ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :
কালো টাকা কাকে বলে সে বিষয়ে আমার ধারণা আছে। তবে কালো টাকা কিভাবে যোগাড় করতে হয় সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা আমার নেই। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে একটা ধারণা করি কালো টাকা কারে কয়! এ কথা সবাই জানেন, যে টাকা আয়ে কোনো উৎস কেউ দেখাতে পারেন না সেটাই কালো টাকা। আমি বেতনভোগী কর্মচারী। এর বাইরে আরো সামান্য কিছু উপার্জন আছে। তা যদি আয়কর সীমার ভেতরে হয় তাহলে আমি সরকারকে জানান দিবো যে, এ বছর আমার এ আয়, আর এই ব্যয়। উদ্বৃত্ত থেকে আমি অতো টাকা সরকারকে আয়কর দিলাম। যেটুকু আমার উদ্বৃত্ত থাকল সেটাই সাদা টাকা।
কিন্তু কালো টাকা এক অসাধারণ টাকা। প্রবাদ আছে, খারাপ টাকা বাজার থেকে ভালো টাকাকে তাড়িয়ে দেয়। সাদা টাকা সবসময় জাতীয় উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিনিয়োগ বলি, ব্যবসায় বাণিজ্য বলি, জাতীয় উৎপাদনশীলতা বলিÑ সব কিছুই সাদা টাকার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও আমরা যে বিদেশ থেকে ঋণ আনি সেটাও সাদা টাকা। সে টাকাও দেখা যায়। ১০ কোটি টাকা ঋণ এনেছি, ওমুক কারখানা নির্মাণ করেছি। সেখানে অতোজন শ্রমিক কাজ করছে। তা যদি রফতানিমুখী হয় তাহলে ঋণের ঐ সাদা টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা লাভজনক। সে লাভের টাকায় সরকার জনকল্যাণে ও উৎপাদনমুখী কাজে আরো ব্যয় করতে পারবে।
কিন্তু কালো টাকা এক চতুর জোচ্চোর। এর কাজ কেবলই সমাজের ভেতরে ক্ষতি সাধন করা। এ সর্বনাশী, সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী। খুব সাধারণ মানুষের মধ্যেও কালো টাকার ক্ষতি সাধন প্রক্রিয়াও বিদ্যমান। ধরা যাক পণ্যমূল্য। এক হালি কলার দাম দোকানে হাঁকল ১৬ টাকা। সে আসলে তা ১২ টাকায়ই বিক্রি করতে পারে। কালো টাকার মালিক ঝটপট তা ১৬ টাকায়ই কিনে নিলেন। মধ্যবিত্ত ক্রেতার হা করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। দোকানী সুযোগ পেয়ে যায়। সে তখন থেকে ওই কলার হালি স্থায়ীভাবে ১৬ টাকায় নির্ধারিত করে থাকেন। তখন নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ক্রেতারা অতিরিক্ত ঐ চার টাকা দিতে বাধ্য হোন। এখানে দোকানীর লাভ বেশি। কিন্তু সে যদি তা দেখায় তবে তার টাকাটা সাদা। এটা শুধু ভোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রেই সত্য নয়। ঈদের বাজারের পণ্যের ক্ষেত্রেও তা সত্য। সত্য গাড়ির ক্ষেত্রেও। যিনি সাদা টাকার মালিক গাড়ি কিনলে তাকে সে টাকা দেখাতে হয়। যিনি কালো টাকার মালিক তিনি ৩০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে দাবি করতে পারেন যে গাড়িটি মাত্র ১০ লাখ টাকায় কিনেছি।
সাদা টাকা সব সময়ই উৎপাদনশীল। কিন্তু কালো টাকা কখনোই তা নয়। ফলে এই টাকা বিনিয়োজিত হয় অন্য কোনো কালো খাতে। যেমনÑ মাদক ব্যবসায়, হাউজিং, জমি কেনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে। জমি যদি সে কেনে ২ কোটি টাকা দিয়ে তা ১০ লাখ টাকাও দেখাতে পারে। আবার এটা দেখানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের ঘুষও সে দিতে পারে। যাকে সে ঘুষটা দিলো সেও কিছুটা কালো টাকার মালিক হলো। তার ভেতরে সঞ্চারিত হলো লোভ। সৎ লোকদের বদলে সে কালো টাকার মালিকদের খুঁজবে আর ঘাটে ঘাটে সৎ লোকেরা খাবি খেতে থাকবে। এভাবে কালো টাকা গোটা সমাজকে কলুষিত করে ফেলে। সরকার যদি শক্ত হাতে কালো টাকা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করেন তা হলে ক্রমেই তা বাড়তে থাকবে।
কালো টাকার মালিকদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের অনেক ধরনের ফাঁদ আছে। যেমন আয়কর, বিনিয়োগ তদারকি, ক্রয় তদারকি প্রভৃতি বিষয়। আয়কর দেয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি আয়কর দিতে বাধ্য। সে আয়কর যদি পাওয়া যায় তাহলে তাও উন্নয়ন ও বিনিয়োগে ব্যবহার করা যায়। তাতেও জাতির কল্যাণ হয়। এই যে আমাদের ভ্যাট সেটিও সর্বত্র সঠিকভাবে আদায় হয় না। আদায় হলে ভ্যাট থেকেই দুই তিন গুণ বেশি আয় করা সম্ভব হতো। ঢাকার চেইন শপগুলো কিংবা বড় দোকান সম্ভবতো আয়কর দেয়। কিন্তু মুদি দোকানের আয়কর নেই। সেওতো জিনিষপত্র বিক্রি করছে। তাহলে ভ্যাট দিবে না কেন। ভ্যাট না দিয়েও সে চেইন শপের সমান দামে জিনিষপত্র বিক্রি করছে। এটি সরকার কখনো আমলে নেয়নি। তবে আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা দুনিয়াজোড়া। উন্নত বিশ্বের লোকরা যেমন যেচে আয়কর দেয় তেমনি আয়কর ফাঁকিও দেয়। আমরা হয়তো হাজার টাকা ফাঁকি দেই। তারা ফাঁকি দেয় শত কোটিতে। এবং ধরা পড়লে মন্ত্রী মিনিস্টার বলে কোনো কথা নেই। দ- তাকে মাথা পেতে নিতেই হবে। সে দ- বড় কঠোর।
কিন্তু আমরা বিন্দু বিন্দু দিয়েই সিন্ধু করতে পারতাম যা একবারের জন্যও ভাবিনি। বরং রাজনৈতিক স্বার্থে দুর্নীতিকে দারুণভাবে প্রশ্রয় দিয়েছি। দলীয় লোকরা যাতে ব্যাপকভাবে কালো টাকার মালিক হতে পারে এই সরকার এসে সেটি নির্লজ্জভাবে বাস্তবায়ন করেছে। সরকার ক্ষমতায় এসেই একটি বিধান করলো যে, কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে কেউ যে কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে। তার অর্থ দাঁড়ালো এই যে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ঘাট-শ্রমিক লীগ, কুলি-মুজর লীগ এ রকম কোনো লীগ করলেই তিনি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডার দিতে পারবেন। এবং সে টেন্ডারে বিজয়ীও হতে পারবেন। এর অর্থ পরিষ্কার, তিনিতো আর ঐ শতকোটি টাকার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারবেন না। কিংবা তার সে পরিমাণ পুঁজিও নেই। তখন তিনি খুঁজবেন কোনো টাকাওয়ালা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে যিনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে দিতে পারবেন। কুলি-মজুর লীগ সদস্য যিনি টেন্ডার পেয়েছেন তিনি বিপুল অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে কাজটি করার সাব-কণ্ট্রাক্ট দিয়ে দিলেন। ধরা যাক এর বিনিময়ে তিনি ২০ কোটি টাকা পেলেন। সে ২০ কোটি টাকাই কালো টাকা। আর ২০ কোটি টাকা যেহেতু তাকে আগেই ছেড়ে দিতে হলো তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মান কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সাব-কণ্ট্রাক্টওয়ালা এদিক ওদিক থেকে পুরান-ধুরান যন্ত্রপাতি কিনে এনে কোনো মতে কেন্দ্রটি চালু করে দিয়ে বিদায়।
তারপর কেন্দ্রটি কদিন চলল নাচলল তাতে কিছু আসে যায় না। তার মেরামতি বাবদ টেন্ডার ডাকা হলো। আবার ফুটপাত দোকানদার লীগের হয়তো সে টেন্ডার পেলেন। আবারো সাব-কণ্ট্রাক্ট, আবারো দুর্নীতি, আবারো কালো টাকা। এভাবে কালো টাকার এক চক্র তৈরি করেছে সরকার। যেনেশুনেই করেছে। ফলে দেশব্যাপী কালো টাকার আয়কারীদের এখন মহোৎসব চলছে। আর এই মহোৎসব বাস্তবায়নের জন্য দেশে ভারতীয় সীমান্ত পথ দিয়ে আসছে ছোট বড় অসংখ্য অস্ত্র। আমরা এখন হামেশাই সেসব অস্ত্রের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। এই ব্যবহারকারীরা প্রধানত লীগ গোত্রভুক্ত, কখনো কখনো এই অস্ত্রের ব্যবহারে তারা নিজেরাই প্রাণ হারাচ্ছে। কখনো কখনো কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ প্রাণ। আর বিচারিক প্রক্রিয়া এমন আশ্চর্য দুইটি খুনের জন্য তারা এই লীগ গোত্রভুক্তদের একদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। আর ককটেল ছোড়ার ভুয়া অভিযোগে লীগ গোত্রভুক্ত নয় এমন তরুণের সাতদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। সর্বনাশে মহাগ্রাসের দেশ এখন অক্টোপাসের থাবার মতো অষ্টেপৃষ্টে বেঁধে গেছে।
প্রতি বছর সরকার তার আদরের লীগ কর্মীদের জন্য কালো টাকা সাদা করার একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। বছরের শেষে এসে বাজেটের আগে এই ঘোষণা দিয়ে সরকার অন্যদের জানান দিচ্ছে যে, বাছারা এ বছর যারা সুযোগ করতে পারোনি তৈরি হয়ে যাও, অস্ত্র-সস্ত্র যোগাড় করো, আগামী বছর টাকা বানাবে। আওয়ামী মেশিন দিয়ে কালো টাকা সাদা করে নিবে। তারপর সে টাকা দিয়ে যা খুশি তাই করবে।
কালো টাকা সাদা করার যে কোনোই উপকারিতা নেই তেমন কথা আমরা বলছি না। কালো টাকা সাদা হয়ে যদি তা উৎপাদনখাতে বিনিয়োজিত হয় তাহলে কর্মসংস্থান হবে। উৎপাদিত পণ্যে বাজার ও রফতানির চাহিদা মেটে। কিন্তু এ কাজটি অন্যান্য দেশে করা হয় হঠাৎ দুই-চার-পাঁচ বছর। বাংলাদেশে এটি ঘটে ফি বছর। ফলে কালো টাকা অস্ত্র-খুন-রাহাজানি এখন এই জনপদে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সমাজের অবক্ষয় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এই অবক্ষয়, এই অস্ত্রবাজি, এই কালো টাকা, কালো টাকা ঘটিত অপরাধ এসব যে দেশকে কোন অতল অন্ধকারে নিয়ে দাঁড় করাবে সে কথা বলা খুবই দুঃসাধ্য। আসলে যেখানে পৃথিবী কেবলই আলোকিত পথের দিকে ধাবিত হয়, উজ্জলতর সম্ভাবনা কেড়ে নিয়ে আসে সেখানে আমরা কেবলই অতল অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছি।
এখানে কে যে আলোর দিশা দেখাতে পারবে সেটি নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। এমন কি এ সরকারের বদলে নতুন যদি কোনো সরকার ক্ষমতায় আসেও তবে তারপক্ষেও এই জঞ্জাল সহজে পরিষ্কার করা সম্ভব হবে না। আমরা তো তিমির বিনাশী হতে চেয়েছিলাম কিন্তু ক্রমেই তিমির বিলাসী হয়ে পড়েছি। এখন আমরা একজন সত্য সাধকের অপেক্ষায় আছি যিনি দেশের জন্য বুক খুলে দাঁড়াতে পারে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন