মানুষ পরিবর্তন চায়, জাতি চায় ঐক্য। গত ১৫ জুন চার সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে ভোটারেরা ব্যালটের মাধ্যমে এ বার্তা দিয়েছেন। এতদিন যে পরিবর্তনের বার্তা ছিল অনানুষ্ঠানিক, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তা পেল আনুষ্ঠানিকতা। চারটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে, আর বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীদের হয়েছে বিজয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোটের শরিকেরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকলেও সরাসরি লড়াই হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের মধ্যেই। এ চার সিটি করপোরেশন হচ্ছে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরেই বিভাগীয় নগরী হিসেবে তাদের স্থান এবং একই কারণে গুরুত্বপূর্ণও। ২০০৮ সালে এসব সিটি করপোরেশনে যে মেয়র নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে ওই বিদায়ী মেয়রেরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন; কিন্তু হেরে গেছেন। এসব নির্বাচনের ফলাফল কতটুকু প্রত্যাশিত ছিল, আর কতটুকু অপ্রত্যাশিত ছিল, তা নিয়ে ভিন্ন মত থাকতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলো এবং বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় জোটের শরিক দলগুলোও একইভাবে নির্বাচনের ফলাফলের মূল্যায়ন করবে না। রাজনৈতিক পর্যাবেক্ষকদের মতামতও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও মূল্যায়নও চলতে থাকবে। এই নির্বাচনের ফলাফলের আলোকেই সাধারণভাবে মানুষ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলও হিসাব-নিকাশ করবে। জাতীয় নির্বাচন আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। অঙ্কের হিসাবে এ সময় খুব বেশি নয়। মানুষের মুখে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলতে থাকা অবস্থায়ই সময় হবে জাতীয় নির্বাচনের। সুতরাং জাতীয় নির্বাচন স্থানীয় নির্বাচনের প্রভাবমুক্ত হবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় না, যেমন বলা যায় না যে চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল। বরং সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে জাতীয় রাজনীতিই ছিল মুখ্য, আর স্থানীয় রাজনীতি ও ফ্যাক্টরগুলো ছিল গৌণ। কোনো কোনো সিটি করপোরেশনে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন কাজ হয়ে থাকলেও জাতীয় রাজনীতির স্রোতে তা ধুয়ে মুছে গেছে। সুতরাং চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির আলোকেই বিচার বিশ্লেষণ করতে হবেÑ এর কোনো বিকল্প নেই।
চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধীদলীয় জোট উভয়েই ঝুঁকি নিয়েছিল কৌশলগত কারণে। বিরোধীদলীয় জোটের কৌশলের সুবিধাটা ছিল যে, জয়-পরাজয় যা-ই হোক, তা হবে তাদের আন্দোলনের জন্য সহায়ক। দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে, এটা প্রমাণের জন্য ক্ষমতাসীন জোট যে কৌশল গ্রহণ করেছিল, তা তাদের বিশেষত আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে, তার পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রমাণ হিসেবে চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলকে দাঁড় করানো হলেও যে নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটেছে তা মেরামত করা যাবে না। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে তাদের কাছে যে হিসাব-নিকাশ ছিল, তা, বলতেই হবে, তাদের প্রতারণাই করেছে। এমন নির্বাচনী বিপর্যয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের ঝুঁকি নেবেন, তা বিশ্বাস করা যায় না। দেশের রাজনৈতিক হাওয়া কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, তা অনুধাবনে ব্যর্থতার কারণে তিনি ও তার মিত্ররা নিজেদের কৌশলের ফাঁদে নিজেরাই পড়েছেন, যে ফাঁদ তারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিরোধীদলীয় জোট তথা বিএনপির জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ কিছু দিন আগে অনেকটা অহঙ্কার করেই বলেছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নয়, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম। এমনি ঘোরের মধ্যে বাস করছে সরকার। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফলের পর এখন তিনি কী বলবেন? এই নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে আরেক দফা পরাজয়ের বোঝা বাড়ানোর ঝুঁকি সরকার নেবে না। অবশ্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করা হবে সরকারের জন্য আরেক ধরনের পরাজয়।
গত সাড়ে চার বছর সরকার দেশ শাসন করেছে গায়ের জোরে। এই গায়ের জোরের উৎস জাতীয় সংসদে তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ‘ব্রুট মেজরিটি’র কারণে সরকারও ‘ব্রুট’ আচরণ করেছে। তারা জনগণকে আস্থায় নিয়ে দেশ শাসন করার চেষ্টা করেনি। বরং মেয়াদের শেষপর্যায়ে এসে ভয়াবহ দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সরকার তার ব্যর্থতা আড়াল করতে চেয়েছিল দমননীতি দিয়ে। তাদের স্বৈরাচারী আচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মৌখিক নির্দেশে সভা, সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করে চালু করেছে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’। বিরোধীদলীয় আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গ্রেফতার, জেল-জুলুম ও দলীয় সন্ত্রাসের মতো দমননীতি গ্রহণ করে। যে বিষয়টি সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে তা হলো, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগের ‘গণজাগরণ’ এবং তার পাল্টা হেফাজতে ইসলামের উত্থান। ৫ মে গভীর রাতে মতিঝিলে বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে হেফাজতের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও বিজিপি যে সশস্ত্র অভিযান চালায়, তা দেখে দেশের মানুষ চমকে ওঠেন। ওলামা-মাশায়েখ, মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রদের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলা তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। ওই রাতে অন্ধকারে কত লোক নিহত ও আহত হয়েছেন, দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় তা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এখনো সে প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, সরকার জঙ্গিবাদ দমনে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, বিদেশে তা প্রশংসিত হয়েছে। তাহলে মতিঝিলে হেফাজতের লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ কি জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের সমাবেশ ছিল? জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলতে তিনি স্পষ্টতই ইউরোপ-আমেরিকার অনুকরণে হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। রানা প্লাজা ধসের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরও তাৎক্ষণিক মন্তব্যে আন্দোলনরত বিএনপি ও জামায়াতকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করেছিল। অর্থাৎ জামায়াত ও হেফাজতকে মুসলিম জঙ্গিশক্তি এবং বিএনপিকে তাদের পৃষ্ঠপোষকরূপে বহির্বিশ্বে প্রচার চালিয়ে সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী ভাবমর্যাদা তুলে ধরে তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা চলছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের ভাষায় সব সন্ত্রাসীই মুসলমান। মুসলমানদের সন্ত্রাসী বললে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো খুশি হয়। শেখ হাসিনা সরকার কূটনীতির নামে সে কাজটিই করছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও হেফাজতে ইসলামির আন্দোলনকে মৌলবাদী শক্তির জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মঞ্চের নেতৃত্বের একাংশ ইসলামবিদ্বেষী প্রচারেও তৎপর হয়ে ওঠে, সরকার যা বন্ধ করার ব্যবস্থা না করে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য তা উৎসাহিত করে। ফলে ধর্মীয় অনুভূতিপ্রবণ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ুব্ধ হয়ে ওঠেন। দীপু মনি তথাকথিত জঙ্গি দমননীতি নিয়ে আস্ফালন করলেও দেশের মানুষ সরকারের এই দমননীতিকে সরকারবিরোধীদের নির্মূল করার কৌশল হিসেবেই দেখছেন।
জনগণের মনে আজ যে ক্ষোভ, তা রাতারাতি দানা বেঁধে ওঠেনি। জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার ভুলে গিয়েছিল যে, ভোটের হিসাবেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের ভোট দেয়নি। এই বিভাজন গণনায় না নিয়েই সরকার সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে গোড়া থেকেই স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করে। এক নম্বর টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করে জিয়া পরিবারকে। বেগম খালেদা জিয়াকে তার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে যেভাবে উচ্ছেদ করা হয় তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে সরকারের সন্ত্রাসী আচরণ হিসেবেই প্রতিভাত হয়। এটা ছিল জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মুজিব পরিবারের ‘প্রতিশোধমূলক’ মনোভাবের পরিচয়। এ ‘প্রতিশোধমূলক’ আচরণে সরকার আদালতের সমর্থন লাভ করে। জিয়া দেশের শহর-গ্রাম-গঞ্জে সব মানুষের কাছে অতিপরিচিত নাম। তার কণ্ঠ তারা শুনেছেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে, তাকে দেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। শাসক হিসেবেও জিয়াকে তাদের দেখার সুযোগ হয়েছে কাছ থেকে; কিন্তু তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য সরকার আদালতকে জড়িত করে যে কর্মকাণ্ড চালিয়েছেÑ একমাত্র শেখ মুজিবের ভাবমর্যাদাকে দেবতুল্য করে নির্মাণের জন্যÑ তা জনগণের একটা অংশের সমর্থন পেলেও সাধারণভাবে ইতিবাচক সাড়া পায়নি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, তা কেবল বিতর্কই সৃষ্টি করেনি, এর ফলে সংবিধানের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হয়েছে ও বাস্তবতাহানি ঘটেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীকে আদালতের রায় হিসেবে পাঠ না করে রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনা হিসেবে পাঠক করলেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। এমনিভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল ও সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাগুলো বাদ দেয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসান এবং দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনÑ প্রভৃতি ঘটনা নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের যোগসাজশেরই সাক্ষ্য বহন করে, যা অনেক নিষ্পন্ন বিষয়কে অনিষ্পন্ন করেছে এবং সমাজে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ দিন জামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের সখ্যের পর চল্লিশ বছর পর যুদ্ধাপরাধের জন্য প্রধানত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার, স্কাইপ সংলাপ ও সংশ্লিষ্ট বিচারকের পদত্যাগ, সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ যে আন্দোলন করে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্যে তাড়াহুড়ো করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে ‘দায়মুক্ত’ করার প্রতিশ্রুতিকে ছাপিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিশোধমূলক রাজনীতিই দৃশ্যত প্রধান হয়ে ওঠে, যা রাজপথে সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট যখন এরকম, তখন সুশাসনে সরকারের নৈরাশ্যব্যঞ্জক ব্যর্থতা ও সীমাহীন দুর্নীতি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজি মানুষের মনে দ্রুত অনাস্থা বাড়িয়ে তোলে। পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি; কিন্তু শুরুর আগেই দুর্নীতি-ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে প্রধান দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করে দেয়। অন্যান্য দাতা সংস্থাও বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে। অভিযোগ ওঠে, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা এই দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত, যে কারণে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করলেও দুদক নানা অজুহাতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকে। এ ছাড়া হলমার্কের আর্থিক কেলেঙ্কারি ও তাতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার জড়িত থাকার অভিযোগ, সোনালী ব্যাংকসহ সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, স্টক মার্কেট কেলেঙ্কারির ব্যাপারে তদন্ত করা হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়াÑ সব কিছু মিলিয়ে দুর্নীতির একটা বিরাট চিত্র ুব্ধ মানুষের চোখের সামনে ভাসছে। এ ছাড়া তারা দেখছে স্থানীয়ভাবে কিভাবে ঘুষ ও দুর্নীতির উৎসব চলছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এককভাবে এই সরকার উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কিছুই অর্জন করতে পারেনি, যদিও অগ্রগতির ধারাবাহিকতার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংযোজন ঘটেছে। এর কারণ একটিই : সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রতিপক্ষ বা বিরোধী দলগুলোকে শায়েস্তা ও দমনে এবং আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সময় ও রাষ্ট্রশক্তি ব্যয় করেছে। মানুষের মনে সঞ্চিত ক্ষোভকে বিস্ফোরণোন্মুখ করে তোলে সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযান, আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশনকে বন্ধ ঘোষণা, আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার এবং এর পরপরই রানা প্লাজার নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়, যে ভবনের মালিক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের একজন নেতা, দায়িত্ব এড়ানোর জন্য যদিও প্রধানমন্ত্রী তার দলের সাথে ওই ভবনের মালিকের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে জাতীয় সংসদে অসত্য ভাষণ দেন।
আওয়ামী লীগ দেশের জন্য যে সবচেয়ে সর্বনাশা কাজটি করে, তা হচ্ছেÑ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি হিসেবে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা। ক্ষমতাসীন হয়ে তারা দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ, মঙ্গলামঙ্গল চিন্তা না করে জাতিকে বিভক্ত করার কাজটি আরো অন্ধ ও নগ্নভাবে করতে থাকে। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম একটাই : আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকেরাই কেবল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বিএনপিসহ অন্যরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। তারা এভাবেই জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করে রাখার কৌশল গ্রহণ করে। যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হাওয়া দিতে শাহবাগে নবপ্রজন্মের গণজাগরণ মঞ্চস্থ করা হয়েছিল, তা এই কৌশলেরই অংশ। উদ্দেশ্য ছিল, নৌকায় এই হাওয়া লাগিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে পার পাওয়া। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি জিয়াউর রহমানের বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা করলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, কোথাও কোনো যুদ্ধে অংশ নেননি, সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন না। তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তার দলের মন্ত্রী, এমপি, নেতা-নেত্রীরাও কোরাস গাইতে শুরু করলেন। তারা বললেন, পাকিস্তানের চর হিসেবে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে ঢুকে পড়েছিলেন। জামায়াত ও হেফাজতের আন্দোলনকে সমর্থন দেয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার দেশপ্রেমকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, পাকিস্তানের জন্য যখন এত প্রেম তখন পাকিস্তানেই চলে যান। শেখ মুজিব হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা তার মরণোত্তর বিচারও দাবি করলেন। বেগম জিয়াকে দেশদ্রোহিতার জন্য বিচার করার হুমকি দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় সব সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতাকে কারারুদ্ধ করা হলো। সরকারবিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য গ্রেফতার করা হলো বিএনপি ও জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের সময়ও বিরোধী দলের ওপর এমন ব্যাপক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই কৌশল বুমেরাং হয়েই দেখা দিয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে চার সিটি করপোশেনের নির্বাচনী ফলাফলে।
দেশের জনগণ তথা ভোটারেরা একটি চমৎকার ও বিজ্ঞচিত নজির স্থাপন করেছে। ১৯৯১ সালে শুরু গণতান্ত্রিক ধারায় তারা একটি রাজনৈতিক দলকে পরপর দুই মেয়াদের জন্য কখনো নির্বাচিত করেনি, যদিও তাদের এই পছন্দ বাস্তব কারণেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এই দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে, এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। জনগণের পরিবর্তনের এই ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটতে পারে কেবল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থার সঙ্কটের কারণেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিল। সেই আস্থার সঙ্কট এখনো রয়ে গেছে; বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ও ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন করে সেই আস্থার সঙ্কটকে আরো গভীরতর করা হয়েছে। এই আস্থার সঙ্কট আছে বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়নি। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা হলে দেশ নতুন সঙ্কটে পড়বে। এ ধরনের নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নিতে পারে না; বরং নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে।
মহাজোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এরশাদের জাতীয় পার্টি এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকেই শ্রেয় মনে করতে পারে। এটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান না করা হলে দলীয় সরকারের অধীনে আদৌ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পরিবেশ থাকবে না, যা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথকেই উন্মুক্ত করে দেবে। তখন পঞ্চদশ সংশোধনী দিয়ে অসাংবিধানিক শক্তিকে ঠেকানো যাবে না, কেননা অসাংবিধানিক শক্তি বুটের নিচে সংবিধানকে চাপা দিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, গলায় সংবিধান ঝুলিয়ে নয়। আর অসাংবিধানিক শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয় প্রধানত সদ্যবিদায়ী ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরাই। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে যে জেল-জুলুমের ভয় দেখাচ্ছেন, তার শিকার প্রথমে তিনিই হবেন। সংলাপে সমঝোতা না হলে সঙ্ঘাত হবে, এ নিয়ে নতুন করে তর্ক-বিতর্কের কিছু নেই। সমঝোতা করবেন, না সঙ্ঘাতে যাবেনÑ প্রধানমন্ত্রীকেই সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্বে বহু নির্বাচিত সরকারও পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিস্ট হয়েছে। এমন উদাহরণ বাংলাদেশেও রয়েছে। শেখ মুজিব চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে সে কাজটিই করেছিলেন, যা ছিল যে গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চনার কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার পরিপন্থী।
শেখ মুজিবের রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা। তিনি কি পিতাকে অনুসরণ করে এমন কোনো কাজ করতে পারেন? দেশে ইতোমধ্যেই আঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। বিরোধী দলের নেতানেত্রীরাসহ অনেকেই বক্তৃতা-বিবৃতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার আশঙ্কা করছেন। জাতীয় নির্বাচনের নিশ্চিত পরাজয়কে এড়ানোর জন্য শেখ হাসিনা কি ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ অজুহাতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পথ বেছে নেবেন? সীমালঙ্ঘনকারীকে জনগণ কখনোই ক্ষমা করে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন