সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৩

শ্রমিক ভোটারদের আক্ষেপ


গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে লক্ষ্য করা গেছে টানটান উত্তেজনা। এই নির্বাচন নিয়ে কত কথা, কত প্রতিশ্রুতি। স্থানীয় এই নির্বাচনে জাতীয় পর্যায়ের নেতারা যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন, তাতে স্থানীয় নেতারা দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ পাননি। এছাড়া নির্বাচনী প্রচার প্রপাগা-ায়ও লক্ষ্য করা গেছে স্থানীয় ইস্যুর চাইতে জাতীয় ইস্যুর প্রাধিকার। এমন চিত্র থেকে স্পষ্টই উপলব্ধি করা যায় যে, আমাদের জাতীয় রাজনীতির অনেক বিষয়ে জনমনে ক্ষুব্ধভাব বিরাজ করছে। গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে আমাদের রাজনীতি এখনও যে অনেক পিছিয়ে আছে তা উপলব্ধি করা যায় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পরিস্থিতি থেকে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনে হার-জিতের বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। নির্বাচনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুসরণ করা হলে হার-জিতের ঘটনায় কলহ বা সংঘাত বাড়ে না, বরং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার চেতনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নির্বাচনে যদি দমন-অবদমন, দাপট ও নিপীড়ন গুরুত্ব পায়, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয় এবং গণতন্ত্রের সংকট বাড়ে। এ কারণে গাজীপুর নির্বাচন প্রসঙ্গে যখন ‘শ্রমিকদের ভোটাধিকার থাকতে নেই’ শিরোনামে সংবাদ মুদ্রিত হয়, তখন নির্বাচন নিয়ে সঙ্গত কারণেই ভাবতে হয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, গরীব মানুষ আর শ্রমিকদের ভোটাধিকার থাকতে নেই বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার কয়েকজন ভোটার। তারা বলেন, নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারবো না। হয় বাড়ির মালিক, কারখানার মালিক অথবা প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির ইচ্ছায় ভোট দিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগরী এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার শিল্প ও পোশাক কারখানা। এতে নিয়োজিত আছেন বিপুল শ্রমিক। তাদের মধ্যে ভোটারের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। বেশির ভাগ শ্রমিকই ভাসমান ও দরিদ্র। তাই এলাকায় তাদের চলতে হয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। এখানকার একটি বড় পোশাক কারখানার কয়েকজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার কারখানার সব শ্রমিক ভোটারদের ১৪দল সমর্থিত দোয়াত-কলম মার্কায় ভোট দিতে বলেন। এর অন্যথা হলে তাদের চাকরি হারাতে হবে। এতে কারখানার শ্রমিক ভোটার, যারা মেয়র ও কাউন্সিলার নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন বলে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করতেন, এখন তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কারণ যদি প্রার্থী হেরে যায় তবে তাদের চাকরি হারাতে হবে। তারা আরো জানান, কয়েকদিন আগে পাশের কয়েকটি পোশাক কারখানার মালিক ও কর্মকর্তারা সেখানকার শ্রমিকদের একই নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া আরো প্রচারণা চালানো হয় যে, ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীর টেলিভিশন মার্কায় ভোট দিলে নারী শ্রমিকদের কারখানায় কাজ করতে দেবে না। এসব চাপ ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় অনেক শ্রমিকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়। তারা জানান, স্থানীয় পোশাক কারখানাগুলোর ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ মালিক পক্ষের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে। তারা আন্দোলনরত নিরীহ শ্রমিকদের মারধর করে। বেতনের পর রাস্তার মোড়ে মোড়ে হামলা করে শ্রমিকদের টাকা-কড়ি ছিনিয়ে নেয়। এছাড়া শ্রমিক নির্যাতন এবং রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশন্্স-এর ঘটনার সমুচিত জবাব তারা নির্বাচনের মাধ্যমে দেবে।
আমরা জানি, ভোটের লড়াইয়ে অনেক প্রচার-প্রপাগা-া হয়, নানা বিভ্রান্তিও ছড়ানো হয়, হুমকি ধমকিও প্রদান করা হয়। এসব তৎপরতার অনেক কিছুই গণতন্ত্র সম্মত নয়। তবুও অনাকাঙ্খিত বিষয়গুলো সহনীয় মাত্রার মধ্যে থাকলে মানুষ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রেখে ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শ্রমিকদের ওপর ক্ষমতাসীন জোটের নেতা-কর্মীরা যেভাবে হুমকি-ধমকি ও চাপ প্রয়োগের তৎপরতা চালিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়েছে। নইলে শ্রমিকরা আক্ষেপ করে কেন বলবে, ‘শ্রমিকদের ভোটাধিকার থাকতে নেই’। দলমত নির্বিশেষে কোনো দল বা জোট যদি চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাহলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। কোনো ব্যক্তি, দল বা জোটের স্বার্থে এমন হুমকিকে মেনে নেয়া যায় না। কারণ ব্যক্তি, দল বা জোটের চাইতেও দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও সংস্কতি। দেশে যারা রাজনীতি কিংবা জনসেবার কাজটি করতে চান তাদের এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads