পাকিস্তানকে সিটো (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা) ও সেন্টোর (কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা) মাধ্যমে। তার পরিণতিতে আজকের পাকিস্তান উপেক্ষিত, বিধ্বস্ত এবং প্যাথেটিক একটা দেশ।
সোভিয়েতের পতন হয়েছে। চীন এরই মধ্যে অর্থনীতির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলার উপক্রম করেছে। তার সামরিক শক্তিও উঠতির দিকে। ওয়াশিংটন এখন নবজাগ্রত চীনা ড্রাগনের প্রসারের ভয়ে শঙ্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের পুরনো বিরোধ অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে। তাছাড়া ভারত চায় এশিয়ার পরাশক্তি হতে। চীনের সঙ্গে সেখানেও তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ওয়াশিংটন এখন দিল্লিকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে ব্যূহ রচনার আয়োজন করছে, সে আয়োজনে তারা বাংলাদেশকেও যুক্ত করতে চায়। অর্থাত্ বাংলাদেশে গণতন্ত্র তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, তারা এদেশে একটা আজ্ঞাবহ সরকার দেখতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ (এবং খালেদা জিয়ার উপদেষ্টারা) পাকিস্তানের মতো পরিণতি চান কিনা সেটা তাঁদের গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখতে হবে।
প্রটোকল ও প্রশস্ততর রাষ্ট্রনীতি
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক দুটি খবরের উল্লেখ করতে চাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গত সেপ্টেম্বরের সফরে খালেদা জিয়াকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বেগম জিয়া এখন সে আমন্ত্রণ রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর দু’জন উপদেষ্টা সফরের আয়োজন পাকা করতে দিল্লিতে গিয়ে ঘুরেও এসেছেন।
চীনে আগামী বছর প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী লী কে কিয়াং। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ সফর করেছেন এবং কয়েকটি দেশের বর্তমান ও সম্ভাব্য নেতাদের বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ করেছেন। শুনেছি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকেও আমন্ত্রণ করেছেন লী কে কিয়াং; কিন্তু বেগম জিয়ার উপদেষ্টারা এ ব্যাপারে ইতস্তত করছেন। তাঁরা নাকি মনে করছেন, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, অন্যদিকে মি. লী প্রধানমন্ত্রী হবেন আগামী বছর, এমতাবস্থায় মি. লীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার ব্যাপারে বেগম জিয়ার পক্ষে প্রটোকল সংক্রান্ত অসুবিধা আছে।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে সত্ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের সম্পর্ক এ যাবত্ বাংলাদেশের সব সরকারেরই নীতি ছিল। কিন্তু দিল্লি সফরের ব্যাপারে অতিমাত্রিক আগ্রহ দেখালে বেগম জিয়া স্বদেশে এ ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন যে ভারতের সঙ্গে নতজানু সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
আগেই বলেছি চীন এরই মধ্যে দুই নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি এবং তার এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি হওয়াও নিছক সময়ের ব্যাপার। সেজন্য চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাংলাদেশের বিশেষ কাম্য হওয়া উচিত। খালেদা জিয়া তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আভাস দিয়েছিলেন যে তিনি ‘লুক ইস্ট’ পররাষ্ট্রনীতিতে আগ্রহী। কিন্তু সে ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি তিনি দেখাতে পারেননি। বরং শোনা গিয়েছিল যে তাঁর সরকারের কোনো কোনো আচরণে বেইজিং সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বর্তমান সময়ে যদি তিনি দিল্লি যান কিন্তু লী কে কিয়াংয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে চীনের সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্ক আশানুরূপ ভালো হবে না। বেগম জিয়াকে মনে রাখতে হবে যে উপদেষ্টারা মাছিমারা কেরানির মতো, তাঁরা বিধিবদ্ধ প্রটোকলই জানেন, কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক ও বিশ্বনেতার দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুপরিসর হওয়া প্রয়োজন। (লন্ডন, ০৬.০৮.১২)
serajurrahman34@gmail.com
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ বিবিসিকে বলে গেছেন, নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার গঠিত হবে। সে সরকারের দরোজা তিনি দয়া করে বিএনপির জন্য খোলা রেখেছেন, বলেছেন তারা ইচ্ছা করলে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। অবশ্যি সেটা যে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার দুর্বল প্রয়াস তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু হাসিনা আশা করছেন তাঁর নিজের এবং বন্ধুদেশ ভারতের প্রচারবিদরা তাঁর নীল-নকশার নির্বাচনটা আন্তর্জাতিক সমাজের গ্রহণযোগ্য করে দেখাতে পারবেন।
এই নীল-নকশায় হাসিনা নিজেই যে তথাকথিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকবেন সেটা তিনি খুলে বলেননি, বলার প্রয়োজনও অবশ্যি ছিল না। এবং এই সরকার যে তাঁর নীল-নকশার কোনো এদিক-ওদিক করতে পারবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে ২০০১ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দৃষ্টে।
বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালনা করেন আমলারা। রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার সবাই সরকারি কর্মকর্তা। ভোট গ্রহণের আগে এবং পরে ব্যালট বাক্সগুলো রাখা হয় তাঁদের তত্ত্বাবধানে পুলিশ কিংবা সরকারি কর্মচারীদের হেফাজতে। ভোট গণনাকারীও নিয়োগ করেন তাঁরাই। বিরোধী দলের এজেন্টদের ভোট গ্রহণ এবং গণনার সময় উপস্থিত থাকতে দেয়া হবে কিনা সেসবও স্থির হয় তাঁদের নির্দেশে। উল্লেখ্য যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আগে থাকতেই পুলিশ ও ডিজিএফআই বিরোধী দলগুলোর এজেন্ট ও ভোটদাতাদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুশিয়ার করে দিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকার ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই নির্বাচন সংক্রান্ত সব দায়িত্বে আওয়ামী লীগের অনুগত কর্মকর্তাদের স্থাপন করেছিল। তারা নিশ্চিন্ত ছিল এসব কর্মকর্তা যে কোনো প্রকারেই হোক আওয়ামী লীগের বিজয় সুনিশ্চিত করবে। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই মাত্র ১২ জন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বদলি করেন। তাতেই আওয়ামী লীগ মহলে ‘গেল-গেল’ বিলাপ শুরু হয়ে যায়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর থেকে হাসিনার আস্থা উঠে যায় তখন থেকে, যদিও এ পদ্ধতি চালুর দাবিতে ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে আন্দোলন করেছিল, দেশ অচল করে দিয়েছিল, বেশকিছু খুন-খারাবি ঘটিয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল। জেনারেল নাসিমকে দিয়ে একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোরও ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন হাসিনা। দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জরুরি ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু করেন। জুন মাসে আবার নির্বাচন দেয়া হয়। ইন্দিরা রোডের এক বাড়িতে গিয়ে হাসিনা গোলাম আযমের দোয়া নিয়ে নির্বাচনে নামেন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক আসন পেলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে হাসিনাকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল।
হাসিনার নির্বাচনী নীল-নকশা
হাসিনার নতুন নীল-নকশা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। সাড়ে তিন বছর আগে থাকতেই শুরু করে তিনি আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীদুটোর সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে ফেলেছেন। এসব ব্যক্তিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে ফলাফল অবশ্যই হবে সরকারের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার হোক কি না হোক, বিএনপি সে সরকারে যোগ দিক কিংবা না দিক, তাতে কিছু এসে যাবে না। শুধু ২০০১ সালের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেই হলো। নির্বাচনী ফলাফল হবে সরকারের পূর্বনির্ধারিত।
এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, সরকার আগামী বছরের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ করে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার আগেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযোগ্য নেতা-কর্মীদের নানা মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হবে। বিএনপির বহু শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে বহু হাস্যকর মামলা সাজানো হয়েছে। ‘দ্রুত আদালতে বিচার’ করে তাঁদের জেলে পোরা এবং নির্বাচনে প্রার্থী হতে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। তারপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হাসিনার পূর্ব-ঘোষিত ১৭৫টি আসন ‘জয় করবে’।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক অবসরপ্রাপ্ত লে. জে. এরশাদ বহু ব্যাপারে পরস্পরের কাছে ঋণী। বিএনপি-বিহীন সংসদে তাঁকে গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা করার পরিকল্পনা হাসিনা অনেক আগেই ঘোষণা করেছেন। নীল-নকশার নির্বাচনে তাঁকে কিছু আসন দিয়ে বিরোধী দলের নেতা করা হবে। তারপর সরকারের এবং ভারতের প্রচারবিদদের দিয়ে জাহির করা হবে যে, সুষ্ঠু নির্বাচনে বহুদলীয় সংসদ গঠিত হয়েছে। প্রয়োজনবোধে লন্ডনের টাইমস এবং অন্যান্য বিদেশি পত্রিকায় লাখ পাউন্ডের বিজ্ঞাপনও দেয়া হতে পারে। বর্তমানে এই হচ্ছে প্রায়-অনিবার্য সিনেরিও।
এজন্য বিএনপির নেতৃত্ব অনেকখানি দায়ী। গত বছরের গোড়ার দিকে খালেদা জিয়া ‘তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা অথবা সরকার উত্খাতের’ যে আন্দোলন শুরু করেন, তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। দেশের মানুষের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছিল যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আসন্ন। কিন্তু দেশবাসীকে হতাশ করে দিয়ে দেখা গেল আন্দোলনে ঢিল পড়েছে। আন্দোলন লাগাতার হবে কিনা সে নিয়ে বিএনপির শীর্ষস্তরের নেতাদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়ে যায়। হরতাল ও কর্মসূচিতে শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ অদৃশ্য থাকেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা হরতালের অপকারিতা নিয়ে নতুন নতুন থিয়োরি আওড়াতে থাকেন এবং মে মাসে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় পর্যন্ত আন্দোলন থেমে যায় বলা চলে।
বানর ও তৈলাক্ত বাঁশ
তারপর থেকে আন্দোলন চলছে পাটিগণিতের বানরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার মতো : বানর কখনও উঠছে, পরক্ষণেই পিছলে নিচে নেমে আসছে। জনসাধারণের উত্সাহে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। তৃণমূলের কর্মীরা মনে করছে সেনাপতিরা (নেতারা) তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ডেকে নিয়ে ‘যুদ্ধ-বনাম-শান্তি’ সম্বন্ধে দার্শনিক তত্ত্বালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমার প্রায়ই ১৭৫৭ সালের পলাশী রণাঙ্গনের কথা মনে হয়েছে। সৈন্যরা যুদ্ধ করতে গিয়েছিল কিন্তু কোনো কোনো সেনাপতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টাকা খেয়ে তাদের যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছিল।
এটা যে আন্দোলনের সাফল্যের ফর্মুলা নয় সে হুশিয়ারি বিএপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গত বছরই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দলীয় ঐক্য বজায় রাখা, পুরনো সহকর্মীদের প্রতি ভ্রান্ত নির্ভরতা কিংবা উপদেষ্টাদের ভ্রান্ত পরামর্শ—যে কোনো কারণেই হোক, বেগম জিয়া সময়োচিত প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হননি। তিনবার দেশের মানুষ ভোট দিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছে, ইস্পাতদৃঢ় আন্দোলন করে তিনি সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে উত্খাত করেছেন, কিন্তু গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলনকে কেন যেন তিনি চলমান ও সক্রিয় রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশার ব্যাপার।
রমজানের আগে খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন যে ঈদুল ফিতরের পরে পর্যন্ত আন্দোলন মুলতবি থাকবে। সেটা সঙ্গত সিদ্ধান্ত ছিল। কেননা, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সংযমের মাসের পবিত্রতা বজায় রাখতে চায়। বিএনপি নেত্রী বিগত কয়দিন বিভিন্ন ইফতার অনুষ্ঠানে বলেছেন যে ঈদের পরে তিনি ‘কঠোর কর্মসূচি’ ঘোষণা করবেন। সেটা আশার কথা। বাংলাদেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে বিশ্বাস করে, তাঁর ওপর আস্থা রাখে। তার প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। এখনও যদি তিনি ঘোষণা করেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা অথবা বর্তমান অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারের পতন পর্যন্ত আন্দোলন অবিরাম চলতে থাকবে, তাহলে দেশের মানুষ আবারও দল বেঁধে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসবে। সে প্রতীতি যদি তাঁর না থাকে তাহলে আন্দোলন প্রত্যাহার করাই তাঁর উচিত হবে। দেশের মানুষ যে যেভাবে পারে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে। কোনো কোনো মহল থেকে শোনা যাচ্ছে যে আন্দোলনকে আবার গতিশীল করতে ছয় মাস পর্যন্ত প্রস্তুতির সময়ের প্রয়োজন হবে। তাই যদি হয় তাহলে আন্দোলন করার মতো কোনো শক্তি বিএনপির থাকবে না।
বিএনপি নেত্রীকে কিছু খাঁটি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। দলের নেতৃত্ব ছাড়াও তাঁর উপদেষ্টা বাহিনীতে বহু বিশিষ্ট এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি আছেন। কথা হচ্ছে সঠিক পরামর্শ তিনি পাচ্ছেন কি? আমার সন্দেহ হয় নেত্রীর লক্ষ্যের সঙ্গে তাঁদের সবার উদ্দেশ্যের সঙ্গতি নেই। তাঁদের কেউ কেউ কি বিদেশ থেকে সমাধান আসবে বলে আশা করে বসে আছেন? তাঁরা বিজ্ঞ ব্যক্তি, তবু তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ২০০৬-০৭ সালে দুটি বিদেশি রাষ্ট্রের দূতরা এবং বাংলাদেশের একটি পত্রিকাগোষ্ঠী একটি সমাধান ছকেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে ‘মাইনাস টু’, নিদেন ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলাই ছিল তাঁদের সমাধান। এটিএম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে ২০০৮ সালে তাঁরা খালেদা জিয়া এবং বিএনপিকে পাশ কাটিয়েই নির্বাচন করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
ভারত-মার্কিন ব্যূহ ও বাংলাদেশ
খালেদা জিয়ার সহকর্মী এবং উপদেষ্টাদের মনে রাখতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আর বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। চল্লিশ-পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাদের স্বার্থ ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যবাদকে ব্যূহবন্দী করে তার সম্প্রসারণকে ঠেকিয়ে রাখা। সে ব্যূহের মূল ভিত্তি তারা করেছিল পাকিস্তানকে সিটো (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা) ও সেন্টোর (কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা) মাধ্যমে। তার পরিণতিতে আজকের পাকিস্তান উপেক্ষিত, বিধ্বস্ত এবং প্যাথেটিক একটা দেশ।
সোভিয়েতের পতন হয়েছে। চীন এরই মধ্যে অর্থনীতির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলার উপক্রম করেছে। তার সামরিক শক্তিও উঠতির দিকে। ওয়াশিংটন এখন নবজাগ্রত চীনা ড্রাগনের প্রসারের ভয়ে শঙ্কিত। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ভারতের পুরনো বিরোধ অরুণাচলের বিস্তীর্ণ এলাকার মালিকানা নিয়ে। তাছাড়া ভারত চায় এশিয়ার পরাশক্তি হতে। চীনের সঙ্গে সেখানেও তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ওয়াশিংটন এখন দিল্লিকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে ব্যূহ রচনার আয়োজন করছে, সে আয়োজনে তারা বাংলাদেশকেও যুক্ত করতে চায়। অর্থাত্ বাংলাদেশে গণতন্ত্র তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, তারা এদেশে একটা আজ্ঞাবহ সরকার দেখতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ (এবং খালেদা জিয়ার উপদেষ্টারা) পাকিস্তানের মতো পরিণতি চান কিনা সেটা তাঁদের গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখতে হবে।
প্রটোকল ও প্রশস্ততর রাষ্ট্রনীতি
এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক দুটি খবরের উল্লেখ করতে চাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গত সেপ্টেম্বরের সফরে খালেদা জিয়াকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বেগম জিয়া এখন সে আমন্ত্রণ রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর দু’জন উপদেষ্টা সফরের আয়োজন পাকা করতে দিল্লিতে গিয়ে ঘুরেও এসেছেন।
চীনে আগামী বছর প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী লী কে কিয়াং। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ সফর করেছেন এবং কয়েকটি দেশের বর্তমান ও সম্ভাব্য নেতাদের বেইজিং সফরের আমন্ত্রণ করেছেন। শুনেছি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকেও আমন্ত্রণ করেছেন লী কে কিয়াং; কিন্তু বেগম জিয়ার উপদেষ্টারা এ ব্যাপারে ইতস্তত করছেন। তাঁরা নাকি মনে করছেন, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, অন্যদিকে মি. লী প্রধানমন্ত্রী হবেন আগামী বছর, এমতাবস্থায় মি. লীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করার ব্যাপারে বেগম জিয়ার পক্ষে প্রটোকল সংক্রান্ত অসুবিধা আছে।
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে সত্ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্বের সম্পর্ক এ যাবত্ বাংলাদেশের সব সরকারেরই নীতি ছিল। কিন্তু দিল্লি সফরের ব্যাপারে অতিমাত্রিক আগ্রহ দেখালে বেগম জিয়া স্বদেশে এ ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন যে ভারতের সঙ্গে নতজানু সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।
আগেই বলেছি চীন এরই মধ্যে দুই নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তি এবং তার এক নম্বর সামরিক পরাশক্তি হওয়াও নিছক সময়ের ব্যাপার। সেজন্য চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাংলাদেশের বিশেষ কাম্য হওয়া উচিত। খালেদা জিয়া তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আভাস দিয়েছিলেন যে তিনি ‘লুক ইস্ট’ পররাষ্ট্রনীতিতে আগ্রহী। কিন্তু সে ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি তিনি দেখাতে পারেননি। বরং শোনা গিয়েছিল যে তাঁর সরকারের কোনো কোনো আচরণে বেইজিং সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বর্তমান সময়ে যদি তিনি দিল্লি যান কিন্তু লী কে কিয়াংয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে চীনের সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্ক আশানুরূপ ভালো হবে না। বেগম জিয়াকে মনে রাখতে হবে যে উপদেষ্টারা মাছিমারা কেরানির মতো, তাঁরা বিধিবদ্ধ প্রটোকলই জানেন, কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক ও বিশ্বনেতার দৃষ্টিভঙ্গি আরও সুপরিসর হওয়া প্রয়োজন। (লন্ডন, ০৬.০৮.১২)
serajurrahman34@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন