রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের পর গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন মহাজোটের ভয়াবহ ভরাডুবি হলো। এক লাখ সাত হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে পরাজিত করলেন ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক এমএ মান্নান। তিনি পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট। আর আজমতউল্লাহ খান পেয়েছেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। ভোটের এ বিশাল ব্যবধান কারও কারও কাছে অপ্রত্যাশিত হলেও নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পরাজয় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। গণমাধ্যমের খবরা-খবরে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও অবাধ হয় তাহলে ১৮ দল-সমর্থিত প্রার্থীর বিজয়কে রোধ করার কোনো উপায় থাকবে না।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের ব্যাপক ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ধারাবাহিক এ পরাজয় সরকারের জনপ্রিয়তায় মহাধসেরই প্রমাণ বহন করে। বলা যায় মহাধসের কবলে পড়েছে মহাজোট। মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে এমন লেজেগোবরে অবস্থা শাসক মহলকে যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করবে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। পরাজয় মেনে নিয়ে তারা হয়তো এখন পুনরায় বলবেন যে, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে এবং তাদের অধীনে যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আপাতদৃষ্টিতে এটাকে সাধুবাক্য হিসেবে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি গাজীপুর নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ওই নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিতে হেন চেষ্টা নেই যা শাসক মহল করেনি। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে তারা একের পর এক চেষ্টা চালিয়েছে। তবে, ভোটার সাধারণের সচেতনতা, ১৮ দলের নেতা-কর্মীদের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার দৃপ্ত প্রত্যয় এবং গণমাধ্যমের প্রখর দৃষ্টি সরকারি পক্ষকে অনেক ক্ষেত্রেই সংযত থাকতে বাধ্য করেছে।
আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অরাজনৈতিক থাকে না। সব সিটি নির্বাচনই শেষ পর্যন্ত দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, শুধু নির্বাচনী প্রতীক ছাড়া। কাগজে-কলমে নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় দলীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবেই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অন্যান্য সিটির মতো গাজীপুরেও তাই হয়েছে। উভয় পক্ষের বাঘা বাঘা নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, কেন্দ্র থেকে করা হয়েছে কঠোর নজরদারি।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ফলাফল ঘরে তোলার লক্ষ্যে শাসক মহল চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ১৮ দলের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বহু অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রিসাইডিং অফিসার-পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেয়ার অভিযোগ ছিল অন্যতম। এছাড়া ভোটের দিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বাইরের জেলাসমূহ থেকে যেসব পুলিশ-র্যাব কর্মকর্তাকে গাজীপুরে জড়ো করা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই সরকারি দলের আস্থাভাজন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং একটি বিশেষ জেলার অধিবাসী এমন অভিযোগও করা হয়েছিল। বিরোধী দলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বেশ কয়েকজনকে নির্বাচন কমিশন সরিয়েও নেয়। তবে, বেশিরভাগকেই বহাল রাখা হয়।
নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন সময়ে গাজীপুরে মন্ত্রীদের যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল নির্বাচন কমিশন। এটা নির্বাচন আচরণ বিধির অন্যতম অংশ। কিন্তু নির্বাচনী এলাকায় না গিয়েও সরকারের মন্ত্রী ও পদস্থ ব্যক্তিদের প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানের ইমেজ নষ্ট করে জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে দূরে বসে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন তারা। এখানে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। গত ২ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন—‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মান্নান একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাবস্থায় হাজীদের শত শত কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছিলেন। প্রভাষক হয়ে অধ্যাপক লেখার দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি চাকরি হারান।’ ড. হাছান মাহমুদ বলেন—‘আমরা চেয়েছিলাম অন্তত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি একজন সত্, যোগ্য নেতাকে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু হতাশ হলাম তারা একজন দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক ও প্রতারক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছে (যুগান্তর ০৩ জুলাই, ২০১৩)।’
লক্ষণীয় হলো, বনমন্ত্রী রাজধানীতে বসে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন সে ব্যাপারে কোনো রা-শব্দ করেনি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো প্রার্থী সম্বন্ধে কোনো প্রকার কটূক্তি করা, অপবাদ বা কুত্সা রটনা নির্বাচনী আচরণ বিধি মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ সরকারের একজন মন্ত্রী সরাসরি সে বিধি-লঙ্ঘন করে একজন প্রার্থীর চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করলেন। এসব নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার অভিযোগ করা হলেও নির্বাচন কমিশন ‘আচ্ছা দেখছি’ জাতীয় কথাবার্তা বলে তা এড়িয়ে গেছে।
অধ্যাপক মান্নানের চরিত্র হনন, তার ইমেজ বিনষ্ট ও জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সরকার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক কাজটি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর মাধ্যমে। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে গত ৩ জুলাই এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এমএ মান্নানের কাছ থেকে পাওনা করের টাকা আদায়ে প্রয়োজনে তার সম্পত্তি বিক্রি করা হবে।’ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ওইদিন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার সময় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত ৬-৭ বছর ধরে মামলা হয়েছে। মামলায় হেরে যাওয়ায় এমএ মান্নান আপিল করেছেন। তাতেও হেরেছেন। তারপর গাজীপুরে ট্যাক্স ফাইল খুলেছেন। ঢাকা অফিস তার পুরনো মামলার জোরে ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে।’ আগে জব্দ না করে এখন কেন করা হলো—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম হোসেন বলেন, ‘তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এজন্য ব্যাংক হিসাব জব্দ ও টাকা চাওয়া যাবে না—এটা কোন যুক্তি? যারা প্রশ্ন করছেন যে নির্বাচনের আগে কর চাওয়া অন্যায্য, তাহলে তারা বলুন, সরকারি পাওনা চাওয়া অন্যায্য।’ তিনি বলেন, ‘যদি সরকারের দেনা দেয়া ন্যায্য হয়ে থাকে তাহলে তাকে মরে গেলেও দিতে হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ জুলাই, ২০১৩)
এনবিআর চেয়ারম্যানের কথায় এটা স্পষ্ট যে, টাকা-আদায় নয়, বরং এমএ মান্নানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই তিনি ওসব বলেছেন। নইলে এর আগে কত সময় পার হয়েছে, তিনি কিছু বলেননি। নির্বাচনের তিনদিন আগে কেন এমএ মান্নানের কাছে পাওনা কর আদায়ের জন্য তার মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি হলো? বিষয়টি বুঝতে কারোরই বাকি ছিল না। যার ফলে এনবিআর চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্য ভোটারদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। গাজীপুরের মানুষ ‘ওসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই’—এমন মন্তব্য করে এমএ মান্নানকে নিয়ে এগিয়ে গেছে।
জনগণ এনবিআর চেয়ারম্যানের কথায় কান দিক বা না দিক, তা যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপকৌশল সম্পর্কে একজন নাগরিকের মন্তব্য তুলে ধরলেই পাঠক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। ভোটের পরদিন (৭ জুলাই) সকালে মতিঝিল কলোনী বাজারের পত্রিকার দোকানের সামনে আলোচনা করছিলেন কয়েক ভদ্রলোক। বিষয় গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল। একজন বললেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান বলল, মান্নানের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় করবে। বাংলাদেশে এমন কোনো উদাহরণ আছে যে সম্পত্তি বিক্রি করে করের টাকা আদায় করা হয়েছে? তাছাড়া আগে উনি সেটা করেননি কেন? ইলেকশনের তিনদিন আগে কেন উনার মনে হলো এমএ মান্নানের কাছ থেকে কর আদায় করা দরকার?’ ভদ্রলোক, বোধকরি সরকারি কর্মকর্তা। তিনি আরও বললেন, ইলেকশনে সরকারি কর্মকর্তাদের এভাবে ব্যবহার করলে ফল ভালো হয় না। এটাও তো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন। তাছাড়া নির্বাচনের জন্য আমদের কেন ব্যবহার করা হবে? আরেকজন বললেন—‘আরে ভাই, এটা হলো মুসলমানদের মারার ফল। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আওয়ামী লীগকে আর ভোট দেবে না।’
তাছাড়া, ভোটের দিনও ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। বিএনপির পক্ষ থেকে দিনভর মিডিয়ায় সেসব অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। লাগাতার ওইসব অভিযোগের ফলে নির্বাচন কমিশন অতিরিক্ত সতর্ক থেকেছে। ফলে পুলিশ কনস্টেবলসহ ১০/১২ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে জাল ভোট দান ও ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগে আটক করা সম্ভব হয়েছে। আর অবস্থা বেগতিক দেখে শাসক দলও ফলাফল ছিনতাইয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, চার সিটি নির্বাচনে হেরে যাবার পর আওয়ামী লীগ গাজীপুর নির্বাচনে জেতার জন্য মরণ কামড় দিয়েছিল। যে কোনো মূল্যে গাজীপুরকে জয় করার একটা ধনুক ভাঙা পণ তাদের ছিল। সে লক্ষ্যে শুরু থেকেই নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় তারা নিয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সম্মত না করাতে পেরে শেষ পর্যায়ে তাকে টঙ্গী থেকে অপহরণ করা হয়। দু’তিন দিন নিখোঁজ ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। কাজটি কাদের এবং কী উদ্দেশ্যে ওটা করা হয়েছিল তা বুঝতে কারও বাকি থাকেনি। জাহাঙ্গীর আলম নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ কেউ তার পরিণতি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মতো হয় কীনা সে শঙ্কায়ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনদিন পর যখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার সন্ধান পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল কী ঝড়টাই না বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে! সেখান থেকেই তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
অভিযোগ রয়েছে, শাসক মহলের শীর্ষ ব্যক্তির নির্দেশে জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। ‘জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়’—এ ভাবনা তাকে শত কষ্ট মনে চেপে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দিতে বাধ্য করে। এটাও ছিল নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। কেননা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো প্রার্থীকে কোনো প্রকার লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা বা সমর্থন আদায় করা বা আদায়ের চেষ্টা নির্বাচন আচরণ বিধি অনুযায়ী বেআইনি। জাহাঙ্গীর আলমের হঠাত্ অন্তর্ধান, হাসপাতালে সন্ধান লাভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে তা বুঝতে কারও বাকি নেই। বিরোধী দল এ বিষয়েও নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গাজীপুরকে জয় করতে ক্ষমতাসীন মহল সাধ্যমতো সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু তারা বিফল হয়েছে। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব পন্থা অবলম্বন করেও তারা তাদের পরাজয় ঠেকাতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা পুনরুল্লেখ প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্লেষকরা বলছেন যে, সিটি করপোরেশনে নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে তাতে পড়েছে। ভোটের দিন রাতে একটি টিভি চ্যানেলে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলছিলেন যে, গাজীপুরে এমএ মান্নানের কাছে আজমত উল্লাহ হারেননি, বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ হেরেছে।’ এ কথার দ্বারা তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের যেসব ‘দৃষ্টান্ত স্থাপন’ করেছে, সিটি নির্বাচনগুলোতে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন চোখে দেখা যায়। কিন্তু জনগণের আন্দোলন হয়তো চোখে দেখা যায় না, সময় সুযোগ মতো তার ফলাফল প্রকাশ পায়। সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের দুঃশাসন, ব্যর্থতা আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ হয়তো মুখে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু যখন যেখানে তারা সুযোগ পাচ্ছে (ভোট দেয়া) সেখানেই ঘোষণা করে দিচ্ছে সুস্পষ্ট রায়। জনগণের এ রায় বড়ই নির্মম। এ রায় কাউকে ক্ষমা করে না।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাঁচদিনের ওয়ানডে সিরিজ হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক পাঁচ সিটি নির্বাচনকে যদি সে রকম সিরিজ হিসেবে ধরে নেয়া হয়, তাহলে বলতেই হয় যে, বিএনপি তথা ১৮ দল ৫-০ ম্যাচে সিরিজ জিতে নিয়েছে। খেলোয়াড়, কলাকুশলী এবং সাপোর্টারদের সমন্বিত প্রচেষ্টা তাদের এ সিরিজ বিজয় এনে দিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের এ ধারাবাহিক পরাজয় কেন, এ প্রশ্নের উত্তর তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো সে রকম পর্যালোচনায় তারা ইতোমধ্যে আত্মনিমগ্ন হয়েও থাকবেন। বাইরে থেকে আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিণতি এর চেয়ে ভালো হয় না। সাগরে জোয়ার এলে নদ-নদী, খালবিলেও যেমন পানি আসে, তেমনি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো দল বা জোট ভুল করলে তার প্রভাব স্থানীয় পর্যায়েও সমানভাবে পড়ে। বিজ্ঞানী প্যাসকলের একটি সূত্র আছে—‘পানি ভর্তি কোনো গোলকের একটি স্থানে চাপ দিলে তা ওই গোলকের সর্বত্র সমান চাপ সৃষ্টি করে।’ বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে মহাজোট সরকার যে চাপ তৈরি করেছে তা দেশের সর্বত্র তাদের এখন তীব্রভাবে আঘাত করছে। সতর্ক না হলে এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে এ চাপ শতগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ভীষণ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
সিটি নির্বাচনগুলোর ফলাফল এটা প্রমাণ করেছে যে, জনমত এখন বিএনপির পক্ষে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন করে আসছে, তার প্রতিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে যদি একটি গণভোট করা হয় তাহলে সিটি নির্বাচনগুলোর মতোই ফলাফল আসবে—এটা প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং, জনমতকে উপেক্ষা করার মতো একগুঁয়েমি সরকারকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় জনগণের রোষানলে পতিত হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচন সেটাই জানান দিয়ে গেল।
আপাতদৃষ্টিতে এটাকে সাধুবাক্য হিসেবে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি গাজীপুর নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, ওই নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিতে হেন চেষ্টা নেই যা শাসক মহল করেনি। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে তারা একের পর এক চেষ্টা চালিয়েছে। তবে, ভোটার সাধারণের সচেতনতা, ১৮ দলের নেতা-কর্মীদের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার দৃপ্ত প্রত্যয় এবং গণমাধ্যমের প্রখর দৃষ্টি সরকারি পক্ষকে অনেক ক্ষেত্রেই সংযত থাকতে বাধ্য করেছে।
আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশন। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অরাজনৈতিক থাকে না। সব সিটি নির্বাচনই শেষ পর্যন্ত দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, শুধু নির্বাচনী প্রতীক ছাড়া। কাগজে-কলমে নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় দলীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবেই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। অন্যান্য সিটির মতো গাজীপুরেও তাই হয়েছে। উভয় পক্ষের বাঘা বাঘা নেতারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, কেন্দ্র থেকে করা হয়েছে কঠোর নজরদারি।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ফলাফল ঘরে তোলার লক্ষ্যে শাসক মহল চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ১৮ দলের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বহু অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রিসাইডিং অফিসার-পোলিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেয়ার অভিযোগ ছিল অন্যতম। এছাড়া ভোটের দিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বাইরের জেলাসমূহ থেকে যেসব পুলিশ-র্যাব কর্মকর্তাকে গাজীপুরে জড়ো করা হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই সরকারি দলের আস্থাভাজন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং একটি বিশেষ জেলার অধিবাসী এমন অভিযোগও করা হয়েছিল। বিরোধী দলের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে বেশ কয়েকজনকে নির্বাচন কমিশন সরিয়েও নেয়। তবে, বেশিরভাগকেই বহাল রাখা হয়।
নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালীন সময়ে গাজীপুরে মন্ত্রীদের যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল নির্বাচন কমিশন। এটা নির্বাচন আচরণ বিধির অন্যতম অংশ। কিন্তু নির্বাচনী এলাকায় না গিয়েও সরকারের মন্ত্রী ও পদস্থ ব্যক্তিদের প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নানের ইমেজ নষ্ট করে জনমনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির লক্ষ্যে দূরে বসে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলেন তারা। এখানে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। গত ২ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন—‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মান্নান একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাবস্থায় হাজীদের শত শত কোটি টাকা আত্মসাত্ করেছিলেন। প্রভাষক হয়ে অধ্যাপক লেখার দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি চাকরি হারান।’ ড. হাছান মাহমুদ বলেন—‘আমরা চেয়েছিলাম অন্তত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি একজন সত্, যোগ্য নেতাকে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু হতাশ হলাম তারা একজন দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক ও প্রতারক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছে (যুগান্তর ০৩ জুলাই, ২০১৩)।’
লক্ষণীয় হলো, বনমন্ত্রী রাজধানীতে বসে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন সে ব্যাপারে কোনো রা-শব্দ করেনি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো প্রার্থী সম্বন্ধে কোনো প্রকার কটূক্তি করা, অপবাদ বা কুত্সা রটনা নির্বাচনী আচরণ বিধি মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ সরকারের একজন মন্ত্রী সরাসরি সে বিধি-লঙ্ঘন করে একজন প্রার্থীর চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করলেন। এসব নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার অভিযোগ করা হলেও নির্বাচন কমিশন ‘আচ্ছা দেখছি’ জাতীয় কথাবার্তা বলে তা এড়িয়ে গেছে।
অধ্যাপক মান্নানের চরিত্র হনন, তার ইমেজ বিনষ্ট ও জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সরকার সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক কাজটি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর মাধ্যমে। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে গত ৩ জুলাই এনবিআর চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এমএ মান্নানের কাছ থেকে পাওনা করের টাকা আদায়ে প্রয়োজনে তার সম্পত্তি বিক্রি করা হবে।’ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ওইদিন বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার সময় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘গত ৬-৭ বছর ধরে মামলা হয়েছে। মামলায় হেরে যাওয়ায় এমএ মান্নান আপিল করেছেন। তাতেও হেরেছেন। তারপর গাজীপুরে ট্যাক্স ফাইল খুলেছেন। ঢাকা অফিস তার পুরনো মামলার জোরে ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে।’ আগে জব্দ না করে এখন কেন করা হলো—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম হোসেন বলেন, ‘তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এজন্য ব্যাংক হিসাব জব্দ ও টাকা চাওয়া যাবে না—এটা কোন যুক্তি? যারা প্রশ্ন করছেন যে নির্বাচনের আগে কর চাওয়া অন্যায্য, তাহলে তারা বলুন, সরকারি পাওনা চাওয়া অন্যায্য।’ তিনি বলেন, ‘যদি সরকারের দেনা দেয়া ন্যায্য হয়ে থাকে তাহলে তাকে মরে গেলেও দিতে হবে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ জুলাই, ২০১৩)
এনবিআর চেয়ারম্যানের কথায় এটা স্পষ্ট যে, টাকা-আদায় নয়, বরং এমএ মান্নানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই তিনি ওসব বলেছেন। নইলে এর আগে কত সময় পার হয়েছে, তিনি কিছু বলেননি। নির্বাচনের তিনদিন আগে কেন এমএ মান্নানের কাছে পাওনা কর আদায়ের জন্য তার মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি হলো? বিষয়টি বুঝতে কারোরই বাকি ছিল না। যার ফলে এনবিআর চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্য ভোটারদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। গাজীপুরের মানুষ ‘ওসব ফালতু কথা শোনার সময় নেই’—এমন মন্তব্য করে এমএ মান্নানকে নিয়ে এগিয়ে গেছে।
জনগণ এনবিআর চেয়ারম্যানের কথায় কান দিক বা না দিক, তা যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপকৌশল সম্পর্কে একজন নাগরিকের মন্তব্য তুলে ধরলেই পাঠক বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। ভোটের পরদিন (৭ জুলাই) সকালে মতিঝিল কলোনী বাজারের পত্রিকার দোকানের সামনে আলোচনা করছিলেন কয়েক ভদ্রলোক। বিষয় গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল। একজন বললেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান বলল, মান্নানের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় করবে। বাংলাদেশে এমন কোনো উদাহরণ আছে যে সম্পত্তি বিক্রি করে করের টাকা আদায় করা হয়েছে? তাছাড়া আগে উনি সেটা করেননি কেন? ইলেকশনের তিনদিন আগে কেন উনার মনে হলো এমএ মান্নানের কাছ থেকে কর আদায় করা দরকার?’ ভদ্রলোক, বোধকরি সরকারি কর্মকর্তা। তিনি আরও বললেন, ইলেকশনে সরকারি কর্মকর্তাদের এভাবে ব্যবহার করলে ফল ভালো হয় না। এটাও তো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন। তাছাড়া নির্বাচনের জন্য আমদের কেন ব্যবহার করা হবে? আরেকজন বললেন—‘আরে ভাই, এটা হলো মুসলমানদের মারার ফল। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আওয়ামী লীগকে আর ভোট দেবে না।’
তাছাড়া, ভোটের দিনও ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। বিএনপির পক্ষ থেকে দিনভর মিডিয়ায় সেসব অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। লাগাতার ওইসব অভিযোগের ফলে নির্বাচন কমিশন অতিরিক্ত সতর্ক থেকেছে। ফলে পুলিশ কনস্টেবলসহ ১০/১২ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে জাল ভোট দান ও ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার অভিযোগে আটক করা সম্ভব হয়েছে। আর অবস্থা বেগতিক দেখে শাসক দলও ফলাফল ছিনতাইয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, চার সিটি নির্বাচনে হেরে যাবার পর আওয়ামী লীগ গাজীপুর নির্বাচনে জেতার জন্য মরণ কামড় দিয়েছিল। যে কোনো মূল্যে গাজীপুরকে জয় করার একটা ধনুক ভাঙা পণ তাদের ছিল। সে লক্ষ্যে শুরু থেকেই নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় তারা নিয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে সম্মত না করাতে পেরে শেষ পর্যায়ে তাকে টঙ্গী থেকে অপহরণ করা হয়। দু’তিন দিন নিখোঁজ ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। কাজটি কাদের এবং কী উদ্দেশ্যে ওটা করা হয়েছিল তা বুঝতে কারও বাকি থাকেনি। জাহাঙ্গীর আলম নিখোঁজ হওয়ার পর কেউ কেউ তার পরিণতি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর মতো হয় কীনা সে শঙ্কায়ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনদিন পর যখন রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তার সন্ধান পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল কী ঝড়টাই না বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে! সেখান থেকেই তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
অভিযোগ রয়েছে, শাসক মহলের শীর্ষ ব্যক্তির নির্দেশে জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। ‘জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়’—এ ভাবনা তাকে শত কষ্ট মনে চেপে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীকে সমর্থন দিতে বাধ্য করে। এটাও ছিল নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। কেননা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো প্রার্থীকে কোনো প্রকার লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা বা সমর্থন আদায় করা বা আদায়ের চেষ্টা নির্বাচন আচরণ বিধি অনুযায়ী বেআইনি। জাহাঙ্গীর আলমের হঠাত্ অন্তর্ধান, হাসপাতালে সন্ধান লাভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে তা বুঝতে কারও বাকি নেই। বিরোধী দল এ বিষয়েও নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গাজীপুরকে জয় করতে ক্ষমতাসীন মহল সাধ্যমতো সব চেষ্টাই করেছে। কিন্তু তারা বিফল হয়েছে। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব পন্থা অবলম্বন করেও তারা তাদের পরাজয় ঠেকাতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা পুনরুল্লেখ প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্লেষকরা বলছেন যে, সিটি করপোরেশনে নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে তাতে পড়েছে। ভোটের দিন রাতে একটি টিভি চ্যানেলে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলছিলেন যে, গাজীপুরে এমএ মান্নানের কাছে আজমত উল্লাহ হারেননি, বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ হেরেছে।’ এ কথার দ্বারা তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ ব্যর্থতা ও দুঃশাসনের যেসব ‘দৃষ্টান্ত স্থাপন’ করেছে, সিটি নির্বাচনগুলোতে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন চোখে দেখা যায়। কিন্তু জনগণের আন্দোলন হয়তো চোখে দেখা যায় না, সময় সুযোগ মতো তার ফলাফল প্রকাশ পায়। সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের দুঃশাসন, ব্যর্থতা আর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ হয়তো মুখে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু যখন যেখানে তারা সুযোগ পাচ্ছে (ভোট দেয়া) সেখানেই ঘোষণা করে দিচ্ছে সুস্পষ্ট রায়। জনগণের এ রায় বড়ই নির্মম। এ রায় কাউকে ক্ষমা করে না।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পাঁচদিনের ওয়ানডে সিরিজ হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক পাঁচ সিটি নির্বাচনকে যদি সে রকম সিরিজ হিসেবে ধরে নেয়া হয়, তাহলে বলতেই হয় যে, বিএনপি তথা ১৮ দল ৫-০ ম্যাচে সিরিজ জিতে নিয়েছে। খেলোয়াড়, কলাকুশলী এবং সাপোর্টারদের সমন্বিত প্রচেষ্টা তাদের এ সিরিজ বিজয় এনে দিয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের এ ধারাবাহিক পরাজয় কেন, এ প্রশ্নের উত্তর তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। হয়তো সে রকম পর্যালোচনায় তারা ইতোমধ্যে আত্মনিমগ্ন হয়েও থাকবেন। বাইরে থেকে আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিণতি এর চেয়ে ভালো হয় না। সাগরে জোয়ার এলে নদ-নদী, খালবিলেও যেমন পানি আসে, তেমনি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো দল বা জোট ভুল করলে তার প্রভাব স্থানীয় পর্যায়েও সমানভাবে পড়ে। বিজ্ঞানী প্যাসকলের একটি সূত্র আছে—‘পানি ভর্তি কোনো গোলকের একটি স্থানে চাপ দিলে তা ওই গোলকের সর্বত্র সমান চাপ সৃষ্টি করে।’ বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে মহাজোট সরকার যে চাপ তৈরি করেছে তা দেশের সর্বত্র তাদের এখন তীব্রভাবে আঘাত করছে। সতর্ক না হলে এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে এ চাপ শতগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ভীষণ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
সিটি নির্বাচনগুলোর ফলাফল এটা প্রমাণ করেছে যে, জনমত এখন বিএনপির পক্ষে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি যে আন্দোলন করে আসছে, তার প্রতিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে যদি একটি গণভোট করা হয় তাহলে সিটি নির্বাচনগুলোর মতোই ফলাফল আসবে—এটা প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং, জনমতকে উপেক্ষা করার মতো একগুঁয়েমি সরকারকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। অন্যথায় জনগণের রোষানলে পতিত হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচন সেটাই জানান দিয়ে গেল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন