বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৩

টিট ফর ট্যাট



একটি বহুল পরিচিত প্রবাদ আছে। ‘‘Tit for tat’  অর্থাৎ ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’। অথবা নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। আর এই প্রবাদ ও সূত্র ধরেই বলতে হবে বর্তমান মহাজোট সরকার একের পর এক যেভাবে বিরোধী মত ও দল দমনে ক্রমেই আগ্রাসি হয়ে উঠছে না জানি কবে তা হিতে বিপরীত হয়ে যায়।
গত ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ডিএমপির পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েও সমাবেশে আগত হেফাজতে ইসলামের নিরীহ তৌহিদী জনতার উপর পথে পথে হামলা ও এক পর্যায়ে গভীর রাতে বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে নির্বিচারে গুলী চালিয়ে এবং গ্রেনেড ছুঁড়ে যে হতাহতের ঘটনা ঘটানো হয়েছে তার খেসারত একসময় এই সরকারকেই বহন করতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামের বিভিন্ন আকিদা বিশ্বাসকে নিয়ে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে যারা সেদিন ঢাকা অবরোধ করেছিল তাদের অধিকাংশের হাতেই ছিল তসবি ও পবিত্র কুরআন শরিফ। তাছাড়া ঢাকার ৬টি প্রবেশ পথ থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশে যোগ দেয়ার পথে এসব নিরপরাধ ও নিরস্ত্র জনতার উপর পল্টন, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তা শুধু নিন্দনীয় ও ন্যক্কারজনকই নয় মহাজোট সরকারের কাপুরুষতার একটি কালো দৃষ্টান্ত হয়ে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
আওয়াম লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের শায়েস্তা করার ঘোষণা দেয়ার পর রাত আড়াইটায় বাতি নিভিয়ে নিরস্ত্র, জিকিররত ও ঘুমন্ত হেফাজত কর্মীদের উপর যে নির্বিচার গুলী চালানো হয়েছে তা এক নৃশংসতা। সরকার হেফাজতকে সমাবেশ করতেই যখন দিবে না, তাদের সমাবেশের অনুমতি দিলেন কেন? আবার বাতি নিভিয়ে রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে গুলী চালালেন কেন? সে রাতের হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা যারা অভিযান চালিয়েছেন তারা এবং আল্লাহই জানেন। এমন অমানবিকতা সেদিন না ঘটালেই পারতেন। কারণ ৬ এপ্রিল সমাবেশে আরো বেশি উপস্থিতি নিয়েই তারা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। দিনভর তাদের উপর সরকারি দলের কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা না চালালে তারাও শাপলা চত্বরে বসে পড়তো না। ৬ এপ্রিলের মতই হয়তো বাড়ি ফিরে যেত। 
গুটি কয়েক গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের নিরাপত্তাসহ সকল সুযোগ সুবিধা দিয়ে তিন মাস জামাই আদরে রেখেছেন। অথচ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে নাস্তিকদের ফাঁসির দাবিতে অল্প কয়েক ঘণ্টার সমাবেশকে সহ্য করা হলো না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য একশ্রেণীর মিডিয়া সরকারদলীয় কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক হেফাজতের কর্মীদের উপর নির্বিচার গুলীকে পাশ কাটিয়ে সব ঘটনা হেফাজতের সহিংসতা বলে চালিয়ে দিলেন। অথচ ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ প্রমাণ করে তারা সহিংস নয়। ৫ মে হেফাজতের কর্মীদের উপর পথে পথে নির্বিচার গুলী চালালো সরকারদলীয় কর্মীরা ও পুলিশ বাহিনী, আর প্রচার করা হলো হেফাজতের সহিংসতা বলে।
এদিকে ৫ মে দিনভর বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের উপর আওয়ামী লীগ ও সরকারি বাহিনী যে হামলা চালিয়েছিল তা প্রতিরোধ করেছিল হেফাজতের গুটিকয়েক কিছু নেতাকর্মী। একের পর এক নিহত ও আহত’র সংবাদ পেয়েও সংবাদ মাধ্যমে লাইভ অনুষ্ঠানে দেখা গেছে হেফাজত কর্মীদের উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন শাপলা চত্বরের মঞ্চে উপবিষ্ট নেতারা। কিন্তু দিনের বেলায় নির্বিচার হামলা, কয়েকজন নিহতের ঘটনার পরও হেফাজতের নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার প্রতিদান রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে দেয়া হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আপলোড করা ছবিগুলোতে দেখলাম বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীরা তাদের সাথে থাকা রুটি, পানি খাবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের খাওয়ার জন্য ভাগ করে দিচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় অতিথি হিসেবে আসা মুসাফিরদের আতিথিয়েতা গ্রহণ করে তার প্রতিদান দেয়া হলো নির্বিচার গুলী দিয়ে। রক্তে রঞ্জিত করা হলো রাজপথ। যাদের আতিথিয়েতা গ্রহণ করেছি তাদের উপর গুলী চালাতে হৃদয়ে সামান্য কষ্ট কী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হৃদয়ে উদয় হয়নি? এতটা নির্দয় ও নিষ্ঠুরতা স্বাধীনতা পরবর্তী এ জাতি কখনো দেখেনি। নির্বাক বিস্ময়ে প্রশ্ন জাগে, ‘কাদের উপর আমরা গুলী চালালাম?’ যারা হেফাজতের এ অন্দোলনে অংশ নিয়েছে তাদের কেউ ক্ষমতার লোভ নিয়ে আসেনি। তাদের ১৩ দফা কর্মসূচির কোথাও ক্ষমতায় যাবার দাবিও ছিল না।
ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে হেফাজতের কর্মীদের হটিয়ে সরকার যদি মনে করে আমরা সফল হয়েছি তাহলে তা হবে সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ, একটি আঘাত আরেকটি প্রতিঘাতের জন্ম দেয়। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। যা আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে পরের দিনই দেখেছি। নারায়ণগঞ্জে পরের দিন ভোরেই আবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে হেফাজত কর্মীরা। সরকারের ক্র্যাকডাউনের পরও যে ক্ষোভের আগুন নেভানো যায়নি যা নারায়ণগঞ্জে দেখা গেছে। যার ফলশ্রুতিতে হেফাজত কর্মীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সদস্যকেও প্রাণ হারাতে হয়েছিল। এছাড়া বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। শুধু পৃথিবীর বিভিন্ন ইতিহাসই নয় বাংলাদেশের ইতিহাসও যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে কোন আগ্রাসনই সাধারণ জনগণের দাবিকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বরং যারা আগ্রাসন চালিয়েছে তারাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ’৫২, ’৭১-এর আন্দোলনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর আগ্রাসন করে শেষ পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারও দমন নিপীড়ন করে একপর্যায়ে জনরোষেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তবে গণআন্দোলনের ফলে যেসব সরকার ক্ষমতা হারিয়েছে তারা আর পরবর্তীতে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। এক সময় দলের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। সাম্প্রতিক ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও মিসরের হোসনি মোবারকই দৃষ্টান্ত।
গত ৪ বছরের ঘটনা প্রবাহ টানলে দেখা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পর জামায়াত বা শিবিরের নেতাকর্মীরা তেমন কোন বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এমনকি একটা হরতালও ডাকেনি। তারা হয়তো সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রত্যাশা করেছিল। এদিকে স্কাইপ কেলেংকারিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যখন ট্রাইব্যুনালের এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের এক চোখা মানবাধিকার সংস্থা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তাতে বিচার প্রক্রিয়া সকলের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার আমিও চাই। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই সরকার যদি এ বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ইচ্ছা পোষণ করতো তাহলে আন্তর্জাতিক সকল মান বজায় রাখা এবং ডিফেন্সকে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া দরকার ছিল। সরকারের দরকার ছিল না সুখরঞ্জন বালিকে ডিবি পুলিশের গাড়িতে করে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। সরকারের দরকার ছিল না রায় পরবর্তী গুটি কয়েক ব্লগার ও অখ্যাত গণজাগরণের বিতর্কিত নেতা কর্মীদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাদের দাবি মেনে নিয়ে সংসদের আপিল সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করা। তড়িঘড়ির আপিল সংক্রান্ত রায় পরিবর্তন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ অনেক কিছুই ট্র্ইাব্যুনাল নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই সুযোগে জামায়াতই তাদের পক্ষে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। যা তাদের চলমান আন্দোলনের চিত্র দেখেই অনুমান করা যায়।
আমি আগেই বলেছি, ‘একটি আঘাত আরেকটি প্রতিঘাতের জন্ম দেয়।’ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দল দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেভাবে ব্যবহার করছে। এখন ঠিক তাদের উপরও সেভাবে ব্যবহার হচ্ছে বিরোধী দল। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর বিরোধী দলগুলোর চড়াও হওয়াই এর প্রমাণ। এক্ষেত্রে জীবিকার তাগিদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যোগ দেয়া এসব সদস্য এক সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ারই সম্ভাবনা রয়েছে। অথবা যদি সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার আসে সমভাবে পূর্বের সরকারের উপর সে বাহিনীকে ব্যবহারের সম্ভাবনাও রয়েছে। এতে শুধু সংঘাতই বাড়বে। যদিও ৫ মে বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ কিন্তু বিরোধী মত দমনে মহাজোট যে আচরণ করছে তাতে সে সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। এমন সম্ভাবনা আমরা বাংলাদেশে চাইও না।  এতে ক্ষতি হবে দেশের। ক্ষতি হবে জনগণের। ক্ষতি হবে সকল দল মতের।
আমি নিজে একজন সাংবাদিক হয়ে সব শেষে আমার সাংবাদিক বন্ধুদের বলতে চাইÑ আমার দেশ, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ানসহ সরকার কর্তৃক কিছু মিডিয়া দলন ও মাহমুদুর রহমানকে আটকে যারা হৃদয়ে আনন্দবোধ করছেন, আপনাদের বেলায় যদি এমনটা ঘটে, তখন আপনাদের আজকের আনন্দ পূর্ববর্তীদের মতোই কষ্টে রূপ নিবে। কেউ সরকার, কেউ বিরোধী দল, কেউ হেফাজত, যখন যে যেভাবেই থাকুক একজন সাংবাদিক হিসেবে দেশের স্বার্থে অন্তত আমাদের সাংবাদিক ভাইদের নিরপেক্ষ থাকা উচিত। আর আমরা যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সংবাদ পরিবেশন করি কোন দল আমাদের গায়ে হাত তোলার বা আমাদের সাংবাদিকতায় বাধা দেয়ার দুঃসাহসও কখনো দেখাবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads