সঙ্গত আইন-কানুন, বিধি-বিধান এবং মৌলিক অধিকার ছাড়া কোনো সমাজ প্রগতির পথে এগুতে পারে না। একথা সভা-সমাবেশে অনেকেই উচ্চারণ করে থাকেন। সরকার ও সরকারি দলের লোকেরা ঐ কথা একটু বেশি করেই বলে থাকেন। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলোÑ কথা ও কাজে মিলের অভাব। অনেক সময় মনে হয় সম্পদের অভাবের চাইতেও এই অভাবটাই এখন জাতির কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির ব্যাপারে কারো তেমন নজর নেই। জাতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েতো সরকারেরই প্রথমে নজর দেয়া উচিত এবং উচিত উদাহরণ সৃষ্টি করাও। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখছি না।
সরকারের কর্তারাতো নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে বর্ণনা করতে ভালবাসেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারের এ কেমন আচরণ? দমন-অবদমন, ডা-াবেড়ি, চাতুর্য ও শক্তি প্রয়োগ কি গণতান্ত্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে? বিরোধী দলও যে ধোয়া তুলসী পাতা তা আমরা বলছি না। ঘন ঘন হরতাল ও ভাংচুরের ঘটনা বিরোধী দল সম্পর্কেও জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। তবে এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। বিরোধী দল কি পাগলামী করে হরতাল ডাকছে, ভাংচুর করছে? নাকি সরকারের অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী আচরণ বিরোধী দলকে ওপথে যেতে বাধ্য করছে? দেশের জনগণ দেখেছে মানববন্ধন করতে গিয়েও কীভাবে বিরোধী দল বাধার সম্মুখীন হয়েছে, দলীয় কার্যালয় থেকে কীভাবে প্রধান বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতে বিরোধী দলও কখনও কখনও সহিংস প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে দেশের সুধীজনরা উভয়পক্ষকেই গণতান্ত্রিক আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সরকার বিরোধী দলসমূহকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিলেতো তাদের আর অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামে নামতে হয় না। কিন্তু শুরুর কাজটা শুরু না হওয়ায় আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেই চলেছে। সরকারের অহংকার ও অবদমন চেতনা এখন এতটাই উগ্র হয়ে উঠেছে যে, বিরোধী দলকে দলীয় কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল করার মতো নিরীহ কর্মসূচিও পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। এমন ঘটনা ঘটেছে ২১শে মে মঙ্গলবার। এদিন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ দোয়া মাহফিলে যোগ দিতে আসা নেতা-কর্মীদের সরে যেতে বাধ্য করে। এরপর বিএনপি কার্যালয় সংলগ্ন ভাসানী হলে দোয়া মাহফিল করতে গেলে সেখানেও বাধা দেয় পুলিশ। এ ব্যাপারে বিএনপির মুখপাত্র ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘দোয়া মাহফিল করতে না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলেছে, ওপরের নির্দেশ আছে’। দুদু বলেন, সরকার সরাসরি জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করে জরুরি আইনের কার্যক্রম পুরোপুরি প্রয়োগ করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মোঃ আশরাফুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচির নাম করে পরে রাস্তায় বেরিয়ে যানবাহন ভাংচুর করা হবে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কার্যালয়ে ঐ অনুষ্ঠান না করতে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। অবশ্য এর আগে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে একমাস কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না।
সন্ত্রাস দমনের ব্যাপারে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনতো খুবই সোচ্চার। কিন্তু প্রশ্ন হলো সন্ত্রাস কি শুধু বিরোধী দলই করে? সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসের ঘটনা তারা এড়িয়ে যান কেন? গত রোববার সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দু’ গ্রুপ প্রকাশ্যে যেভাবে গোলাগুলী করলো, সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালালো তখন কাছে দাঁড়িয়ে থেকে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করলো কেন? একই দেশে পুলিশের এমন দ্বিমুখী আচরণ কেন? সরকারের অনুরাগ ও প্রশ্রয়ের ফলে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীরা এখন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তাদের দমন করার মতো নৈতিক সাহসও যেন হারিয়ে ফেলেছে আমাদের পুলিশ ও প্রশাসন। তেমন উদাহরণ লক্ষ্য করা গেছে গত সোমবারও। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গত সোমবার রাতে পুলিশের কাছ থেকে গোলাম রহমান চৌধুরী নামে এক অস্ত্রবাজ যুবককে ছিনিয়ে নিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ঐ যুবক সিলেটের এমসি কলেজের সংঘর্ষের সময় অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছিল। আসলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলেই যে সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না তার বড় উদাহরণ বর্তমান সরকার। বর্তমান সরকার মুখে গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে আচরণে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী হওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছে। এমন কৌশলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আকাক্সক্ষা প্রকাশ পেলেও দেশ ও জনগণের কল্যাণের কোনো চেতনা
লক্ষ্য করা যায় না।
অবাক ব্যাপার হলো, বর্তমান সরকার কথামালার যে রাজনীতি চর্চা করছে, সেখানেও তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সংহতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এ বিষয়টি লক্ষ্য করে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, দেশে এখন তিনটি সরকার বিরাজমান। এর একটি হলো প্রধানমন্ত্রীর সরকার, অপরটি এলজিআরডি মন্ত্রীর সরকার এবং আর একটি হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরকার। দেশে একমাস সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য যে, গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন সন্ত্রাসী কার্যক্রম ঠেকাতে একমাস কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। একইদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআর ডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর স্বার্থে সভা-সমাবেশের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আর সভা-সমাবেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় নাকি ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে খবরে বলা হয়। প্রধানমন্ত্রী নাকি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কথা বলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঠিক হয়নি। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দলের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার পর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে আক্রান্তদের ত্রাণ তৎপরতা শেষ হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাখ্যাসহ নিষেধাজ্ঞাটি প্রত্যাহার করা হবে। কারণ এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। ভাবতে ভালো লাগছে, সরকারের চেতনায় এখনও ভাবমূর্তির বিষয়টি আছে। কিন্তু ভাবমূর্তির বিষয়টিকে সরকার যদি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করেন তাহলে তো অনেক আগেই তাদের জেগে ওঠার কথা ছিল। সরকারের ভাবমূর্তি যে এখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সে কথা বলার মত সাহস কোনো নেতা-কর্মীর বোধহয় এখন আর সরকারি দলে বিরাজমান নেই। এই হলো আমাদের তথাকথিত গণতান্ত্রিক দল ও সরকারের চেহারা। সরকার যদি আসলেই ভাবমূর্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে শেষ সময়ে আর যে কটা দিন আছে সে দিনগুলোতে আর একটা ভুল করারও সুযোগ নেই সরকারের। সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একের পর এক ভুল করে গেছে এবং সে ব্যাপারে বিরোধীদলের সমালোচনাকে পাত্তা না দেয়ার সংস্কৃতি পালন করে গেছে। তবে সামনের দিনগুলোতে আর যেন সেই ভুল না করে তেমন উপলব্ধির জন্য বিএনপি ঘরানার বাইরের এক বিশ্লেষকের একটা বিশ্লেষণ সরকারের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন উল্লেখ করে অধ্যাপক, লেখক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, এ ইস্যুতে সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক। শুধু জরুরি অবস্থায়ই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতে পার্ েকিন্তু দেশ এখন জরুরি অবস্থার মধ্যে নেই। তিনি আরো বলেন, সরকার বলছে মহাসেনের ত্রাণকার্যে যাতে বিঘœ না ঘটে সে কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি যে, সভা-সমাবেশের কারণে ত্রাণ বিতরণে কোনোরকম সমস্যা হবে না। আসলে সরকারের বক্তব্য যুক্তিতে টিকছে না। বিগত বছরগুলোতে বহু ইস্যুতেই সরকার এরকম অযৌক্তিক বক্তব্য ও আচরণের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এতে দেশের জনগণের দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তির মাত্রা বেড়েছে, আর জনসমর্থন কমেছে সরকারের। শেষ সময়ে এসে ক্ষতিকর ও অযৌক্তিক পথ থেকে সরে আসে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে সরকারের জন্য প্রথম পরীক্ষার বিষয় হলো, নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয়া। এ পরীক্ষায় সরকার পাস করলে খুশী হবে দেশের সবাই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন