অ লি উ ল্লা হ নো মা ন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৩ সদস্যের বহর নিয়ে লন্ডন সফরে রয়েছেন। রাষ্ট্রীয় খরচে এই সফর। সফরে তার বোন রেহানার মেয়ে টিউলিপের বিবাহ-উত্তর অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। বিবাহ-উত্তর অনুষ্ঠান উপলক্ষেই মূলত এই সফরের আয়োজন। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বোনের পরিবারও বিধর্মীদের সঙ্গে আরও একটি আত্মীয়তায় প্রবেশ করল। শেখ রেহানার ছেলেও বিধর্মী মেয়েকে বিয়ে করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় আমেরিকায় বিয়ে করেছেন একজন বিধর্মীকে। প্রধানমন্ত্রী মাত্র কয়েক দিন আগে তার ছেলের বউ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বলে জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে উল্লেখ করেন। এই পুত্রবধূ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই গর্ববোধ করেন। তিনি ফতোয়া দিয়েছেন খ্রিস্টানরা আহলে কিতাবি। আহলে কিতাবিদের বিয়ে করা জায়েজ রয়েছে। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বা বোনের মেয়ের জন্য উপযুক্ত বাঙালি কোনো বর, কনে খুঁজে পাননি বা বাংলাদেশের প্রতি তাদের দরদ বেশি! এজন্য বিদেশি ও বিধর্মীদের বিয়ে করে আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্প্রসারণ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুলের জামাতাও বাংলাদেশের ফরিদপুরের বিখ্যাত রাজাকারের নাতি। অর্থাত্ বাঙালি না কেউ-ই। প্রধানমন্ত্রী ও তার বোনের বেয়াই পরিবার হয় বিধর্মী না হয় অবাঙালি। কারণ রাজাকার তো আর বাঙালি হতে পারেন না। এটা হতেই পারে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে বেশিকিছু বলা উচিতও নয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির(?) নাতি-নাতনিরা অবাঙালির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলেন। দেশপ্রেমের কথা বলে তারা মানুষের কাছে ভোট চাইতে যান। এজন্যই আসলে কথাগুলো বলা। সেটা যাক।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে রাষ্ট্রীয় টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথা বলার কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিবাহ-উত্তর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাষ্ট্রীয় খরচে ৪৩ জনের বহর নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেন।
এই সফরে বিয়ে অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করছেন ব্রিটিশ কর্তাদের সঙ্গেও। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের কথা রয়েছে।
আসার পর পরই তিনি ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের সরকার ও নির্বাচনের উদাহরণ দিয়েছেন। বৈঠকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন। অবাধ নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্রিটিশ সরকার দেখতে চায়। এটাই হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের সরকারের উদাহরণ দেন। ব্রিটেনে বিদায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটেনে ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস চলছে। তাদের নাগরিকদের রয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। পুলিশ মানবাধিকারকে সবচেয়ে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। মানবাধিকার হরণ নয়, মানবাধিকার রক্ষার জন্য পুলিশ সতর্ক থাকে। ব্রিটিশ সরকারি অফিস-আদালতগুলো চলে তাদের নিজস্ব রুলস্্ অনুযায়ী। আদালতের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় সেটা রয়েছে ব্রিটেনে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আদালত আইনের মূল্যায়নে রায় দেয়। এজন্যই মূলত গ্রেট ব্রিটেন।
বিপরীতে বাংলাদেশের আইন-আদালত, পুলিশ পুরো উল্টা অবস্থানে। সরকারি ইশারায় বাংলাদেশে আইন চলে। আদালত আইনকে সরকারের ভাষায় ব্যাখ্যা করে। বাংলাদেশে আইন আদালত নিজস্ব গতিতে চলে না। নাগিরকদেরও কার্যত কোনো অধিকার নেই। সব অধিকার হরণ করেছে সরকার। সুতরাং ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে পার্লামেন্ট নির্বাচন বাংলাদেশে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
শুধু কি তাই? প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিটেনের রাজনীতিবিদ বা প্রধানমন্ত্রী কি সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করেন? ব্রিটেনে কি রাজপথে গণহত্যা চালানো হয়! হত্যাকাণ্ডের পর কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন যে রাস্তায় প্রতিবাদীরা রঙ মেখে শুয়ে ছিল! এখানে নির্বাচনের আগে মিথ্যা কথা বলার কারণে মন্ত্রিত্ব চলে যায়। বর্তমান ব্রিটিশ সরকারেও এ ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মতো কি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ করেছে? ব্রিটেনে কি শেয়ার মার্কেট লুটপাট হয়! হলমার্কের মতো অখ্যাত কোম্পানিকে কি ব্রিটেনের কোনো ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লুটপাটের সুযোগ দেয়? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগের পর ওই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ সফরে যান? বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সৈয়দ আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সফরে রয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে যার মন্ত্রিত্ব চলে গেছে, সেই সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রেমিক হিসেবে সার্টিফিকেট দেন, সঙ্গে বিদেশ সফরে নেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে সরকারের উদাহরণ দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখানে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেরকম-ই হবে। ব্রিটেনে যেমন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অথচ মাগুরার উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বাংলাদেশে মাসের পর মাস জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তার দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বসানোর জন্য রাস্তায় লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জে বর্তমান রাষ্ট্রপতির ছেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচন মাগুরার উপনির্বাচনকে হার মানিয়েছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের-ই বিদ্রোহী প্রার্থী। জনগণের ভাষা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছায় না। কারণ কান বিশেষজ্ঞ প্রাণ গোপালের তথ্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কানে সমস্যা রয়েছে। এজন্যই হয়তো জনগণের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সর্বশেষ গাজীপুরেও পরাজয় বরণ করতে হয়েছে সরকারদলীয় প্রার্থীর। এই গণরায় থেকেও প্রধানমন্ত্রী কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন না। ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়কের জন্য গো-ধরেছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে তার পছন্দের তত্ত্বাবধায়কপ্রধান বানানোর জন্য কী না করেছিলেন সেটা দেশের মানুষ-ই সাক্ষী। এবার তার অধীনে নির্বাচনের জন্য আবার উল্টা গো-ধরেছেন। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের, কষ্ট বাড়ছে দেশের মানুষের।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে ৫টায় তিনি লন্ডনে পৌঁছেন। যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন সেই হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। তার আগমন উপলক্ষে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি নিয়েছিল ১৮ দলভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। কালো পতাকার সঙ্গে অনেকেই বাড়তি জুতাও নিয়ে আসে। লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীকে প্রদর্শন করা। ব্রিটেনে ইসলামি দলগুলোর অবস্থানও অনেকটা শক্তিশালী। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামা, সেফ বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠনের রয়েছে অনেক শক্ত অবস্থান। বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মীরা হাজির হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশী এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে স্বাগত জানানোর জন্য। জুতাও প্রদর্শন করা হয়েছে কালো পতাকার সঙ্গে। এই কর্মসূচি পালনের জন্য হোটেলের সামনের রাস্তায় তারা অবস্থান নেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জড়ো হয়েছিলেন এখানে।
দুই পক্ষই পাশাপাশি অবস্থান নেয়ায় সাময়িক উত্তেজনা ছিল হোটেলের সামনের রাস্তায়। কিছুটা হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও বিরোধী জোটের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা পুলিশের হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশ পুলিশকে হিমশিম খেতে দেখা গেছে। ব্রিটেনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হয়তো ব্রিটিশ পুলিশকে এরকম পুরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না কখনও। গত সাড়ে ৬ মাসের নির্বাসিত জীবনে ব্রিটেনের স্থানীয় রাজনীতির পাল্টাপাল্টি কোনো কর্মসূচি কখনও চোখে পড়েনি। পত্রিকার পাতায়ও দেখিনি এরকম কোনো ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশকে তত্পর থাকতে দেখেছি বহুবার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ উত্তেজনা রয়েছে এখানেও। বাংলাদেশে কোনো কিছু হলেই পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কমিটি রয়েছে ব্রিটেনে। এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা কাজের ফাঁকে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দেশের প্রতি ভালোবাসার টানেই মূলত রাজনীতি নিয়ে প্রবাসীদের ব্যস্ত থাকা। সবাই থাকেন দেশ নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ রয়েছে ব্রিটেনজুড়ে। কিন্তু বাংলাদেশীদের মতো এত রাজনৈতিক উত্তাপ নেই কোনো দেশের মানুষের মধ্যে। সেই উত্তাপ থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সফরেও ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ মানুষ কালো পতাকা, জুতা নিয়ে আসেন প্রতিবাদ জানাতে। অন্য কোনো দেশের নাগরিকের মধ্যে এরকম প্রবণতাও নেই। এটাকে আমি মনে করি আমাদের জাতির জন্য একটি লজ্জাও বটে। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন না বাংলাদেশের শাসকরা। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হলে হয়তো এরকম হতো না। ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে সরকার পরিচালনা করলে তো আর এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হোটেলে প্রবেশ করিয়েছেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। কালো পতাকা এবং জুতা প্রদর্শনের জন্য যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হোটেল-কক্ষে পৌঁছায় পেছনের দরজা দিয়ে। যারা এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের অনেকের কাছেই আমি প্রশ্ন করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর সফরে আপনারা জুতা প্রদর্শন করলেন কেন? উত্তরে একটাই জবাব তাদের। যে দেশে আলেম-ওলামাকে হত্যা করা হয়, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী আলেম-ওলামা হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলেন, লাল রঙ লাগিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা রাস্তায় শুয়ে ছিলেন বলে হত্যাকাণ্ডকে উপহাস করেন, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আসলে তো কালো পতাকা এবং জুতা ছাড়া আর কিছু দেখানো যায় না। তারা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। উপস্থিত সবাই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্যই তাকে কালো পতাকা এবং জুতা প্রদর্শন করা হয়। ব্রিটেনের পুলিশ এবং যারা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছিলেন সবাই বাংলাদেশের নাগরিকদের এই রকম বিক্ষোভ দেখলেন। তাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ল না কমল সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। তবে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে সেটা স্পষ্ট। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই কালো পতাকা কর্মসূচিতে বাড়তি জুতা নিয়ে এসেছেন অনেকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা দলমত নির্বিশেষে স্বাগত জানালে দেখতে ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। কবে বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে বিদেশে স্বাগত জানাবে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সেই অপেক্ষায় থেকেই আজকের লেখা শেষ করলাম।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে রাষ্ট্রীয় টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথা বলার কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিবাহ-উত্তর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাষ্ট্রীয় খরচে ৪৩ জনের বহর নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেন।
এই সফরে বিয়ে অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করছেন ব্রিটিশ কর্তাদের সঙ্গেও। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অলপার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের কথা রয়েছে।
আসার পর পরই তিনি ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের সরকার ও নির্বাচনের উদাহরণ দিয়েছেন। বৈঠকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন। অবাধ নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্রিটিশ সরকার দেখতে চায়। এটাই হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের বক্তব্য। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের সরকারের উদাহরণ দেন। ব্রিটেনে বিদায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটেনে ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস চলছে। তাদের নাগরিকদের রয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা। পুলিশ মানবাধিকারকে সবচেয়ে ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। মানবাধিকার হরণ নয়, মানবাধিকার রক্ষার জন্য পুলিশ সতর্ক থাকে। ব্রিটিশ সরকারি অফিস-আদালতগুলো চলে তাদের নিজস্ব রুলস্্ অনুযায়ী। আদালতের স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় সেটা রয়েছে ব্রিটেনে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আদালত আইনের মূল্যায়নে রায় দেয়। এজন্যই মূলত গ্রেট ব্রিটেন।
বিপরীতে বাংলাদেশের আইন-আদালত, পুলিশ পুরো উল্টা অবস্থানে। সরকারি ইশারায় বাংলাদেশে আইন চলে। আদালত আইনকে সরকারের ভাষায় ব্যাখ্যা করে। বাংলাদেশে আইন আদালত নিজস্ব গতিতে চলে না। নাগিরকদেরও কার্যত কোনো অধিকার নেই। সব অধিকার হরণ করেছে সরকার। সুতরাং ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে পার্লামেন্ট নির্বাচন বাংলাদেশে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
শুধু কি তাই? প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিটেনের রাজনীতিবিদ বা প্রধানমন্ত্রী কি সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার করেন? ব্রিটেনে কি রাজপথে গণহত্যা চালানো হয়! হত্যাকাণ্ডের পর কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন যে রাস্তায় প্রতিবাদীরা রঙ মেখে শুয়ে ছিল! এখানে নির্বাচনের আগে মিথ্যা কথা বলার কারণে মন্ত্রিত্ব চলে যায়। বর্তমান ব্রিটিশ সরকারেও এ ঘটনা ঘটেছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মতো কি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ করেছে? ব্রিটেনে কি শেয়ার মার্কেট লুটপাট হয়! হলমার্কের মতো অখ্যাত কোম্পানিকে কি ব্রিটেনের কোনো ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লুটপাটের সুযোগ দেয়? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্নীতির অভিযোগের পর ওই ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশ সফরে যান? বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সৈয়দ আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সফরে রয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে যার মন্ত্রিত্ব চলে গেছে, সেই সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রেমিক হিসেবে সার্টিফিকেট দেন, সঙ্গে বিদেশ সফরে নেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে সরকারের উদাহরণ দিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখানে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেরকম-ই হবে। ব্রিটেনে যেমন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অথচ মাগুরার উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বাংলাদেশে মাসের পর মাস জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তার দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বসানোর জন্য রাস্তায় লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। গত সপ্তাহে কিশোরগঞ্জে বর্তমান রাষ্ট্রপতির ছেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচন মাগুরার উপনির্বাচনকে হার মানিয়েছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের-ই বিদ্রোহী প্রার্থী। জনগণের ভাষা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছায় না। কারণ কান বিশেষজ্ঞ প্রাণ গোপালের তথ্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কানে সমস্যা রয়েছে। এজন্যই হয়তো জনগণের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর সর্বশেষ গাজীপুরেও পরাজয় বরণ করতে হয়েছে সরকারদলীয় প্রার্থীর। এই গণরায় থেকেও প্রধানমন্ত্রী কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন না। ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়কের জন্য গো-ধরেছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে তার পছন্দের তত্ত্বাবধায়কপ্রধান বানানোর জন্য কী না করেছিলেন সেটা দেশের মানুষ-ই সাক্ষী। এবার তার অধীনে নির্বাচনের জন্য আবার উল্টা গো-ধরেছেন। এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের, কষ্ট বাড়ছে দেশের মানুষের।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে ৫টায় তিনি লন্ডনে পৌঁছেন। যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন সেই হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন দল ও সংগঠন। তার আগমন উপলক্ষে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি নিয়েছিল ১৮ দলভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। কালো পতাকার সঙ্গে অনেকেই বাড়তি জুতাও নিয়ে আসে। লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীকে প্রদর্শন করা। ব্রিটেনে ইসলামি দলগুলোর অবস্থানও অনেকটা শক্তিশালী। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামা, সেফ বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠনের রয়েছে অনেক শক্ত অবস্থান। বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মীরা হাজির হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশী এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে স্বাগত জানানোর জন্য। জুতাও প্রদর্শন করা হয়েছে কালো পতাকার সঙ্গে। এই কর্মসূচি পালনের জন্য হোটেলের সামনের রাস্তায় তারা অবস্থান নেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জড়ো হয়েছিলেন এখানে।
দুই পক্ষই পাশাপাশি অবস্থান নেয়ায় সাময়িক উত্তেজনা ছিল হোটেলের সামনের রাস্তায়। কিছুটা হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ ও বিরোধী জোটের কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা পুলিশের হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশ পুলিশকে হিমশিম খেতে দেখা গেছে। ব্রিটেনের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হয়তো ব্রিটিশ পুলিশকে এরকম পুরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না কখনও। গত সাড়ে ৬ মাসের নির্বাসিত জীবনে ব্রিটেনের স্থানীয় রাজনীতির পাল্টাপাল্টি কোনো কর্মসূচি কখনও চোখে পড়েনি। পত্রিকার পাতায়ও দেখিনি এরকম কোনো ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশকে তত্পর থাকতে দেখেছি বহুবার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ উত্তেজনা রয়েছে এখানেও। বাংলাদেশে কোনো কিছু হলেই পাল্টাপাল্টি সভা-সমাবেশ হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কমিটি রয়েছে ব্রিটেনে। এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা কাজের ফাঁকে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দেশের প্রতি ভালোবাসার টানেই মূলত রাজনীতি নিয়ে প্রবাসীদের ব্যস্ত থাকা। সবাই থাকেন দেশ নিয়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ রয়েছে ব্রিটেনজুড়ে। কিন্তু বাংলাদেশীদের মতো এত রাজনৈতিক উত্তাপ নেই কোনো দেশের মানুষের মধ্যে। সেই উত্তাপ থেকেই প্রধানমন্ত্রীর সফরেও ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ মানুষ কালো পতাকা, জুতা নিয়ে আসেন প্রতিবাদ জানাতে। অন্য কোনো দেশের নাগরিকের মধ্যে এরকম প্রবণতাও নেই। এটাকে আমি মনে করি আমাদের জাতির জন্য একটি লজ্জাও বটে। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন না বাংলাদেশের শাসকরা। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতকে প্রাধান্য দেয়া হলে হয়তো এরকম হতো না। ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলে সরকার পরিচালনা করলে তো আর এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হোটেলে প্রবেশ করিয়েছেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। কালো পতাকা এবং জুতা প্রদর্শনের জন্য যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হোটেল-কক্ষে পৌঁছায় পেছনের দরজা দিয়ে। যারা এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের অনেকের কাছেই আমি প্রশ্ন করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর সফরে আপনারা জুতা প্রদর্শন করলেন কেন? উত্তরে একটাই জবাব তাদের। যে দেশে আলেম-ওলামাকে হত্যা করা হয়, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী আলেম-ওলামা হত্যার পর সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলেন, লাল রঙ লাগিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীরা রাস্তায় শুয়ে ছিলেন বলে হত্যাকাণ্ডকে উপহাস করেন, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আসলে তো কালো পতাকা এবং জুতা ছাড়া আর কিছু দেখানো যায় না। তারা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। উপস্থিত সবাই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্যই তাকে কালো পতাকা এবং জুতা প্রদর্শন করা হয়। ব্রিটেনের পুলিশ এবং যারা রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছিলেন সবাই বাংলাদেশের নাগরিকদের এই রকম বিক্ষোভ দেখলেন। তাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ল না কমল সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। তবে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে সেটা স্পষ্ট। পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই কালো পতাকা কর্মসূচিতে বাড়তি জুতা নিয়ে এসেছেন অনেকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা দলমত নির্বিশেষে স্বাগত জানালে দেখতে ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা হয়নি। হওয়া সম্ভবও নয়। কবে বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে বিদেশে স্বাগত জানাবে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সেই অপেক্ষায় থেকেই আজকের লেখা শেষ করলাম।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন