শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৩

কর্নেল তাহের নায়ক না খলনায়ক?


তাহেরকে নিয়ে এক অদ্ভুত খেলা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। সঙ্গত কারণেই যেহেতু ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহকে বাদ দিয়ে এ দেশের ইতিহাসকে বোঝা যাবে না, সেহেতু বারবার তাহেরকে নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক চলতেই থাকবে। এই বিতর্কের উৎস ষোলোআনা রাজনৈতিক। এটাও আমাদের সবার জানা, এ দেশে যেখানে রাজনীতি সেখানে সত্য বরাবরই মিথ্যার সাগরে খাবি খায়। এ ধরনের মতলবি বিতর্ক রাষ্ট্রীয় জীবনে কখনো কল্যাণকর প্রতীয়মান হয় না। সম্প্রতি তাহেরের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে হাইকোর্টের দেয়া রায় যে এই বিতর্কে নতুন ইন্ধন জোগাবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাহেরের প্রধানত দু’টি পরস্পরবিরোধী মূল্যায়ন চোখে পড়ে। একটি পরে কাছে তাহের এক মহানায়ক। বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের চেহারাই তিনি পাল্টে দিতেন। অন্য পরে কাছে তাহের একজন ষড়যন্ত্রকারী এবং রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্টকারী। এই দুই ধারা অবশ্য ভীষণভাবে অসম। তাহের আমরণ যে রাজনীতিকে লালন করেছেন, তা কখনো বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ আপন করে না নিলেও তাহেরের পে লেখনির বিস্তর উদাহরণ দেয়া চলে। অন্য দিকে, পছন্দ হোক বা না হোক, এটি স্বীকার করতেই হবে যে, জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রাণপুরুষ। এই ধারাটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচারযন্ত্রগুলোর এক ধরনের অবিরাম আক্রমণের মুখেও টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও স্বমহিমায় টিকে থাকবে বলে আশা করা যায়। তার পরেও, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের তাহের ইস্যুতে জিয়ার পে শক্ত অবস্থান নিতে কদাচিৎ দেখা যায়। এর কারণটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাহের এবং জিয়ার জীবনের নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে জিয়াপন্থীদের এই দুর্বল অবস্থানটি আরো অদ্ভুত ঠেকে। এর কারণ কি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের অযোগ্যতা? কোনো বিশেষ কারণে দুর্বল নৈতিক অবস্থান? ঠিক উত্তরটি পাওয়া মুশকিল। তবে ধারণা করি অযোগ্যতা এবং দুর্বল নৈতিক অবস্থান দু’টিরই কিছু ভূমিকা আছে। এই পরিস্থিতি লজ্জাজনক। জাতীয়তাবাদী ধারার বুদ্ধিজীবীরা সময়ভেদে সরকারের সুবিধাভোগী কিন্তু বারবার দেখা যায় দলের সঙ্কটের মুহূর্তে এরা বুদ্ধি, পরামর্শ বা লেখনি নিয়ে দিকনির্দেশনা দিতে অপারগ। কর্মসূত্রে তাহের এবং জিয়ার পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাদের মধ্যে একধরনের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা ল করা যায়, যার মূলে রয়েছে সম্ভবত সেক্টর কমান্ডারদের ভেতরে বিরাজমান একধরনের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, জিয়া প্রথম থেকেই একজন পেশাদার সৈনিকের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ১৯৭১ থেকে একরকম যেন ইতিহাসের দায় মেটাতেই জিয়াকে নানা ভূমিকায় দেখা যায়। অন্য দিকে তাহের শুরু থেকেই একজন রাজনীতিঘনিষ্ঠ সৈনিক। সেনাবাহিনীকে নিয়ে শুরু থেকেই তার অপ্রচলিত ধ্যানধারণা ছিল। তাহের ছিলেন একজন আপাদমস্তক শ্রেণিসংগ্রামী। পেশাগত জীবনে এই অবস্থানের কারণে তাহেরকে বিভিন্ন সময় বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। তাহেরের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি জিয়ার কোনো ধরনের সহানুভূতির প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। ১৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীতে পেশাদারিত্ব ও চেইন অব কমান্ড ভীষণভাবে তিগ্রস্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মতা দখল করেন। এই অভ্যুত্থানের সময় জিয়াকে সেনানিবাসে অন্তরীণ করা হয়। খালেদের এই মতাগ্রহণ ছিল রক্তপাতহীন। ৩ নভেম্বরের পালাবদলের পেছনে কী ধরনের রাজনীতি ক্রিয়াশীল ছিল তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। খালেদের প থেকে যে কারণগুলো দেখান হয়ে থাকে তা হচ্ছে, প্রধানত সেনাবাহিনীতে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার এবং ১৫ আগস্টের নায়কদের সীমাহীন দাপটের নিরসন। ১৫ আগস্টের পর জিয়া একধরনের নীরব অবস্থান গ্রহণ করেন, যা খালেদের চোখে ১৫ আগস্টের নায়কদের হাত শক্তিশালী করারই নামান্তর ছিল। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক রূপটি অস্পষ্ট হলেও এখানে যে একধরনের ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত এবং মতার লড়াই বিদ্যমান ছিল তা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়। খালেদের অভ্যুত্থানের স্থিতি ও স্থায়িত্ব দুটোই ছিল নড়বড়ে। সেনাবাহিনীতে গ্রহণযোগ্যতার অভাব, সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করতে না পারা এবং ঘটনাচক্রে ভারতপন্থী বলে চিত্রিত হওয়ায় দ্রুত খালেদ নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকেন। সেনাবাহিনীতে খালেদের অনুগত অংশটি মুজিবপন্থী বলে বিবেচিত হওয়াটাও সে সময়ের পরিপ্রেেিত ছিল এক বড় ধরনের দুর্বলতা (মনে রাখা দরকার ১৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে তীব্র মুজিববিরোধী আবেগ ক্রিয়াশীল ছিল)। দেশজুড়ে বিদ্যমান এই শূন্যতার এবং সেনাবাহিনীর একধরনের বেহালদশার ভেতর তাহের আরেকটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আঁটেন। ফলে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলির শুরু। যার শেষটুকুর নিয়ন্ত্রণ গণভিত্তিহীন তাহের ধরে রাখতে পারেননি। তাহের একটি পরিষ্কার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তাহের ছিলেন একজন র‌্যাডিক্যাল লেফটিস্ট। বামপন্থার কোনো গণভিত্তি এই ভূখণ্ডে না থাকলেও তাহের একটি উগ্র বাম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। এটা বলে নেয়া ভালো, আমজনতার কাছে এ ধরনের রাষ্ট্রকে শোষণমুক্ত এবং শ্রেণিহীন বলে পরিচয় দেয়া হলেও এর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। উগ্র বামপন্থীদের এটি এক ভাঁওতাবাজি। যা হোক, বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা এবং নেতৃত্বশূন্যতা তাহেরকে একটি মোম সুযোগ এনে দেয়। জাসদ, গণবাহিনী এবং সামরিক বাহিনীতে থাকা তাহের-অনুগত অংশ (বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা) আরো একটি পালটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদকে মতাচ্যুত করতে সম হন। এই মতার পটপরিবর্তন ছিল রক্তাক্ত। তাহের অনুগত সৈনিকদের হাতে বেশ কিছু সেনাকর্মকর্তা খুন হন। এমনকি কোনো কোনো েেত্র তাদের পরিবারের সদস্যরাও রা পাননি। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, তাহের-অনুগত সৈনিকদের স্লোগানের একটি অংশ ছিল ‘অফিসারদের রক্ত চাই’। ‘শ্রেণিহীন’ সেনাবাহিনী গড়ার মানসে তাহের যে ধরনের প্রণোদনার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাতে রক্তয় ছিল একরকম অনিবার্য। ৭ নভেম্বর সকালে খালেদ মোশাররফ দু’জন সহযোগী সামরিক অফিসারসহ নিহত হন। হত্যাকারীদের মধ্যে ছিলেন ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিল। এই দুই সেনাকর্মকর্তা ’৭১-এ খালেদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এমনটিও শোনা যায়, ’৭১-এ নিজ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খালেদ আসাদের জীবন রা করেন। অপশাসন, পুঞ্জীভূত ােভ ও নৈরাজ্যের দাপটে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় ’৭১-এর ঐক্য ও সংহতির কী হাল হয়েছিল তা খালেদের হত্যাকাণ্ড থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়। এ দিকে ক্যান্টনমেন্টের দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। সেনাবাহিনীতে জিয়ার জনপ্রিয়তা ছিল অন্য যেকারো চেয়ে বেশি। জিয়া-অনুগত সেনারা অভ্যুত্থানে অংশ নেন এবং একই সাথে জনসাধারণের একটি বড় অংশ এই অভ্যুত্থানের সাথে সংহতি জানায়। এ পর্যায়ে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি প্রকৃত অর্থেই একটি সিপাহি-জনতার বিপ্লবের চেহারা ধারণ করে। জিয়া মুক্ত হন এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের একক নেতৃত্বের অবস্থানে চলে যান। ’৭১-এর পর আরো একবার ইতিহাসের দায় মেটাতেই যেন জিয়ার এই উত্থান। যুক্তির বিচারে বলা যায়, এ দেশের মানুষের কাছে এবং দিগ্ভ্রান্ত সেনাবাহিনীতে সেই সময়ে জিয়ার চেয়ে গ্রহণযোগ্য আর কেউ ছিলেন না। জিয়ার মুক্তিতে তাহের-অনুগত সৈনিকদের ভূমিকা ছিল। এটিও প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, মুক্তির পর জিয়া তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেনাবাহিনীর ঠিক কোন দলটি জিয়াকে মুক্ত করেন তা নিয়ে কিছুটা বিতর্কের অবকাশ আছে। এই বিতর্ক এই প্রবন্ধের জন্য প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় তার বিশ্লেষণে যেতে চাই না। তাহের নিজে তার শুরু করা এই অভ্যুত্থানের অন্তর্গত দুর্বলতাÑ বাম রাজনীতির প্রতি আমজনতার বিরাগ এবং সেনাবাহিনীতে তার নিজের গ্রহণযোগ্যতার অভাব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। জিয়ার প্রতি বিশেষ কোনো দুর্বলতা না থাকলেও তাহের জানতেন জিয়ার সহযোগিতা ছাড়া উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার নয়। জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে নয়, বরং তাহেরের ভাষায় হি উইল বি আন্ডার মাই ফুট, অর্থাৎ জিয়াকে পায়ের নিচে রেখে তাহের তার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। যে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তাহেরপ্রেমিকেরা সব সময় এড়িয়ে যান তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সাকে পদদলিত করে বাম শাসন চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তাহের কোথায় পেলেন? এই প্রশ্নের ফয়সালা ছাড়া তাহেরের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন অসম্ভব। সেনাবাহিনীতে জিয়ার জনপ্রিয়তা এবং সাধারণ জনতার মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা জিয়াকে মতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করে। জিয়া না বিশ্বাস করতেন বাম ধারায়, না তার সমর্থন ছিল তাহেরের স্বপ্নের অপ্রচলিত ধারার সেনাকাঠামোয়। তাহের ও জিয়ার সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। অভ্যুত্থানকালে রক্তপাত এবং খালেদের মৃত্যু তাহেরের দুর্বল অবস্থানকে আরো দুর্বল করে ফেলে। তাহের যা শুরু করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। খালেদের মতোই তাহের ব্যর্থ হন। দু’জনকেই ব্যর্থতার জন্য দিতে হয় উচ্চমূল্য। জিয়া এবং সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশের ইচ্ছায় তাহেরকে সামরিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। এর ফলে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। তাহেরের বিচারপ্রক্রিয়া ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তাহের আত্মপ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি। বিচারকার্যক্রমে সব বিধিবিধান যথারীতি পালন করা হয়নি। যদিও বিচার চলাকালীন, এমনকি দণ্ড কার্যকর করার সময়ও জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন না, তবুও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ৭ নভেম্বেরের পর থেকে মতার চাবিটি প্রধানত জিয়ার হাতেই ছিল। তাহেরের ওপর যে বিচারিক অবিচার হয়েছে তার দায় জিয়া এড়াতে পারেন না। সে সময়কার বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ বিশ্বাস করতেন, তাহেরকে জীবিত রেখে কোনো অবস্থাতেই সেনা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় এবং দেশ ও সেনাবাহিনীর স্বার্থে বিষয়টির দ্রুত সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। বিচার চলাকালীন ৭ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া রক্তপাতের দায় তাহের অস্বীকার করেন। তাহেরের এই অবস্থান যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সব সেনা অভ্যুত্থানে রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে এবং এর দায়দায়িত্ব নেতৃত্বকেই নিতে হয়। এ কথাটি আরো সত্য হয়ে দাঁড়ায় ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বেলায়। ইতিহাসে এর কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না বললেই চলে। জিয়াকে ‘পায়ের তলায়’ রেখে তাহের তার রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করতে চেয়েছেন। জিয়া ‘পায়ের তলায়’ থাকেননি, দাবার ছক উল্টে যায় এবং তার মাশুল জীবন দিয়ে তাহেরকে মেটাতে হয়। তাহের ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সফল সেক্টর কমান্ডার এবং একজন স্বপ্নচারী বাম রাজনীতিক। স্বপ্ন এবং বাস্তবতার ভেতর বিস্তর ফারাক থাকলে অনেক সময় করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়। তাহেরের েেত্র ঠিক তা-ই ঘটেছিল। ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাহেন্দ্রণ। প্রকৃত অর্থে এর পর থেকেই হোঁচট খেতে খেতে দুর্বল হলেও একটি গণতান্ত্রিক ধারার দিকে দেশ এগিয়ে যায়। তাহেরের দুর্ভাগ্য তার হঠকারী রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হয়নি। পান্তরে এটা বাংলাদেশের জন্য সৌভাগ্য। জনভিত্তিহীন বাম-বিপ্লবের জন্য বাংলাদেশ কখনোই উপযুক্ত ছিল না। বলা যায়, তাহের ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ ভিন্ন মোড়কের আরেকটি বাকশালের হাত থেকে রেহাই পায়। এই লেখায় বারবার বামপন্থীদের জনবিচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুজিব শাসনামলে জাসদ ও গণবাহিনী বিরোধী ধারার সৃষ্টি করে। এর পরেও খুব জোর দিয়েই বলা যায়, ধারাগুলো মোটা দাগে জনসমর্থনহীন ছিল। এর জ্বলন্ত প্রমাণ স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের ফলাফল। বামধারার দলগুলোর ফলাফল রীতিমতো করুণার উদ্রেক করে। এখানে এ কথাও বলে নেয়া ভালো, তাহেরের বিচার চলাকালীন দেশের ভেতর থেকে নিজ দল ছাড়া কোনো প থেকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ এমনকি কোনো ধরনের অভিযোগও উত্থাপিত হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, তাহের সমর্থক জাসদ কর্মীদের বিচার চলাকালীন একটি স্লোগান ছিল ‘রুখো বাকশাল, হটাও জিয়া, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’। এখানে দু’টি কৌতুকপ্রদ দিক আছে। প্রথমটি হচ্ছে তাহের যে ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন তা বাকশালের চেয়ে খুব উন্নততর কিছু ছিল না এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাহেরভক্ত আওয়ামী লীগাররা এমনকি আজকের জাসদ নেতৃত্ব এ কথা বেমালুম চেপে যায়, তাহেরের সংগ্রামের একটি প্রধান দিক ছিল বাকশালী অপশাসনের বিরুদ্ধে। তাহের বন্দনাকারীদের এই মতলববাজি বাংলাদেশের নোংরা রাজনৈতিক কূটচালের একটি বড় উদাহরণ। পুঁজিবাদী আওয়ামী লীগ এবং (তথাকথিত) সমাজবাদীরা অতি সহজে একই সুরে গান ধরে শুধু জিয়াবিরোধী প্রচারণার স্বার্থে। ইতিহাস ও মতাদর্শ চুলোয় যাক। জাতি হিসেবে আমরা অপরিপক্ব। নির্মোহ ইতিহাসচর্চা এ দেশে শেকড় গাড়তে পারেনি। তাই ইতিহাসে তাহের এবং জিয়ার অবস্থান এখনো অনির্ণেয়। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং নিজ নিজ রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই করি। বিরোধী মত যৌক্তিক হলেও তা বিবেচনা করতে চাই না। সামরিক শাসন কখনো কাক্সিত নয়। জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের শুরু একজন সামরিক শাসক হিসেবে। এখানে মনে রাখা দরকার, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে থেকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়া মতা দখল করেননি। এমনকি যে অভ্যুত্থানের ফলে জিয়া মতার কেন্দ্রে চলে আসেন, সেখানেও তার নিজের কোনো বড় ভূমিকা ছিল না। পারিপার্শ্বিকতা এবং দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেেিত জিয়াকে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হয়। এ কথা স্বীকার করতে হবে জিয়া ছিলেন এ দেশে সত্যিকার অর্থে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনাকারী। বাংলাদেশের অন্যান্য শাসকের শাসনামলের মতো জিয়ার শাসন আমলেও ভুলত্রুটি হয়েছে কিন্তু দেশের প্রতি জিয়ার ভালোবাসা এবং মানুষের হৃদয়ে তার যে স্থান তা প্রশ্নাতীত। একজন রাজনীতিবিদের সবচেয়ে বড় যে অর্জনগুলো রয়েছে, তার ভেতর গণমানুষের ভালোবাসা পাওয়াটা অন্যতম। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে জিয়ার বিদায়। এর তাৎপর্য বোঝার দরকার আছে। আজ দেশজুড়ে জিয়াবিরোধী যে প্রচারণা চলছে, তার উপযুক্ত জবাব ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। দুঃখের বিষয় এই বিরামহীন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ধারার বুদ্ধিজীবীরা কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads