বাংলাদেশের মানুষের কাছে ইফতার একটি প্রিয় বিষয়। রমযানে ইফতারের সৌন্দর্যই আলাদা। ইফতারে খাদ্যের চাইতেও বেশি কিছু থাকে থাকে সৌহার্দ্য, প্রার্থনা ও মিলনের অনুভূতি। ইফতারের টেবিলে শুধু রোজাদাররাই বসেন না, বসে ছোট্ট শিশুরাও। আর ইফতারের সামাজিক অনুষ্ঠানেতো ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও উপস্থিত হন সানন্দে। ইফতারের পবিত্র পরিবেশে মানুষ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং মহান ¯্রষ্টার কাছে কামনা করেন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ। এমন প্রেক্ষাপটে ইফতার বিষয়টি এখন ব্যক্তি ও পরিবারের গ-ি পেরিয়ে সামাজিক সংস্কৃতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রমযান মাসে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলও ইফতার পার্টির আয়োজন করে যাচ্ছে। বিষয়টিকে বাংলাদেশের মানুষ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই গ্রহণ করেছে। ইফতারের জমজমাট পরিবেশ থেকে সহজেই বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।
আমরা জানি, যে কোনো বিষয়ে সফলতার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়ত ও লক্ষ্যের স্বচ্ছতা। এ বিষয়ে ঘাটতি থাকলে ভাল উদ্যোগও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আর ইফতার পার্টির মত অনুষ্ঠানে সংযম, পরিমিতিবোধ ও বক্তব্যের যথার্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই পবিত্র ধর্ম ইসলাম সীমা লংঘন না করার জন্য বার বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কোনো কোনো ইফতার পার্টিতে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ঘরানার ইফতার পার্টিতে অনেক ক্ষেত্রে সীমালংঘনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে জাতি আরো সচেতনতা কামনা করে।
আমরা জানি, জাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ সময় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রয়োজন, প্রয়োজন সঙ্গত চিন্তা-চেতনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং দিন দিনই যেন অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশবাসীর আশা ছিল, পবিত্র রমযান উপলক্ষে হয়তো বরফ গলবে। ইফতার পার্টির সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তেমন একটি মাধ্যম হতে পারে। তেমন সম্ভাবনা উঁকিও দিয়েছিল। গত ১৩ জুলাই রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্মানে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার এলডি-২ হলে ইফতার পার্টির আয়োজন করেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আমন্ত্রিত বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা পার্টিতে উপস্থিত হলেও আওয়ামী লীগ সেখানে যোগ দেয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের পার্টিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। এ কারণে জনমনে কিছুটা আশাবাদেরও সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সরকারি দল আওয়ামী লীগ এ রমযান মাসেও বিরোধীদলীয় নেত্রীর দাওয়াতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হলো না। উক্ত ইফতার পার্টিতে ১৮ দলীয় জোটের নেতারা ছাড়াও জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জেএসডির নেতারা অংশ নেন। ইফতারের আগে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন তারা। ইফতারের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমরা সব দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। যারা এসেছেন আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আওয়ামী লীগের আসার কথায় আমরা উৎসাহী ও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য তারা আসেননি। ” জামায়াত নেতাদের দাওয়াত দেওয়ায় আওয়ামী লীগ আসেনি এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মীর্জা ফখরুল বলেন, “এটা কোনো অজুহাত নয়। তারা (আওয়ামী লীগ) অনেকবার জামায়াতের সঙ্গে বসেছে, এখন তারা বলছে জামায়াত যুদ্ধাপরাধী। এটা আসলে আওয়ামী লীগের পুরানো চরিত্র।” এদিকে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ ইফতারে না আসায় একটি সমঝোতার সুযোগ হারিয়েছে। ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের যোগ না দেয়ার ঘটনায় কাজী জাফর আহমদ বলেন, এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এখানে আওয়ামী লীগের অংশ না নেয়াটা দুঃখজনক ঘটনা। তারা আসলে রাজনীতিবিদদের একটি মিলন মেলা সৃষ্টি হতো। আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, জনগণের ভাষা বুঝুন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করুন। দেশব্যাপী আন্দোলন ও পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছে তাকে যৌক্তিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে হবে।
বিএনপির ইফতার পার্টিতে না যেয়ে আওয়ামী লীগ যে বড় মাপের একটি ভুল করেছে তা দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের মন্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়। আমরা জানি ইসলাম ধর্মে দাওয়াত প্রদান এবং গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিনা কারণে কিংবা অযৌক্তিক অজুহাতে দাওয়াতকে অবজ্ঞা করা ইসলাম ধর্মে একটি গর্হিত কাজ। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা বিবেচনা করে দেখেছেন কিনা জানি না। আর মুখে মুখে তারা সমঝোতা ও শান্তির যে কথা বলেন, বাস্তব আচরণে তার পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া ইফতার পার্টিতে জামায়াত নেতারা আসলে তারা আসবেন না, একথাও যুক্তির কষ্টিপাথরে টেকে না। কারণ ইতঃপূর্বে তারা জামায়াতের সাথে বহুবার বসেছেন, এক সাথে আন্দোলনও করেছেন। আর ইফতার পার্টির মতো একটি পবিত্র ও মহতী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক বাহাস ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি টেনে আনলে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভেদ ও বিদ্বেষ দূর হবে কেমন করে? তাই মানতে হয়, বদরুদ্দোজা চৌধুরী যথার্থই বলেছেন যে, ইফতার পার্টিতে না এসে আওয়ামী লীগ সমঝোতার একটি সুযোগ হারিয়েছে।
আমাদের রাজনীতিবিদরা তো রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের ধর্মপ্রবণ বলে পরিচয় দিতে ভালবাসেন। আর নির্বাচনের সময় তাদের ধর্ম চর্চার তৎপরতা যেন বেড়ে যায়। তখন অনেকের মাথায় টুপি ওঠে, কারো মাথায় ঘোমটা শোভা পায়, তাসবিহও দেখা যায় কারো কারো হাতে। তবে বিজ্ঞজনরা বলেন, ধর্ম চর্চা ভাল, তবে ধর্মের প্রদর্শন ভাল নয়। বাংলাদেশের নির্বাচনে ধর্ম চর্চা ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও যেন প্রবেশ করেছে। সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সনাতন হিন্দুদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট পেতে তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান বদলে ফেলেছেন। সভা-সেমিনারে এখন তিনি ‘বন্দেমাতরম জয়হিন্দ ইনশাল্লাহ’ বলে উপস্থিত জনতার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শনে গেলে পর্দানশীন সাজতে গায়ে চাপান বিশেষ ধরনের স্কার্ফ। এসব দেখে বলা যায়, ধর্মনিষ্ঠ রাজনীতি আর ভোটের জন্য ধর্ম প্রদর্শনের রাজনীতি এক জিনিস নয়।
বর্তমান সময়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিভ্রান্তি যেন শিকড় গেড়ে বসেছে। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতি করেন তাদের যেমন মন্দ বলা হয়, তেমনি ধর্মকে জীবনদর্শন হিসেবে বিশ্বাস করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যারা করেন তাদেরকেও মন্দ বলে চিহ্নিত করার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, কমিউনিজমকে জীবনদর্শন হিসেবে বিশ্বাস করে রাজনীতি করা যাবে, পুঁজিবাদ কিংবা নাস্তিক্যবাদকে বিশ্বাস করে রাজনীতি করা যাবে কিন্তু ইসলামকে বিশ্বাস করে রাজনীতি করতে গেলে আপত্তি উঠবে কেন? ইসলাম কি একটি জীবনদর্শন নয়? ইসলাম যদি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি জীবনদর্শন হয়ে থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে রাজনীতি করার অধিকার পৃথিবীর যে কোনো মানুষের রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদেরও এ অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। ইসলামী জীবনদর্শন ও ইসলামী রাজনীতির ভিত্তিতে একটি অন্ধকার সমাজকে যে আলোকিত করে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছানো যায়, তেমন উদাহরণ এ পৃথিবীতে রেখে গেছেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। ইসলাম ও ইসলামের নবীর কার্যক্রমকে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে স্বীকার করে নিলে, তার আলোকে কেউ যদি বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায় তাহলে তেমন তৎপরতাকে সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী তৎপরতা হিসেবে বিষোদগার করা কি বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি মন্দ কৌশল নয়? বাংলাদেশে কি এমন কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি আছেন যার কোনো ভুল নেই বা যাদের কোনো সমালোচনা হয় না। বাংলাদেশে যারা ইসলামী রাজনীতি করেন তারাও মানুষ। তাদেরও ভুল হতে পারে। তবে ভুলের সমালোচনা করা এক জিনিস, আর উৎখাতের কথা বলা ভিন্ন জিনিস। ভুলের জন্য উৎখাত কিংবা নির্মূল তত্ত্বকে মেনে নিলে তো এই সমাজে আর কারো বসবাসের সুযোগ থাকবে না। হিংসা-বিদ্বেষ আর নির্মূলের জঘন্য রাজনীতিতে স্বপ্নের সোনার বাংলা পরিণত হবে এক নারকীয় বাংলায়। এমন পরিণতি কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের রাজনীতি যেন সে দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। বিএনপির ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের না যাওয়ার ঘটনা তারই একটি ছোট্ট প্রমাণ। রমযানের এই পবিত্র সময়ে মানুষের মধ্যে পরকালের জবাবদিহিতার ভয় জাগ্রত হয়। তেমন চেতনা থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি আপন আপন ভুল ত্রুটি নির্ণয়ে আত্মসমালোচনায় উদ্বুদ্ধ হন তাহলে জাতি বেঁচে যেতে পারে। এ পথে আমাদের রাজনীতিবিদরা অগ্রসর হন কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন