ভালমন্দ যাই বলি না কেন, রাজনীতি আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। রাজনীতি সঠিক পথে চললে আমাদের জীবনে সুখ বাড়ে, আর ভুল পথে চললে জীবনে দুঃখ বাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে শাহবাগ মঞ্চ এবং হেফাজতে ইসলাম। আর হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু ও রেল কেলেঙ্কারিসহ নানা দুর্নীতির ঘটনা এ বিষযটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, বর্তমান সরকার দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ। বিদায় বেলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক গোলাম রহমানও বলে গেছেন, নখ-দন্তহীন দুদক দিয়ে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। সরকার তো বিগত বছরগুলোতে মহাপরাক্রমে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। বিরোধী দলকে দমন-অবদমন ও চাতুর্যের নানা অংক কষে নির্মূল করতে চেয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের কথা বলে গণতন্ত্রের বাইরে থাকলে যে জনগণের আস্থা হারাতে হয় সে কথাটি আবারো প্রমাণিত হয়েছে। পর পর ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা যে শোচনীয়ভাবে হেরেছে তাতে উপলব্ধি করা যায় যে, সরকারের প্রতি জনসমর্থন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ক্ষমতার আসনে বসলে অনেকের পক্ষেই হয়তো স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা করা সম্ভব হয় না। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা এবং জনভাষাও তখন তাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। এমন বিচ্ছিন্নতার সূত্র ধরেই পতন ঘটে সরকারের। সরকারের বিজয় ও পতন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে সরকারের পতনের চাইতে অনেক বড় বিষয় হলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পতন। এ কারণেই জাতি ও রাষ্ট্রের সুরক্ষা রাজনীতির সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতি ও রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতির মাধ্যমে এমন লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের রাজনীতি এতটাই দুর্বল ও অপরিছন্ন হয়ে উঠেছে যে, সুন্দরভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার এখনও জাতির সামনে গ্রহণযোগ্য কোনো ফর্মুলা হাজির করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকারের একগুয়েমি মনোভাব জনমনে ক্ষোভের মাত্রাই শুধু বৃদ্ধি করছে। এসব বিষয় নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও টিভি-টকশোতে সরকারকে অনেক পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সরকার এসব পরামর্শকে কোনো গুরুত্ব তো দেয়ইনি, বরং উপহাসের ভাষায় বিরক্তি প্রকাশ করেছে। সরকারি দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা সুযোগ পেলেই মিডিয়ার প্রতি বিরূপ সমালোচনা করেছে। সামান্য কারণে অনেক মিডিয়া বন্ধও করে দেয়া হয়েছে। এসব তৎপরতা লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই বলছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। তবে পর্যবেক্ষক মহল এখনই হতাশ হতে চান না। তারা মনে করছেন, দেশের প্রাচীন গণতান্ত্রিক দল হিসেবে শেষ মুহূর্তে এসেও হয়তো আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। বিশেষত গাজীপুর সিটি করপোরেশনসহ পর পর ৫টি সিটি নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের পর সরকারের তো এ বিষয়টি উপলব্ধি করার কথা যে, তাদের দাম্ভিক ও খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণকে জনগণ কোনভাবেই মেনে নেবে না। এমন অবস্থায় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে গণ-আকাক্সক্ষার অনুকূলে পদক্ষেপ নেয়াটাই হবে সরকারের জন্য স্বাভাবিক। এমন প্রেক্ষাপটেই হয়তো গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর কার্যালয়ের সভাকক্ষে ‘গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে পত্রিকাটি। উক্ত আলোচনায় বলা হয়, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনই সমঝোতা হওয়া দরকার। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তা না হলে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ফিরবে না। নির্বাচন পদ্ধতি, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি স্থিতিশীল অবস্থা দাঁড় করানো যাবে না। গোলটেবিল আলোচনায় রাজনৈতিক দলের নেতা ও নানা পেশার মানুষ এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, রাজনীতিতে এখন সংকট হলো আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে। এর সমাধান নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের হাতে নেই। এর সমাধান করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। এই জন্য তাদের আলোচনায় বসতে হবে, একটা পদ্ধতি বের করতে হবে। আর নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ কারচুপির রাজনীতি করেনি, বিএনপিকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, এখন আর কারচুপি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে বিএনপি মনে করে না। বিএনপির প্রস্তাব হলো, দুটি বড় জোট আলোচনার মাধ্যমে দশজন নির্দলীয় লোককে বাছাই করবে। ঐ দশজন একজনকে প্রধান হিসেবে বেছে নেবেন। বিএনপি মনে করে এটা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। নির্বাচনের সময় সব দল সমান সুবিধা পাবে। জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সংবিধান সংশোধনের সময় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আরো দুই মেয়াদের জন্য রাখার কথা ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ সময় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কারণে সংবিধান থেকে তা বাতিল করা হয়। এদিকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, শেখ হাসিনা বলছেন ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলে নির্বাচন হবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তো এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। যেখানে দুই প্রধান দলের দুই নেত্রী একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন না, কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্কে নামেন না সেখানে কিভাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব? তিনি উপস্থিত তিনটি দলের নেতার কাছেই প্রশ্ন করেন, এই আস্থাহীনতায় কিভাবে সরকার অন্যান্য দলগুলোকে নির্বাচনে আনবে?
গোলটেবিল আলোচনায় বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট কোথায় তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে সম্ভব তার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। আর সংবিধান তো কোনো বাইবেল নয় যে, দেশের কল্যাণে তার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সরকার চাইলে খুব সহজেই সংবিধান সংশোধন করে গণআকাক্সক্ষার অনুকূলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে। পর পর ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তো দেশের জনগণ রায়ের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে, সরকারের একরোখা দাম্ভিক মনোভাবকে তারা পছন্দ করছে না। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকার জরিপেও লক্ষ্য করা গেছে যে, দেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে চায়। তাই আমরা মনে করি, গণতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা যখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তখন গণআকাক্সক্ষার অনুকূলেই আগামী নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয়। বর্তমান সময়ে জাতির কাছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করা যাবে না তা নয়, তবে সে সময়টা এখনও আমাদের রাজনীতিতে আসেনি। আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলে, আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হলে, তখন জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠবে যে, আমাদের আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকার নেই। এমন দিনের অপেক্ষায় আমরা প্রহর গুণছি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন