এক দেশে এক জনপ্রিয় রাজা ছিলেন, দেশের প্রজারা তাঁকে খুব ভালবাসতো। রাজাও প্রজাদের ভালবাসতেন এবং সুখে-দুঃখে এগিয়ে যেতেন। সুন্দরভাবে চলছিল দেশ। বেশ কিছুদিন পর ধীরে ধীরে রাজার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। দেশের প্রজাগণ রাজার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। দেশের প্রজাগণ প্রকাশ্যে রাজপথে রাজার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। রাজাকে ক্ষমতার মসনদ থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামাতে চাইছে প্রজাগণ। দেশে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। যে যাকে পারছে তাকে মারছে। দেশ বেসামাল হয়ে উঠল। রাজার কথা এখন আর কেউ শুনছে না। যুদ্ধের একপর্যায়ে রাজ প্রাসাদে এসে আক্রমণ করে প্রজারা। শুরু হয় রাজার সৈন্য বাহিনীর সাথে যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে প্রজাদের বিজয় হয় এবং রাজাকে রাজবন্দি করে রাখা হয়। যুদ্ধে অনেক প্রাণহানি ও দেশের ক্ষতি হয়েছে। দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে এলেন প্রতিবেশি দেশের রাজাগণ। রাজাগণ এসে প্রকাশ্যে জানতে চাইলেন প্রজাদের দাবিটা কি? প্রজারা একবাক্যে উত্তর দিয়ে বললেন, এ রাজাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে নতুন রাজাকে সিংহাসনে বসাতে হবে। এত কিছুর পরও নির্বাসিত রাজা জানতেও পারলেন না কেন তার এ করুণ পরিণতি। অবশেষে নির্বাসনে যাওয়ার পূর্বে রাজার শেষ মন্তব্য জানতে চাওয়া হলো। রাজা তাঁর মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দেশের প্রজাগণ আমাকে খুব ভালবাসতেন এবং আমিও তাদেরকে খুব ভালবাসতাম। তবে বেশ কিছুদিন ধরে কেন তারা এত বিদ্রোহী হয়ে উঠল আমি বুঝতে পারছি না। রাজার শেষ ইচ্ছা হিসেবে দেশের প্রজাদের কাছে জানতে চাইলেন আমার অপরাধ কি? এ সময় প্রজাদের মধ্যে একজন উত্তর দিয়ে বললেন, রাজার কৃতকর্ম। বিষয়টি পরিষ্কার করে বলার জন্য রাজা আবার অনুরোধ জানালেন। এবার উত্তরে দেশের প্রজাগণ সবাই একবাক্যে বলতে লাগলেন রাজাকে, আমরা অনেক ভালবাসতাম কিন্তু রাজার চারপাশে থাকা লোকজনের মধ্যে অনেকের আত্মীয়-স্বজন ও পাইক পেয়াদাদের লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতনে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। রাজাকে বিষয়টি জানাতে আমরা বারবার রাজ দরবারে গেলেও রাজার সাথে দেখা বা কথা বলার সুযোগ দেয়া হতো না। তাই আমরা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহী হয়েছি। যখন রাজা আসল ঘটনা জানতে পারলেন তখন রাজার আর কিছুই করার ছিল না। এ সময় প্রজাদের মধ্যে একজন বুদ্ধিজীবী বললেন, একেই বলে রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়, গৃহিণীর দোষে ঘর নষ্ট শান্তি চলে যায়। এ গল্পের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেকটা মিল রয়েছে।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত করে ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে ছিলেন দেশের জনগণ। এখন কেন সেই জনগণ টেনে-হেঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাইছে এটা সরকারকে বুঝতে হবে। সরকারের কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা ছিল। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে সরকার ভুল করলেও জনগণ কখনো ভুল করে না। সরকারের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে জনগণ কখনো যায় না বরং নির্বাচন এলে দয়া ভিক্ষা চাইতে জনগণের কাছে যেতে হয় জনপ্রতিনিধিদের। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গিয়ে অনেক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর মনে থাকে না। কিন্তু জনগণ ঠিকই মনে রাখে। জনপ্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে ৫ বছর পর পর আবার আপনাদেরকে জনগণের কাছে আসতে হবে। তাই বিগত দিনে ক্ষমতায় থাকাকালে দেশ ও জনগণের জন্য কি করেছেন এবং জনগণ আপনাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবে এই হিসাব আপনাকেই মেলাতে হবে। সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা মনে করতে পারেন তারা জনগণকে নিয়ে খেলছেন, কিন্তু না। প্রকৃতপক্ষে জনগণ সরকারকে নিয়ে খেলছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত স্বৈরশাসক ব্যতীত কোন গণতান্ত্রিক সরকারকে একটানা দুই বার ক্ষমতায় রাখেনি জনগণ। এ ক্ষেত্রে জনগণেরও কিছুই করার নেই। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ জেনেও পালাবদল করে তাদেরকেই ক্ষমতায় বসাতে হয়। হয়তো বা আগামীতেও তাই হতে পারে? যখন যারাই ক্ষমতায় গেছেন জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ও বিরোধীদল দমনে ব্যস্ত রয়েছেন। বিরোধী দলও সরকারি দলকে কোণঠাসা করতে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ব্যস্ত থাকে। যে স্বপ্ন নিয়ে জনগণ তাদের প্রিয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেই ব্যক্তিই যখন জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে মূল্যায়ন করে না তখন জনগণ ক্ষুব্ধ হয় এবং সরকারি দলকে প্রত্যাখ্যান করে বিরোধীদলকে আবার সমর্থন করে।
বিগত ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের ভরাডুবি ও বিরোধী দলের বিজয় হয়েছে। এটি সরকারের জন্য একটি অশুভ সংকেত। তবে বিরোধী দলের খুশি হওয়ার কিছুই নেই। কারণ জনগণ এখন আপনাদেরকে সমর্থন করেছে পরে আবার তাদেরকে করবে।
ইদানীং জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের অশালীন কথাবার্তায় দেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব অশালীন আচরণে বহির্বিশ্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের উঁচু মাথা নিচু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সংসদ সদস্যদের মনে রাখতে হবে জাতীয় সংসদ দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের একমাত্র ভরসাস্থল। জনগণ আপনাদেরকে সংসদে পাঠিয়েছে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কথা বলার জন্য, চুদুর বুদুর বলার জন্য নয়। দেশের জন্য রাজনীতি না রাজনীতির জন্য দেশ? বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা বুঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন দেশের স্বার্থে আর আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করছেন ক্ষমতার জন্যে। প্রতিবেশি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ডিগবাজির গুঞ্জনকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই যদি হয় জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হবে এবং তার প্রভাব সময়ই বলে দেবে।
বর্তমান সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো হচ্ছে, বিডিআর বিদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সাভার ট্রাজেডি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক, ডেসটিনি, গণজাগরণ মঞ্চ, মন্ত্রীর ঘুষ কেলেঙ্কারি, নাম পরিবর্তন, সাংবাদিক দম্পতি খুন, ইলিয়াস আলী ও আমিনুল গুম, বিরোধীদল দমন, বিরোধী দলের হরতাল অবরোধ ও হেফাজতে ইসলামের কর্মকা- কিভাবে দেখছেন দেশের জনগণ তা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীয়মান হবে।
দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা খুব বেশি নয়। ভাল আচরণ, সামাজিক নিরাপত্তা, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দ্রুত সার্ভিস, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর খেটে খাওয়া মানুষের চাহিদা হচ্ছে দু’বেলা ডালভাত ও মাথা গোঁজার ঠাঁই। জনগণের এ সামান্য চাহিদা একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে পূরণ করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সরকার তা পূরণ করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মানুষ সর্বপ্রথম তাদের জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ভাল ব্যবহার ও দ্রুত সার্ভিস চায়। এতেই তারা খুশি। জনপ্রতিনিধি ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের তা বুঝতে হবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সকল জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের চারপাশে কিছু মানুষ থাকেন। চারপাশে থাকা এসব মানুষের মধ্যে অনেকের আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় পাতি নেতাদের মধ্যে অনেকের প্রভাব বেশি থাকে। মূলত তাদের কর্মকা- ও খারাপ আচরণের কারণে সাধারণ জনগণ বেশি কষ্ট পায়। আর তার প্রভাব পড়ে এসব জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের ওপর। তাই এসব জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের চারপাশে থাকা মানুষ ও দলীয় পাতি নেতাদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। দেশের ঘুষ ও দুর্নীতি রোধে দেশের সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিতে হবে। এরপরও যদি কেউ ঘুষ, দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের সকল উন্নয়ন কর্মকা- স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সঠিকভাবে করতে হবে। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আয়ের উৎস বাড়াতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের জনগণের এসব চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। তাহলে দিনে দিনে দেশ এগিয়ে যাবে। দেশ ও দেশের জনগণ ভাল থাকলে আপনাদের রাজনীতি করা সার্থক হবে। তা না হলে আপনাদের সকল অর্জন ভেস্তে যাবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন