অজ্ঞাত লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই ৭ মাসে রাজধানী থেকে ৬৫৯টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর সবগুলোই আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাশ উদ্ধার হয়েছে ঢাকার উপকন্ঠের বিভিন্ন স্পট থেকে। সাভারের প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকা, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথের দু’ পাশ, কামরাঙ্গীর চর ও বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে। এসব স্পট তখন এলাকাবাসীর জন্য আতঙ্ক। তারা স্পটগুলোকে কিলিং জোন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার মানবজমিনকে বলেন, অপরাধপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে এসব এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এর বাইরে কোন জায়গায় একের পর এক লাশ পাওয়া গেলে সে এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। তবে এরকম অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অপমৃত্যুর মামলা হয়। প্রতিটি ঘটনায় বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা নেয়া হয়। কোন লাশের ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব রহস্য উদঘাটন করা।
প্রস্তাবিত ট্যানারি ও বুড়িগঙ্গা পয়েন্ট: সদ্য বিদেশফেরত রফিকুল ইসলাম। হাতে নগদ টাকার ছড়াছড়ি। তাই দেখে লোভ সামলাতে পারেনি স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। ওই টাকা হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশে কৌশলে নিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা নদী সংলগ্ন প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকায়। ছিনিয়ে নেয় নগদ লাখ খানেক টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। ঘটনা চাপা দিতে হত্যার পরিকল্পনা করে দুর্বৃত্তরা। তারা তিনজন মিলে রফিকের গলা চিপে ধরে। অচেতন রফিক লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেয়া হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে। রফিকের সেই বিচ্ছিন্ন মাথা আজও খুঁজে পায়নি তার স্বজনরা। শুধু রফিক নয়, সামপ্রতিক সময়ে নির্জন ওই ট্যানারি এলাকা ও পাশের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অন্তত ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওইসব লাশের পরিচয় মেলেনি। গতকাল সাভার থানাধীন ওই প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকা সরজমিনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে মাইলের পর মাইল ধূধূ প্রান্তর। ঘন কাশবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় পিচ ঢালা রাস্তা। পাঁচ গজ দূরের মানুষের অস্তিত্ব বোঝাও মুশকিল। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে দেখা মেলে নেশাখোরদের জমাট আড্ডা। ক্যামেরার ফ্ল্যাশগান ঝলকে উঠতেই দৌড়ে পালায় তারা। এলাকাবাসী জানান, একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকা এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। দিনে-দুপুরে একা যেতে সাহস পান না অনেকেই। গত সপ্তাহে লঙ্কার চরের এক যুবককে অপহরণ করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। তারও মাস খানেক আগে অজ্ঞাত মহিলার লাশ ভেসেছিল প্রায় পাঁচ দিন। ঝাউচরের বাসিন্দা মিরাজ বলেন, পুলিশকে খবর দেয়া হলেও তারা উদ্ধার করেনি। লাশ উদ্ধার নিয়ে ঠেলাঠেলি করে সাভার, কেরানীগঞ্জ মডেল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। লাশ ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার বলেন, ওই এলাকায় মাঝে-মধ্যেই লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এ কারণে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ফল মেলেনি। এখানেই শেষ নয়। ময়লা স্্েরাতের বহমান বুড়িগঙ্গা নদীর আরও অন্তত ৮টি পয়েন্ট সন্ত্রাসীদের নিরাপদ কিলিং জোনে পরিণত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সুজন বেপারীর ঘাট, হাসনাবাদ ঘাট, লালকুঠি আলু ঘাট, পোস্তগোলা সেনানিবাস সংলগ্ন আশপাশের এলাকা, রফিক টাওয়ার, আগানগর ও তেলঘাট। এসব ঘাট সংলগ্ন নদীর পানিতে মাঝে-মধ্যেই অজ্ঞাত পুরুষ ও মহিলার লাশ ভেসে উঠছে। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় লাশগুলো উদ্ধার করা হলেও তাদের পরিচয় মিলছে না। হত্যার পর কারও শরীর থেকে হাত-পা ও কারও মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার কারও চোখ উপড়ে এবং মুখ বিকৃত করে লাশ বস্তাবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রমতে, চলতি বছরের ৮ মাসে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৩১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগের পরিচয় মেলেনি। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী লাশের ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে। ময়লা আবর্জনার পাশাপাশি নানা ধরনের বিকৃত লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীরা হত্যার পর নদীতে ফেলে দিয়ে লাশ গুমের চেষ্টা করে। ওই লাশ ভাসতে ভাসতে আমার থানা এলাকায় জড়ো হয়। গত ২৮শে জানুয়ারি হাসনাবাদ চৌধুরী কোল্ডস্টোরেজ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ৩২ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ই মার্চ উদ্ধার হয় ষাটোর্ধ্ব অজ্ঞাত মহিলার লাশ। পরের দিন ৬ই মার্চ উদ্ধার করা হয় ২৫-৩০ বছর বয়সী অজ্ঞাত যুবকের লাশ। ৭ই মার্চ পাওয়া যায় ৪২ বছর বয়সী অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ। ৯ই মার্চ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের নদী থেকে আনুমানিক ৪৮ বছর বয়সী অজ্ঞাত ব্যক্তির বিকৃত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত তার পরিচয় মেলেনি। ১৪ই মার্চ উদ্ধার হয় ২৮ বছর বয়সী অজ্ঞাত যুবকের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। এছাড়া ৫ই মে জাকির হোসেন নামে এক যুবককে হাত ও পা বেঁধে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে শুভাড্যা পশ্চিম পাড়া হারুন মিয়ার বালুমাঠে ফেলে পালিয়ে যায়। পরের দিন ৬ই মে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। একই রাতে এক গার্মেন্ট শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরের দিন কালীগঞ্জ আলীনগর এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪ঠা মে পানগাঁও কন্টিনেন্টাল পোর্ট এলাকার নদী থেকে ভাসমান মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। ১০ই মার্চ লালকুঠি আলুঘাট থেকে উদ্ধার হয় আসলাম শেখ ওরফে লিয়াকত নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ। ২৬শে এপ্রিল পোস্তাগোলা সেনানিবাস সংলগ্ন ঘাট থেকে ৩২ বছরের আরও এক অজ্ঞাত পুরুষের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এক কর্মকর্তা বলেন, এর বাইরে আরও ১০-১২টি লাশ পাওয়া গেছে। এসব লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।
মিরপুর বেড়িবাঁধ: মিরপুর বেড়িবাঁধের তুরাগ তালতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে চটবাড়ি ছায়ানীড় রেস্তরাঁ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার পথ ব্যবহৃত হচ্ছে কিলিংজোন হিসেবে। মিরপুর বেড়িবাঁধের এ এলাকাটি এখন নবগঠিত রূপনগর থানার আওতাধীন। গত ৬ মাসে এ এলাকা থেকে অন্তত ৬টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বেশির ভাগ লাশ ছিল ক্ষতবিক্ষত। দীর্ঘ এ পথের দু’পাশে নদী ভরাট করে তৈরি করা বালুচর আর ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে দেখা মেলে শুকিয়ে যাওয়া নদীর ক্ষীণ প্রবাহ। বিস্তীর্ণ এলাকায় কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেখা মেলে না। সন্ধ্যা নামলেই গা ছম ছম করা আবহ নেমে আসে। পেশাদার কিলার আর অপরাধীদের দখলে চলে যায় এ এলাকা। আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বলছেন এ এলাকায় রাতে নজরদারি তেমন থাকে না। এখান থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে অজ্ঞাত পরিচয় মরদেহ। কোনটির মস্তক নেই। কোনটির দেহ থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করা। তুরাগ থানার ওসি এবিএম জিয়াউল করীম বলেন, এ এলাকায় মাঝে-মধ্যেই লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এলাকাটা কিছুটা অরক্ষিত হওয়ায় অপরাধীরা অন্য কোথাও খুন করার পর লাশ ফেলে যায় এখানে। তিনি বলেন, তুরাগের একটি বড় অংশ পল্লবী ও নবগঠিত রূপনগর থানায় পড়েছে। তুরাগ তালতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে জাহান সিএনজি ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত রাস্তায় রাত ৮টার মধ্যে পুলিশি টহল উঠে যায়। মূলত বেড়িবাঁধের বউর এলাকা থেকে শুরু হয় অপরাধীদের অভয়ারণ্য। মিরপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত চলাচলকারী সিয়াম পরিবহনের হেল্পার সেলিম বলেন, এ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই পচা লাশের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক সময় দেখি পড়ে থাকা লাশ ঘিরে মানুষের ভিড়। বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে থাকা বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির সাইনবোর্ডটির আশপাশে গরু চরাতে আসেন বৃদ্ধ আহাদ আলী। তিনি বলেন, আমি এক মাসে ৩টি লাশ দেখেছি। লাশগুলো কয়েকদিন পড়েছিল। কাকে-চিলে খেয়েছে। আধাখাওয়া লাশ পরে নিয়ে যায় পুলিশ। বেড়িবাঁধের রুস্তমপুর এলাকার ভ্যানচালক কালাম বলেন, ১৫ দিন আগেও বাঁধের ঢালে একটা পুরুষ লাশ পড়েছিল। কয়েকদিন পড়ে থেকে পচন ধরেছিল লাশে। পরে রূপনগর থানা পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে। বাঁধের বিরুলিয়া এলাকার মুদি দোকানদার কাশেম বলেন, আমি সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে দোকান লাগিয়ে চলে যাই। সন্ধ্যার পর পরই অপরিচিত লোকজন এ এলাকায় আসতে শুরু করে। অনেকে আবার গাড়িতে করে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসে। তিনি বলেন, মাস খানেক আগে দোকান লাগিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ৩ জন লোক আমার কাছে এসে শরীরে পিস্তল ঠেকায়। তারা দুই হাজার টাকা চায়। আমার কাছে টাকা ছিল না। তখন তারা আমাকে দোকান খুলিয়ে ৫ প্যাকেট বেনসন সিগারেট নিয়েছে। ধউর চৌরাস্তা থেকে কিছুদূর এগোলেই কাশ্মিরী গার্ডেন। এ গার্ডেনের কেয়ারটেকার প্রভাস বলেন, আমরা সন্ধ্যার পর গার্ডেনের মেইন গেট লাগিয়ে দিই। মাঝে-মধ্যেই এ এলাকায় মানুষের লাশ পড়ে থাকার কথা শুনি। আবদুল্লাহপুর থেকে এগিয়ে গিয়ে মিরপুর ব্রিজের ৩/৪ কিলোমিটার আগেই গোড়ান চটবাড়ি ছায়ানীড় রেস্তরাঁ। রেস্তরাঁর গার্ড লুৎফর বলেন, সন্ধ্যার পর আমরা কেউ থাকি না। অনেক দিনই বেড়িবাঁধের আশপাশে গলা-পচা লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। বেড়ি বাঁধের শেষ প্রান্তে রূপনগর থানার চেকপোস্ট। সোমবার দুপুরে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন থানার এএসআই ফারুক। তিনি বলেন, মাঝে-মধ্যেই ২-১টা লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রাতে দু’টো পার্টি পালা করে এ এলাকায় ডিউটি করে। তারপরও অপরাধীরা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে।
বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী: বিমানবন্দর স্টেশন থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথের দু’ ধারে ঘন গাছের সারি, ঝোপ-ঝাড় আর মজে যাওয়া কচুরিপানায় ঢাকা ডোবা। গত ৬ মাসে এ রেলপথের আশপাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮টি অজ্ঞাত লাশ। রেলপথের এ অংশটুকু কিলিংজোন হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাওলা, বিমানবন্দর ও টঙ্গী রেলস্টেশনের অদূরে প্রায় খণ্ড বিখণ্ড লাশ পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকতে দেখে অনেক লাশ স্থানীয়রাই উদ্ধার করে দাফন করছেন। রেলওয়ে থানা পুলিশ অব্যাহত লাশ উদ্ধারের পেছনে ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আলাউদ্দীন বলেন, পশ্চিমে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পূর্বে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিশাল এলাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানার আওতাধীন। গত এক মাসে এ এলাকা থেকে ৩৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এগুলো পরিকল্পিতভাবে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের লাশ কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, হত্যার পর লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে দেয়ার ঘটনা বিরল নয়। চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে লাশ কয়েক টুকরা হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করা ব্যক্তি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন এমন ধারণা থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় অপমৃত্যুর মামলা হচ্ছে। নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলছেন, অপরাধীরা হত্যার পর সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে লাশ গুম করা নিয়ে। তিনি বলেন, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সেটির পরিচয় শনাক্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। লাশের ছবি তুলে পত্রিকায় দেয়া হয়। ছবি সংশ্লিষ্ট থানায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অজ্ঞাত লাশের ছবি সিআইডি’র গেজেটেও প্রকাশ করা হয়।
আতঙ্ক কামরাঙ্গীরচরে: এক গডফাদার আর পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ সন্ত্রাসী সক্রিয় কিলিংজোন কামরাঙ্গীরচরে। মা-ছেলে বা স্বামী-স্ত্রীও একসঙ্গে যোগ দিচ্ছে কিলিং মিশনে। থানা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে এখান থেকে ২৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ১৯টি। হত্যা মামলা ৫টি। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে- নাদিম আহমেদ, ইসমাইল হোসেন ভুট্টো, কবির, সুমন, সালাউদ্দিন, মোক্তার হোসেন ওরফে মুক্তা ওরফে গাঁজা মুক্তা, পালন, নাইন, সুরাইরা বেগম সুরি প্রমুখ। তাদের রয়েছে বেশ কিছু সহযোগী। কামরারঙ্গীরচরে তারা গড়ে তুলেছে কয়েকটি কিলিং স্পট। এসব স্পটের মধ্যে রয়েছে- ঝাউলাহাটি, মধ্য রসুলপুর, হুজুরপাড়া, শহীদনগর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা এবং লালবাগের শ্মশানঘাট। এছাড়া অন্য এলাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিরাপদ ভেবে সন্ত্রাসীরা এসব স্থানে লাশ রেখে যাচ্ছে। মাটিচাপা দিয়েও লাশ রাখা হচ্ছে। কয়েক মাস পর লাশ উদ্ধার হচ্ছে। লাশ ভেসে উঠছে নদীতেও। সর্বশেষ শনিবার রাতে হুজুরপাড়াস্থ বেলি রোডের হৃদয় বেকারির সামনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় সুমন (২৭) নামের এক যুবককে। স্কুলছাত্র কাওসার আহমেদ অপরণের ৩ মাস পর তার লাশ উদ্ধার করা হয় ঝাউলাহাটি থেকে। মুক্তিপণ নেয়ার পরও অপহরণকারীরা ফিরিয়ে দেয়নি কাওসারকে। কাওসারের মা তাসলিমা বেগম জানান ছেলেকে হারানোর নির্মম কাহিনী। তিনি বলেন, আমার ছেলে স্থানীয় সূচনা একাডেমির অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ১৬ই জুন বাসার সামনে থেকে অপহরণ করা হয় তাকে। লাশ উদ্ধার হয় ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে। তিনি জানান- এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সরাসরি জড়িত। কাওসারকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। রাত ২টায় হত্যা করে বাউন্ডারি দেয়ালের ভেতর একটি খোলা জায়গায় লাশ পুঁতে রাখে। থানা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৭শে এপ্রিল গভীর রাতে পূর্ব রসুলপুরের একটি বাসায় বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় জোবেদা খাতুন নামের এক গৃহবধূকে। ২৩শে মার্চ পূর্ব রসুলপুরের ১০ নম্বর গলিতে ফরিদ নামের একজনকে হত্যা করা হয়। শহীদনগর বেড়িবাঁধ এলাকার বিল্লাল হোসেন জানান, এখানকার নদীতে প্রায়ই ভেসে ওঠে লাশ। কিছুদিন আগে আমি নিজে একটি লাশ ভেসে উঠতে দেখে প্রথমে লালবাগ থানায় খবর দিই। লালবাগের পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তিনি জানান, নদীতে অনেক কচুরিপানা থাকায় লাশ দেখা যায় না। লাশ পচে দুর্গন্ধ তৈরি হলে বোঝা যায়। উৎকট গন্ধের কারণে তখন নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে চলাচল করতে হয়। তিনি জানান, শহীদনগর এলকার বিপরীতে থাকা চর এলাকা রাতের বেলায় অন্ধকার থাকে। এ কারণে সন্ত্রাসীরা সহজেই লাশ এনে ফেলে রেখে যেতে পারে। শ্মশানঘাট এলাকার বদরুল আলম জানান, এখানকার পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানীর কোথাও থেকে কেউ নিখোঁজ হলে এখানকার নদীতে এসে তারা লাশ খোঁজেন। কোন লাশ উদ্ধার হলে অনেক স্বজনরা এসে ভিড় জমান। তিনি জানান, নদীর স্রোতে প্রায়ই এ এলাকায় লাশ ভেসে আসে। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি একেএম নাসির উল্লাহ বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে-মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে।
অজ্ঞাত লাশ দাফনের হিসাব: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আন্জুমান মুফিদুল ইসলাম সর্বমোট ৬৫৯ টি অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করেছে। ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট এর ২ তারিখ পর্যন্ত মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে ৩৩টি লাশ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২৩৬টি অজ্ঞাত লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে এদের মধ্যে ১২টি ছিল অজ্ঞাত নবজাতকের লাশ। এছাড়া শাহবাগ থানা থেকে ২টি, ডেমরা থানা থেকে ৩টি, খিলক্ষেত থানা থেকে ১টি, তেজগাঁও থানা থেকে ২টি, উত্তরা মডেল থানা থেকে ১টি, বিমানবন্দর থানা থেকে ১টি, মতিঝিল থানা থেকে ১টি, বনানী থানা থেকে ১টি, শাহজাহানপুর থানা থেকে ১টি, মুগদা থানা থেকে ৮টি, কাঁচপুর থেকে ১টি ও বংশাল থেকে ১টি। বিভিন্ন থানা থেকে সর্বমোট ২৩টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ট্যানারি ও বুড়িগঙ্গা পয়েন্ট: সদ্য বিদেশফেরত রফিকুল ইসলাম। হাতে নগদ টাকার ছড়াছড়ি। তাই দেখে লোভ সামলাতে পারেনি স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। ওই টাকা হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশে কৌশলে নিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা নদী সংলগ্ন প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকায়। ছিনিয়ে নেয় নগদ লাখ খানেক টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। ঘটনা চাপা দিতে হত্যার পরিকল্পনা করে দুর্বৃত্তরা। তারা তিনজন মিলে রফিকের গলা চিপে ধরে। অচেতন রফিক লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ফেলে। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেয়া হয় বুড়িগঙ্গা নদীতে। রফিকের সেই বিচ্ছিন্ন মাথা আজও খুঁজে পায়নি তার স্বজনরা। শুধু রফিক নয়, সামপ্রতিক সময়ে নির্জন ওই ট্যানারি এলাকা ও পাশের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অন্তত ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওইসব লাশের পরিচয় মেলেনি। গতকাল সাভার থানাধীন ওই প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকা সরজমিনে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে মাইলের পর মাইল ধূধূ প্রান্তর। ঘন কাশবনের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় পিচ ঢালা রাস্তা। পাঁচ গজ দূরের মানুষের অস্তিত্ব বোঝাও মুশকিল। হঠাৎ ঝোপের মধ্যে দেখা মেলে নেশাখোরদের জমাট আড্ডা। ক্যামেরার ফ্ল্যাশগান ঝলকে উঠতেই দৌড়ে পালায় তারা। এলাকাবাসী জানান, একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রস্তাবিত ট্যানারি এলাকা এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। দিনে-দুপুরে একা যেতে সাহস পান না অনেকেই। গত সপ্তাহে লঙ্কার চরের এক যুবককে অপহরণ করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। তারও মাস খানেক আগে অজ্ঞাত মহিলার লাশ ভেসেছিল প্রায় পাঁচ দিন। ঝাউচরের বাসিন্দা মিরাজ বলেন, পুলিশকে খবর দেয়া হলেও তারা উদ্ধার করেনি। লাশ উদ্ধার নিয়ে ঠেলাঠেলি করে সাভার, কেরানীগঞ্জ মডেল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। লাশ ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে যায়। তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার বলেন, ওই এলাকায় মাঝে-মধ্যেই লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এ কারণে ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ফল মেলেনি। এখানেই শেষ নয়। ময়লা স্্েরাতের বহমান বুড়িগঙ্গা নদীর আরও অন্তত ৮টি পয়েন্ট সন্ত্রাসীদের নিরাপদ কিলিং জোনে পরিণত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সুজন বেপারীর ঘাট, হাসনাবাদ ঘাট, লালকুঠি আলু ঘাট, পোস্তগোলা সেনানিবাস সংলগ্ন আশপাশের এলাকা, রফিক টাওয়ার, আগানগর ও তেলঘাট। এসব ঘাট সংলগ্ন নদীর পানিতে মাঝে-মধ্যেই অজ্ঞাত পুরুষ ও মহিলার লাশ ভেসে উঠছে। স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সহায়তায় লাশগুলো উদ্ধার করা হলেও তাদের পরিচয় মিলছে না। হত্যার পর কারও শরীর থেকে হাত-পা ও কারও মাথা বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার কারও চোখ উপড়ে এবং মুখ বিকৃত করে লাশ বস্তাবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রমতে, চলতি বছরের ৮ মাসে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৩১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগের পরিচয় মেলেনি। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী লাশের ডাম্পিং জোনে পরিণত হয়েছে। ময়লা আবর্জনার পাশাপাশি নানা ধরনের বিকৃত লাশের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীরা হত্যার পর নদীতে ফেলে দিয়ে লাশ গুমের চেষ্টা করে। ওই লাশ ভাসতে ভাসতে আমার থানা এলাকায় জড়ো হয়। গত ২৮শে জানুয়ারি হাসনাবাদ চৌধুরী কোল্ডস্টোরেজ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে ৩২ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়। ৫ই মার্চ উদ্ধার হয় ষাটোর্ধ্ব অজ্ঞাত মহিলার লাশ। পরের দিন ৬ই মার্চ উদ্ধার করা হয় ২৫-৩০ বছর বয়সী অজ্ঞাত যুবকের লাশ। ৭ই মার্চ পাওয়া যায় ৪২ বছর বয়সী অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ। ৯ই মার্চ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের নদী থেকে আনুমানিক ৪৮ বছর বয়সী অজ্ঞাত ব্যক্তির বিকৃত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এখন পর্যন্ত তার পরিচয় মেলেনি। ১৪ই মার্চ উদ্ধার হয় ২৮ বছর বয়সী অজ্ঞাত যুবকের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। এছাড়া ৫ই মে জাকির হোসেন নামে এক যুবককে হাত ও পা বেঁধে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে শুভাড্যা পশ্চিম পাড়া হারুন মিয়ার বালুমাঠে ফেলে পালিয়ে যায়। পরের দিন ৬ই মে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। একই রাতে এক গার্মেন্ট শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরের দিন কালীগঞ্জ আলীনগর এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪ঠা মে পানগাঁও কন্টিনেন্টাল পোর্ট এলাকার নদী থেকে ভাসমান মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। ১০ই মার্চ লালকুঠি আলুঘাট থেকে উদ্ধার হয় আসলাম শেখ ওরফে লিয়াকত নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ। ২৬শে এপ্রিল পোস্তাগোলা সেনানিবাস সংলগ্ন ঘাট থেকে ৩২ বছরের আরও এক অজ্ঞাত পুরুষের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এক কর্মকর্তা বলেন, এর বাইরে আরও ১০-১২টি লাশ পাওয়া গেছে। এসব লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।
মিরপুর বেড়িবাঁধ: মিরপুর বেড়িবাঁধের তুরাগ তালতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে চটবাড়ি ছায়ানীড় রেস্তরাঁ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার পথ ব্যবহৃত হচ্ছে কিলিংজোন হিসেবে। মিরপুর বেড়িবাঁধের এ এলাকাটি এখন নবগঠিত রূপনগর থানার আওতাধীন। গত ৬ মাসে এ এলাকা থেকে অন্তত ৬টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বেশির ভাগ লাশ ছিল ক্ষতবিক্ষত। দীর্ঘ এ পথের দু’পাশে নদী ভরাট করে তৈরি করা বালুচর আর ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে দেখা মেলে শুকিয়ে যাওয়া নদীর ক্ষীণ প্রবাহ। বিস্তীর্ণ এলাকায় কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেখা মেলে না। সন্ধ্যা নামলেই গা ছম ছম করা আবহ নেমে আসে। পেশাদার কিলার আর অপরাধীদের দখলে চলে যায় এ এলাকা। আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই বলছেন এ এলাকায় রাতে নজরদারি তেমন থাকে না। এখান থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে অজ্ঞাত পরিচয় মরদেহ। কোনটির মস্তক নেই। কোনটির দেহ থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করা। তুরাগ থানার ওসি এবিএম জিয়াউল করীম বলেন, এ এলাকায় মাঝে-মধ্যেই লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এলাকাটা কিছুটা অরক্ষিত হওয়ায় অপরাধীরা অন্য কোথাও খুন করার পর লাশ ফেলে যায় এখানে। তিনি বলেন, তুরাগের একটি বড় অংশ পল্লবী ও নবগঠিত রূপনগর থানায় পড়েছে। তুরাগ তালতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে জাহান সিএনজি ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত রাস্তায় রাত ৮টার মধ্যে পুলিশি টহল উঠে যায়। মূলত বেড়িবাঁধের বউর এলাকা থেকে শুরু হয় অপরাধীদের অভয়ারণ্য। মিরপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত চলাচলকারী সিয়াম পরিবহনের হেল্পার সেলিম বলেন, এ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই পচা লাশের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক সময় দেখি পড়ে থাকা লাশ ঘিরে মানুষের ভিড়। বেড়িবাঁধের কোল ঘেঁষে থাকা বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটির সাইনবোর্ডটির আশপাশে গরু চরাতে আসেন বৃদ্ধ আহাদ আলী। তিনি বলেন, আমি এক মাসে ৩টি লাশ দেখেছি। লাশগুলো কয়েকদিন পড়েছিল। কাকে-চিলে খেয়েছে। আধাখাওয়া লাশ পরে নিয়ে যায় পুলিশ। বেড়িবাঁধের রুস্তমপুর এলাকার ভ্যানচালক কালাম বলেন, ১৫ দিন আগেও বাঁধের ঢালে একটা পুরুষ লাশ পড়েছিল। কয়েকদিন পড়ে থেকে পচন ধরেছিল লাশে। পরে রূপনগর থানা পুলিশ লাশ নিয়ে গেছে। বাঁধের বিরুলিয়া এলাকার মুদি দোকানদার কাশেম বলেন, আমি সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে দোকান লাগিয়ে চলে যাই। সন্ধ্যার পর পরই অপরিচিত লোকজন এ এলাকায় আসতে শুরু করে। অনেকে আবার গাড়িতে করে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে আসে। তিনি বলেন, মাস খানেক আগে দোকান লাগিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ৩ জন লোক আমার কাছে এসে শরীরে পিস্তল ঠেকায়। তারা দুই হাজার টাকা চায়। আমার কাছে টাকা ছিল না। তখন তারা আমাকে দোকান খুলিয়ে ৫ প্যাকেট বেনসন সিগারেট নিয়েছে। ধউর চৌরাস্তা থেকে কিছুদূর এগোলেই কাশ্মিরী গার্ডেন। এ গার্ডেনের কেয়ারটেকার প্রভাস বলেন, আমরা সন্ধ্যার পর গার্ডেনের মেইন গেট লাগিয়ে দিই। মাঝে-মধ্যেই এ এলাকায় মানুষের লাশ পড়ে থাকার কথা শুনি। আবদুল্লাহপুর থেকে এগিয়ে গিয়ে মিরপুর ব্রিজের ৩/৪ কিলোমিটার আগেই গোড়ান চটবাড়ি ছায়ানীড় রেস্তরাঁ। রেস্তরাঁর গার্ড লুৎফর বলেন, সন্ধ্যার পর আমরা কেউ থাকি না। অনেক দিনই বেড়িবাঁধের আশপাশে গলা-পচা লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। বেড়ি বাঁধের শেষ প্রান্তে রূপনগর থানার চেকপোস্ট। সোমবার দুপুরে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন থানার এএসআই ফারুক। তিনি বলেন, মাঝে-মধ্যেই ২-১টা লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রাতে দু’টো পার্টি পালা করে এ এলাকায় ডিউটি করে। তারপরও অপরাধীরা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে।
বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী: বিমানবন্দর স্টেশন থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথের দু’ ধারে ঘন গাছের সারি, ঝোপ-ঝাড় আর মজে যাওয়া কচুরিপানায় ঢাকা ডোবা। গত ৬ মাসে এ রেলপথের আশপাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮টি অজ্ঞাত লাশ। রেলপথের এ অংশটুকু কিলিংজোন হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কাওলা, বিমানবন্দর ও টঙ্গী রেলস্টেশনের অদূরে প্রায় খণ্ড বিখণ্ড লাশ পাওয়া যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় পড়ে থাকতে দেখে অনেক লাশ স্থানীয়রাই উদ্ধার করে দাফন করছেন। রেলওয়ে থানা পুলিশ অব্যাহত লাশ উদ্ধারের পেছনে ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছে। কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি আলাউদ্দীন বলেন, পশ্চিমে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে পূর্বে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিশাল এলাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানার আওতাধীন। গত এক মাসে এ এলাকা থেকে ৩৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এগুলো পরিকল্পিতভাবে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের লাশ কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, হত্যার পর লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে দেয়ার ঘটনা বিরল নয়। চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে লাশ কয়েক টুকরা হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করা ব্যক্তি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন এমন ধারণা থেকে সংশ্লিষ্ট থানায় অপমৃত্যুর মামলা হচ্ছে। নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকছে দিনের পর দিন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলছেন, অপরাধীরা হত্যার পর সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে লাশ গুম করা নিয়ে। তিনি বলেন, অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সেটির পরিচয় শনাক্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। লাশের ছবি তুলে পত্রিকায় দেয়া হয়। ছবি সংশ্লিষ্ট থানায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অজ্ঞাত লাশের ছবি সিআইডি’র গেজেটেও প্রকাশ করা হয়।
আতঙ্ক কামরাঙ্গীরচরে: এক গডফাদার আর পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড ১৫ সন্ত্রাসী সক্রিয় কিলিংজোন কামরাঙ্গীরচরে। মা-ছেলে বা স্বামী-স্ত্রীও একসঙ্গে যোগ দিচ্ছে কিলিং মিশনে। থানা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে এখান থেকে ২৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ১৯টি। হত্যা মামলা ৫টি। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে- নাদিম আহমেদ, ইসমাইল হোসেন ভুট্টো, কবির, সুমন, সালাউদ্দিন, মোক্তার হোসেন ওরফে মুক্তা ওরফে গাঁজা মুক্তা, পালন, নাইন, সুরাইরা বেগম সুরি প্রমুখ। তাদের রয়েছে বেশ কিছু সহযোগী। কামরারঙ্গীরচরে তারা গড়ে তুলেছে কয়েকটি কিলিং স্পট। এসব স্পটের মধ্যে রয়েছে- ঝাউলাহাটি, মধ্য রসুলপুর, হুজুরপাড়া, শহীদনগর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা এবং লালবাগের শ্মশানঘাট। এছাড়া অন্য এলাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিরাপদ ভেবে সন্ত্রাসীরা এসব স্থানে লাশ রেখে যাচ্ছে। মাটিচাপা দিয়েও লাশ রাখা হচ্ছে। কয়েক মাস পর লাশ উদ্ধার হচ্ছে। লাশ ভেসে উঠছে নদীতেও। সর্বশেষ শনিবার রাতে হুজুরপাড়াস্থ বেলি রোডের হৃদয় বেকারির সামনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় সুমন (২৭) নামের এক যুবককে। স্কুলছাত্র কাওসার আহমেদ অপরণের ৩ মাস পর তার লাশ উদ্ধার করা হয় ঝাউলাহাটি থেকে। মুক্তিপণ নেয়ার পরও অপহরণকারীরা ফিরিয়ে দেয়নি কাওসারকে। কাওসারের মা তাসলিমা বেগম জানান ছেলেকে হারানোর নির্মম কাহিনী। তিনি বলেন, আমার ছেলে স্থানীয় সূচনা একাডেমির অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ১৬ই জুন বাসার সামনে থেকে অপহরণ করা হয় তাকে। লাশ উদ্ধার হয় ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে। তিনি জানান- এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সরাসরি জড়িত। কাওসারকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। রাত ২টায় হত্যা করে বাউন্ডারি দেয়ালের ভেতর একটি খোলা জায়গায় লাশ পুঁতে রাখে। থানা পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২৭শে এপ্রিল গভীর রাতে পূর্ব রসুলপুরের একটি বাসায় বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয় জোবেদা খাতুন নামের এক গৃহবধূকে। ২৩শে মার্চ পূর্ব রসুলপুরের ১০ নম্বর গলিতে ফরিদ নামের একজনকে হত্যা করা হয়। শহীদনগর বেড়িবাঁধ এলাকার বিল্লাল হোসেন জানান, এখানকার নদীতে প্রায়ই ভেসে ওঠে লাশ। কিছুদিন আগে আমি নিজে একটি লাশ ভেসে উঠতে দেখে প্রথমে লালবাগ থানায় খবর দিই। লালবাগের পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তিনি জানান, নদীতে অনেক কচুরিপানা থাকায় লাশ দেখা যায় না। লাশ পচে দুর্গন্ধ তৈরি হলে বোঝা যায়। উৎকট গন্ধের কারণে তখন নাকে-মুখে কাপড় গুঁজে চলাচল করতে হয়। তিনি জানান, শহীদনগর এলকার বিপরীতে থাকা চর এলাকা রাতের বেলায় অন্ধকার থাকে। এ কারণে সন্ত্রাসীরা সহজেই লাশ এনে ফেলে রেখে যেতে পারে। শ্মশানঘাট এলাকার বদরুল আলম জানান, এখানকার পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানীর কোথাও থেকে কেউ নিখোঁজ হলে এখানকার নদীতে এসে তারা লাশ খোঁজেন। কোন লাশ উদ্ধার হলে অনেক স্বজনরা এসে ভিড় জমান। তিনি জানান, নদীর স্রোতে প্রায়ই এ এলাকায় লাশ ভেসে আসে। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি একেএম নাসির উল্লাহ বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে-মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে।
অজ্ঞাত লাশ দাফনের হিসাব: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আন্জুমান মুফিদুল ইসলাম সর্বমোট ৬৫৯ টি অজ্ঞাতনামা লাশ দাফন করেছে। ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট এর ২ তারিখ পর্যন্ত মিডফোর্ড হাসপাতাল থেকে ৩৩টি লাশ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২৩৬টি অজ্ঞাত লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে এদের মধ্যে ১২টি ছিল অজ্ঞাত নবজাতকের লাশ। এছাড়া শাহবাগ থানা থেকে ২টি, ডেমরা থানা থেকে ৩টি, খিলক্ষেত থানা থেকে ১টি, তেজগাঁও থানা থেকে ২টি, উত্তরা মডেল থানা থেকে ১টি, বিমানবন্দর থানা থেকে ১টি, মতিঝিল থানা থেকে ১টি, বনানী থানা থেকে ১টি, শাহজাহানপুর থানা থেকে ১টি, মুগদা থানা থেকে ৮টি, কাঁচপুর থেকে ১টি ও বংশাল থেকে ১টি। বিভিন্ন থানা থেকে সর্বমোট ২৩টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন