আমাদের দেশে গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, আইনের শাসনের জায়গাটুকু আর বাকি নেই। গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজের মধ্যে বড় অংশই বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, শ্রমিক সংগঠনের নেতা, ব্যবসায়ীও রয়েছে। চৌধুরী আলম, তাবির উদ্দিন, রফিকুল, মিজানুর রহমান, আলী আকবর, তপন দাস, আবদুল করিম হাওলাদার, কেএম শামীম আকতার, শামীম হাসান সোহেল, ইসমাইল, আমিনুল ইসলাম, এম ইলিয়াস আলীসহ সৌদি কূটনীতিক হত্যা-গুম এবং বিচারের ব্যর্থতা সরকারের একটি চরম ব্যর্থতা। মহাজোট সরকারের সদ্য সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএসের টাকা কেলেঙ্কারি ফাঁসের নায়ক ড্রাইভার আজম, এম ইলিয়াস আলীর ড্রাইভার আনসার আলীও গুমের শিকার।
ইলিয়াস আলীর অপহরণের চাক্ষুষ সাক্ষী নির্মাণ শ্রমিক, পুলিশের এসআই, ডাবের দোকানদার ও জলখাবার হোটেলের কর্মচারী—এরা সবাই দেখেছে পুলিশের ভ্যান এসে ইলিয়াস আলীর গাড়ি ধাক্কা দেয় এবং তাকে টেনে-হিঁচড়ে পুলিশের ভ্যানে তুলে নেয়। এসব খবর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকায়ও প্রকাশ পেয়েছে।
কারা কীভাবে গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ঘটাচ্ছে তা রাষ্ট্র, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি। বর্তমানে গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ এমন পর্যায়ে যে মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। অপরিচিত কোনো ব্যক্তির ফোন রিসিভ করতেও ভয় পায়।
গুম-গুপ্তহত্যার শিকার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা (সাদা পোশাকের) বাহিনীর পরিচয়ে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের জন্য চরম উদ্বেগ, আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার বিষয়। যদি এটি অনুমান করি যে, রাষ্ট্র এর সঙ্গে জড়িত নয়; তাহলে যারা গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ করছে তারা কি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী? আর তা হলে সাধারণ নাগরিকের বাঁচার অধিকার কোথায়?
অনেকেরই ক্ষত-বিক্ষত লাশ ঢাকার আশপাশের পথে-ঘাটে, আশুলিয়া, বিরুলিয়া, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের অন্যান্য নদীতে, খালে, বিলে ও বনে-জঙ্গলে প্রতিদিন পাওয়ার খবর আসছে মিডিয়ায়। এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে সরকার জড়িত কি জড়িত নয়, এ প্রশ্ন মুখ্য নয়। মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনে অপহরণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এরকম—দণ্ডবিধির ৩৬২ ধারা মতে, যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো স্থান থেকে গমন করার জন্য জোরপূর্বক বাধ্য করে বা কোনো প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ করে, সেই ব্যক্তি ওই ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে বলে গণ্য হবে। জাতিসংঘের কনভেনশনে মানব গুমের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে—‘রাষ্ট্র আথবা রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত এজেন্ট, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে বা সম্মতিক্রমে সংঘটিত গ্রেফতার, আটকাদেশ, অপহরণ বা অন্য কোনো ধরনের অধিকার হরণ; যার মধ্যে আটকাবস্থার কথা অস্বীকার, সর্বশেষ অবস্থা বা ভাগ্য সম্পর্কে জানতে না দেয়া, যার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত করা।’
বর্তমান সরকারের প্রায় সাড়ে তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকায় ৬ হজার ৫৭৬টির অধিক বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আন্জুমান মুফিদুল ইসলাম। রাজধানীর বাইরে দাফন করেছে আরও ৬ হাজার লাশ এ সংস্থাটি (এমআরটি)। এ যেন লাশের মিছিল।
তারপরও শাসক শ্রেণী বলছে, দেশ ভালো আছে। বিরোধী দল লাগাতার সংসদ বর্জন করলেও আমাদের গণতন্ত্র সুসংহত; এগোচ্ছে।
এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের চেয়েও গুপ্তহত্যার ঘটনা ভয়াবহ ও জঘন্যতর। ক্রসফায়ারের ঘটনায় কাউকে না কাউকে দায়ী করার সুযোগ থাকে। কিন্তু গুপ্তহত্যার ঘটনায় সে সুযোগটুকুও থাকে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যতগুলো খারাপ উদাহরণ রয়েছে, গুপ্তহত্যা হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম ঘটনা। এ ধরনের ঘটনায় স্বজনরা তাদের অপহৃত ব্যক্তির লাশও দেখতে পায় না। স্বজনরা পায় না জানাজা-দাফন করার অধিকার টুকু। মনে হয় এ রাষ্ট্রে এখন সব চেয়ে সস্তা মানুষের জীবন। এভাবে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, অনেকের লাশ পাওয়া যায় না। এ এক দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি।
কারও সঙ্গে রাজনৈতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আদর্শিক মতপার্থক্য থাকতে পারে; এজন্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এসব নীল নকশায় গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। মানবতাবোধ ও মানবিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা সরকার যখন আইনানুগভাবে একজন স্বাধীন নাগরিককে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তখন তাকে গুম-খুন-অপহরণ করে থাকে। ন্যায়পরায়ণ শাসক বা শাসন যন্ত্র; স্বাধীন এবং কল্যাণ রাষ্ট্র কখনও নিজ জনগণকে গুম-খুন-অপহরণ করে না। নিরপেক্ষ আইনের শাসন বলবত্ থাকলে গুম-খুন-অপহরণ কল্পনা করা সম্ভব নয়। চলমান এ অস্থিরতা থেকে আশু পরিত্রাণের জন্য নাগরিক, সামাজিক গণপ্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। গুম-গুপ্তহত্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে হবে।
ন্যায়পরায়ণ শাসক ও নিরপেক্ষ আইনের শাসন আমাদের সমাজের চলমান অস্থিরতা থেকে মুক্তির নিয়ামক পাথেয়। শাসক বা শাসন যন্ত্রকে এ কথাটি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক
ইলিয়াস আলীর অপহরণের চাক্ষুষ সাক্ষী নির্মাণ শ্রমিক, পুলিশের এসআই, ডাবের দোকানদার ও জলখাবার হোটেলের কর্মচারী—এরা সবাই দেখেছে পুলিশের ভ্যান এসে ইলিয়াস আলীর গাড়ি ধাক্কা দেয় এবং তাকে টেনে-হিঁচড়ে পুলিশের ভ্যানে তুলে নেয়। এসব খবর বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকায়ও প্রকাশ পেয়েছে।
কারা কীভাবে গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ঘটাচ্ছে তা রাষ্ট্র, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করতে পারেনি। বর্তমানে গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ এমন পর্যায়ে যে মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। অপরিচিত কোনো ব্যক্তির ফোন রিসিভ করতেও ভয় পায়।
গুম-গুপ্তহত্যার শিকার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা (সাদা পোশাকের) বাহিনীর পরিচয়ে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের জন্য চরম উদ্বেগ, আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার বিষয়। যদি এটি অনুমান করি যে, রাষ্ট্র এর সঙ্গে জড়িত নয়; তাহলে যারা গুম-গুপ্তহত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ করছে তারা কি রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী? আর তা হলে সাধারণ নাগরিকের বাঁচার অধিকার কোথায়?
অনেকেরই ক্ষত-বিক্ষত লাশ ঢাকার আশপাশের পথে-ঘাটে, আশুলিয়া, বিরুলিয়া, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের অন্যান্য নদীতে, খালে, বিলে ও বনে-জঙ্গলে প্রতিদিন পাওয়ার খবর আসছে মিডিয়ায়। এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুপ্তহত্যার সঙ্গে সরকার জড়িত কি জড়িত নয়, এ প্রশ্ন মুখ্য নয়। মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনে অপহরণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এরকম—দণ্ডবিধির ৩৬২ ধারা মতে, যে ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে কোনো স্থান থেকে গমন করার জন্য জোরপূর্বক বাধ্য করে বা কোনো প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ করে, সেই ব্যক্তি ওই ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে বলে গণ্য হবে। জাতিসংঘের কনভেনশনে মানব গুমের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে—‘রাষ্ট্র আথবা রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত এজেন্ট, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে বা সম্মতিক্রমে সংঘটিত গ্রেফতার, আটকাদেশ, অপহরণ বা অন্য কোনো ধরনের অধিকার হরণ; যার মধ্যে আটকাবস্থার কথা অস্বীকার, সর্বশেষ অবস্থা বা ভাগ্য সম্পর্কে জানতে না দেয়া, যার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত করা।’
বর্তমান সরকারের প্রায় সাড়ে তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকায় ৬ হজার ৫৭৬টির অধিক বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আন্জুমান মুফিদুল ইসলাম। রাজধানীর বাইরে দাফন করেছে আরও ৬ হাজার লাশ এ সংস্থাটি (এমআরটি)। এ যেন লাশের মিছিল।
তারপরও শাসক শ্রেণী বলছে, দেশ ভালো আছে। বিরোধী দল লাগাতার সংসদ বর্জন করলেও আমাদের গণতন্ত্র সুসংহত; এগোচ্ছে।
এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের চেয়েও গুপ্তহত্যার ঘটনা ভয়াবহ ও জঘন্যতর। ক্রসফায়ারের ঘটনায় কাউকে না কাউকে দায়ী করার সুযোগ থাকে। কিন্তু গুপ্তহত্যার ঘটনায় সে সুযোগটুকুও থাকে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যতগুলো খারাপ উদাহরণ রয়েছে, গুপ্তহত্যা হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম ঘটনা। এ ধরনের ঘটনায় স্বজনরা তাদের অপহৃত ব্যক্তির লাশও দেখতে পায় না। স্বজনরা পায় না জানাজা-দাফন করার অধিকার টুকু। মনে হয় এ রাষ্ট্রে এখন সব চেয়ে সস্তা মানুষের জীবন। এভাবে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, অনেকের লাশ পাওয়া যায় না। এ এক দুঃস্বপ্নের পরিস্থিতি।
কারও সঙ্গে রাজনৈতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও আদর্শিক মতপার্থক্য থাকতে পারে; এজন্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এসব নীল নকশায় গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। মানবতাবোধ ও মানবিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা সরকার যখন আইনানুগভাবে একজন স্বাধীন নাগরিককে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় তখন তাকে গুম-খুন-অপহরণ করে থাকে। ন্যায়পরায়ণ শাসক বা শাসন যন্ত্র; স্বাধীন এবং কল্যাণ রাষ্ট্র কখনও নিজ জনগণকে গুম-খুন-অপহরণ করে না। নিরপেক্ষ আইনের শাসন বলবত্ থাকলে গুম-খুন-অপহরণ কল্পনা করা সম্ভব নয়। চলমান এ অস্থিরতা থেকে আশু পরিত্রাণের জন্য নাগরিক, সামাজিক গণপ্রতিরোধ অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। গুম-গুপ্তহত্যা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে হবে।
ন্যায়পরায়ণ শাসক ও নিরপেক্ষ আইনের শাসন আমাদের সমাজের চলমান অস্থিরতা থেকে মুক্তির নিয়ামক পাথেয়। শাসক বা শাসন যন্ত্রকে এ কথাটি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন