আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিয়ে আশঙ্কা বুঝি আর কাটল না। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহল এ নিয়ে অব্যাহতভাবে তাদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছে। কিন্তু নির্বিকার দেশের সরকার। চলতি বছরের শেষের দিকে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গত ১৮ জুন যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলেছেÑ আন্দোলন ও সহিংসতা এ নির্বাচনকে ব্যাহত করতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো সমঝোতা না হওয়ায় এই আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আর ৪২ বছর আগে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল দেশটির বিভাজিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে দুই মেরুর দিকে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজগুলো ‘সম্পূর্ণ সঠিক পথে রয়েছে’। আর ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের বিচার থেকে জাতিকে এর আগে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল এখন সে বিচার করছে। তবে গার্ডিয়ানের মতে, অনেক বিষয়ই এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গার্ডিয়ানের মতে, এখানে তিনটি বিষয় এখন গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছেÑ ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা, চলমান যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও দেশের বিভক্ত রাজনীতির কারণে আস্থা হারানো তরুণ ভোটারদের সাম্প্রতিক আন্দোলন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ‘তথাকথিত ট্রাইব্যুনাল’ উল্লেখ করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ট্রাইব্যুনালের বিবাদীদের বেশির ভাগই জামায়াতের নেতা হওয়ায় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিযোগ রয়েছে, যদিও সরকার তা অস্বীকার করছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের সার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অমীমাংসিত বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান। গত ২৭ জুন বাজেট অধিবেশনে সংসদে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে সরকারদলীয় সদস্যরা বিরোধী দলকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। সংসদে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বিরোধী দলের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের প্রশ্নই ওঠে না। আগামী নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে। কারণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অপর দিকে ওই দিন বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়। তারা বলেন, এ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা ’৯৬ ও ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এখন কেন তিনি এর বিরোধিতা করছেন। বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার বক্তব্যে বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মৌলিক কাঠামো সংবিধানে যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকতে পারে। এখানে কোনো নতুন প্রস্তাব বা রূপরেখা বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দেয়া হবে না। তবে প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই যখন অবস্থা, তখন গার্ডিয়ানের নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সহিংসতার আশঙ্কা অমূলক বলা যাবে না। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে সামনে এসেছে বেশ কিছু বিবেচ্য।
চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব ক’টিতে সরকারি দল পরাজিত হয়ে এখন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা একটি নতুন কোরাস গাইতে শুরু করেছে। এরা বলছেনÑ এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলেই বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পেরেছেন। অতএব আগামী সংসদ নির্বাচনও এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবির আর কোনো প্রয়োজন নেই। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হলেই যদি এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়, তবে ১৯৯১-৯৬ সালে যখন বিএনপি সরকারের আমলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন, তখন বিএনপি সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নিরপেক্ষ হবে নাÑ আওয়ামী লীগের সে দাবির কী যৌক্তিকতা ছিল? আওয়ামী লীগের বেলায় যা সত্য, বিএনপির বেলায় তা মিথ্যা হবে কেন? তবে কেন তখন ১৭৬ ঘণ্টা ধর্মঘট আর ১৭৩ দিন হরতাল দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বিএনপিকে বাধ্য করা হলো।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় সরকারদলীয় নেতানেত্রীদের বোধগম্য হওয়ার কথাÑ বাস্তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে এক পাল্লায় মাপা যাবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব পদে বিরোধী দল জয়ী হলেও সরকারের পতন হবে না। অপর দিকে জাতীয় নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে সরকারে থাকা না থাকার বিষয়টি। ফলে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে ব্যবহার করে জয় নিশ্চিত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পেশিশক্তি ও অস্ত্রশক্তি ব্যবহার করে চলে ভোট চুরি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, মারামারি, ধরাধরি ইত্যাদি সবই চলে জান বাজি রেখে। বিরোধী দল সে সুযোগ পায় না। এ ছাড়া আরো অনেক কারণেই এটি বলা যাবে নাÑ চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্তমান সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু হয়েছে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এ সরকার ও এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু হবে।
এবার চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীরা জয়ী বলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে, সে দাবিই বা কতটুকু যৌক্তিক? বলা দরকার, বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে এ নির্বাচনী লড়াই লড়তে পারেননি। পারলে ভোটের ব্যবধান নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক বাড়ত। তেমনটিই একটি জাতীয় দৈনিকের জরিপে দেখানো হয়েছিল। এখানে শুধু একটি অভাবনীয় জনজোয়ারই তাদের জয় নিশ্চিত করেছে, যা ঠেকানো সরকারি দলের পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব হয়নি। তাই বলে ঠোকানোর চেষ্টা হয়নি, নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেয়ার কোনো চেষ্টাই সরকারি দলের লোকেরা করেনি, তা নয়। সরকারি প্রভাব বলয়ে থেকেই একটি চরম প্রতিকূল অবস্থায় বিরোধী দলের প্রার্থীদের এ নির্বাচনী লড়াইয়ে লড়তে হয়েছে। তাদের লড়তে হয়েছে এমন এক দলীয় সরকারের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে, যে সরকার বিগত সাড়ে চার বছর ধরে অব্যাহতভাবে বিরোধী দল দমনে চরম অসহিষ্ণু আচরণ করেছে। তাদের অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাদ-প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামতে দেয়া হয়নি। অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। ভিন্ন মতের গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর জেল-জুলুম চলেছে অব্যাহতভাবে। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। হত্যা ও গুমের ঘটনা ঘটেছে। ফলে বিরোধী দলের প্রার্থীদের নেতাকর্মীহীন অবস্থায় নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়েছে, যেখানে সাধারণ ভোটারেরাই ছিলেন তাদের একমাত্র ভরসা। নির্বাচনের আগের রাতেও বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি তল্লাশি চলার অভিযোগ উঠেছে। সিলেটে পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ভোটের আগের রাতে হামলার শিকার হয়েছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খুলনায় ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার সময় দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পরে র্যাব এই ব্যালট বাক্স উদ্ধার করে। ১৮ দলীয় মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামালসহ একজন সাবেক সংসদ সদস্য ১৪ দলীয় প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। টেলিভিশনের পর্দায় তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। খুলনার খালিশপুরে ১৮ দলীয় প্রার্থী জয়ী হওয়ায় বিএনপির অফিস ভাঙচুর করেছে প্রতিপক্ষরা। রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরে র্যাবের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে ছাত্রলীগের। বরিশালের ১৮ কেন্দ্র থেকে ১৮ দলীয় পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই পড়েছি। সামনে গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের নির্বাচন/উপনির্বাচন। সেখানে এ ধরনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে প্রবলভাবে। সরকারের নীতি-সমর্থক একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়েছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধীদলীয় এক কাউন্সিলর প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি দেয়া হয়েছে। অতএব সদ্য সমাপ্ত চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে হয়েছেÑ এমন দাবির সুযোগও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হাতে নেই।
সরকারি দলের লোকেরা জোর দিয়ে বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের তথা শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হবেন। এরা হয়তো কঠোরহস্তে আন্দোলন দমনের সাফল্যের কথাটি মাথায় রেখেই এমনটি বলছেন। এরা বলছেন, আন্দোলন করে লাভ নেই। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন। এখন চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল দেখে সেদিক থেকে সরকারি দলের নেতানেত্রীরা একটু চুপসে গেছেন বলা যায়। এখন বলতে শোনা যায় না বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কারণ চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন জানান দিয়ে গেছে, কার্যত সরকারি দলই জনগণ থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমাদের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রায় প্রতিদিনই খালেদা জিয়াকে বলতেন, জামায়াতের সাথে থাকলে আপনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। অতএব জামায়াত ছাড়–ন। তিনি জামায়াত না ছাড়লে খালেদা জিয়াকে দেশ ছাড়া করার হুমকিও দিয়েছিলেন। এ হুমকি দেয়ার সময় তিনি একটুও ভাবেননি, খালেদা জিয়া এ দেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং এ পর্যন্ত যে ক’টি আসনে নির্বাচন করেছেন প্রতিটিতেই বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার রেকর্ড তার নেই। যে রেকর্ড গড়তে পারেননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সেই খালেদা জিয়াকে আমাদের তথ্যমন্ত্রী যখন বলেন খালেদা জিয়া জনবিচ্ছিন্ন, তখন তার ভাবা উচিত তাকে নৌকায় ওঠে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হয়। তার দল এককভাবে নির্বাচন করলে আজ এক শতাংশ ভোট পাবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগে। আর জামানত হারানোটা নিশ্চিত ব্যাপার।
সে যা-ই হোক, চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হেরে মনে হয় সরকারি দলের নেতারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন দল নয়, বরং এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। তাই হয়তো সরকারদলীয় এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওই দিন বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেছেনÑ ‘সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসুন। এ আলোচনা সংসদে বা সংসদের বাইরে যেকোনো স্থানে হতে পারে। যতই দিন যাচ্ছে, আলোচনার পথ সরু হয়ে যাচ্ছে। তাই আগামী অক্টোবরের আগেই আলোচনায় বসুন। আপনারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার না অন্তর্বর্তী সরকার চান, না কি সর্বদলীয় সরকার চান? অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে কিসের ভিত্তিতে নেয়া হবে? আপনারা কোন মন্ত্রণালয় চান? ক’জন চান? আসুন এসব বিষয়ে আলোচনা করি। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা নিয়েও আলোচনা হতে পারে।’ তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার বিরোধী দলকে এক ধরনের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেনÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টির অপচেষ্টা মেনে নেয়া হবে না। রোজ কেয়ামত পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারির কিংবা অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের আর কোনো সুযোগ নেই। বিরোধী দল নির্বাচন বয়কটের হুমকি দেয়। একইভাবে আওয়ামী লীগও যদি বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে না, তখন কী হবে? আওয়ামী লীগ নির্বাচন করল না, বিএনপিও নির্বাচন করল না। সংসদও নেই, তখন কী হবে? তখন রাষ্ট্রপতি যদি সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ নিয়ে বর্তমান সংসদকে পুনরুজ্জীবিত করেন, তখন বিরোদী দল কী করবে? জানি না আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারিয়ে নির্বাচন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো পথ খুঁজছে কি না? তা ছাড়া অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উচ্চারণ না করাই ভালো। কারণ তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই। কখনোই পেছনের দরজা দিয়ে আসেননি।
বিএনপি কেন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে? কারণ বিএনপি ভালো করেই জানে সরকার খোলাখুলিভাবে এই সাড়ে চার বছর প্রশাসনে যেভাবে চরম দলীয়করণ করেছে এবং চূড়ান্ত দলীয়করণের প্রক্রিয়া এখন বাস্তবায়নের পথে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের প্রশাসনে পদ-পদায়ন, পদোন্নতি-চাকরিচ্যুতি খবর প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। সত্যাশ্রয়ী যে কেউ স্বীকার করবেন বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন চালায়, তখন বিএনপি প্রশাসনে ততটা দলীয়করণ করেনি, আজকের আওয়ামী লীগ যতটা করেছে। তখন আওয়ামী লীগ প্রশাসন দলীয়করণ প্রশ্নে সে ধরনের অভিযোগও তোলেনি।
আজ বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সামনেই তো অব্যাহতভাবে চলছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসবাজিসহ নানা ধরনের দখলবাজি। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেও আছে খুনোখুনি। আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলে তা ব্যালট বাক্স দখলবাজি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে না, সে নিশ্চয়তাই বা কোথায় পায় বিএনপি।
আন্দাজ-অনুমান করা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে নামবে। এর কারণ, এরা জানে এই সাড়ে চার বছরে এরা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের যেভাবে দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হত্যা-গুম করেছে, ক্ষমতা হারালে বিএনপি তাদের ওপর সে ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন চালাবেÑ এমন একটা আশঙ্কা এদের মধ্যে কাজ করছে। এরা মনে করে, এর মাত্রা আরো বেড়ে গেলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। এ ধরনের একটি ভয় তাদের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর এই ভীতির মাত্রা তাদের মধ্যে আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। অতএব আগামী নির্বাচনে যে করেই হোক, তাদের জয়ী হওয়ার সর্বাত্মক বেপরোয়া প্রয়াস থাকবেই। সে প্রয়াসই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করতে পারে। গোটা নির্বাচনপ্রক্রিয়াই সহিংসতার শিকার হতে পারে। সে আশঙ্কাই বিভিন্ন মহল এখন করছে। তাই সাধারণ মানুষ চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে হোক আগামী নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না গিয়ে এতটা অনড় অবস্থান নেয়ার কারণ, দলটি জানতে পেরেছে তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে দলটির ভরাডুবি হবে। জামানত হারানো প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। চার দিকে নানাজন এমন কথাই বলছে। নানা জরিপে দলটির জনপ্রিয়তা মুখথুবড়ে পড়ার আভাসই দিচ্ছে। একটি বিদেশী সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, সাড়ে চার বছরে সরকারের জনপ্রিয়তা ২০ শতাংশ কমে গেছে। পাশাপাশি বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা আরো ৬ শতাংশ বেড়ে গেছে। ৮০ শতাংশ মানুষ বলছে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচন না হলে সঠিক জনমতের প্রতিফলন ঘটবে না, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না (মানবজমিন)। প্রথম আলোর জরিপ মতে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেছেন, শুধু দেশের সাধারণ মানুষই নয়, প্রকৃত আওয়ামী লীগের ৯৫ শতাংশ কর্মী-সমর্থকও দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তিনি বলেন, যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তবে আওয়ামী লীগ বাধ্য হবে প্রতিটি আসনে দলের পরীক্ষিত, ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতাদের নমিনেশন দিতে। একটি টেলিভিশন টকশোতে তিনি এ দাবি করেন (ইনকিলাব)। অন্যত্র তিনি দেশের সদ্য সমাপ্ত চার সিটি করপোরেশনে সরকারি দলের শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘জনগণের আদালতে যড়যন্ত্রের রাজনীতি ও অপকর্মের বিচার শুরু হয়ে গেছে। এ নির্বাচনে জনগণের মত ও ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটেছে।’
আওয়ামী লীগ নেত্রীকে বুঝতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল আজ এক জনদাবি। এ জনদাবি উপেক্ষা করলে আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতাই শুধু বাড়বে। কোনো কূটকৌশলই এখানে কাজে আসবে না। এই জনদাবি মেনে নিয়ে সরকারের উচিত হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছা। সেই সাথে সরকারের মেয়াদের বাকি ছয়টি মাস জনআস্থা ফিরিয়ে আনায় মনোযোগী হওয়া। দলীয় লোকদের লাগাম টেনে ধরা। দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি বাজিকরি বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে, দলের পক্ষ থেকে আন্তরিক পদক্ষেপ নেয়া। তবেই যদি হয় দল-মান-কুল রক্ষা। নইলে সামনে বিপর্যয় আর বিপর্যয়। কারণ জনরোষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেউ রক্ষা পায়নি, পাবেও না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন