শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে : পানি যেন আবারও ঘোলা না হয়



অবশেষে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক। অনেক দেনদরবার, রশি টানাটানি ও নাটকীয়তার পর ওয়াশিংটন থেকে এ সংক্রান্ত খবরটি এসেছে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে। সেখানে ব্যাপক তত্পরতা চালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ছুটি চেয়ে যে দরখাস্ত পেশ করেছেন তার ‘অরিজিনাল’ কপিটিই নাকি বিশ্বব্যাংককে দেখাতে হয়েছে। সেটা দেখার অর্থাত্ দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত প্রধান একজন থাকছেন না বলে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। সংস্থাটি সেইসঙ্গে চারটি শর্তও জুড়ে দিয়েছে। শর্ত চারটি হলো, সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ছুটিতে পাঠানো, অনিয়ম তদন্তে দুদকের নেতৃত্বে বিশেষ একটি তদন্ত দল গঠন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া এবং নতুন প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীকে ক্রয় ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া। বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবিসহ অন্য দাতাদেরকেও সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে। ফলে তারাও পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আগের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাহায্য দেবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও জানিয়েছেন, উপদেষ্টা গওহর রিজভী দেশে ফেরার দু’চারদিনের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে ঢাকায় আসবেন।
পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ দেয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সম্মত হওয়ার খবরটি নিঃসন্দেহে উত্সাহব্যঞ্জক। বাংলাদেশের সব মানুষই খবরটি শোনার পর আবারও আশান্বিত হয়ে উঠেছে। আমরা কিন্তু একইসঙ্গে ইতিহাস স্মরণ না করে পারি না। কারণ, এই পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে বিগত কয়েক মাসে সমগ্র জাতিকেই লজ্জায় ডুবতে হয়েছে। সব দোষ অবশ্য কেবলই বিশ্বব্যাংকের নয়। সংস্থাটির জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন সরকারের মধ্যকার বিশেষ কয়েকজন— বিশ্বব্যাংক যাদের ‘সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তারা ঠিক কারা এবং তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কারও ঘনিষ্ঠ স্বজনরা রয়েছেন কি না সেকথা জনগণকে এখনও জানতে দেয়া হয়নি, যদিও বিশ্বব্যাংক নাম ধরে ধরেই সবার কথা সরকারকে জানিয়েছিল। বলেছিল, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে বিভিন্ন উত্স থেকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসবের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের পরিচালিত তদন্তের দুটি রিপোর্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে দেয়া হয়েছিল। দুর্নীতির ব্যাপারে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের প্রতিক্রিয়া ও জবাবও ‘সন্তোষজনক’ ছিল না। সে কারণেই বিশ্বব্যাংকের পক্ষে ‘চোখ বুজে থাকা’ সম্ভব হয়নি। সংস্থাটি তাই পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তিই বাতিল করেছিল। উল্লেখ্য, চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রদত্ত ৩০ জুনের বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি এবং এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে আওয়ামী মহাজোট সরকারের অসহযোগিতার কথাও বলেছিল।
অন্যদিকে সরকার নিয়েছিল আক্রমণাত্মক কৌশল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এমনভাবে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করেছিলেন যা দেখে মনে হয়েছিল যেন বিশ্বব্যাংক বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো এদেশের কোনো রাজনৈতিক দল! আমরা কিন্তু সে সময়ও বলেছিলাম, সত্যি দুর্নীতি না হয়ে থাকলে সরকারের তো বিশ্বব্যাংকের দাবি ও অভিযোগের ব্যাপারে আপত্তিই থাকার কথা নয়। এতদিনে অবশ্য অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ছুটির দরখাস্ত করায় বুঝতে বাকি থাকেনি যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ঠিক কার বা কোন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিল। তাছাড়া কানাডা থেকে পাওয়া বিভিন্ন খবরেও অনেকের সম্পর্কেই জানা যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক অসত্য বলেনি, আসলেও ‘উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র’ হয়েছিল। সেজন্যই নিজেদের লেখা ছয়টি চিঠি প্রকাশ করলেও সরকার বিশ্বব্যাংকের দুটি রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। দুর্নীতি হয়েছিল বলেই সরকারকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। এমনকি নতুন পর্যায়ে চারটি কঠিন শর্তও মেনে নিতে হয়েছে।
আমরা মনে করি, পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তিকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতাসীনদের জন্য অনেক বার্তাই এসেছে। দেশ ও জাতিকে লজ্জায় আসলে তারাই ডুবিয়েছেন। লম্ফ-ঝম্ফ করার পরিবর্তে প্রথম উপলক্ষেই তারা যদি বিশ্বব্যাংকের দাবি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন তাহলে পানি এতটা ঘোলা হতো না। এজন্যই বিশ্বব্যাংককে এককভাবে দোষ দেয়ার সুযোগ নেই। কেননা, টাকার সদ্ব্যবহার সংস্থাটি নিশ্চিত করতে চাইবেই। আমরা আশা করতে চাই, ক্ষমতাসীনরা মাত্র সেদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন এবং নতুন পর্যায়ে আর কোনো দুর্নীতি ঘটবে না। বিশ্বব্যাংকেরও উচিত সীমা অতিক্রম না করা। টাকা দিচ্ছে বলেই সববিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads