বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৩

বিশাল বাজেট তবু অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক হচ্ছে


আওয়ামী মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রী লক্ষ হাজার কোটি টাকার নিচে কথা না বললেও এবং জাতীয় সংসদকে দিয়ে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল একটি বাজেট পেশ করিয়ে চমক সৃষ্টি করতে চাইলেও দেশ বাস্তবে কঠিন সমস্যার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনেই পবিত্র রমযান। আয়-রোজগার কমে যাওয়ার পাশাপাশি লাগামহীন মূল্যম্ফীতিতে অনেক আগেই মানুষের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। এরই পাশাপাশি সীমাহীন লোডশেডিং-এর কবলে পড়েছে জনগণ। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, রাজধানীসহ সব নগরী-মহানগরীতেও এখন লোডশেডিং হচ্ছে যখন-তখন। কোনো কোনো এলাকায় এমনকি ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। কোথাও কোথাও একনাগাড়ে ছয় থেকে আটঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে জনগণের। ওদিকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে অনেক উপলক্ষেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড করার দাবি জানানো হয়েছে। দেশে নাকি বর্তমানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে! সরকার একই সঙ্গে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ থাকছে। অন্যদিকে ভুক্তভোগীরা বলেছেন এবং একথা অনস্বীকার্যও যে, সরকারের দাবি সত্যের কিছুটা কাছাকাছি হলেও এভাবে সীমাছাড়ানো লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া পর্যায়ক্রমে সরকার বিদ্যুতের দামও যথেষ্টই বাড়িয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের খাতে বছরে ২২ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়ার দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানোর ফলে গ্রাহকদের আটশ-এক হাজার টাকার স্থলে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সংকট থেকে রেহাই তো মেলেইনি, উপরন্তু নিয়মিত লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা মানুষকে দিশেহারা করে ফেলেছে। ওদিকে সরকারের ঘুষ-দুর্নীতি এবং ভুল নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে বৈদেশিক ঋণই শুধু বাতিল বা স্থগিত হয়ে যায়নি, প্রতিশ্রুত অনেক সহায়তাও পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার নিজেই বল্গাহীনভাবে ঋণ নেয়ায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে শিল্পখাত ধসের মুখে পড়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে কর্মসংস্থান। একযোগে কমে চলেছে রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স। চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞদের অভিমত উদ্ধৃত করে বিভিন্ন দৈনিকের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সব মিলিয়েই মারাত্মক মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এখনও গলার স্বর নামিয়ে আনার নাম করছেন না। যেমন সর্বশেষ এক অনুষ্ঠানেও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তারা নাকি সাত শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করবেনই!

অর্থমন্ত্রী যা কিছুই বোঝাতে চান না কেন, প্রাত্যহিক জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার আলোকে কিন্তু না মেনে উপায় নেই যে, দেশ আসলেও চরম মন্দার কবলে পড়েছে। মুহিত সাহেবরা বিশ^মন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মতো কিছু গৎবাঁধা কারণের দোহাই দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করতেই পারেন, অন্যদিকে প্রমাণিত সত্য হলো, ঘুষ-দুর্নীতির পাশাপাশি দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে বিপুল অপব্যয়সহ সামগ্রিকভাবে সরকারের অব্যবস্থাপনাই অর্থনৈতিক মন্দাকে অনিবার্য করেছে। যেমন ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল সরকারের প্রথম বছরেই। শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং আমদানি-রফতানিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার তখন ধুম পড়ে গিয়েছিল। এই ঋণ নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, যাদের খুব কমসংখ্যকই অর্থ ফেরৎ দিয়েছেন। ফেরৎ না দেয়ার কারণ, ঋণের টাকা মোটেও শিল্পায়নের কাজে লাগানো হয়নি। এর ফলে ব্যাংকগুলোই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, দেশের শিল্প-বাণিজ্যের খাতটিও স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই সাথে কর্মসংস্থানও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দলীয় লোকজনের পকেট ভারি করার জন্য প্রকল্প তৈরি করায় উন্নয়ন খাতে বিপুল অপব্যয়ের ছড়াছড়ি দেখা গেছে, যার কুফলও ব্যাংকগুলোকেই সইতে হয়েছে। সে অবস্থাই এখনও চলছে।

এরপর এসেছে সরকারের ঋণ নেয়ার পালা। এবছরও দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার একাই ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ঋণ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এভাবে ঋণ তারা প্রথম অর্থবছর থেকেই নিচ্ছেন। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে মুহিত সাহেবরা সীমা তো ছাড়িয়েছেনই, রেকর্ডও করে ফেলেছেন। ঋণের সুদও সরকারকে যথেষ্টই গুণতে হয়েছে। এদিকে সরকার একাই ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়ার ফলে ব্যাংকগুলো তো বিপন্ন হচ্ছে এবং হতে থাকবেই, দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক বিপর্যয়ের অতলে হারিয়ে যাবে। সরকারকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিতে হচ্ছে বলে ব্যাংকগুলোকে উচ্চ হারে সুদের বিনিময়ে কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। একই কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়া কমানো ছাড়া ব্যাংকগুলোর সামনে পথ থাকেনি। এই নীতি-সিদ্ধান্তের প্রধান শিকার হয়েছেন সৎ ও প্রকৃত শিল্পপতি এবং আমদানিকারক ও রফতানিকারকসহ ব্যবসায়ীরা।

এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের পাশাপাশি রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করা গেলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারতো। কিন্তু সে সম্ভাবনাও সরকারই নস্যাৎ করেছে। ক্ষমতাসীনদের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে বিশ^ব্যাংক ও আইএমএফসহ দাতাগোষ্ঠী ঋণ ও সাহায্য দেয়া প্রায় বন্ধ করেছে। বৈদেশিক সহায়তাও কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পেছনেও রয়েছে সরকারের ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর পররাষ্ট্রনীতি। সর্বতোভাবে একদেশমুখী হয়ে পড়ায় এবং দেশের ভেতরে মুসলমান ও ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ায় মুসলিম দেশসহ বিদেশে বাংলাদেশীদের চাকরির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। ফলে রেমিট্যান্সও অনেক কমে এসেছে। ওদিকে গার্মেন্ট খাতের অবস্থাও  সব মিলিয়ে শোচনীয়। এজন্যই বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে তামাশা করার পরিবর্তে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠা এবং জনগণের আয়-রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করা। না হলে অল্প সময়ের মধ্যে অন্ধকার দেখতে হতে পারে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads