ব দ রু দ্দী ন উ ম র
কী ধরনের সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের মধ্যে তর্কবিতর্ক, বাকবিতণ্ডা এখন তুঙ্গে। এই বাকবিতণ্ডা এমন এক শাসন ব্যবস্থাতেই সম্ভব যেখানে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই, গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়া যেখানে অনুপস্থিত। যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন ক্ষমতা কার হাতে যাবে তা নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম-কানুন, রীতি-পদ্ধতি থাকে। এই অনুযায়ী কোনো গদিনশীন সরকার নয়, নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। এদিক দিয়ে নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সরকারের থাকে না। সরকার এই শর্ত মেনে চললেই একটি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হতে পারে। অন্য কোনো দূর দেশে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, এমনকি সামরিক শাসনে অভ্যস্ত পাকিস্তানেও নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা করে এবং তা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে কারচুপির কথা উঠলেও অবস্থা এমন দাঁড়ায় না যাতে বিরোধী পক্ষ প্রতিষ্ঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে কোনো ধরনের অনির্বাচিত মধ্যবর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। ১৯৯০ সালের পর সংসদীয় ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টি সামনে এলে কী ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এটা পরিণত হয় একটি বড় রকমের রাজনৈতিক সমস্যায়। এর কারণ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোট গঠন করে এমনভাবে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় যাতে একমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই তাদের মধ্যে ঐকমত্য অসম্ভব হয়। এ সময়েই একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি সামনে আসে। কিন্তু কীভাবে এ সরকার গঠিত হবে এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় সঙ্কট দেখা দেয়। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে শহরাঞ্চলে, বিশেষত ঢাকায় এক গণঅভ্যুত্থান এই পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায় এবং একটি তত্ত্বাবধায় সরকার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দুই পক্ষই এই সরকার গঠন প্রক্রিয়া বিষয়ে একমত হয়। স্থির হয় যে, সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হবে এবং তিনিই তাকে সাহায্য করার জন্য অন্য উপদেষ্টা মনোনীত করবেন। এই বিষয়ে দুই জোটের নেত্রীই তত্কালীন সামরিক বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে এই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করতে সম্মত হন ও সেই অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনই সে নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচন শেষে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সে সময় কোনো গ্রাহ্য বিতর্ক হয়নি। তার কোনো সুযোগই ছিল না।
যেভাবে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো তার মধ্যে গণতন্ত্রের থেকে গণতন্ত্রের সঙ্কটেরই প্রতিফলন ঘটেছিল। এই সঙ্কট আবার নতুনভাবে মাথাচাড়া দেয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময়। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার তাদের অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটা নিরপেক্ষ হবে না। কাজেই নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। বিএনপি আওয়ামী লীগের দাবি অস্বীকার করে নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচন বয়কট করে এবং খালেদা জিয়া বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে গায়ের জোরে নির্বাচন করে সরকার গঠন করলেও তার বিরুদ্ধে দেশে যে তুমুল আন্দোলন শুরু হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে সে নির্বাচন যেভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় তাতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিএনপিকে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক সংশোধনী বিল উপস্থিত করে তা পাস করাতে হয়। স্থির হয় যে, সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন এবং তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন পরিচালিত হবে। সেই অনুযায়ী খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠাতা।
২০০১ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। খালেদা জিয়া তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তার মন্ত্রিসভার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর ২০০৭ সালের নির্বাচন আসন্ন হলে বিএনপি দ্বিতীয়বারের মতো এক সঙ্কট সৃষ্টি করে। সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন, এ নীতির বিরোধিতা না করলেও পূর্ববর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে কাকে গণ্য করা হবে এ নিয়ে এক জটিল বিতর্ক অমীমাংসিত অবস্থায় থাকাকালে অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সামরিক বাহিনী ফখরুদ্দীনকে শিখণ্ডী হিসেবে সামনে রেখে এক সরকার গঠন করে। এই বেনামি সামরিক সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে ২০০৮ সালের নির্বাচন করে। বেনামি এই সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারও কোনো আপত্তি থাকেনি।
এখন নির্বাচন কার অধীনে হবে এ নিয়ে নতুন করে আবার তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। পরে তারা সুর কিছুটা নরম করে বলছে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ছোট সরকার গঠন করা হবে যাতে বিএনপিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন শেখ হাসিনা। বিএনপি সরাসরি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বা যে কোনো নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিএনপি যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন কোনো সরকারের কথা বলুক, এ সরকার কীভাবে গঠিত হবে এ নিয়ে কোনো প্রস্তাব বা ফর্মুলা আজ পর্যন্ত উপস্থিত করেনি। আসলে এই সমস্যার সমাধান এক কঠিন ব্যাপার।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী এখন কীভাবে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করবে, এটা তাদের ব্যাপার। এ নিয়ে জনগণের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু শাসক শ্রেণীর দলগুলো এ সমস্যার সমাধান ঠিকমত করতে ব্যর্থ হলে দেশের সঙ্কটজনক বিদ্যমান পরিস্থিতি যে আরও সঙ্কটজনক হবে এতে সন্দেহ নেই। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতিকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত এ কারণে হয়নি যে, বিচারপতিরা দেবতুল্য লোক। এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল যান্ত্রিকভাবে কোনো বিতর্কের অবকাশ না রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিযুক্তির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার পর কীভাবে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে এটা শাসক শ্রেণী, বিশেষত বিএনপির সামনে এক বড় সমস্যা। যেহেতু প্রকৃতপক্ষেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে, সে কারণে তাদেরকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে উপস্থিত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই এবং তার অধীনে ছাড়া নির্বাচন করা হবে না—একথা বলে এখন পর্যন্ত এই সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বিএনপি কর্তৃক উপস্থিত করার ক্ষেত্রে অপারগতা শুধু যে এই দলটির সঙ্কটই নির্দেশ করছে তা-ই নয়, সমগ্র শাসক শ্রেণীর গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রতিফলনও এর মধ্যেই ঘটছে।
৮.৮.২০১২
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। ১৯৯০ সালের পর সংসদীয় ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টি সামনে এলে কী ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এটা পরিণত হয় একটি বড় রকমের রাজনৈতিক সমস্যায়। এর কারণ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোট গঠন করে এমনভাবে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ায় যাতে একমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই তাদের মধ্যে ঐকমত্য অসম্ভব হয়। এ সময়েই একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নটি সামনে আসে। কিন্তু কীভাবে এ সরকার গঠিত হবে এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় সঙ্কট দেখা দেয়। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে শহরাঞ্চলে, বিশেষত ঢাকায় এক গণঅভ্যুত্থান এই পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায় এবং একটি তত্ত্বাবধায় সরকার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দুই পক্ষই এই সরকার গঠন প্রক্রিয়া বিষয়ে একমত হয়। স্থির হয় যে, সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হবে এবং তিনিই তাকে সাহায্য করার জন্য অন্য উপদেষ্টা মনোনীত করবেন। এই বিষয়ে দুই জোটের নেত্রীই তত্কালীন সামরিক বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে এই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করতে সম্মত হন ও সেই অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনই সে নির্বাচন পরিচালনা করে। নির্বাচন শেষে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সে সময় কোনো গ্রাহ্য বিতর্ক হয়নি। তার কোনো সুযোগই ছিল না।
যেভাবে ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো তার মধ্যে গণতন্ত্রের থেকে গণতন্ত্রের সঙ্কটেরই প্রতিফলন ঘটেছিল। এই সঙ্কট আবার নতুনভাবে মাথাচাড়া দেয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময়। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার তাদের অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, বিএনপি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটা নিরপেক্ষ হবে না। কাজেই নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। বিএনপি আওয়ামী লীগের দাবি অস্বীকার করে নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচন বয়কট করে এবং খালেদা জিয়া বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে গায়ের জোরে নির্বাচন করে সরকার গঠন করলেও তার বিরুদ্ধে দেশে যে তুমুল আন্দোলন শুরু হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে সে নির্বাচন যেভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়ায় তাতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বিএনপিকে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ক সংশোধনী বিল উপস্থিত করে তা পাস করাতে হয়। স্থির হয় যে, সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন এবং তার সরকারের অধীনেই নির্বাচন পরিচালিত হবে। সেই অনুযায়ী খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠাতা।
২০০১ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। খালেদা জিয়া তার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তার মন্ত্রিসভার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর ২০০৭ সালের নির্বাচন আসন্ন হলে বিএনপি দ্বিতীয়বারের মতো এক সঙ্কট সৃষ্টি করে। সুপ্রিমকোর্টের বিদ্যমান প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন, এ নীতির বিরোধিতা না করলেও পূর্ববর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে কাকে গণ্য করা হবে এ নিয়ে এক জটিল বিতর্ক অমীমাংসিত অবস্থায় থাকাকালে অস্থির পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সামরিক বাহিনী ফখরুদ্দীনকে শিখণ্ডী হিসেবে সামনে রেখে এক সরকার গঠন করে। এই বেনামি সামরিক সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে ২০০৮ সালের নির্বাচন করে। বেনামি এই সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কারও কোনো আপত্তি থাকেনি।
এখন নির্বাচন কার অধীনে হবে এ নিয়ে নতুন করে আবার তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ঘোষণা করেছে তাদের সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। পরে তারা সুর কিছুটা নরম করে বলছে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ছোট সরকার গঠন করা হবে যাতে বিএনপিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকবেন শেখ হাসিনা। বিএনপি সরাসরি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বা যে কোনো নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিএনপি যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন কোনো সরকারের কথা বলুক, এ সরকার কীভাবে গঠিত হবে এ নিয়ে কোনো প্রস্তাব বা ফর্মুলা আজ পর্যন্ত উপস্থিত করেনি। আসলে এই সমস্যার সমাধান এক কঠিন ব্যাপার।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী এখন কীভাবে নিজেদের শাসন কাজ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করবে, এটা তাদের ব্যাপার। এ নিয়ে জনগণের মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু শাসক শ্রেণীর দলগুলো এ সমস্যার সমাধান ঠিকমত করতে ব্যর্থ হলে দেশের সঙ্কটজনক বিদ্যমান পরিস্থিতি যে আরও সঙ্কটজনক হবে এতে সন্দেহ নেই। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা অব্যবহিত পূর্বের প্রধান বিচারপতিকে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত এ কারণে হয়নি যে, বিচারপতিরা দেবতুল্য লোক। এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল যান্ত্রিকভাবে কোনো বিতর্কের অবকাশ না রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিযুক্তির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার পর কীভাবে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে এটা শাসক শ্রেণী, বিশেষত বিএনপির সামনে এক বড় সমস্যা। যেহেতু প্রকৃতপক্ষেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে, সে কারণে তাদেরকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাব স্পষ্ট ও স্বচ্ছভাবে উপস্থিত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই এবং তার অধীনে ছাড়া নির্বাচন করা হবে না—একথা বলে এখন পর্যন্ত এই সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বিএনপি কর্তৃক উপস্থিত করার ক্ষেত্রে অপারগতা শুধু যে এই দলটির সঙ্কটই নির্দেশ করছে তা-ই নয়, সমগ্র শাসক শ্রেণীর গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রতিফলনও এর মধ্যেই ঘটছে।
৮.৮.২০১২
লেখক : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন