গত ১৫ জুন দেশের ৪ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা গোহারা হেরেছিলেন। ক্ষমতাসীনদের সে দগদগে ঘা শুকানোর আগেই মাত্র তিন সপ্তাহ পরই গত ৬ জুলাই নবগঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন মহাজোট প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লা ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় একটি অতি স্বাভাবিক ও অলংঘনীয় প্রক্রিয়া। তাই এ নিয়ে যেমন অতিউৎসাহ দেখানোর সুযোগ নেই, ঠিক তেমনিভাবে পরাজিতকে নিয়ে খিস্তিখেউর করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
প্রধানমন্ত্রী প্রায়শই বলে থাকেন যে, বিরোধী দল সব সময়ই নির্বাচনকে ভয় পায়। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে নাকি জনগণ তাদের জামানত কেড়ে নেয়। তাই তারা বিনা নির্বাচনে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসতেই অসাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকারের বাহানা তুলেছে। মূলত প্রধানমন্ত্রী যে কেয়ারটেকার সরকারকে অসাংবিধানিক বলছেন সে সরকার পদ্ধতি তো সংবিধানের অংশই ছিল এবং তাদের আন্দোলন ও দাবির মুখেই তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আইনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তারা ২০০৮ সালে ফখর-মইনদের সহায়তায় ব্যাপক ক্ষমতায় এসে ব্রুট মেজরিটির জোরে সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলসহ নানাবিধ সংশোধনী এনে রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে আওয়ামী লীগের দলীয় ইস্তেহারে পরিণত করেছে। এ জন্য আদালতের রায়ের দোহাই দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দু’টি নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করার নির্দেশনা ছিল। আর আপিল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সরকার সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছিল। তাই কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিলের ক্ষেত্রে আদালতের রায়ের দোহাই মোটেই ধোপে টেকে না। আর দেশের মানুষ সরকারের এই মওকাটা ভাল করেই বুঝে গেছে। তাই এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
আমার শিক্ষকদের মধ্যে যে কয়জন আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইংরেজী শিক্ষক মরহুম ময়েজ উদ্দীন। যেহেতু তিনি আমাকে খুব ¯েœহ করতেন তাই আমি তাকে অতিমাত্রায় প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতাম। তাকে কোন দিন বিরক্ত বা বিব্রত হতে দেখিনি। তাই একদিন তাকে প্রশ্ন করে বসলাম, নৌকাডুবিকে ইংরেজীতে Capsize বলা হয় কেন ? আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, Capsize অর্থ দাঁড়ায় টুপির আকার ধারণ করা, এক কথায় ‘ টুপিবৎ’ বা ‘টুপীসদৃশ’ । কিন্তু এটাকে নৌকাডুবি বা অন্য কোন সমার্থক অর্থে নেয়া আমি কোনভাবেই মানতে পারছি না। কিন্তু তিনি আমার কথায় সায় দিলেন না। আমিও আমার অবস্থানে অটল রইলাম। শেষে তিনি আমার উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে গর্দভ ‘ পটল তুললে’ যদি মানুষ মরে, আর ‘অর্ধচন্দ্র’ যদি গলা ধাক্কা দেয় তাহলে Capsize নৌকা ডুবাতে বাধা কোথায়’? আর Cats and dogs কে কুত্তা-বিলাই বলবো কেন ?
সেদিনের পর Capsize শব্দটা আমাকে খুব একটা ব্যবহার করতে হয়নি। হয়তো কালে-ভদ্রে এই শব্দটার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে থাকতে পারে। তবে হালে এই শব্দটার সাথে আমার প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ হচ্ছে এবং আমার সেই শ্রদ্ধেয় স্যার মরহুম ময়েজ উদ্দীনের কথাই বারবার মনে পড়ছে। শুধুই কী তাই বরং আমজনতাকে এই শব্দটা নিয়ে কানাঘুষা করতে শোনা যাচ্ছে। দেশের যেখানে নির্বাচন হচ্ছে সেখানেই ক্ষমতাসীনদের কিস্তি Capsize হওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এমন কী রাষ্ট্রপতির ছেড়ে দেয়া কিশোরগঞ্জের একদলীয় উপনির্বাচনেও রাষ্ট্রপতি পুত্র রেদোয়ানকে ‘হাতের পাঁচ’ করেই জিততে হয়েছে। এ অভিযোগ কথিত স্বাধীনতাবিরোধী বা তাদের ভাষায় সেনা তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয়া কেউ করেননি বরং তাদের দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থী মহিতুল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ করেছেন। তিনি ৩১ টি কেন্দ্রে সরকারি দলের ‘গণনয়ছয়’ এর অভিযোগ এনেছেন। এর আগে গাজীপুরের কাপাসিয়ার উপনির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে চাচা-ভাতিজীর নির্বাচনটাও বর্তমান সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করতে পারেনি বরং চাচাজান ¯েœহধন্যা ভাতিজীর বিরুদ্ধে ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু হালে সে অবস্থার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার পক্ষ যতখানি জালিয়াতি করলে নির্বাচনী ফল অনুকূলে নেয়া যাবে বলে মনে করতো তা দিয়ে আর হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য এটা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মাধ্যমে। জনগণের কাছে ধবল ধোলাই হওয়ার আশংকায় সে নির্বাচনে সরকার বাহাদুর নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ‘ হাতের পাঁচ’ করার হুকুম জারি করেছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন নির্বাচন কর্মকর্তা জেসমিন টুলী। তিনি অতকিছু বুঝলেন না। তড়িঘড়ি করে গণরায় ঘোষণা করলেন। মহীউদ্দীনের সা¤্রাজ্য কুপোকাৎ! এরপর উপাখ্যানের দ্বিতীয় পর্ব। ১৫ জুন! খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হলো। সরকারি দলের প্রভাব বিস্তার কম হলো না। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন কেন্দ্র দখল করে গণহারে সিল মারলো, বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের বুথ থেকে বের করে দেয়া হলো। আতংক ও উস্কানি সৃষ্টি করতে কম করা হলো না। ফলে তারা কিছু ভোট সংগ্রহ করতে পারলেন। কিন্তু অনিবার্য পরিণতি পরাজয় এড়ানো সম্ভব হলো না। শুধুমাত্র পরাজয়ের ব্যবধানটা কমানো গেল মাত্র।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উদ্দেশে যে কথা প্রায়শই বলে থাকেন যে, নির্বাচনে তারা নাকি ভরাডুবির আশংকায় কেয়ারটেকার সরকারের অসাংবিধানিক দাবি তুলছে। অথচ এই অসাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর দল আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল পালন করেছিল। কেয়ারটেকার সরকার প্রধান নিজেদের মর্জিমত না হওয়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। লগি-বৈঠার তা-ব চালিয়ে ১/১১ এর প্রেক্ষাপট তৈরী করে সেনা সমর্থিত একটি অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল। এখন তো বাস্তবতা হলো যেখানেই নৌকা ভাসানোর প্রয়াস চালানো হচ্ছে জনগণ তো সেখানেই তলিয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অতিকথন তার জন্যই অভিশাপ হয়ে দাঁড়ালো না তো ? এই অতিকথন সম্পর্কে বন্ধুবর আব্দুল হাই শিকদারের অতিচমকপ্রদ তথ্য পাঠকদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করছি। তিনি একটি নিবন্ধে লিখেছেন,
‘কথার উৎপাদনযন্ত্র জিহবা সম্পর্কে প্রাচীন জাপানী প্রবাদে বলা হয়েছে, দেখতে তিন ইঞ্চি লম্বা হলে কী হবে, ৬ ফুট লম্বা মানুষকে সে মুহূর্তে ধরাশায়ী করতে পারে। সে জন্যই গ্রিক মনীষী পিখাগোরাস বলেছেন, জিহবা দ্বারা কৃত আঘাত অসি দ্বারা কৃত আঘাতের চেয়ে বিষময়। আবার সেই জিহবা যদি মেয়েদের হয় (পাঠিকাগণ আমাকে ক্ষমা করবেন) তাহলে ? চীনা প্রবাদে আছে, মেয়েদের জিহবা হলো তাদের তরবারি। তাতে যাতে মরচে না ধরে, সেদিকে তারা খুবই যতœশীল। হারিবী বলেছেন, এজন্যই তারা অধিক কথা বলে। তাছাড়াও একথা তো সর্বজনবিদিত, যাদের চিন্তাশক্তি কম তারাই বেশি কথা বলে। এ জন্য মনীষী অ্যারিস্টটল বলে গেছেন, বেশি কথা বলা, তা যতই মূল্যবান হোক, নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। ফলে শেক্সপিয়র উপসংহার টেনে বলেছেন, স্বল্পভাষী মানুষই সর্বোত্তম’। ( আমার দেশ, ৭ জুলাই/১৩, ইশপের কচ্ছপ ও প্রধানমন্ত্রীর কথামৃত- আব্দুল হাই শিকদার )
সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের এই বেহাল অবস্থা কেন ? এ ব্যাপারে সরকার ও বিরোধী দলের নানান মূল্যায়ন চলছে। তবে আওয়ামী লীগের এই ভয়াবহ কিস্তি ডুবি যে সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র, বিরোধী দলের উপর জুলুম-নির্যাতন, হামলা, মামলা, গণহত্যা, গণগ্রেফতার, কথিত রিমান্ডের নামে বর্বর নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চরিত্র হনন, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, পদ্মা সেতু, হলমার্ক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, সরকারি দল ও তার অংগসংগঠনের দেশব্যাপী বেপরোয়া নৈরাজ্য, গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, গণমাধ্যমের প্রতি দলন-পীড়ন, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উপর নির্যাতন, পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত, জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টিভি বন্ধ, আত্মস্বীকৃত নাস্তিক-মুরতাদদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ বিরোধী ষড়যন্ত্র এবং শাপলা চত্বরে গণহত্যা যে অন্যতম কারণ তা হলফ করেই বলা যায়। এসব কথার যথার্থতা মেলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য থেকে। তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন যে, সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে। সরকারের একজন মন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি অবশ্যই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কোন সরকারের উপর জনগণ যখন আস্থা হারায় তখন সে সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় থাকার কোন নৈতিক অধিকার থাকে না। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতও অভিন্ন। বিষয়টির একটি অতিচমকপ্রদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ লর্ড ব্রাইস। তিনি বলেছেন,‘ A government in which the will of the majority of the qualified citizens rules........say, at least three-fourths so that the physical force of the citizens coincides with their voting power.’.’ অর্থাৎ যে শাসন প্রথায় জনসমষ্ঠির অন্তত তিন-চতুর্থাংশ নাগরিকের অধিকাংশের মতে শাসনকার্য পরিচালিত হয়, তাই গণতন্ত্র। এক্ষেত্রে এও গ্রহণযোগ্য যে, নাগরিকের ভোটের শক্তি যেন তাদের শারীরিক বলের সমান না হয়।
এমন কী আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমদ বলেছেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাদের ভুল ছিল’। আরেক প্রবীণ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জনগণকে সরকারের ভুল সংশোধনের সুযোগ দানের আহ্বান জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে সরকার বোধ হয় বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। কিন্তু হয়তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ভুলের মাত্রাও বোধ হয় সীমা অতিক্রম করেছে। তাই জনগণ তাদেরকে ভুল সংশোধনের সময় দেবে বলে মনে হয় না। ভুল সংশোধনের মত যথেষ্ট সময়ও হাতে নেই। আর অতীতে আওয়ামী লীগ তাদের ক্রান্তিকালীন সময়ে জনগণের কাছে এমন সুযোগ চেয়ে প্রতারণা করেছে। তারা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও এমনটি করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা আবার সেই অতীত আবর্জনার স্তূপে আটকা পড়েছিল। তাই তাদের কথায় আবার দেশের মানুষ বিভ্রান্ত হবে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বাস্তবতা স্বীকার করলেও অন্যরা এ পরাজয়কে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলীয় মুখপাত্র মাহবুব-উল-আলম হানিফ পরাজয়ের জন্য তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত না নেয়া, প্রার্থী নির্বাচনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অপপ্রচারকে দায়ী করেছেন। আওয়ামী এমপি গোলাম মাওলা রনী চাটুকারদের কথায় অতিবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন। তবে দেশের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলোকে সরকারি দলের করুণ পরাজয়কে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনতার নীরব প্রতিশোধ হিসাবেই দেখা হচ্ছে। যদিও মহাজোটের অন্যতম শরীক সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কথিত গণজাগরণ মঞ্চের কুশীলবদের সমর্থন দেয়াকে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করে পরাজয়কে সরকারের জন্য ১০ নং মহাবিপদ সংকেত আখ্যা দিয়েছেন। তবে সরকার অপশাসন, সীমাহীন ব্যর্থতা, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও জুলুম-নির্যাতনের জন্য গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতারা পরাজয়কে বিভিন্নভাবে মূল্যায়নসহ বিরোধী দল সম্পর্কে নানাবিধ খিস্তিখেউর করলেও তারা একথা জোর গলায় দাবি করে আসছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এতে বিরোধী দলের কেয়ারটেকার সরকারের দাবি অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদও অনুরূপ দাবি করেছেন। কিন্তু অভিজ্ঞ মহল থেকে বলা হচ্ছে সর্বসাম্প্রতিক নির্বাচনে জনগণ বিরোধী দলীয় প্রার্থীদেরকে নির্বাচিত করে বিরোধী দলীয় দাবি-দাওয়া ও অবস্থানের প্রতি গণরায় দিয়েছে। বিশেষ করে জনগণ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে ক্ষমতা চর্চা হতে হবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক উইলোবী ‘( Willoughby) বলেন, It is admitted by all that the state should possess powers sufficiently extensive for the maintenance of its own continued existence against foregin interference, to provide the means whereby its national life may be preserved and developed and to maintain internal order including the protection of life, liberty and proverty.’.’ অর্থাৎ এটি সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে, রাষ্ট্রের আয়ত্তে প্রচুর ক্ষমতা থাকা উচিত যার দ্বারা বৈদেশিক হস্তক্ষেপ প্রতিহত করে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে, জাতীয় জীবনকে সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে পারে এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বিধান করতে পারে।
কিন্ত সরকার দেশ পরিচালনার সকল ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছে এবং অসৎ উদ্দেশ্যেই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে। ফলে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনে পর্যবেক্ষকরা সিটি নির্বাচনকে শতভাগ অবাধ ও নিরপেক্ষ বলেনি। এমনকি গণমাধ্যমগুলোও সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সরকারি দলের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের কথা বেশ জোরেশোরেই বলা হয়েছে। বিরোধী দল সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি তুললেও আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সে কথায় কর্ণপাত করেনি। সেনা মোতায়েন না করার পক্ষে সরকারি দল যেসব যুক্তি দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশনও সেসবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলের সেনা মোতায়েনের দাবির ব্যাপারেও নির্বাচন কমিশন সরকারের অবস্থানকে মেনে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকিব উদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, এই সংশোধনী জনগণ মেনে নিয়েছে। অথচ বিরোধী দলগুলো এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। ফলে একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ নয়। তাই দলনিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনই তাদের পক্ষে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে করা সম্ভব হবে না।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞমহলও একই কথা বলেছেন। তাদের মতে, পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলে সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ ও বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন প্রমাণিত হয়েছে। তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর দাবি আরো জোরালো হয়েছে বলে মনে করেন। তারা মনে করেন নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের বিষয়ে সরকারি দলের আত্মতুষ্টি থাকলেও বেশ কিছু কারণে কমিশন অন্যদের আস্থা অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে বিরোধী দলের সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে দেশ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হবে। তারা মনে করেন, সিটি নির্বাচন বড় ধরনের কারচুপি ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে বলে জাতীয় নির্বাচনও এমন হবে, তা মনে করা সঙ্গত হবে না। তিন কারণে গাজীপুরের নির্বাচনের সাথে জাতীয় নির্বাচন মিলিয়ে ফেলা যাবে না। প্রথমত , গাজীপুরের নির্বাচনে সাড়ে ১০ হাজার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ছিলেন। সেই হিসাবে জাতীয় নির্বাচনে ৩১ লাখেরও বেশি সদস্য প্রয়োজন, যা নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনে পাবে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে গণমাধ্যমের নজরদারী ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারা দেশে একযোগে জাতীয় নির্বাচনে গণমাধ্যম সেভাবে তৎপরতা দেখাতে পারবে না। তৃতীয়ত, গাজীপুর নির্বাচনে কমিশনের পুরো দৃষ্টি ছিল গাজীপুরের দিকে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকল ক্ষেত্রে তাদের সমান দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হবে না। তারা অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন বলিষ্ঠতা দেখাতে পারেনি। গাজীপুরের নির্বাচনের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভূমিকা অথবা সেনা মোতায়েনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বলিষ্ঠ কোন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচন সার্বিক আস্থার বিষয়। কিন্তু সে আস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তারা আরও অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার কারণেই সাম্প্রতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সিটি নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে জনগণ বিরোধী দলের দাবির সাথেই একাত্মতা ঘোষণা করেছে। মূলত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশে সংঘর্ষের রাজনীতি শুরু হবে। তাই দেশ ও জাতিকে মারাত্মক অনিশ্চয়তার হাত থেকে বাঁচাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোন বিকল্প আছে বলে সচেতন মহল মনে করে না। কিন্তু সরকার যদি এই গণদাবি পাশ কাটানোর চেষ্টা করে তা আওয়ামী লীগের জন্যই বুমেরাং হবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দীন আহমদ বলেছেন, সরকার গণদাবিকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগকে ’৭৫ এর চেয়ে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। বাস্তবে কী ঘটে তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন