ইতিহাস খ্যাত জাহাজ টাইটানিক-এর নির্মাতারা নাকি দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন যে, এই জাহাজটি অপরাজেয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ভাসানোর প্রথম পর্যায়েই সমুদ্রে জমাটবাঁধা বরফের সাথে ধাক্কা লেগে সেই জাহাজটি ডুবে যায়। এতে দর্প চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় টাইটানিক নির্মাতাদের। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন বলে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে মনে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ জিসিসি নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলেই দলের উপদেষ্টাম-লীর অন্যতম সদস্য ও প্রবীণ রাজনীতিক তোফায়েল আহমদ সাহেব দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন যে, গোপালগঞ্জের পর গাজীপুর হচ্ছে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুর্গ। এই ঘোষণা দিয়ে প্রকারান্তরে তিনি এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এই দুর্গে আঘাত করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। জয়ের ব্যাপারে তার এতোটা আস্থার কারণও বোধ করি অমূলক নয়। কারণ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর আসন থেকে বরাবরই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসছেন। ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও গাজীপুরের এই আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগেরই। একবার শুধু গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বিপূল ভোটে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে তার ভোট প্রাপ্তির সংখ্যা ছিল সারা দেশের ৩শ’ আসনের মধ্যে সর্বাধিক। এবার মেয়র নির্বাচনেও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। তা’ছাড়া এই সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত দু’টি অধুনালুপ্ত পৌরসভা---জয়দেবপুর ও টঙ্গীর মেয়রও ছিলেন আওয়ামী লীগের। ৬টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তারাই। এ কারণেই হয়ত আওয়ামী লীগের ডার্ক-সাইটে নেতা, যিনি ডাকসুর ভিপি ছিলেন সেই তোফায়েল আহমদ গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের অভেদ্য দুর্গ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তার ঘোষিত সেই দুর্গের পতন তিনি নিজেই অবলোকন করলেন। এতে তার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কি না জানিনা। তিনি নিশ্চয় জানেন যে, কোন দুর্গই কারো জন্যে চিরস্থায়ী নয়। কত রাজা-বাদশাহর দুর্গের পতন হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর তারাও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাদের এসব পরবর্তীতে অন্যদের করতলগত হয়। তোফায়েল সাহেবের নিজের কথাই যদি ধরি, তাহলে এ কথা বলা কি অত্যুক্তি হবে? যে তিনি নিজেই তো একদিন আওয়ামী লীগের একজন অপরাজেয় দুর্গ হিসেবে তার পদচারণা ছিল। তার সেই অবস্থান কতটুকু বহাল আছে, তাতো তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন নিশ্চয়ই। একই দিন অনুষ্ঠিত নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী, নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার ও নরসিংদী জেলার গোপালদি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনে ১৮-দলীয় জোট প্রার্থীর বিপুল বিজয় এবং ১৪ দলীয় মহাজোট প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় সম্পর্কে ইতোমধ্যে আলোচনা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। টক শোতে, যা আজকাল খুবই জনপ্রিয়, বলাবলি এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বলা যায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি। যেমনটা হয়েছিল সিলেট, বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর। যা এখনো অব্যাহত আছে। গাজীপুরে ক্ষমতাসীন জোটের পরাজয়ের পর সেই আলোচনা আরো জোরেশোরে শুরু হয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কোনটিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন প্রার্থীরা জয়লাভ করতে পারেন নি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত মেয়র আইভি রহমান যদিও আওয়ামী লীগ করেন। তিনিও কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিএনপি সমর্থিত হয়ে বিজয়ী হন। কেননা নির্বাচনের আগের দিন মধ্যরাতে বিএনপি নিজ প্রার্থী এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে বসিয়ে দিয়ে আইভিকে সমর্থন দেন এবং তিনি জয়ী হন।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি সম্পর্কে কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের যে লেজে-গোবরে অবস্থা, তাতে জনগণ ধরেই নিয়েছেন যে, তারা আগামীতে আর ক্ষমতায় আসতে পারছেন না। কাজেই আগামীতে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাময় জোট হচ্ছে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট। তাই ভোটাররা আগে থেকে সেই দিকে ঝুঁকছেন বলে অনেকের ধারণা। আবার অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের অপশাসন, অদক্ষতা ও ব্যর্থতা দেশের জনগণকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। তাই তারা সুযোগ পেলেই তাদের অসন্তোষের কথা ব্যালটের মাধ্যমে সরকারকে জানিয়ে দিচ্ছেন। আর ব্যালটই হচ্ছে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর উপযুক্ত মাধ্যম। কারণ সরকারের বৈরি আচরণের কারণে বিরোধী দল বিশেষ করে ইসলামী দল ও সংগঠন সমূহ তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারছে না। তাই তারা নির্বাচনকে বেছে নিয়েছেন, তাদের দাবি তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে। আওয়ামী শিবিরের লোকজন নির্বাচনে হারার জন্যে দোষারোপ করছেন ইসলামী দল ও সংগঠন সমূহকে। বিশেষ করে তাদের দোষারোপের এই তীর নিক্ষেপিত হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের দিকে। কারণ অন্যান্য ইসলামী দলসহ হেফাজতে ইসলামের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ফলেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনসমূহে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীরা ধরাশায়ী হচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা। এই ধারণা কেবল অমূলক নয়, কারণ সরকারের দ্বিমুখী আচরণে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা এখন সংক্ষুব্ধ। বিশেষ করে ৫ মে শাপলা চত্বরে সমবেত হেফাজত কর্মীদের ওপরে সাঁড়াশি অভিযানে নানাভাবে নিগৃহীত হয় তারা। সমাজের অন্যান্য নির্যাতিত শ্রেণীর মতো হেফজতিরাও যদি সরকার কর্তৃক তাদের ওপর কৃত লাঞ্ছনার জবাব ব্যালটের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে? যারা হেফাজতের সমালোচনায় মুখর, তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায় যে, হেফাজত যে দাবি নিয়ে মাঠে নেমে এসেছে, সেই দাবির কি কোনো যৌক্তিকতা নেই? আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোন ধর্ম সম্পর্কে অশোভন উক্তি করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে একশ্রেণীর ইসলাম বিদ্বেষী লোকজন যেভাবে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অরুচিকর ভাষায় মন্তব্য করেছে এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক উক্তি করেছে, তার বিরুদ্ধে সরকার কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অথচ সরকার নানাভাবে ইসলাম বিদ্বেষীদের পুরস্কৃত করেছেন, এতে হেফাজতিরা যদি ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে।
এই সরকারের আমলে এমন ক’টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার ফলে দেশের অনেকেই সংক্ষুব্ধ হয়ে আছেন এই সরকারের বিরূদ্ধে। তাদের ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে এসব নির্বাচনে। যেমন বিডিআর ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা কি সরকারের পক্ষালম্বন করবেন? শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে ৯৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি যারা হারিয়েছেন, তাদের ভোট সরকার কিভাবে আশা করবেন। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানোর লক্ষ্যে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজো প্রকাশ করেননি এই সরকার। এই কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩ লাখেরও বেশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারি আজ পথে বসেছেন। অনেকে আত্মহত্যা করে জীবন লীলা সাঙ্গ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন চিরদিনের জন্যে। কিন্তু তাদের ঋণের দায় কে মেটাবে? এসব বিনিয়োগকারিদের পরিবার আজ দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এমন আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে এই সরকারের আমলে, যা সবিস্তার বর্ণনা করা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তাছাড়া এই সরকারের নানামুখী দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণও আজ এই সরকারের ওপর থেকে যে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন, তা প্রকাশ পাচ্ছে সিসি নির্বাচনে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ স্থগিত হওয়া উল্লেখযোগ্য। সরকারের কতিপয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে তাদের অর্থায়ন স্থগিত করে। জাইকা, এডিবি, আইডিবিও একই পন্থা অবলম্বন করে। ফলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সরকারকে বন্ধ রাখতে হয়। নিজস্ব অর্থায়নে এতা বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না বলে এব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন। সর্বসাম্প্রতিক সরকারের আরেকটি ব্যর্থতায় এদেশের মানুষকে হতাশ করেছে চরমভাবে। তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা স্থগিত। এতে সিরামিকসহ কয়েকটি শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সরকার এর জন্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে দায়ী করে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। বিরোধী নেত্রীর কথায় যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করেছে বলে সরকার যে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তা কেউ আমলে নিতে চাচ্ছেন না। কেন না জিএসপি বাতিলের উদ্যোগ শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে। তাছাড়া তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদন ছাড়াই সরকার ভারতকে একতরফাভাবে করিডোর দিয়ে দিয়েছেন। দেশের আলেম-উলামাসহ বিরোধী দলের লক্ষাধিক নেতা-কর্মী জেলে আটক। জিহাদী বই বলে অনেক ইসলামী বই জব্দ করা ছাড়াও বহু আলেম উলামা কারা নির্যাতন ভোগ করছেন। এসব কারণে দেশের জনগণ আজ অতিষ্ঠ। সরকার তারই জবাব পাচ্ছেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন