ক্ষমতা কখনোই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক সমাজে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসিতরা শাসক নির্বাচন করে । নির্বাচকরা যদি শাসকগোষ্ঠীর কাছে সুশাসন ও ন্যয়বিচার পায় তাহলে নির্বাচকরা তাদের আবারও নির্বাচিত করে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী গণমানুষের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হলে নির্বাচকরা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন শক্তিকে শাসন ক্ষমতায় আনে। আর এটাই বাস্তবতা। এর ব্যতিক্রম সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। তাই একটি গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক শক্তি বা রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গণমানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক লিকক বলেন, `Far from being in conflict with the theory of democratic government’. অর্থাৎ রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের বিরোধী হওয়া তো দূরের কথা বরং দলীয় সরকার গণতন্ত্রকে সফলতা দান করে।
ক্ষমতা অর্জন যত না কঠিন তার চেয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা তত কঠিন। মূলত ক্ষমতা কোন উপভোগ্য বিষয় নয় বরং এটি একটি মহান দায়িত্বের নাম। ফলবান বৃক্ষের ডালপালা, পত্র-পল্লব যেমন ঊর্ধ্বমুখী হয় না বরং ফল-ফুলের ভারে ন্যূব্জ হয়ে আসে, তেমনি ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক বা অহঙ্কারী বানায় না বরং অতিমাত্রায় বিনয়ী ও দায়িত্বশীল করে তোলে। মূলত ক্ষমতা ও রাজনীতি একটি সেবামূলক কাজ। আর রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও অবশ্যই সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আর প্রতিটি রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে গণমানুষের সেবার কথা উল্লেখ আছে এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও অভিন্ন। রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব ও সম্ভাবনা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফাইজার বলেন, `Representatives are selected, catechized, pledged, supported and afterwards controlled in their parliamentary activties by the parties in close and continuous touch with the electorate’ অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিবর্গ নির্বাচন করা, তাদের শিক্ষা দেয়া, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করা, সমর্থন করা ও নির্বাচনের পরে তাদের পরিষদীয় কার্যাবলীতে নির্বাচকগণের ঘনিষ্ঠ ও ক্রমাগত সংসর্গে করা দলের দ্বারাই সম্ভব হয়।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক দল জনমত গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন করে। আর ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচক তথা গণমানুষের কল্যাণ করা। আর সরকার যখন সে মহান দায়িত্ব পালন করে তখন রাষ্ট্র গণমানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে ওঠে। মূলত রাজনৈতিক দলের কর্মতৎপরতা হবে সর্বজনীন স্বার্থের ভিত্তিতে। এ প্রসঙ্গে মনিষী এডমান্ড বার্ক বলেন, `A body of men united together for by their joint endeavours the national interest upto some particular principles on which they are all agreed’’ অর্থাৎ কতকগুলো লোক যখন সমবেত চেষ্টার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বার্থ অর্জনের উদ্দেশ্যে কতকগুলো নীতি সম্বন্ধে একমত হয়ে সংঘবদ্ধ হয়, তখন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের জন্য তাদের দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা বিস্মৃত হয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থের জন্য গণবিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার দম্ভ ও অহমিকার কারণে দেশের মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচর্চা গণমানুষের কল্যাণে না করে আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষায় তা অপচর্চা করা হচ্ছে। মূলত সরকার গণমানুষের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতাকে কীভাবে প্রলম্বিত করা যায় সে প্রচেষ্টায় সদা তৎপর। এ ব্যাপারে কোন নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করার পরিবর্তে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় ভিন্নমতকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী হলেও ক্ষমতাসীনরা জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কা করছে না বরং তারা ভিন্নমতের ওপর দলন-পীড়ন চালিয়ে রীতিমতো গণবিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে এবং তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধর প্রতি কুঠারাঘাত করে চলছে। এ ব্যাপারে তারা কোন বিধি-বিধান এবং নিয়ম-নীতির ধার ধারছে না। কিন্তু কোন গণতান্ত্রিক সমাজে শাসকদের পক্ষে কোনভাবেই স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভাবের মতে, ‘গণতান্ত্রিক শাসনে সরকার জনগণের এজেন্ট মাত্র এবং সে হিসাবে তারা সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করেন’। এ বিষয়ে সিএফ স্ট্রং-এর সংজ্ঞা আরও বেশি গতিশীল ও প্রাণবন্ত। তিনি বলেছেন, `Demcracy implies that government which shall rest on the active consent of the governed’’. অর্থাৎ শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির ওপরে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাকে গণতন্ত্র বলা হয়।
পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান। গণতন্ত্রের বহু মতের সম্মিলনের সুযোগ থাকে। মূলত এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও সুফল। আমাদের দেশের সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু আছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় অপরাজনীতির কারণে দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কলঙ্কিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে এবং অতি নিপুণতার সাথে তা করে যাচ্ছে। তাদের এ ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরমানসিকতার কারণে তাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পরে তারা সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্র বিলোপ করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। তারা ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। মনে করা হয়েছিল যে তারা অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে গণমানুষের কল্যাণে কাজ করেবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা জনগণকে মারাত্মকভাবে হতাশ করেছে। তারা তো অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেইনি বরং নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিরোধী দল ও ভিন্নমতের প্রতি যত প্রকারে নিগ্রহ চালানো যায় তার সবকিছুই করে যাচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ ধরনের ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তি নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারেনি। প্রাচীনকালের মিশরের প্রবল ক্ষমতাধর ফারাও স¤্রাটদের ইতিহাস ক্ষমা করেনি। হয়তো আওয়ামী লীগের জন্যও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অপেক্ষা করছে।
দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু থাকলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয় একথা তারা ভাল করেই বুঝতে পেরেছে। মূলত এমন নেতিবাচক চিন্তা থেকেই ১৯৭৫ সালে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়েছিল। কিন্তু এবার তারা ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দিয়ে বাকশালী শাসন কায়েম করেনি ঠিকই কিন্তু দেশে অঘোষিতভাবে বাকশালের চেয়ে নিকৃষ্ট অপশাসন চালানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দেশে উদার গণতান্ত্রিক ধারা চালুর অঙ্গীকার করলেও বর্তমান মেয়াদে সরকার গঠনের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এক সেমিনারে বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে নাকি লিবারেল ডেমোক্রেসি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আসলে স্ববিরোধিতায় ভরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিক দর্শন। তা না হলে তারা কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৭৩ দিন হরতাল পালন করে তারাই আবার তা বাতিল করে?
ক্ষমতাসীনরা অতীত থেকে এ শিক্ষাই গ্রহণ করেছে যে, সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা ও লিবারেল ডেমোক্রেসি চালু এবং ভিন্নমতের অস্তিত্ব জিইয়ে রেখে প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাই তারা শুরু থেকে বিরোধী দলের ওপর খড়গহস্ত হয়েছে। জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে করাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষভাবে টার্গেট করে তাদেরকে নির্মূল করার জন্য আদা জল খেয়ে লেগেছে। বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। আমরা একথা সকলেই জানি যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার তদন্তের মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সনাক্ত করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে এখন বিচারের নামে বিরোধী দলের জনপ্রিয় নেতাদের চরিত্র হননের আয়োজন করেছে। কথিত বিচার যে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র ও প্রহসনমূলক তা বিচার বিচারপতির স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে পরিষ্কার। ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে ডিফেন্স পক্ষের সাফাই স্বাক্ষী অপহরণ ও পরবর্তীতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কারাগারে তার সন্ধান লাভ পুরো বিচার প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি কর্তৃক ট্রাইব্যুনালের রায়ের ব্যাপারে আগাম মন্তব্য ও পরবর্তীতে তার প্রতিফলন এবং জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বিচারকদের উদ্দেশ্যে ‘শুধু আইন দেখে নয় বরং জনমতের ভিত্তিতে রায়’ দেয়ার নির্দেশনার পর কথিত বিচার নিয়ে সরকারের থলের বিড়াল বেড়িয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর এহেন গর্হিত মন্তব্যের পর কথিত বিচার অব্যাহত রাখার আর কোন নৈতিক ভিত্তি থাকে না। গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে বিএনপি’র মহিলা সংসদ সদস্য পাপিয়া এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “শাগবাগ করে কলম ছিনতাইয়ের মাধ্যমে ফাঁসির রায় দিতে বিচারকদের বাধ্য করা হয়েছে।” কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে কথিত বিচারের নামে প্রহসন এখন পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু এতে তারা লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে মনে হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কথিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যু এখন ক্ষমতাসীনদের জন্য বুমেরাং হতে চলছে। তা রীতিমতো এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে।
মূলত জনগণ ভীতির কারণেই জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দেশের উচ্চ আদালতের রায়ের দোহায় দেয়া হলেও আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এবং সংক্ষিপ্ত রায়ের পর্যবেক্ষণ উপেক্ষা করেই গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচনের রক্ষাকবজ কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করা হয়েছে। আর আদালতের রায় নিয়েও জনমনে ব্যাপকভাবে সন্দেহ-সংশয় দানা বেঁধে উঠেছে। গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সাংসদ মোস্তফা আলী বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় ঘুষের মাধ্যমে হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে মাহবুব উদ্দীন খোকন বলেছেন, “কেয়ারটেকার সরকার বাতিলের রায় নিতে বিচারপতি খায়রুল হককে ত্রাণের টাকা থেকে ঘুষ দেয়া হয়েছে।” মহান জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের আদালত সম্পর্কে এমন প্রকাশ্য মন্তব্যের পর পুরো প্রক্রিয়াটিই বিতর্কিত হয়েছে।
আসলে আওয়ামী লীগ বর্তমান মেয়াদে আধিপত্যবাদীদের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছে। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের নানাভাবে সহায়তা করেছে। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে দিয়েছে। আসলে ভারত তো প্রতিবেশীদের স্বাধীনসত্তাই স্বীকার করে না। ইতিহাস পর্যালোচনায় এর প্রমাণ মেলে। ১৯৩৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে সভাপতির ভাষণে সাভারকার (U D Savarkar) বলেছিলেন,`The land which extends from the Indus to the southern sea is Hindustan, the land of the Hindus are the nation that own it. To us Hindus, Hindustan and India mean one and the same thing.’ অর্থাৎ যে ভূমি সিন্ধু থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত তাহলো হিন্দুস্থান। হিন্দুদের নিজস্ব ভূমি। হিন্দুরা যে জাতি গঠন করেছে তারাই এর মালিক। আমাদের নিকট হিন্দুস্থান ও ভারত সমার্থক। শেখ হাসিনাও বোধ হয় নিজেকে দেশের মালিক-মোখতারই মনে করছেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের পালেই হাওয়া দিয়ে যাচ্ছেন। তাই দেশে নিজেদের ছাড়া অন্যদের অধিকার স্বীকারই করতে পারছেন না।
কথিত যুদ্ধাপরাধ, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, শেয়ারবাজারসহ নানাবিধ কেলেংকারির কারণে আওয়ামী লীগ সরকার রীতিমত গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। অপরদিকে সরকারের উপর্যুপরি ইসলাম বিরোধিতা ও আত্মস্বীকৃত নাস্তিক-মোরতাদদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সরকার ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এমনকি দেশের ধর্মীয় শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচিও চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উপর্যুপরি ইসলাম বিরোধিতার কারণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামের অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনের উত্থান ঘটেছে। সংগঠনটি ১৩ দফা ধর্মীয় দাবির ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী সফল লংমার্চ করেছে। গত ৫ মে তারা ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিও সফলভাবে পালন শেষে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সরকার হেফাজতের গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে সহজভাবে মেনে নেয়নি। আওয়ামী লীগ মনে করেছিল যে, তারা যেহেতু অতীতে সকল ক্ষেত্রেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতা পেয়েছে তাই তারা হেফাজতকে অস্ত্রের মুখে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ৫ মে গভীর রাতে ইবাদত-বন্দেগীরত ও ঘুমন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর যৌথবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। এতে প্রভূত সংখ্যক হেফাজত কর্মী প্রাণ হারায়। এ ঘটনার পর সরকারকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেছে। তারা ধরেই নিয়েছে যে, হেফাজত নামের উটকো ঝামেলাকে তারা এ দেশ থেকে উৎখাত করতে সমর্থ হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত তো অনেক আগেই রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছে। তাই তাদের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো কোন শক্তি আর অবশিষ্ট থাকলো না। কিন্তু সরকারের হরিষে বিষাদ হতে খুব একটা সময় লাগেনি। সদ্য সমাপ্ত ৪টি সিটি ও ১টি পৌর নির্বাচনে জনগণ সরকারকে যে শিক্ষা দিয়েছে তাতে সরকারের বোধদয় না হলেও অন্তত বাস্তবতাটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছে। এক রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে হেফাজত কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত করার পর সরকার বেশ খোশ মেজাজেই ছিল এবং সরকারের দায়িত্বশীলরা হেফাজতে ইসলামের দাবি-দাওয়া নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রƒপসহ দাবিগুলোকে মধ্যযুগীয় বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। কিন্তু সম্প্রতি সরকার কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসেছে। তারা নবগঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সৈয়দ আশরাফের ভাযায় ‘যারা রাজাকারের সন্তান তারাই হেফাজতে ইসলাম’ তাদের সাথেই সমঝোতার প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বোধ হয় বুঝতে পেরেছে যে, হেফাজতের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর অভিযানে তাদের কোনই লাভ হয়নি বরং সে ঘটনার কারণে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই মহাসংকটে পরেছে। তারা হেফাজতের সাথে সমঝোতার জন্য হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফীর কাছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিতর্কিত ডিজি এবং ব্যালে ড্যান্সের পৃষ্ঠপোষক শামীম মোহাম্মদ আফজালকে পাঠালেও আল্লামা শফী তাকে পাত্তা দেয়ার মোটেই গরজ বোধ করেননি। বাধ্য হয়ে গাজীপুর নির্বাচনে কিছু লোককে জোব্বা ও টুপি পরিয়ে হেফাজতের এক অংশ আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে আছে বলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। হেফাজতের পক্ষে এই মিথ্যাচারের কড়া প্রতিবাদ ও জবাব দেয়ার পর সরকারের আম-ছালা সবই যাবার উপক্রম।
মূলত আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের দিয়ে প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। তারা মনে করেছিল যে, সবকিছুই তারা পেশীশক্তির জোরে অর্জন করবে। বামপন্থীদের ঝার-ফুঁকে সরকারের বেলুন কিছুটা স্ফিত হলেও তা এখন ফুটো হয়ে গেছে। তাই তারা হঠাৎ করেই হেফাজত দরদী হয়ে ওঠেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, হেফাজতের সমাবেশে কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি বরং পুলিশ গভীর রাতে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পরিবহনে তুলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এমন আবেগী বক্তব্যকে দেশের মানুষ ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’ হিসেবেই দেখছে। শেখ সেলিম তো চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, হেফাজতের সমাবেশে কোন মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করতে পারলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। সরকারের পক্ষে হঠাৎই হেফজত দরদী হওয়া বেশ গুরুত্ব বহন করে। সরকার বোধ হয় উপলব্ধি করেছে যে, এ দেশে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ অনেক আগেই গণমানুষের কাছে আস্থা হারিয়েছে। দেশের মানুষ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকা-কে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভ-ামী বলেই মনে করছে। কারণ, একদিকে সরকার হেফাজতের সাথে সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অপরদিকে সরকারের তথ্যমন্ত্রী ২৮ জুন বগুড়ায় সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ‘মোল্লাদের রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়ন করা না গেলে জাতিকে নিরাপদ গণতন্ত্র উপহার দেয়া সম্ভব নয়’। এটি কী সরকারের স্ববিরোধিতা নয়? তারা অতীতেও জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা বিগত ২০০৬ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে ৫ দফা চুক্তি সম্পাদন করেছিল। সে দফাগুলোর অন্যতম ধারা ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন করবে না। সে চুক্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পদক আব্দুল জলিল ও ঐক্যজোটের পক্ষে মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক। কিন্তু সে চুক্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কথিত যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতের সাথেও যুগপৎ আন্দোলন করেছে। কিন্তু তারা তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ রাখতেই এক সময়ের মিত্র জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে বিচারের নামে প্রহসন করছে। তাই আওয়ামী ছলাকলায় হেফাজতের বিভ্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
মূলত ক্ষমতার দম্ভ, অহমিকা, অগণতান্ত্রিক চেতনা, ফ্যাসিবাদী মানসিকতা ও অতিমাত্রায় ক্ষমতা লিপ্সার কারণে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে মিত্রহীন হয়ে পড়েছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে তারা তো হেফাজতের সমর্থন আদায় করতেই পারেনি বরং তাদের অন্যতম মিত্র জাতীয় পার্টিও তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে তারা এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছে। মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলার পরিবর্তে পেশীশক্তির মাধ্যমে মোকাবেলা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই এখন মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন ও সীমাহীন অহমিকার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। এতে আমাদের দেশীয় শিল্পগুলো মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে প্রহসন করার অপচেষ্টা চালালেও একই ধরনের অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আর ইতিহাসের সে অমোঘ নিয়মেই আওয়ামী নেত্রী এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এখন দেখার বিষয় ইতিহাস তার সাথে কী আচরণ করে ?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন