বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

রোজা রমজানের গুরুত্ব, সওয়াব, করণীয় ও নিয়মাবলী


রোজার গুরুত্ব :
আল্লাহ মুসলমানদেরকে আল্লাহর বাহিনী তথা হিজবুল্লাহ ঘোষণা করে বলেন, উলায়িকা হিজবুল্লাহ। মানে মুসলমানগণ আল্লাহর বাহিনী। দুনিয়ার শাসকগণ যেমন তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয় আল্লাহ ও মুসলমান নামক তাঁর বাহিনীর চারিত্রিক, নৈতিক ও মানবিক গুণের বিকাশের জন্য মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। যেন তারা লোভ মোহের, অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে তাদের সকল রকমের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করতে পারে। তাদের দ্বারা যেন কোন ধর্ম বর্ণের মানুষ নিগৃহীত ও নির্যাতিত না হয়। সব অঞ্চলের সকল রকমের সব ধর্মের মানুষ যেন ন্যায়বিচার পায়। আল্লাহ বলেন, তোমরাই সর্বোত্তম জাতি মানবতার উপকারের জন্যই তোমাদেরকে বাছাই করা হয়েছে (আল-কুরআন)। মুসলমানগণ আন্তর্জাতিক খোদায়ী সৈনিক। এদের কাজ হচ্ছে মানব জাতিকে সকল অন্যায় পাপ ও মানবতাবিরোধী কাজ থেকে মুক্ত করা। মানুষকে মানুষের গোলামী প্রভুত্ব ও জুলুম অত্যাচার থেকে মুক্ত করে দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য চাই লোভমোহ মুক্ত মানব প্রেমিক একদল খোদাভীরু নিরপেক্ষ বাহিনী। তাই তাদের জন্য সেই সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণ।
রোজা আল্লাহর দেয়া একটি মৌলিক ইবাদত ও প্রশিক্ষণ। প্রতিটি মুসলিম নর-নারীকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। সুব্হে সাদেক থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খানা পানীয় ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। সাওম শব্দের অর্থ হল বিরত থাকা। সকল ধরনের অন্যায় পাপাচার ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে হয় বলেই রোজা সওম অভিধায় আখ্যায়িত । সাওম মুসলমানদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় শুধু নাজায়েজ কাজ নয়, প্রয়োজনে যেখানে আশঙ্কা জায়েজ কাজও বর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করে ইহাই সাওমের মূল কথা। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারেরা তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেন তোমরা তাকওয়া তথা খোদাভীতি পূর্ণ সংযমী জীবনে অভ্যস্ত হতে পার”।-আল-কুরআন। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, “যে মিথ্যা ও পাপাচার ত্যাগ করতে পারল না সে খানা পানীয় ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”।-আল হাদীছ। আল্লাহর নবী (দঃ) আরও বলেন, “যে ঈমানদারী ও আত্মসমালোচনার সাথে রোজা রাখবে আল্লাহ তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন”।-আল হাদীস।
রমজানের গুরুত্ব :
রমজুন শব্দ থেকে রমজান, রমজুন অর্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া। যে মাস মানুষের কাম রিপু, লোভ, মোহ ও ভোগের মানসিকতাকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, উহাই রমজান মাস। রোজা রমজানকে যারা সেভাবে কাজে লাগাতে পারল তারা সফল হল। আর যারা সেভাবে আত্ম সংশোধন করতে পারল না তারা বড়ই দুর্ভাগা। তাদের সিয়াম সাধনা যেন কোন কাজেই আসল না। এ মাস এত গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, মানব জাতির মুক্তি সনদের মত গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ নাজিল করার জন্য আল্লাহ এ মাসকেই বাছাই করেছেন।
আল্লাহ বলেন, “আমি মানুষের হেদায়েতের জন্য পথ নির্দেশনার বিস্তারিত বর্ণনাসহ সত্য মিথ্যার মাপকাঠি হিসাবে এই রমজান মাসেই কুরআন নাজিল করেছি। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, “রমজান মাসে যে একটি ভাল কাজ করবে সে যেন একটি ফরজ আদায়ের কাজ করল আর যে একটি ফরজ আদায় করল সে যেন ৭০টি ফরজ আদায় করল। এ মাস ধৈর্য্য ও সহানুভূতিশীল হওয়ার মাস।
মুসলমানদের করণীয় :
১) রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা, পবিত্রতা রক্ষার জন্য অন্যকে উৎসাহিত করা।
২) ঈমানদারী ও আত্মসমালোচনার সাথে হিসাব করে করে রোজা রাখা।
৩) সকল ধরনের মিথ্যা, পাপ, দুর্নীতি ও অপকর্ম চিরতরে বর্জন করা।
৪) রোজা রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী নিজের জীবন পরিবার ও সমাজ গঠনের চেষ্টা করা।
৫) কুরআন পড়া, বুঝা এবং কুরআনের শিক্ষা ও দাবি অনুযায়ী পরিবার এবং সমাজ গঠন করা।
৬) ধৈর্য্য ও ত্যাগের গুণ অর্জন করা।
৭) গরীব অসহায় মানুষের প্রতি সদয় হয়ে তাদের সাহায্য করা,
৮) আল্লাহর নবী (দঃ) রমজান মাসকে রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির মাস ঘোষণা করেছেন তাই সবার উচিত রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তি লাভ করার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা।
৯) অতীতের সকল রকমের ভুল-ত্রুটির জন্য তাওবা করা ভবিষ্যতে ঐ ধরনের অন্যায়, ইসলাম, সমাজ, দেশ ও মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত না হওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তাওবা ও সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকা।
রোজা রাখার নিয়মাবলী :
১) রোজার নিয়তে সুব্হে সাদেক হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খানা পানীয় ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। সকল অন্যায় মিথ্যা ও পাপের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
২) রোজার নিয়ত : নাওয়াইতুআন আছুমা গাদাম মিন শাহরি রমজানাল মুবারাক, ফারদাল্্ লাকা ইয়া আল্লাহু! ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাছ ছামিয়ুল আলীম। অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি তোমার জন্য ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম। তুমি আমার রোজা কবুল কর।-আমীন।
ইফতারের নিয়ত :
আল্লাহুম্মা ইন্নি লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু বিসমিল্লাহ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি তোমার জন্যই রোজা রেখেছিলাম তোমার দেয়া রিজিক দিয়েই ইফতার করছি বিসমিল্লাহ।
ইফতারের সময় দোয়া কবুলের সময়। ইফতারের একটু আগে বসে দরুদ পড়া ও দোয়া করা। অন্য রোজাদারকে ইফতার করালে রোজার ছাওয়াব পাওয়া যায়।
রোজার মাসায়েল :
১) রোজা রেখে ভুলে কিছু খেলে রোজা ভঙ্গ হয় না। যদি মনে হওয়ার সাথে সাথে খানা বন্ধ করে।
২) নির্ধারিত সময় অর্থাৎ সুব্হে সাদেক হওয়ার পরও খেতে থাকলে রোজা হবে না।
৩) রোজা রেখে তেল সাবান ও আতর ব্যবহার করা যায় তবে আগরবাহি, টুথপেস্ট ও দাঁতের মাজন ব্যবহার করা যাবে না।
৪) নির্ধারিত সময়ের আগে ইফতার করলে রোজা ভেঙে যাবে।
৫) অজু বা গোছলের সময় পানি খাওয়া গেলে রোজা ভেঙে যাবে। সারা দিন রোজাদারের মত থাকতে হবে।
৬) স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙে না তবে ইচ্ছা করে বীর্যপাত ঘটালে রোজা ভেঙে যাবে।
৭) ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙলে ১টি রোজার পরিবর্তে ৬০টি রোজা কাফফারা দিতে হবে। অনিচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙলে ১টি রোজার পরিবর্তে ১টি রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে।
রোজা রমজানের শিক্ষা :
ইসলামী জীবনের প্রায় সব এবাদত  ও অনুষ্ঠানের একটা শিক্ষা থাকে তারই ধারাবাহিকতায় রোজা রমজানের শিক্ষা :
১. রমজানের ১ মাস যেভাবে আল্লাহকে ভয় করে তার এবাদত-বন্দেগী করে জীবন অতিবাহিত করেছি রমজানের পর সেভাবে বাকী ১১ মাস আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহর দেয়া আদেশ-নিষেধ মত জীবন যাপন করা।
২. মহব্বতের সাথে কুরআন পড়া কুরআনের দাবি ও শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করা।
৩. নিজের জীবন ও চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সক্রিয় ও সচেতন থাকা।
৪. আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা এবং আদিষ্ট কাজগুলো আমল করা এবং ত্যাগ ও ধৈর্য্যরে গুণ অর্জন করা।
৫. লোভ মোহ পরিহার করা এবং গরীব অসহায় মানুষের জন্য সহায়ক হওয়া এবং সাহায্য সহযোগিতা করা।
আল্লাহ আমাদেরকে ধৈর্য্যরে গুণ এবং রোজা রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন ও চরিত্র গঠনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads