জনসভা, রোডমার্চ, গণমিছিলসহ সব ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি এবং চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিবার্যভাবে প্রমাণ হয়েছে জনগণ বিরোধী জোটের পে আছেন। এখন এই জনগণের শক্তিকে কী কাজে লাগানো যায়Ñ সেই স্ট্র্যাটেজি আগে বিরোধী জোটকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ঠিক করতে হবে। বিরোধী নেতৃত্বকে একটা বিষয় ভাবতে হবে যে, তারা মতায় যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ধারণ করার পর্যায়ের একটি রাজনৈতিক জোট; দেশে আগামীকাল নির্বাচন হলে বিরোধী জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সমর্থ হবে বলে রাজনৈতিক বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। তাই বিরোধী জোটকে বিভিন্ন কৌশলে বিপথের দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
বিএনপি উদার গণতান্ত্রিক একটি রাজনৈতিক দল। জনগণের মধ্যে বিএনপির জনপ্রিয়তা আজো প্রশ্নাতীত; উদার ও মধ্যপন্থী পরিচয়ের কারণেই সাধারণ মানুষ দলটিকে বারবার ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। উদার গণতান্ত্রিক পরিচয়টা বিএনপিকে অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে। এখানে সমস্যা সৃষ্টি হলে, বিএনপির আর রাজনীতি বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণতান্ত্রিক দাবি। এই দাবির সাথে এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ একমত। অচিরেই এই দাবির পে দেশের সব রাজনৈতিক দল মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। কাজেই ধূম্রজাল সৃষ্টি করে এ দাবি পাশ কাটানো সম্ভব নয়। এই দাবি আদায়ে বিরোধী জোটকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অতঃপর পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তখন দেশের জনগণসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা সঙ্গী হিসেবে কাছে পাবে।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ও গণমাধ্যম। দেশে এখন ২৫টি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও বেশ কয়েকটি মানসম্পন্ন জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি, যা মানদণ্ডে বিশ্বে ১১তম স্থান দখল করেছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন।
তা ছাড়া ব্লগ, ইউটিউব, টুইটারসহ আরো অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ এখন একে অপরের কাছাকাছি। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অতি সহজেই কোটি কোটি মানুষের কাছে যেকোনো বিষয় পৌঁছে দেয়া সম্ভব এবং বাস্তবেও তাই হচ্ছে। কিন্তু নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে তথ্যপ্রযুক্তি ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সর্বতো ব্যবহারে বিরোধী জোট সমর্থ হয়নি। যার কারণে নির্দলীয় সরকারের মতো একটি সর্বজনীন ইস্যুও হালে পানি পাচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের পে কোনো প্রচার-প্রচারণাই চোখে পড়ে না।
শুধু যুদ্ধাপরাধের বিচারই এখানে মূল আলোচ্য বিষয়। ফলে বিএনপির সহযোগী শক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত হচ্ছে। এই বাস্তবতা বিএনপিকে মেনে নিতে হবে। রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আগামী কয়েকটি মাস বিরোধী জোটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে তাদের একটি স্বচ্ছ ও ইমেজ-সম্পন্ন রাজনৈতিক চিত্র দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে স্বল্প সময়ের আন্দোলনে সরকারকে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা কায়েমে বাধ্য করা যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে জনস্রোত কেউ আটকে রাখতে পারেনি। জনস্রোত যে সময় যা চেয়েছে বাস্তবে তা-ই হয়েছে। জনগণ আগামী জাতীয় নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা চান। জনগণের এই আবেগ বিভিন্ন মাধ্যমে পরিস্ফুটিত হচ্ছে, তারা শান্তিপূর্ণ এই দাবির পে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। কিন্তু সরকার যে পথে এগোচ্ছে এটা কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ নয়। আগামী নির্বাচনে যে তাদের শোচনীয় পরাজয় হবে এটি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আগেই তারা জেনে গেছে। তাই অনির্বাচিত ব্যক্তির অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তিকে তারা মেনে নেবে না। একজন অনির্বাচিত ব্যক্তি যার ক্যারিয়ারে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের কোনো রেকর্ড নেই তাকে যদি নির্বাচিত জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে মেনে নেয়া যায়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একজন ব্যক্তিকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে বাধা কোথায়? তাদের এ যুক্তি তো ধোপে টিকে না। তাদের জনগণের দাবি মেনে নিতেই হবে; এ ব্যাপারে কোনো দুরভিসন্ধি ও টালবাহানা মানুষ বরদাশত করবে না।
সরকারের চোখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক মনে হলেও নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টির ফয়সালা না হলে, যেকোনো সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ের দিকে মোড় নিতে পারে। কাজেই মতাসীনদের উচিত বিপজ্জনক রাজনৈতিক ইস্যু জিইয়ে না রেখে, বর্তমান শান্ত পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছা। তাতে আখেরে মতাসীনদেরই ফায়দা হবে সবচেয়ে বেশি। দেশবাসীর কাছে তাদের দায়িত্বশীলতার দিকটি ফুটে উঠবে। ফলে জনগণের চোখে তাদের অনেক ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে যাবে, আগামী নির্বাচনে তারা প্রত্যাশিত ফল পাবে।
আমরা ল করছি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাকেই সরকার সর্বতোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। বিএনপির রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি সরকার আগেভাগেই জেনে যাচ্ছে এবং সেই হিসেবে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে সারা দেশে আন্দোলনে গতিশীলতা দেখা গেলেও কেন্দ্রীয়পর্যায়ে আন্দোলনে ঢিলেঢালা ভাব ল করা যাচ্ছে। তবে একটি বিষয় দিবালোকের মতো সত্য, বিএনপির বিরুদ্ধে ইতিহাসের নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চলছে; সরকারের দমন-পীড়নের মুখে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সরকার এতই বেপরোয়া ও মারমুখো যে, মানুষকে কথা বলার অধিকার পর্যন্ত দিচ্ছে না। এই অবস্থায় রাজনৈতিক কৌশল ঠিক রাখা কঠিন। তারপরও বিএনপি রাজপথে আছে এবং অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিয়েই আছে। অন্য কোনো দল হলে এত দিনে গর্তে ঢুকে যেত।
দেশ যেখানে নির্বাচনী ডামাডোলে মুখরিত হওয়া কথা, সেখানে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো কাজ সরকার করে যাচ্ছে। যে সরকার মানুষকে কথা বলার অধিকার দেয় না, সভা-সমাবেশ করার অধিকার হরণ করে; বিরোধী দলকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেয় না, তাদের অধীনে একটি পপাতহীন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কিভাবে হবে? শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার হলে নিরপে নির্বাচন হবেÑ এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?
আগামী নির্বাচন প্রশ্নে কেউই স্বস্তিতে নেই; সবার মাঝেই একটা অজানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি ফয়সালা না করে সংসদ ভেঙে দিলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা ভেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা রীতিমতো আতঙ্কিত। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক ভয়ানক পর্যায়ের দিকে চলে যেতে পারে যে, তখন কারো কাছেই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না; নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে ওঁৎ পেতে থাকা বাইরের অপশক্তির হাতে।
অনিশ্চয়তার মধ্যেই হয়তো মতাসীনেরা একটা নিশ্চয়তার পথ খুঁজতে পারেন, যেমনটা এক-এগারোতে হয়েছিল। এই বিপজ্জনক পথে মতাসীনেরা যদি দেশকে ধাবিত করে, তাহলে তাদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেবে। গণমাধ্যম তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেবে। তাই গণমাধ্যমকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু গণমাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে। আসছে নতুন নীতিমালা। বাজেটে বাড়ানো হয়েছে আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের মূল্য। এসব কৌশলে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস। এসব করে শেষ রা হবে না। বরং দেশের অপূরণীয় তি হয়ে যাবে। এমনিতেই দেশের অবস্থা ভয়াবহ। দেশের রফতানি বাণিজ্য নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট জিএসপি সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছে। এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ তার অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্রগুলো। অন্য দিকে বাংলাদেশের পরীতি বন্ধু জাপানের রাষ্ট্রদূত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এসব রফতানিমুখী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ভয়ানক দুঃসংবাদ।
বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে বিপজ্জনক খেলা চলছে। আমরা মনে করি তাতে কোনো অশুভ শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, ধর্মের ওপর আঘাত, কুরআন-হাদিস ও নবী-রাসূলকে নিয়ে কটূূক্তি করা এবং অশালীন ভাষায় গাল-মন্দ করা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক খেলা। এ খেলা খেলে সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে। এই উত্তেজিত মানুষেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশে আগে কখনো দেখা যায়নি।
গত কয়েক মাসে প্রচুর সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে এই আত্মঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, সুকৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এই জাতি বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ; জনগণকে বিপন্ন করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, এর ফলে এক সময় এই রাষ্ট্রও বিপন্ন হবে। কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যাতে কোনো প্রাণ ঝরে না যায়, আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
রাজনীতিবিদের শুভ চিন্তাই বদলে দিতে পারে সব কিছু। আশার কথা হলো, আওয়ামী লীগ নেতা ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, একদলীয় নির্বাচন করে আবার মতায় যাওয়ার ইচ্ছা আওয়ামী লীগের নেই। তার কথাই যেন সত্য হয়; সব দলকে সাথে নিয়েই মতাসীন দল নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেÑ এ প্রত্যাশা সবার। তাতে নিশ্চিত অন্ধকার থেকে রা পাবে দেশ; রা পাবে আওয়ামী লীগ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন