বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৩

আওয়ামী লীগ ইতিহাসের করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে


সরকারের অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক ও ফ্যাসিবাদী আচরণে বাংলাদেশ আজ গভীর সংকটে নিপতিত। দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি হুমকির সম্মুখীন। সরকারের অসহিষ্ণু আক্রমণাত্মক ও উস্কানিমূলক ভূমিকায় রাজনৈতিক ময়দানে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা। দেশের উৎপাদন সেক্টরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র, জাতিসত্তা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং গণতন্ত্রায়নে রাজনৈতিক লক্ষ্য এখন চরমভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর একগুঁয়েমিতা, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার মনোবৃত্তি আমাদের জাতীয় জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ভাগ্য বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে সচেতন মহলে রয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। সব কিছুর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
গণতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সভা-সমাবেশ করার অধিকার অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সংবিধানে এসব অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার একের পর এক সংবিধানে বর্ণিত অধিকার কেড়ে নিয়েছে। সরকার কার্যত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ৫৪ মাসের শাসনামলে সরকার বিরোধী দলকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। বৃহৎ ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয়, মহানগরী ও অধিকাংশ জেলার কার্যালয়সমূহ প্রায় ২২ মাস যাবৎ বন্ধ করে রেখেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১ জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তল্লাশির নামে ব্যাপক ভাংচুর করা হয়। অফিসের মূল্যবান কাগজপত্র, আসবাবপত্র, কম্পিউটার ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র তছনছ করা হয়। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ.টি.এম আজহারুল ইসলাম, প্রচার সম্পাদক অধ্যাপক তাসনীম আলম ও অফিসের কর্মচারীসহ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ.টি.এম আজহার ও অধ্যাপক তাসনীম আলমকে ডা-াবেড়ী পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ডে নিয়ে এ.টি.এম আজহারের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কর্মপরিষদের অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
এ সরকারের শাসনামলে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের প্রায় ৪৩ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৬ হাজার। আসামী সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে প্রায় ৫ সহস্রাধিক। পুলিশী নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে গেছে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৪ শতাধিক। তন্মধ্যে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলী করায় ৪ জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে এ ধরনের নির্যাতন নজিরবিহীন ঘটনা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তল্লাশির নামে তা-বতা চালানো হয়েছে। বোমা উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে ১৫৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে দেশবাসী এ দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়েছেন। রাজপথে দমন-পীড়ন চালিয়ে এবং গ্রেফতার করে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের কারাগারে অন্যায়ভাবে আটক করে রেখেছে। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে ডা-াবেড়ী পরিয়ে তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে কলঙ্কিত করেছে।
সরকারের সীমাহীন বাড়াবাড়ি অসহিষ্ণুতা ও একগুঁয়েমি আচরণের জন্য সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদই হচ্ছে সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দু। সেই সংসদ আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিরোধী দলকে সংখ্যার আলোকে বিবেচনা করা হবে না। কিন্তু কার্যত: সরকারি দলের সংখ্যাধিক্যের জোরে সংসদ পরিচালিত হয়েছে। জনগণের মতামতকে অবজ্ঞা করে জনপ্রত্যাশার বিরুদ্ধে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ফলে দেশ আজ এক ভয়াবহ সংকটে নিমজ্জিত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকার কথায় কথায় নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলেন। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন কোন ক্ষেত্রে অনির্বাচিত ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। মন্ত্রীর পদমর্যাদায় অনির্বাচিত ব্যক্তিগণ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদের নব নির্বাচিত স্পীকার একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি। তিনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হননি। সংরক্ষিত মহিলা আসনে দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ লাভ করেছেন। তিনি আজ জাতীয় সংসদের স্পিকার। এসব ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কথা ও কাজে বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে। আওয়ামী লীগ চায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসতে। নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা প্রদান না করার বাহানা অবলম্বন করেছে মাত্র।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করে চলমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি। ১৯৯১ সালে সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কনসেপ্টের ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐ নির্বাচন ছিল স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। দেশে বিদেশে এ নির্বাচন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিল। যদি এটাকে অনির্বাচিত সরকার ধরা হয় তাহলে আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের মুখে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করার বক্তব্য মানায় না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে কোন নির্বাচনই নিরপেক্ষ হয়নি। ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালটবক্স ছিনতাই, প্রতিপক্ষের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে ও জালভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল আবারো ক্ষমতায় এসেছে। এদেশে যে কয়টি নির্বাচন নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অবাধ হয়েছে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলে আওয়ামী লীগ নিজ দলের অধীনে নির্বাচন স্বচ্ছ হওয়ার যে দৃষ্টান্ত দেয়ার চেষ্টা করে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতার পরিবর্তন হয় না। ক্ষমতার পরিবর্তন হয় সংসদ নির্বাচনে। তাই এ নির্বাচন স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। নিরপেক্ষ, অবাধ, স্বচ্ছ নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। কেবলমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। তাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহাল অপরিহার্য।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার।
পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলসমূহ, দেশের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও সুশীল সমাজের মতামত নেয়া হয়েছিল। সকলেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মামলায় এমিকাস কিউরিদের মতামত গ্রহণ করেছিলেন। প্রকাশ্য আদালতে প্রায় সকল এমিকাস কিউরিগণ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রের এটর্নি জেনারেলও কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামতের ভিত্তিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পূর্বেই আওয়ামী লীগ সরকার তড়িঘড়ি করে আদালতের রায়ের কথা বলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। আজকের রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সূচনা এখান থেকেই।
দেশের অধিকাংশ মানুষ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার জনমত জরিপে দেখা যায় শতকরা ৯০ ভাগ লোক কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পক্ষে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত বলে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে পুনর্বহালের দাবি উপেক্ষা করে আসছে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এমনকি আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয় দেখা দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তব্য ও দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক বক্তব্য জনগণের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। নির্বাচন না করে ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতায় থাকার অবাঞ্ছিত কৌশলের গন্ধ পাওয়া যায় তাদের বক্তব্যে।
দেশের ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ সমঝোতায় আসার জন্য সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল রাজনৈতিক সংকটের গভীরতা উপলব্ধি করে এ সমস্যা নিরসনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের সাথে আলাপ আলোচনা করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বহুমাত্রিক অমীমাংসিত ইস্যু থাকলেও সরকার ও বিরোধী জোটের সংলাপ ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সকলের জন্য অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই মূল সংকটের আপাতত শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য নিজেদের পছন্দের লোকদের দ্বারা  প্রশাসন সাজানো হয়েছে। বিরোধী দল যাতে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে সে জন্য সরকার মামলা, হামলা, গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এই নির্যাতনে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণও রেহাই পাচ্ছেন না। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে রিমান্ডে নির্মম অত্যাচার, নির্যাতনে মরণাপন্ন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিনি আইসিইউতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজও তিনি সুস্থ হয়ে উঠেননি।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলাওয়ার হোসেনকে একটানা ৫৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে তার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় দেশের মনুষ দেখেছে অচেতন অবস্থায় পাঁজাকোলা করে তাকে আদালতে হাজির করে আবারো রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। শিবিরের ৮ জন নেতাকে গুম করা হয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য হলো বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। তাদেরকে কোণঠাসা অবস্থায় রাখা। যাতে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারে। তাদের টার্গেট নিজ দলের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা। বিরোধী দল ঘোষণা দিয়েছে কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না, নির্বাচনও হতে দিবে না। এ অবস্থায় সময় থাকতে সমাধান না হলে দেশ এক ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন হবে। ক্ষমতার জোরে সরকার একদলীয় নির্বাচনের পথ বেছে নিলে তা হবে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বিরোধী দলবিহীন কোন নির্বাচন পৃথিবীর কোন দেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, বাংলাদেশেও পাবে না। এমনকি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একদলীয় নির্বাচন করাও সম্ভব হবে না।
সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে দেশের মানুষ আজ বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। যার কিঞ্চিৎ নমুনা ৪ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনগণ রেখেছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল তার একটিও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিশেষ করে তেল, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, জনদুর্ভোগ লাঘব, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঘরে ঘরে চাকুরি প্রদান ও বিনামূল্যে সার প্রদানের কোন ঘোষণাই বাস্তবায়িত হয়নি। আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাস, পুলিশ বাহিনীকে দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য, ডেসটিনি-হলমার্ক-শেয়ারমার্কেট-পদ্মাসেতু কেলেঙ্কারী, সীমাহীন দুর্নীতিসহ সর্বত্র নৈরাজ্য সৃষ্টি আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
ইসলামী মূল্যবোধের উপর আঘাত, আল্লাহ, রাসূল (সাঃ), কোরআন, নামাজ ও হজ্জ সম্পর্কে কটাক্ষকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, দেশের সম্মানিত আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের উপর হামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, ৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যাসহ সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকা- জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তালা লাগানো, ৩ শতাধিক মসজিদে সরকারি নজরদারী বসানো, ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের উপর হামলা, মামলা, আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করে তুলেছে। এসব কর্মকা-ের কারণে আওয়ামী লীগ ইসলাম ও মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ ও চেতনার বিপক্ষে অবস্থানকারী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর ফল আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অবশ্যই ভোগ করতে হবে।
দলীয়করণের অসৎ মনোবৃত্তি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগুলোকে বিধ্বস্ত করেছে। রাষ্ট্রের সব ধরনের আইন-শৃংখলা বাহিনীকে জনগণের কাছে বিতর্কিত ও আস্থার সংকট তৈরীর ন্যক্কারজনক ভূমিকাও পালন করেছে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকার।
পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনীর মত ব্যবহার করে যে গণগ্রেফতার, গণনির্যাতন ও গণহত্যা চালানো হয়েছে তার মাশুলও আওয়ামী লীগকে দিতে হবে। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর কোরআন প্রেমিক সৈনিকগণ রাজপথে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ জানিয়েছিল তা নিশ্চিহ্ন করতে সরকার পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে যে গণহত্যা চালিয়েছে তা জনগণ কখনো ভুলে যেতে পারে না। প্রায় ৪০টি জেলায় পরিচালিত এ গণহত্যায় ২৩১ জন মানুষ জীবন দিয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে শত শত। পুলিশ আন্দোলন দমনের নামে গণগ্রেফতার চালাতে গিয়ে গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। কোন কোন স্থানে পুলিশকে জনগণের নিকট ক্ষমা চেয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। নির্বাচনের সময় এসব এলাকায় এক বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষে জনতার এ প্রতিরোধ মোকাবিলা করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। এসব কারণে আওয়ামী লীগ স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অধিকাংশ আসনে তাদের জামানত হারাতে হবে। এ জন্য যেকোন উপায়েই হোক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে।
সংবাদপত্র বন্ধ, টিভি চ্যানেল বন্ধ ও সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার সাময়িকভাবে আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও এর সুদূর প্রসারী ফল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাবে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ও সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মানুষ মুহূর্তের মধ্যেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সংবাদ আদান প্রদানের যে সুযোগ লাভ করেছে তাতে টিভি চ্যানেল এবং সংবাদ পত্র বন্ধ করেও সরকারের কোন লাভ হবে না। বরং সরকার গণতন্ত্র হত্যাকারী ও সংবিধান লংঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। সরকারের এ অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার ১৫ সম্পাদক এক বিবৃতির মাধ্যমে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দলনের প্রতিবাদ জানিয়ে বন্ধ টিভি চ্যানেলসমূহ খুলে দেয়ার দাবী জানান। সম্পাদকদের এই বিবৃতি সরকারের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী যে ভাষায় সম্পাদকদের তিরস্কৃত করেছেন এবং আটক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানের পক্ষে উকালতি না করার পরামর্শ দিয়েছেন তাতে তার দাম্ভিকতার প্রকাশ ঘটেছে। জনগণ এসব বিবেচনায় নিবে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করে, জনগণের সভা-সমাবেশের অধিকার কেড়ে নিয়ে, জোর করে জনগণের উপর ক্ষমতার বাহাদুরী কখনো সুফল বয়ে আনে না। স্বৈরাচারের শেষ পরিণতি হচ্ছে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে পরাজয়। আওয়ামী লীগ সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে।
সরকার সংলাপের কথা বলে যে ধোকাবাজী ও প্রতারণার খেলা খেলে সময় পার করেছে তার জন্য তাদেরকে পস্তাতে হবে। রাষ্ট্রের পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার যে উন্মত্ততা সরকারকে পেয়ে বসেছে তাও তাদের জন্য বুমেরাং হবে। আসল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহায় রাজনৈতিক নেতাদেরকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় জড়িয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে যেসব রায় ঘোষণা করা হচ্ছে তা সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে। বিশেষ করে আল্লামা সাঈদীর মামলায় সাক্ষী দিতে আসা সুখরঞ্জন বালীকে আদালতের দরজা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। সেই মামলায় ঐ অভিযোগে সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া এবং পরবর্তীতে সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান লাভ ও তার সাক্ষাৎকার পত্রিকায় প্রকাশ এ বিচার প্রক্রিয়াকে এবং সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়কে আরো প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করেছে। ষড়যন্ত্র করে একজন আলেমে দ্বীনকে বিচারের নামে হত্যার চক্রান্ত জনগণ বুঝতে পেরেছে। সাঈদীর বিরুদ্ধে সরকারের যেকোন ষড়যন্ত্র সরকারের পতনকে নিশ্চিত করবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ এদেশের এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গণহত্যা চালিয়েছে, জনগণ অবশ্যই তার বিচার চায়। বিচারের নামে কেউ অবিচারের শিকার হোক তা কারো প্রত্যাশা নয়। বিচার হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে রাজনৈতিক নেতাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। যাদেরকে আজ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তারা বিগত ৪২ বছর এদেশের মুক্ত পরিবেশে জনগণের মাঝে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন দুর্নীতির গন্ধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। জাতি এসব নেতৃবৃন্দের ত্যাগ ও কোরবানীর মূল্যায়ন অবশ্যই করবে। যারা ভেবেছেন, মিডিয়ায় ঝড় তুলে, তিলকে তাল বানিয়ে, নিরপরাধ মানুষগুলোকে অপরাধী সাব্যস্ত করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করবেন- তাদের ভেবে দেখা দরকার ইতিহাস সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবেই চিহ্নিত করবে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার শাহাদাতের পর মানুষ বুঝতে পেরেছিল, তার বিরুদ্ধে আনীত অপবাদ ছিল এক নির্লজ্জ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। আজ জাতীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের যে নাটক আওয়ামী লীগ মঞ্চস্থ করছে তা একদিন অবশ্যই উন্মোচিত হবে। সেদিন জাতি ষড়যন্ত্রের শিকড় ও গভীরতা জানতে পারবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে এ ষড়যন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগকে ইতিহাসের করুণ পরিণতি বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads