সৈয়দ আবদাল আহমদ
তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থার খবরটি পড়ে মন খুব ভারাক্রান্ত। পেশাগত কাজে লন্ডনে গিয়েছিলেন সহকর্মী অলিউল্লাহ নোমান। সেখানে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়। দেশে ফিরে তারেক রহমানের শারীরিক অবস্থা নিয়ে তিনি একটি রিপোর্ট করেন। খবরটিতে বলা হয়, তারেক রহমান এখনও বাম পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তাকে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে। থেরাপি নিতে হচ্ছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে তার আরও অনেকদিন লাগবে। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কতদিন লাগবে কিংবা আদৌ তিনি ফিরতে পারবেন কি-না এবং আগের মতো চলাফেরা করতে পারবেন কি-না, সে ব্যাপারে চিকিত্সকরা তারেক রহমানের পরিবারকে এখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা দেননি। খবরটিতে আরও বলা হয়, চিকিত্সা শেষ হওয়ার আগে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। ডাক্তার যতদিন পর্যন্ত চিকিত্সা নিতে বলবেন, ততদিন তাকে চিকিত্সা নিতে হবে। সুস্থতার ওপরই নির্ভর করছে তার দেশে ফেরা। লন্ডনে চিকিত্সার পাশাপাশি তিনি পড়াশোনাও করছেন। আপাতত রাজনীতি নিয়ে তিনি চিন্তা-ভাবনা করছেন না। তবে ইন্টারনেটে পত্র-পত্রিকা পড়ার মাধ্যমে দেশের খোঁজ-খবর রাখেন তিনি। চিকিত্সার জন্য লন্ডনে অবস্থান করলেও তার মনটা পড়ে আছে বাংলাদেশে। তিনি তার সুস্থতা কামনা করে দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিচয় তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। তবে এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়; তিনি এদেশের জননন্দিত প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের সন্তান। তিনি আরেক জনপ্রিয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ দুই মহান নেতা-নেত্রীর অবদান অতুলনীয়। শহীদ জিয়াউর রহমান শুধু বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার মহান ঘোষক। ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে একাত্তরের রণাঙ্গনে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া দিন-রাত পরিশ্রম করে আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তেমনি বেগম খালেদা জিয়াও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ৯ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এরপর দু’বার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো ঘটেছে প্রেসিডেন্ট জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে। এ দু’জন মহান ব্যক্তিত্বের সন্তান হিসেবে তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভবিষ্যত্ কাণ্ডারি। সেটাই তারেক রহমানের বড় পরিচয়। আর সে কারণেই তারেক রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের মূল টার্গেট।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে তিনি গ্রামগঞ্জে অবিরাম হেঁটে মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি কৃষকের পর্ণকুটিরে গেছেন। তাদের লাউ গাছে লাউ আছে কি-না, ধান-গমের ফলন কেমন হচ্ছে, কীভাবে চলছে সংসার—জিজ্ঞাসা করতেন। এভাবে মানুষের মাঝে থাকার রাজনীতি করতেন জিয়া। তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়াও বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুরেছেন। ভাঙা সেতু, ভাঙা রাস্তা দেখে মর্মাহত হয়েছেন। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে মাইলের পর মাইল রাস্তা, সেতু, কালভার্ট করে দিয়েছেন। কৃষককে কৃষিকাজে উত্সাহিত করেছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিয়েছেন। তাদের সন্তান তারেক রহমানও রাজনীতির সেই ধারা অনুসরণ করে গ্রামগঞ্জে শুরু করেছিলেন গ্রাম মার্চ বা গ্রাম পদযাত্রা। তিনিও কৃষক, শ্রমিক, কামার-মজুরসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে তাদের সমস্যাগুলো অবহিত হচ্ছিলেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দলে দায়িত্ব পাওয়ার পর দলের কাজে অংশ নিয়ে তৃণমূলকে সংগঠিত করছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন দলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত করার মধ্যেই শক্তি নিহিত। তাই বিএনপিকে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। তৃণমূল সভা, নির্বাচন, প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে গুছিয়ে আনতে শুরু করেন দল। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রমাদ গুনতে থাকে। তারেক রহমান যদি এভাবে দল সংগঠিত করে ফেলেন, তাহলে বিরোধীদের পক্ষে কোনোদিনই বিএনপির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। তাই তারা তারেক রহমানকে টার্গেট করে শুরু করে অপপ্রচার। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচারের কল্পকাহিনী ছড়িয়ে তার চরিত্র হনন ও ইমেজে কালিমা লেপনে লিপ্ত হয়। তারেক রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন, তিনি দুর্নীতির প্রতীক, হাওয়া ভবন দুর্নীতির আখড়া, তিনি জঙ্গি মদতদাতা—কত কী! একইভাবে তাকে ফাঁসানোর, তাকে শেষ করে দেয়ার কাজ চলতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ১/১১-র মূল টার্গেট করা হয় তারেক রহমানকে। তার বিরুদ্ধে রটনা ছড়িয়ে দেয়া হয়, তারেক রহমান গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রধান বাধা। তাকে ঘিরে গল্প ফাঁদা হয়। ওইসব কল্প-কাহিনী ছড়িয়ে তার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচারের ঝড় বইয়ে দেয়া হয়। এরপর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে তারেক রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে ১/১১’র জরুরি সরকার গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগমুহূর্তে তার সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্য দোয়া করবেন, মুরব্বিদের দোয়া করতে বলবেন।’ সেই কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে। আমি তাকে সাহস জুগিয়ে বলেছিলাম, ‘মনোবল ভাঙবেন না। আল্লাহকে ডাকবেন। ওরা ব্যক্তি তারেক রহমানকে গ্রেফতার করতে আসেনি। শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার উত্তরসূরি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কাণ্ডারিকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্যই তারা পরাজিত হবে।’
সেদিন তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে ১/১১-র ষড়যন্ত্রকারীরা তার বিরুদ্ধে ১৩টি মিথ্যা মামলা রজু করেছিল। একই সঙ্গে তার ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল, দেশবাসীর স্মৃতি থেকে তা মুছে যায়নি। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় রিমান্ডে। সেখানে চালানো হয় বীভত্স নির্যাতন। ভয়াবহ নির্যাতনের একটি হলো তাকে অনেক উপর থেকে ফেলে দিয়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়। গ্রেফতার করে তাকে কোর্টে তোলা হয় র্যাবের জ্যাকেট পরিয়ে। মাথায় দেয়া হয় হেলমেট। এর আগে এ ধরনের হেলমেট পরানো হয়েছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের। সেদিনের এ দৃশ্য দেখে দেশের সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। আমিও সেদিন ক্ষোভে দুঃখে ঘুমাতে পারিনি। এ কী আচরণ! যে দেশের জন্য তারেক রহমানের বাবা-মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের সন্তানের আজ এ পরিণতি কেন? এটা অন্যায়। এটা চরম অন্যায়। জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে এ বাহিনীকে গৌরবের আসনে বসিয়ে গেছেন, তারা কেন তার সন্তানের সঙ্গে এ আচরণ করছে? বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান তো সেনা পরিবারেরই সদস্য। তাদের তো এটা করার কথা নয়। তাদের সন্তানকে তারা এটা করছে কেন? না, সেদিন এর জন্য গোটা সেনাবাহিনী দায়ী ছিল না, সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু লোক ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্ধনে এ কাজ করেছিল। তারা তারেক রহমানের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। সেই বর্ণনা পরে তারেক রহমান নিজেও দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সেই বীভত্স নির্যাতনের অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু তাদের মায়া-দয়া হয়নি। তাদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘসময় আমি কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিত্সা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়।’ একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীর বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে? সে কাজটিই করেছে ১/১১-র সরকার। তাদের নির্যাতনের কারণে আজও অনেকটা পঙ্গুত্ব আর অসহ্য বেদনা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তারেক রহমানকে।
একটানা ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাবাসের পর ১২টি মামলায় জামিন পেয়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপেম্বর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তখনও তিনি হাসপাতালের বেডে। মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার কারণে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পান মা খালেদা জিয়া। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি পিজি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন নির্যাতন-নিপীড়নে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী এক তারেক রহমানকে। সেদিন মা-ছেলের কান্নায় পিজি হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এরপর চিকিত্সার জন্য তাকে নেয়া হয় বিদেশে। লন্ডনে যাওয়ার প্রাক্কালে আমিও তাকে পিজি হাসপাতাল দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের বেডে মেরুদণ্ড ভাঙা অসহায় তারেক রহমানকে দেখে, তার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে শিহরিত হয়েছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম বিদেশে চিকিত্সায় তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই থেকে প্রায় চার বছর হলো লন্ডনে তারেক রহমানের চিকিত্সা হচ্ছে। এখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি।
সেই ১/১১-র দুষ্টচক্রের একনম্বর টার্গেট ছিলেন তারেক রহমান। তাকে দেশ ছাড়তে প্রচণ্ড চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি মায়ের মতোই রাজি হননি দেশ ছাড়তে; ফলে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিল। তার ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালানো হয়। তার শরীর অসংখ্য জখমে ভরে দেয়া হয়। মামলা আর ঘৃণ্য অপপ্রচার তো ছিলই। কিন্তু দেশবাসীর দোয়ায় তিনি স্রেফ বেঁচে যান। সেদিন তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে পাচারের যে কল্পকাহিনী প্রচার করা হয়েছিল, তার কি কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? ১/১১-র সরকার তন্ন তন্ন করে তারেক রহমানের দুর্নীতি খুঁজেছে, বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার খুঁজছে। কিন্তু সেগুলো যে একান্তই রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য করা হয়েছে আজ তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একচুল পরিমাণ প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তবুও ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি। এখনও তিনি প্রতিহিংসার শিকার। বর্তমান মহাজোট সরকারও ১/১১-র পদাঙ্ক অনুসরণ করে কীভাবে তারেক রহমানকে ফাঁসানো যায়, তাকে কীভাবে রাজনীতিতে আসতে না দেয়া যায়, সে কৌশল নিয়েই মরিয়া। মামলা ও ঘৃণ্য অপপ্রচার এখনও চলছে সমানতালে। তারেক রহমানকেই শেখ হাসিনার ভয়। কারণ তারা দেখেছে তারেক রহমানের সক্ষমতা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের নেপথ্য রূপকার ছিলেন তারেক রহমান। এরপর গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে, তৃণমূল সমাবেশ করে তিনি যেভাবে দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সেটা উপলব্ধি করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে, তারেক রহমানকে থামাতে না পারলে আগামী দিনের রাজনীতি তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তারেক রহমানের মাঝে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখে আওয়ামী লীগ দিশেহারা। সেজন্য তারেক রহমানকে রুখে দেয়াই এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম এজেন্ডা।
তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, সেদিন হয়তো আসবে, মানুষের ভালোবাসার বাঁধভাঙা জোয়ার আবারও তারেক রহমানকে এ মাটিতে অভিবাদন জানাবে। মানুষ চাচ্ছে, সুস্থ হয়ে তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন। সেদিনের প্রতীক্ষায় সবাই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিচয় তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। তবে এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়; তিনি এদেশের জননন্দিত প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানের সন্তান। তিনি আরেক জনপ্রিয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। বাংলাদেশ বিনির্মাণে এ দুই মহান নেতা-নেত্রীর অবদান অতুলনীয়। শহীদ জিয়াউর রহমান শুধু বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার মহান ঘোষক। ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে একাত্তরের রণাঙ্গনে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া দিন-রাত পরিশ্রম করে আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তেমনি বেগম খালেদা জিয়াও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ৯ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এরপর দু’বার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো ঘটেছে প্রেসিডেন্ট জিয়া ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আমলে। এ দু’জন মহান ব্যক্তিত্বের সন্তান হিসেবে তারেক রহমান জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভবিষ্যত্ কাণ্ডারি। সেটাই তারেক রহমানের বড় পরিচয়। আর সে কারণেই তারেক রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের মূল টার্গেট।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে তিনি গ্রামগঞ্জে অবিরাম হেঁটে মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি কৃষকের পর্ণকুটিরে গেছেন। তাদের লাউ গাছে লাউ আছে কি-না, ধান-গমের ফলন কেমন হচ্ছে, কীভাবে চলছে সংসার—জিজ্ঞাসা করতেন। এভাবে মানুষের মাঝে থাকার রাজনীতি করতেন জিয়া। তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়াও বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুরেছেন। ভাঙা সেতু, ভাঙা রাস্তা দেখে মর্মাহত হয়েছেন। এরপর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে মাইলের পর মাইল রাস্তা, সেতু, কালভার্ট করে দিয়েছেন। কৃষককে কৃষিকাজে উত্সাহিত করেছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিয়েছেন। তাদের সন্তান তারেক রহমানও রাজনীতির সেই ধারা অনুসরণ করে গ্রামগঞ্জে শুরু করেছিলেন গ্রাম মার্চ বা গ্রাম পদযাত্রা। তিনিও কৃষক, শ্রমিক, কামার-মজুরসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে তাদের সমস্যাগুলো অবহিত হচ্ছিলেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দলে দায়িত্ব পাওয়ার পর দলের কাজে অংশ নিয়ে তৃণমূলকে সংগঠিত করছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন দলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত করার মধ্যেই শক্তি নিহিত। তাই বিএনপিকে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংগঠিত করতে শুরু করেন। তৃণমূল সভা, নির্বাচন, প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে গুছিয়ে আনতে শুরু করেন দল। সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রমাদ গুনতে থাকে। তারেক রহমান যদি এভাবে দল সংগঠিত করে ফেলেন, তাহলে বিরোধীদের পক্ষে কোনোদিনই বিএনপির মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। তাই তারা তারেক রহমানকে টার্গেট করে শুরু করে অপপ্রচার। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচারের কল্পকাহিনী ছড়িয়ে তার চরিত্র হনন ও ইমেজে কালিমা লেপনে লিপ্ত হয়। তারেক রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন, তিনি দুর্নীতির প্রতীক, হাওয়া ভবন দুর্নীতির আখড়া, তিনি জঙ্গি মদতদাতা—কত কী! একইভাবে তাকে ফাঁসানোর, তাকে শেষ করে দেয়ার কাজ চলতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ১/১১-র মূল টার্গেট করা হয় তারেক রহমানকে। তার বিরুদ্ধে রটনা ছড়িয়ে দেয়া হয়, তারেক রহমান গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রধান বাধা। তাকে ঘিরে গল্প ফাঁদা হয়। ওইসব কল্প-কাহিনী ছড়িয়ে তার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচারের ঝড় বইয়ে দেয়া হয়। এরপর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিনা অভিযোগে তারেক রহমানকে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের বাসা থেকে ১/১১’র জরুরি সরকার গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগমুহূর্তে তার সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। আমি কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্য দোয়া করবেন, মুরব্বিদের দোয়া করতে বলবেন।’ সেই কণ্ঠ এখনও আমার কানে বাজে। আমি তাকে সাহস জুগিয়ে বলেছিলাম, ‘মনোবল ভাঙবেন না। আল্লাহকে ডাকবেন। ওরা ব্যক্তি তারেক রহমানকে গ্রেফতার করতে আসেনি। শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার উত্তরসূরি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কাণ্ডারিকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্যই তারা পরাজিত হবে।’
সেদিন তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে ১/১১-র ষড়যন্ত্রকারীরা তার বিরুদ্ধে ১৩টি মিথ্যা মামলা রজু করেছিল। একই সঙ্গে তার ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিল, দেশবাসীর স্মৃতি থেকে তা মুছে যায়নি। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় রিমান্ডে। সেখানে চালানো হয় বীভত্স নির্যাতন। ভয়াবহ নির্যাতনের একটি হলো তাকে অনেক উপর থেকে ফেলে দিয়ে তার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হয়। গ্রেফতার করে তাকে কোর্টে তোলা হয় র্যাবের জ্যাকেট পরিয়ে। মাথায় দেয়া হয় হেলমেট। এর আগে এ ধরনের হেলমেট পরানো হয়েছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের। সেদিনের এ দৃশ্য দেখে দেশের সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। আমিও সেদিন ক্ষোভে দুঃখে ঘুমাতে পারিনি। এ কী আচরণ! যে দেশের জন্য তারেক রহমানের বাবা-মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের সন্তানের আজ এ পরিণতি কেন? এটা অন্যায়। এটা চরম অন্যায়। জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে এ বাহিনীকে গৌরবের আসনে বসিয়ে গেছেন, তারা কেন তার সন্তানের সঙ্গে এ আচরণ করছে? বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান তো সেনা পরিবারেরই সদস্য। তাদের তো এটা করার কথা নয়। তাদের সন্তানকে তারা এটা করছে কেন? না, সেদিন এর জন্য গোটা সেনাবাহিনী দায়ী ছিল না, সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু লোক ষড়যন্ত্রকারীদের ইন্ধনে এ কাজ করেছিল। তারা তারেক রহমানের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। সেই বর্ণনা পরে তারেক রহমান নিজেও দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সেই বীভত্স নির্যাতনের অসহ্য যন্ত্রণায় আমি কুঁকড়ে উঠেছি। কিন্তু তাদের মায়া-দয়া হয়নি। তাদের দায়িত্ব ছিল আমাকে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলা। তারপর থেকে দীর্ঘসময় আমি কারাগারে। কোনো ডাক্তার নেই। চিকিত্সা হয়নি। প্রতিটি দিন কেটেছে নারকীয় যন্ত্রণায়।’ একজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেফতার চলতে পারে। কিন্তু নির্যাতন করার, শরীর বিকল করার, মানবাধিকার পদদলিত করার অধিকার সভ্যতার কোথায় আছে? সে কাজটিই করেছে ১/১১-র সরকার। তাদের নির্যাতনের কারণে আজও অনেকটা পঙ্গুত্ব আর অসহ্য বেদনা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তারেক রহমানকে।
একটানা ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাবাসের পর ১২টি মামলায় জামিন পেয়ে ২০০৮ সালের ৩ সেপেম্বর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু তখনও তিনি হাসপাতালের বেডে। মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার কারণে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি পান মা খালেদা জিয়া। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি পিজি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন নির্যাতন-নিপীড়নে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী এক তারেক রহমানকে। সেদিন মা-ছেলের কান্নায় পিজি হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। এরপর চিকিত্সার জন্য তাকে নেয়া হয় বিদেশে। লন্ডনে যাওয়ার প্রাক্কালে আমিও তাকে পিজি হাসপাতাল দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের বেডে মেরুদণ্ড ভাঙা অসহায় তারেক রহমানকে দেখে, তার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে শিহরিত হয়েছিলাম। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম বিদেশে চিকিত্সায় তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেই থেকে প্রায় চার বছর হলো লন্ডনে তারেক রহমানের চিকিত্সা হচ্ছে। এখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি।
সেই ১/১১-র দুষ্টচক্রের একনম্বর টার্গেট ছিলেন তারেক রহমান। তাকে দেশ ছাড়তে প্রচণ্ড চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি মায়ের মতোই রাজি হননি দেশ ছাড়তে; ফলে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিল। তার ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালানো হয়। তার শরীর অসংখ্য জখমে ভরে দেয়া হয়। মামলা আর ঘৃণ্য অপপ্রচার তো ছিলই। কিন্তু দেশবাসীর দোয়ায় তিনি স্রেফ বেঁচে যান। সেদিন তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে পাচারের যে কল্পকাহিনী প্রচার করা হয়েছিল, তার কি কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে? ১/১১-র সরকার তন্ন তন্ন করে তারেক রহমানের দুর্নীতি খুঁজেছে, বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার খুঁজছে। কিন্তু সেগুলো যে একান্তই রাজনৈতিক কারণে করা হয়েছে, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য করা হয়েছে আজ তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একচুল পরিমাণ প্রমাণও পাওয়া যায়নি। তবুও ষড়যন্ত্র তার পিছু ছাড়েনি। এখনও তিনি প্রতিহিংসার শিকার। বর্তমান মহাজোট সরকারও ১/১১-র পদাঙ্ক অনুসরণ করে কীভাবে তারেক রহমানকে ফাঁসানো যায়, তাকে কীভাবে রাজনীতিতে আসতে না দেয়া যায়, সে কৌশল নিয়েই মরিয়া। মামলা ও ঘৃণ্য অপপ্রচার এখনও চলছে সমানতালে। তারেক রহমানকেই শেখ হাসিনার ভয়। কারণ তারা দেখেছে তারেক রহমানের সক্ষমতা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ঐতিহাসিক বিজয়ের নেপথ্য রূপকার ছিলেন তারেক রহমান। এরপর গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে, তৃণমূল সমাবেশ করে তিনি যেভাবে দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছিলেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সেটা উপলব্ধি করেছে। তারা উপলব্ধি করেছে, তারেক রহমানকে থামাতে না পারলে আগামী দিনের রাজনীতি তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তারেক রহমানের মাঝে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক চরিত্রের প্রতিচ্ছবি দেখে আওয়ামী লীগ দিশেহারা। সেজন্য তারেক রহমানকে রুখে দেয়াই এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম এজেন্ডা।
তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, সেদিন হয়তো আসবে, মানুষের ভালোবাসার বাঁধভাঙা জোয়ার আবারও তারেক রহমানকে এ মাটিতে অভিবাদন জানাবে। মানুষ চাচ্ছে, সুস্থ হয়ে তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন। সেদিনের প্রতীক্ষায় সবাই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
abdal62@gmail.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন