সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১২

কঠিন সংগ্রামে নামতে হবে



আ তা উ স সা মা দ
একেকটা দিন যাচ্ছে আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশে একটা নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম যেদিন অধিবেশনে বসে, সেদিন থেকেই তার পাঁচ বছরের মেয়াদ গোনা শুরু হয়ে যায়। তবে প্রথম দিকে এই মেয়াদ হিসাব করার তাগিদ কারও তেমন থাকে না। সে সময় জনসাধারণ দেখতে থাকে কারা মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা কেমনভাবে সরকার চালাচ্ছেন, মন্ত্রীরা জাতীয় সংসদে কতখানি জবাবদিহি করছেন, সংসদ কেমনভাবে চলছে, যে জাতীয় সংসদের ওপর সাধারণ মানুষ এত ভরসা করে ভোট দিয়েছেন, সেটি তাদের কোনো কাজে এলো কিনা ইত্যাদি।
তবে জাতীয় সংসদের বয়স আড়াই বছর পার হয়ে গেলে ভোটাররা স্বাভাবিকভাবেই হিসাব-নিকাশ শুরু করেন যে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারটি দশ ও দেশের জন্য কতটুকু কাজ করল, সরকারটি আদৌ যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারল কি-না, মন্ত্রিসভা কি দুর্নীতিপরায়ণ না সত্, প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের নীতি ও দেশের আইন মেনে চলেন নাকি তিনি স্বৈরাচারী এবং ক্ষমতাসীন দল কি শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাকি তারা নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী। তখন থেকেই শুরু হয় চিন্তা-ভাবনা যে, পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে আবার সরকারে ফিরিয়ে আনা হবে নাকি একে বিদায় করতে হবে এবং এই সময়টা থেকেই আগ্রহ বাড়তে থকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংসদের পুরো মেয়াদ শেষ হতে অবশিষ্ট আছে আর মাত্র ষোলো মাস। দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে এই ক’টা দিন। এবার এই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসবের মধ্যে অন্যতম দুটি হচ্ছে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি সরকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং নির্বাচিত সরকারটি আইনের শাসন কায়েম করবে তা নিশ্চিত করা যায়।
২০০৬ সালে সংবিধানের তত্কালীন বিধান মোতাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান কে হবেন—একদিকে সেই প্রশ্নে চারদলীয় জোট তথা ওই জোটের প্রধান দল বিএনপির একগুঁয়েমি ও ভুলের জন্য এবং অন্যদিকে একই সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের লগি-বৈঠার সহিংস আন্দোলনকে তারা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ার দরুন দেশে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। সারা দেশ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়ে। সেই সময় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তড়িঘড়ি করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে বসে পড়লেন নিজের কর্মক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মনোবল আছে কিনা সেকথা বিবেচনা না করেই। ফলে তার প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে ভুল হতে লাগল ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে থাকল। একই সঙ্গে বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ভোটার লিস্ট তৈরির কাজে তালগোল পাকিয়ে ফেলল। অসংখ্য ভুয়া ভোটার আছে এবং বহু প্রকৃত ভোটার নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন—এই কারণ দেখিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনয়নপত্র দাখিল করেও নির্বাচন বয়কট করে বসল। একইসঙ্গে জেনারেল এরশাদের মনোনয়নপত্রও বাতিল করার প্রতিবাদে তার জাতীয় পার্টিও নির্বাচন বর্জন করল। তার পরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল বলে বসল তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে না। অতঃপর তত্কালীন সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে ধমক দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিয়ে ২২ জানুয়ারি ২০০৭ অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিল করিয়ে দিলেন। তিনি অবশ্য অজুহাত দেখালেন, সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে দেশে যে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা সামাল দিতে সশস্ত্র বাহিনীকে সরকার আহ্বান জানালে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হবে না বলে জাতিসংঘের মহাসচিব তাকে জানিয়েছেন। এভাবেই তিনি ক্ষমতা দখল করলেন তবে সুশীল সমাজের একজন খ্যাতনামা সিএসপি (সাবেক) প্রতিভূকে সঙ্গে করে। অতঃপর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার দাবি মোতাবেক সচিত্র ভোটার তালিকা তৈরির নামে দুই বছর রাজত্ব করলেন তারা।
এ সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ ও অন্যান্য মামলায় বিএনপির জাতীয় এবং স্থানীয় নেতাদের দলে দলে জেলে ঢুকিয়ে ডিজিএফআই, টাস্কফোর্স ইত্যাদি নানা সংস্থার লোকদের দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করেছিল ওই ক্ষমতাদখলকারী অসাংবিধানিক, অতএব অবৈধ সরকার। তাদের অবৈধ শাসনের একপর্যায়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও বন্দি করে। আওয়ামী লীগেরও কয়েকজন নেতা এবং আরও কয়েকজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী গ্রেফতার হন ওই সরকারের অত্যাচারী হাতে। কিন্তু জেনারেল মইন ও সিএসপি (সাবেক) ফখরুদ্দীনের সরকারের বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড ছিল বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার লক্ষ্যে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অভাবনীয় ভরাডুবি এবং আওয়ামী লীগের বিস্ময়কর সংখ্যাধিক্য আসনে জয়লাভের পেছনে বিএনপির ছত্রভঙ্গ ও হতোদ্যম অবস্থা এবং দলটির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ছদ্মবেশী সামরিক সরকারটির অবিশ্রান্ত প্রচারণা দুটি বড় কারণ। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৭ ও ২০০৮-এর তত্ত্বাবধায়ক নামধারী অসাংবিধানিক সরকারটি রাজনীতিবিদদের ওপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায় এবং যে অপকর্ম সমর্থন করে কোনো কোনো সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল চরম নীতিহীনভাবে উল্লাস প্রদর্শন করে, তার প্রধান হোতারা—জেনারেল, মেজর জেনারেল, ব্রিগেডিয়াররা (সবাই বর্তমানে অবসরে) ও সিএসপি (সাবেক)-গণসহ, বর্তমানে স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন। তাদের এই পরবাসই সাক্ষ্য দেয় যে তারা অবৈধ কাজ করেছেন আর সেজন্য ধিক্কার পেয়েছেন বলেই স্বদেশে বসবাস করতে সাহস পাচ্ছেন না, এমনকি বর্তমান সরকার তাদের কাজকর্মকে বৈধতা দেয়া সত্ত্বেও।
নিকট অতীতের এসব পীড়াদায়ক ঘটনাবলি আজকে পুনরুল্লেখ করতে হচ্ছে এজন্য যে, রাজনৈতিক ভ্রান্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বপ্রাপ্তদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সংকীর্ণতা এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের হাতে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও এসব কুকর্ম সম্পর্কে আমাদের বর্তমান ক্ষমতাধরদের স্মৃতি ক্রমাগতই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে এবং তাদের ভ্রান্তিবিলাস দূর হচ্ছে না। অন্যদিকে একই সময়ে বর্তমান শাসকদের দুর্নীতি বাংলাদেশকে শুধু বিশ্বব্যাপী দুর্নামের ভাগীদারই করছে না, তা আমাদের দেশটিকে নির্দয়ভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে ক্ষমতাসীনদের ফ্রন্টম্যানদের মাধ্যমে জাল-জালিয়াতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করা, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র ব্যক্তিখাতে আমদানি করিয়ে সেগুলোকে ভর্তুকি দেয়ার নামে সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন, ড্রেজার কেনায় মিথ্যাচার, সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়োগ-বাণিজ্য, এমপিওভুক্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবিহীন ক্রয়, বাংলাদেশ রেল ও বাংলাদেশ বিমানের মুখ থুবড়ে পড়া, দলীয় ঠিকাদাররা কাজ শেষ না করেই সম্পূর্ণ বিল তুলে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়া, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি গত সাড়ে তিন বছর ধরে এ সবকিছুই চলেছে বাধাহীনভাবে ও অবিরাম। ফলে দেশের দৃশ্যমান অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে (রেলপথ ও সড়ক যোগাযোগের দুরবস্থা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ), ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মানা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, ক্ষমতাসীনদের যে যেভাবে পারে সেভাবে টাকার পাহাড় বানাচ্ছে, এই লুটপাটের একটি বিষময় ফল হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্নীতিপরায়ণ, লুটেরা ও ঘুষখোরদের দাপটের ফলে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল বিত্তহীন, বুভুক্ষু ও জীবন সংগ্রামে পরাজিত শ্রেণীর। বাংলাদেশে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, অতীতের বৈষম্যের সব কাহিনী লোকে ভুলতে বসেছে। এ এক অতি দুঃখজনক পরিস্থিতি, কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুই হয়েছিল বৈষম্য ও বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচার দাবি তোলায়। তখন বৈষম্যের সুবিধাভোগী ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত থেকে আগত উদুভাষী নওয়াবজাদা ও ব্যবসায়ীরা।
আজকে এ পর্যন্ত যা লিখেছি তা সবাই জানেন বা উপলব্ধি করছেন। তবে এবার ঈদের ছুটিতে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো প্রসঙ্গে দেশের ক্রমাবনতিশীল সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তার কথা বললেন। তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন-তখন চাঁদাবাজদের হুমকির কথা বললেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথাও বললেন অনেকে। তাই ঈদের ছুটি কাটল ভারাক্রান্ত মনে, আর এখন কাজে ফিরে কেবলই মনে হচ্ছে যে আমরা দুঃশাসন ও দুর্নীতির আবর্তে পড়ে ক্রমেই কঠিন সঙ্কটের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছি।
এরকম অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়তো ব্যর্থ, অসহিষ্ণু, মিথ্যাচারী, অত্যাচারী, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, লুটেরা ও আইনের শাসন ধ্বংসকারী বর্তমান শাসকদের হাত থেকে আমাদের নিজেদের ও দেশকে বাঁচানোর একটা উপায় হতে পারত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল যেভাবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করলেন এবং তারা এখনও যেভাবে আওয়ামী লীগের অধীনেই সংসদ নির্বাচন করতে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছেন, তাতে দেশে শান্তি থাকবে কিনা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে জনগণকে দেশ, গণতন্ত্র ও নিজেদের রক্ষা করার জন্য কঠিন সংগ্রামে নামতে হবে আর তা হতে হবে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই। কারণ, ওই নির্বাচন হতে হবে দুঃশাসনের অবসান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার, দুর্নীতি হঠিয়ে সততা ও ন্যায়নীতি প্রচলনের, নাগরিক জীবনে অশান্তির বদলে শান্তি প্রতিষ্ঠার এবং নিগৃহীত, বঞ্চিত ও শোষিত অসহায় জনগোষ্ঠীর বাঁচার সুযোগ করে দেয়ার পথ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads