সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৩

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ও অতঃপর


মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আইসিসি তথা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম.খা. আলমগীরসহ ২৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট ফর বাংলাদেশ এবং গ্রেটার ওয়াশিংটন ডিসি বাংলাদেশী আমেরিকানদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরানুযায়ী গত ২৮ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিআর নিউজওয়্যার ইউএস নিউজওয়্যার এক প্রতিবেদনে এই খবর দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গণতন্ত্র বিপণœ হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- ঘটিয়েছে, হয়রানি বেড়েছে, বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতন বেড়েছে। এমনকি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও অপমানকর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে। বিরোধী দল সমর্থিত দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিরোধী নেতাদের বিচার করা হচ্ছে এবং পুলিশ বিবাদী পক্ষের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে তুলে নিয়ে গেছে। আদালতে দায়ের করা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাদেরকৃত মানবতা বিরোধী অপরাধের একটি বিরাট ফিরিস্তিও দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর ছাড়াও যাদের এই মামলায় আসামী করা হয়েছে তারা হচ্ছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সামছুল হক টুকু, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মুখলেসুর রহমান ও বিজিবির মহাপরিচালক আজিজ আহমদ প্রমুখ।
উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত হচ্ছে সন্ধিপত্র ভিত্তিক (ঞৎবধঃু-নধংবফ) বিশ্বের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক আদালত যা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এর স্বাক্ষরকারী দেশগুলোতে আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখা এবং গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং বিনা উস্কানিতে ভিন দেশে হামলার ন্যায় মারাত্মক অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা। অবশ্য শেষোক্ত অপরাধটি বিচারের এখতিয়ার ২০১৭ সালের আগে এই আদালতের আওতায় আসবে না। এই আদালতটি জড়সব ঝঃধঃঁঃব-এর অধীনে গঠিত হয়েছে এবং ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে এর কার্যক্রম চলছে। জড়সব ঝঃধঃঁঃব গঠিত হয়েছে ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই। এই দিন জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত একটি কূটনৈতিক সম্মেলনে বিশ্বের ১২০টি দেশ অংশগ্রহণ করে এবং একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের লক্ষ্যে রোম প্রবিধি নামক আইনী কাঠামো তৈরিতে সম্মত হয়। এ জন্য যে চুক্তি হয়, তাতে তারা সকলেই স্বাক্ষর করেন এবং পরবর্তীকালে আদালত গঠনের পর তা জধঃরভরপধঃরড়হ করে আদালতের গঠন প্রণালী ও বিচার প্রক্রিয়ার বাধ্যবাধকতার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেন।
ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকগুলো দেশ চুক্তির ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করলেও আদালত গঠনকে ৎধঃরভু  বা অনুস্বাক্ষর করেনি। বাংলাদেশ এর দু’টিই করেছে এবং এ প্রেক্ষিতে আদালতের বিচার প্রক্রিয়া তারা মানতে বাধ্য। এই আদালতের সদর দফতর হেগ-এ হলেও এর কার্যক্রম যে কোন স্থানে হতে পারে। বর্তমানে এই আদালতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্যাঙ্গ হাইউন সং, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যথাক্রমে ফাটোমাটা ডেমবিলি ডায়ারা এবং হ্যান্স পিটার কাউল কাজ করছেন। এই আদালতের চীফ প্রসিকিউটর হচ্ছেন লুই মরেনো ওকাম্পো এবং রেজিস্ট্রার হচ্ছেন সিলভানা আবিয়া। খ্যাতনামা যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আদালতে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে আইভরিকোস্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট লরেন্ট এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের টমাস লুবাঙ্গা ডাইল হচ্ছেন অন্যতম প্রধান। তবে এই আদালতে বর্তমানে অভিযুক্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে ২৫ জনের বিশাল একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার ঘটনা শুধু প্রথম নয়, এশিয়া মহাদেশের মধ্যেও একটি অনন্য ঘটনা। এই ২৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীসহ ৯ জনকে আসামী করা হয়েছে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায়ে। অবশিষ্টদের আসামী করা হয়েছে অপরাধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার জন্যে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমদ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ওসি প্রদীপ কুমার, ডিএমপি মতিঝিল জোনের ওসি মেহেদী হাসান, লালবাগ বিভাগের ডিসি হারুনুর রশিদ, মিরপুর মডেল থানার ওসি সালাউদ্দিন, গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি মশিউর রহমান, দারুস সালাম থানার ওসি খলিলুর রহমান, কাফরুল থানার ওসি আব্দুল লতিফ, কাফরুল থানার সাব-ইন্সপেক্টর আশিক, যাত্রাবাড়ি থানার ওসি রফিকুল ইসলাম, মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূর, শহিদুল ইসলাম, এম.এস মোস্তাফিজুর রহমান ও হারুন রশিদ, পাবলিক প্রসিকিউটর সাজ্জাদুল হক ও আসলাম। বাদী পক্ষের এটর্নী মার্টিন এফ ম্যাকহাম মামলা-উত্তর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, খুন, গুম ও নির্যাতনের এক মর্মস্পশী পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি সাংবাদিক নির্যাতন, রাজনৈতিক হত্যাকা-, নারী নির্যাতন প্রভৃতি সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য উত্থাপন করে বলেন যে, রাষ্ট্রের চাপে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিরাট এক হুমকির মুখে পড়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত বেসামরিক মানুষ হত্যা, হয়রানি এবং গ্রেফতার ও অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ৫-৬ মে’র হত্যাকা-সহ দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার, রিমান্ড নির্যাতন, হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ও ছাত্রনেতা দেলোয়ার হোসেনের গ্রেফতার, নির্যাতন, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নিখোঁজ হওয়া ও কোলকাতার জেলে আটক থাকার ঘটনাও তিনি তুলে ধরেন। এটর্নি মার্টিন দাবি করেন যে, বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ পুলিশসহ র‌্যাব, বিজিবি ও ডিজিএফআই সদস্যরা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এর সাথে ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীরাও সাধারণ মানুষসহ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এটর্নি মার্টিন আরো বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক আদালতে তারা অভিযোগ দাখিল করেছেন এবং আশা করছেন যে, আদালত অভিযোগগুলো তদন্ত করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
= দুই =
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন জুলুম-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সভ্য দুনিয়ায় এর নজির খুব কম। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই বিডিআর সদর দফতরে বিদ্রোহের নামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে। এতে একই দিন সেনাবাহিনীর ৫৭জন চৌকস কর্মকর্তাসহ প্রায় ৮০ জন লোক মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। অভিযোগ উঠেছে যে, এই হত্যাকা- ছিল পরিকল্পিত এবং এর সাথে সরকারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যারা এই প্রশ্ন তুলেছেন তাদের অভিযোগ হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সেনাবাহিনীকে ভয় পান। এবং অতীতে সেনাবাহিনী তাদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং এতে দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাদের দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ‘আওয়ামী লীগকে সর্বদা তাদের সরকার বলেই মনে করে এবং এই দলটির ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে তারা প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বর্ডারে বিডিআরদের শক্ত অবস্থান ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল নয়। এই অবস্থায় তাদের ইচ্ছানুযায়ী বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিডিআরকে ধ্বংস করে দিতে পারলে ভারতীয় চোরাচালানীরা যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সীমান্ত বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে পারে, তেমনি সীমান্ত প্রহরায় দেশটির ব্যয় বাবদও হাজার হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। তারা মনে করেন এই কাজে আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগিতার অভিব্যক্তি ঘটেছে বিডিআর হত্যাযজ্ঞে। এই হত্যাযজ্ঞের তদন্ত করার জন্যে সেনাবাহিনী এবং সরকারের পক্ষ থেকে দুটি’ কমিটি করা হয়েছে। দুটি কমিটির তরফ থেকেই অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে তা না করলে হত্যাকা-ে জড়িত আসল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভবপর হবে না। এই সুপারিশ অনুযায়ী সরকার অধিকতর তদন্ত না করেই প্রায় সাত সহ¯্রাধিক বিডিআর সদস্যকে গ্রেফতার করেন এবং তাদের বিচারের আওতায় আনেন। গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো  হয় এবং এই নির্যাতনের ফলে ৯৩ জন বিডিআর সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। এটি ছিল এই সরকারের মানবতাবিরোধী প্রথম অপরাধ। রিমান্ডে নির্যাতনে মৃতদের আত্মীয়রা হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেও কোন ইনসাফ পায়নি। মানবতাবিরোধী তাদের দ্বিতীয় অপরাধ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্মম অত্যাচার, গ্রেফতার, জুলুম, নির্যাতন প্রভৃতি। এর প্রথম শিকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার জন্য তারা জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নানা মামলায় অভিযুক্ত করে। তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ আনা হয় এবং চিহ্নিত পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০৯ সালে সংশোধন করে তাদের ওপর তা প্রয়োগ করা হয়। এই বিতর্কিত আইন ও ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজনকে যাবজ্জীবনসহ মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। এই দ-ের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কুরআন এবং খ্যাতনামা পার্লামেন্টারিয়ান ও জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ-াদেশের পর দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সরকারি নির্দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় তিন শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গুলী করে হত্যা করে। তাদের নির্যাতনে আহত ও পঙ্গু হয়েছে কয়েক সহ¯্র মানুষ। জামায়াত ও শিবির নেতা-কর্মীদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নির্যাতন ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। বিক্ষোভ, সমাবেশ গণদাবি পূরণের লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন প্রভৃতি যে কোন রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। এই সরকার এই অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করেছে। বহিরাঙ্গনের মিছিল-মিটিং-ই শুধু তারা বন্ধ করেনি। বরং অফিসের বদ্ধ কক্ষে, হলঘরে, এমনকি বাসা-বাড়িতেও একাধিক ব্যক্তির সমাবেশ তারা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এসব স্থানে যাদেরই পাওয়া যাচ্ছে তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং নাশকতার কাল্পনিক অভিযোগ এনে রিমান্ডে নিয়ে তাদের পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। গ্রেফতার নির্যাতন পুলিশের নিয়মিত বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। পুলিশ ও শাসকদলীয় ক্যাডারদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ন্যায় মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। তাদের এই নির্যাতন থেকে সিনিয়র বর্ষীয়ান রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিশোর তরুণ ছাত্ররাও নিস্তার পাচ্ছে না। মানুষ প্রতিবাদ করতেও পারছে না। কোনও প্রকার অপরাধ ছাড়া গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে ৮/১০টা মামলা তৈরি করে তাদের ঐসব মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে এবং আদালত থেকে অবলীলায় তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের সকল প্রকার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। পর্দানশীন নারী, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, প্রসূতি মা, গার্মেন্টস-এর নারী কর্মী সকলেই এই সরকারের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগকারীরা অভিযোগের যে ফিরিস্তি দিয়েছেন তা এই সরকারের অপরাধের একটি খ-চিত্র মাত্র। এবং এই অপরাধগুলো তারা করছেন গণতন্ত্র রক্ষা ও মানুষের অধিকার রক্ষার নামে। আসলে তাদের এই কর্মকা-ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তাদের সুস্পষ্ট দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া এবং জামায়াত-বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করা। বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। ক্ষমতাসীনরা এটা ভালভাবেই জানেন এবং জানেন বলেই তারা প্রথমে জামায়াতকে বিএনপি জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তারা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। এই উভয় কাজে ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথমে জামায়াত ও পরে বিএনপির ওপর ক্র্যাক ডাউন করেন। উদ্দেশ্য একটাই; হামলা মামলা জেল জরিমানা দিয়ে দল দু’টোর শীর্ষ ও প্রতিভাবান নেতৃবৃন্দকে জেলে রেখে কিংবা নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বার বার ক্ষমতায় আসা। প্রতিবেশী দেশটিকে তার চাহিদার অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তারা ধারণা করছেন যে, ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার গ্যারান্টি তারা পেয়েই গেছেন, দেশের মানুষের সমর্থন না হলেও চলবে। এই অবস্থায় ক্ষমতাসীনরা বিএনপি জামায়াত জোটকে ধ্বংস করার অশুভ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের আলেম ওলামাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তারা তাদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করছেন এবং মন্ত্রিসভায় নাস্তিক মুরতাদ কমিউনিস্টদের আমদানি করে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইসলাম, ইসলামী অনুশাসন ও আলেম ওলামাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের মহাসম্মেলনে আগত লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর পুলিশ, র‌্যাব ও আধাসামরিক বাহিনীর ১০-১২ হাজার সশস্ত্র সদস্যের নির্মম হামলা ও অসংখ্য মানুষকে রাতের অন্ধকারে হত্যার ঘটনা এই সরকারের মানবতাবিরোধী তৎপরতার ক্ষুদ্রতম একটি অংশ মাত্র।
প্রখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের নাম  পাঠকরা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। আধুনিক চীনে এখনো তার কোটি কোটি অনুসারী রয়েছেন। তার জীবনী লেখকরা চীন দেশে রাষ্ট্রীয় শোষণের বিস্তারিত বর্ণনা রেখে গেছেন। কথিত আছে যে, তার নিজের প্রদেশে রাষ্ট্রীয় জুলুম ও নির্যাতনের মাত্রা সকল সীমা অতিক্রম করায় তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে একবার দুর্গম পর্বতসংকুল পথ অতিক্রম করে অন্য প্রদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রাপথে তিনি দেখতে পান যে, একজন মহিলা কবরের পাশে বসে কাঁদছেন। কনফুসিয়াস তার শিষ্য জে-লুকে মহিলার কান্নার কারণ জানতে তার কাছে পাঠালেন। মহিলাটি তাকে জানালেন যে, তার শ্বশুরকে বাঘে খেয়েছে, তার স্বামী বাঘের হাতে প্রাণ হারিয়েছে এবং তার ছেলেও একইভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। কনফুসিয়াস মহিলাকে প্রশ্ন করলেন, তিনি কেন এত বিপজ্জনক একটি এলাকায় বসবাস করছেন। মহিলার জবাব ছিল, এখানে বিপদ থাকলেও অত্যাচারী শাসক নেই। উত্তর শুনে কনফুসিয়াস তার শিষ্যদের বলেছিলেন, “বৎসগণ, অত্যাচারী সরকার বাঘের চেয়েও হিং¯্র।” কনফুসিয়াসের এই গল্পটির সাথে রেলগেট কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কৃপায় নিয়োগ পাওয়া দফতরবিহীন মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনের একটি বিখ্যাত মন্তব্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে মিলে যায়। প্রায় বছর দেড়েক আগে তিনি বলেছিলেন, “বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে শেখ হাসিনা ছাড়ে না।” তিনি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঘের চেয়েও হিং¯্র। তার মন্তব্য দেশের সকল পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এখন পাঠকরা কনফুসিয়াসের মন্তব্যের সাথে সুরঞ্জিত বাবুর মন্তব্য মিলিয়ে দেখতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি এবং তার সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার যৌক্তিকতা খুঁজে দেখতে পারেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দায়ের করা এই মামলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেকেই হয়ত জানতে চাইবেন। যারা মামলা করেছেন তাদের কারোর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। তবে তারা যে কাজটি করেছেন মানবিকতা ও বিবেকের তাড়নায়ই তা করেছেন বলে আমার ধারণা। অপরাধের মালমশলা ও উপকরণ তথা আলামত সম্পর্কে তারা গণমাধ্যমের তথ্যাবলি এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো কর্তৃক প্রকাশিত বিবরণীসমূহ আদালতে পেশ করেছেন। এগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এই সরকারের দুঃশাসন নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু নজিরও প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং ভুক্তভোগী পরিবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেশের ও বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাসমূহ, ক্ষতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দল ও ভুক্তভোগীরা যদি এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন এবং আইসিসি প্রসিকিউটরদের তদন্ত কাজে সহযোগিতা করেন তাহলে বিচার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারেরও উচিত আইসিসিকে সহযোগিতা করা। তারা যদি অপরাধ না করে থাকেন তা হলে আদালতের সামনে প্রমাণ উপস্থাপন করে নিজেদের পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। তা না করে জুলুম নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়ে যদি প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করেন তা হলে তারা তাদের ইমেজকে আরো ধ্বংস করবেন বলে আমার বিশ্বাস।
 শেষ করার আগে একটা কথা বলে নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও তার অধীনস্থ সরকার বাংলাদেশকে বহু ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছেন। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের মধ্যে এখন দেশ সীমাবদ্ধ নেই। ইসলামকেও তারা শুধু প্রতিপক্ষ নয় শত্রু পক্ষের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম মানে জঙ্গিবাদ ও মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদতা। ইসলামের অনুসরণ করলে, রাজনীতি তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম থাকলে দেশ ১৫শ’ বছর পেছনে চলে যাবে। নাস্তিক, কমিউনিস্টদের এই বড়িটি আওয়ামী লীগ এখন গিলে ফেলেছে। যারা এসব কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান তাদের আমি জ্ঞানপাপী ও অন্ধ বলি। তাদেরকে আমি মালয়েশিয়ার দিকে তাকাতে বলি। এই দেশটি এশিয়ায় উন্নয়নের একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তাদের এই অগ্রগতি ধর্ম তথা ইসলামকে পরিত্যাগ করে নয়, ধারণ করেই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ষাট এর দশকের একটা ঘটনা বলি। তখন তাদের অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুর রহমান সস্ত্রীক পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। তার সফর উপলক্ষে নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (আপওয়া) করাচীতে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠানে পাকিস্তানী মহিলারা মঞ্চে এসে নিজ নিজ মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাদের কেউ নেচেছেন, কেউ গান গেয়েছেন আবার কেউ যন্ত্র সংগীত বাজিয়েছেন। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী টেংকু আবদুর রহমানের স্ত্রীকে একটা নাচ বা গান উপহার দেয়ার অনুরোধ করা হয় এবং তিনি পিনপতন নীরবতার মধ্যে মাইকের সামনে এসে পবিত্র কুরআনের একটা রুকুই তিলাওয়াত করে ফেললেন। তেলাওয়াত শেষে তিনি বললেন, “বোনেরা আমার পক্ষে শুধু এটাই সম্ভব ছিল। আমি শুধু কুরআন তেলাওয়াত করাই জানি।” পাশ্চাত্যের মানসিক গোলামদের জন্য এটা ছিল একটা চপেটাঘাত। আমাদের দেশের এই গোলামরা কখন এই সত্যটি উপলব্ধি করবেন?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads