বুধবার, ৮ মে, ২০১৩

বিশ্বাসভঙ্গের নিষ্ঠুর রাজনীতি


গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকার কোনো সমস্যাই সামরিক কায়দায় সমাধান করতে চায় না। নৃশংসতা গণতন্ত্রের সাথে যায় না। নিষ্ঠুরতা গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ। তাই ভিন্নমতকে সহ্য করেই সহিষ্ণুতা ও সংযমের পথ ধরে গণতান্ত্রিক সরকার পথ চলে। গণতন্ত্রে সামরিক ধরনের অ্যাকশন নেই বলেই অনেক ক্ষতি হজম করে পিলখানায়ও সরকার সামরিক অ্যাকশন চায়নি বলে দাবি করে। অথচ হেফাজতে ইসলামকে ‘দমনের’ নামে এভাবে নৃশংস অভিযান চালিয়ে সরকার শতাব্দীর নিকৃষ্টতম বীভৎস ইতিহাস সৃষ্টি করল কেন। এটা কি কোনো রাজনৈতিক চমক, নাকি সরকারকে দিয়ে কেউ বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে নিলো। বর্তমান সরকার ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় দিন বদলের চমক দেখানোর পথে হেঁটে অনেক বিতর্কিত পথ মাড়িয়ে আজকের পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। ঠাণ্ডা মাথায় ঘুমন্ত ও জিকিরে মশগুল আলেমদের ওপর হামলা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। সরকার সান্ত্বনার প্রলেপ দিলেও ইতিহাসের সব অসহিষ্ণুতাকে এ ঘটনা হার মানিয়েছে। তার ওপর মিথ্যার বেসাতি করে সরকার ভাবছে এর মাধ্যমে ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা ভেসে গেছে।

এই প্রেক্ষাপটে দেশী-বিদেশী চাপে পড়ে লোক দেখানো সংলাপ প্রস্তাব আরো একটি টাটকা চমক। সংলাপ যদি সমাধানের পথ হয় তাহলে আলেমদের সাথেও হতে পারত। সরকার তা চায়নি, চেয়েছে ক্ষমতা দেখাতে। অথচ ক্ষমতার চমকে জাতির রক্তক্ষরণ বাড়ছে। কিন্তু রাজনৈতিক চমকের পর নিষ্ঠুর চমক দেখানোর পরও সরকার এখনো কান্ত নয়। প্রহসন, উপহাস, রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন ও  রাজনৈতিক প্রতারণার শেষ নেই। কুরআনের দাবি পূরণের দায় নিয়ে রাজপথে এসে আজ সম্মানিত আলেমসমাজ কুরআন পোড়ানোর জন্য অভিযুক্ত, কী তামাশার রাজনীতিই না চলছে। তবে জনগণ কান্ত, পরিশ্রান্ত ও বিরক্ত। চাপা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠার সুযোগ খুঁজছে। দুর্ভাগ্য প্রতিটি ট্র্যাজেডির পর এর হোতারা ফুরফুরে মেজাজে ভাবে কেল্লাফতে। বিজয়ই নিশ্চিত হয়েছে। ক্ষমতার মুখে জঞ্জাল সরে গেছে। বাস্তবে সরকার নিরীহ নিরপরাধ আলেমদের রক্ত দিয়ে গোসল করে পতনের কফিনে আরো একটি পেরেক ঠুকে দিলো কি না, সেটাও ভাবার আছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর প্রথম চমকপ্রদ বক্তব্য দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে। বলেছিলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে বিজয়ী করে, বিপরীতে চারদলীয় জোটকে হারিয়ে দিয়ে জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেই ফেলেছে। এরপর চমক দেখালেন অভিজ্ঞ ও সিনিয়রদের বাদ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে। আনকোরা অখ্যাত ও অনভিজ্ঞদের মন্ত্রী করে চমক দেখানোর পর সুরঞ্জিত বাবু বললেন, কচিকাঁচার আসরÑ মন্ত্রিসভা নয়। তার পরের চমক বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুকায়ন করা হলো। এই চমক শেষ হওয়ার আগেই জিয়ার নাম উপড়ে ফেলতে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নামও পাল্টে হজরত শাহ জালাল র:-এর নামে করা হলো। এটা আলেম-আওলিয়া কিংবা দরবেশ বা পীরপ্রীতি ছিল না, ছিল জিয়াভীতি এবং অ্যালার্জি কিংবা বাতিক। সত্যিই আলেম, দরবেশ ও পীরপ্রীতি হলে আলেমদের ওপর এভাবে প্রতিশোধ নিতে হাত কাঁপত। ব্যথাতুর মনে সংবেদনশীলতা জাগত। আলেমদের খালেদার সাথে মিলিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রƒপের ভাষা জাগত না। অনেকেই ভুলে যায়নি কিভাবে চমক দেখিয়ে ধনুক ভাঙা পণ করে বেগম জিয়াকে শহীদ জিয়ার স্মৃতিবাহী মইনুল সড়কের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়া হয়েছিল। এটাও ছিল সরকারের অরাজনৈতিক ও অমানবিক চমক। এটা হয়তো এক টাকায় গণভবন লিখে নিতে না দেয়ার প্রতিশোধের চমক। তবে আলেমদের ওপর কিসের প্রতিশোধ নিয়ে সরকার চমক দেখাল তার জবাব মিলল না। কিন্তু রাজনীতি শূন্যে মিলিয়ে গেলেও আলেমদের রক্ত প্রতিটি বাঁকে কথা কইবে। মুনাজাতে আহাজারির হাতগুলো আরশের প্রভুর কাছে প্রতিদান চাইবে।
গেল ক’দিনে যে ছাত্রলীগ পিস্তল উঁচিয়ে আলেমদের শায়েস্তা করতে পুলিশের সাথে পেটুয়া বাহিনী সাজল, তাদেরই লাল ঘোড়ার মতো দাবড়িয়ে দেয়া হলো। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, চর দখলের মতো শিক্ষাঙ্গন, খালবিল, নদীনালা, ডোবা দখল করে চলল। চমক দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব বর্জনের এক উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়ে লোক হাসালেন। এর মাধ্যমে দেশবাসীকে বছরের সেরা চমকটাও দেখাতে ভুল করলেন না। ৬ মে রাজপথে সেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা পিস্তল উঁচিয়ে আলেম বধ কাব্য রচনা করল, জাতীয় দৈনিকে সেই ছবি ছাপা হলো।
এক সময় পিলখানায় সেনা কিলিং মিশন বাস্তবায়নের হৃদয়বিদারক চমকটা জাতি হজম করতে বাধ্য হলো। শেয়ারবাজারেও চমকের আগুন জ্বালিয়ে ছোট পুঁজির মানুষকে দগ্ধ করল। এটা ছিল দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেয়ারবাজার ধসের সেরা চমক। এই চমকে লাখো মানুষের কপাল ভাঙল। অসংখ্যবার প্রশ্ন উঠলÑ দেশ চালায় কে? মন্ত্রীরা, না উপদেষ্টারা। সংসদীয় গণতন্ত্রে এত উপদেষ্টার কলরব ইতিহাসে বিরল। এত উপদেষ্টা থাকার পরও হঠাৎ করে একদিন জনগণকে চমকে দেয়ার মতো ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘুরিয়ে দেয়া হলো। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও সূর্যের আলো কাজে লাগানোর এক চমকপ্রদ কাহিনী ফেঁদে ঘুমকাতুরে শিশুদেরও হাসালেন। তত দিনে আড়িয়াল বিল ভরাট করে বঙ্গবন্ধুর নামে একটা স্বপ্নের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার চমক দেখানোর তোড়জোড় শুরু হলো। ভাগ্যিস, জনতা সেই ঘোড়া রোগে আক্রান্ত দৈত্যকে রুখে দিলো। চমক ও তামাশা দেখানোর কসরত সেই মুহূর্তে থামাতে হলো। তারপর ক্ষোভের আগুনে দগ্ধ জনগণকে সরকার কুইক রেন্টালের চমক দিয়ে দিশেহারা করে দিলো। তার পরও বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, কলকারখানার চাকা একের পর এক বন্ধ হওয়ার চমক শুরু হলো। তার ওপর হাইকোর্টের একটা খণ্ডিত রায়কে ছুতো বানিয়ে সংবিধান সংশোধনের নতুন চমকটি ছিল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রহসনমূলক নাটক। সংবিধান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলো গণনন্দিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা উপড়ে ফেলার খেসারত বা মাশুল জাতি এখনো গুনছে। এই দাবিতেই গণ-অভ্যুত্থানের আলমতে দেশ-জাতি আজ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার সম্ভবত বিরোধী দলের চাপে পড়ে দিশা হারিয়ে নিরস্ত্র আলেম-ওলামাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে ঝিকে মেরে বউকে শেখাতে চাইল। সরকার হয়তো ভেবেছে তাবৎ আলেমসমাজ বিরোধী দলে ভিড়ে গেছে। এ মূল্যায়ন যথার্থ নয়।
দিল্লি সফরের চমক দিয়ে সরকার বাংলাদেশীদের আশাবাদের খোয়াব দেখাল। দিল্লিতে কী প্রতিশ্রুতি দিলেন, কী নির্দেশ পেলেন জাতি আজো জানল না। অথচ বাঙ্গালদের দেখালেন ভারতীয় তাঁবেদারির অভিনব এক হাইকোর্ট। বাংলাদেশীরা পানি পেল না। কোনো চুক্তিই বাস্তবায়ন হলো না। এত তেল ঢালার পরও রাধা নাচল না। তিস্তা চুক্তি হলো না। প্রণব বাবুর প্রতিশ্রুত সাহায্যও এলো না। অনেকেই মনে করছেন, আলেমদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার নেপথ্যে ভোটের রাজনীতির সংখ্যাতত্ত্ব এবং ভারতীয় ইন্ধন সরকারকে হয়তো ভাবিয়েছে। এমন ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করার দায়ও সরকার মাথায় তুলে নিলো।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতির চমক শুরু হওয়ার আগেই হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারির গদ্য রচনা শুরু হলো। পদ্মা সেতু যেন নতুন এক পদ্মাবতী কাব্য। মিথ্যাচারের ডিপো সাজল সরকার। এরই মধ্যে আগুনে দগ্ধ হলো তাজরীনের শ্রমজীবী মানুষ। জনগণ চমক দেখল শ্রমিক পুড়ে কয়লা হলেও মালিক তেলতেলে থাকতে পারেন। বহদ্দারহাটে ফাইওভার পড়ল মানুষের গর্দানের ওপর। যে ফাইওভার চমক দেখানোর জন্য দ্রুত ফিতা কাটার লক্ষ্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। পদ্মা সেতুর চমক শেষ পর্যন্ত মিস্টার পারসেন্টেজ বানাল অনেককে। দুদক ফিডারে দুধ চুষেই চলল। এতসব ব্যর্থতার ক্ষোভ ঢালা হলো হেফাজতের ওপর। তারা এখন ফেরারি। সরকার আক্রমণ ভাগে খেলছে।
সরকার বিশ্বব্যাংককে চোর সাজাল, আবুলকে দিলো দেশপ্রেমের সনদ। নোবেল বিজয়ী ইউনূসকে সাজাল সুদখোর, গ্রামীণ ব্যাংক দখল নেয়ার চমক শুরু হলো পুরোদমে। মানি-গুণী মানুষকে বেইজ্জত করার জন্যই যেন এ সরকার ক্ষমতায় বসেছিল। মানি লোকদের অসম্মান করার জন্যই যেন সরকার মিশন নিয়ে এসেছিল। ইলিয়াস আলীকে নিয়ে সরকারের কথার চমক যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। চৌধুরী আলমেরা আর ফিরলেন না। সাগর-রুনিদের সন্তানেরা মেঘের প্রতীক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বেহায়া-বেশরম হয়ে থাকেন সব ইস্যুতে। সাভার ট্র্যাজেডিতে তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। হেফাজত ট্র্যাজেডিতে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো দৃষ্টান্ত পেলেন না। শুধুই তালেবানি ভূত দেখলেন। জনমনে প্রশ্ন, সরকার কি এসব দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই হেফাজত ট্র্যাজেডির জন্ম দিলো?
গজবমার্কা চমক এলো সাভারের রানা প্লাজার ধস ও রানা-জংদের জংলি আচরণে। জনগণ যখন আর চমক দেখতে চাচ্ছিল না, তখনো মিথ্যার গরল ঢেলে সিএনএনকেও তাজ্জব বানিয়ে দেয়া হলো। বোকা সাজতে বাধ্য হলো পুরো জাতি।
বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আক্রান্ত হলে চমক থাকে না, বিরোধীদলীয় সব নেতাকে জেলে ঢোকালে লজ্জার মাত্রা বাড়ে। এ সত্য কে কাকে বোঝাবে! সেসব জনগণ যখন ভুলতে চাইল তখন আরো একটি চমক দেখতে হলো স্পিকার নির্বাচনের মাধ্যমে। লাঙ্গল যার জমিন তার যেমন হচ্ছে না, তেমনি সংসদও সংসদ সদস্যদের হলো না। হাউজ অব দি লিডারের দাপুটের ময়দান হয়ে থাকল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ডিজায়ার বঙ্গবন্ধুর ডিজায়ারকে হার মানাল। সে সময় বাকশালী ডিজায়ারে বাগড়া দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও জেনারেল ওসমানী। এবার র‌্যাট ক্যাট সিনিয়র-জুনিয়র কোনো আওয়ামী লীগারই বুকের পাটা দেখিয়ে তামাশার মতো চমক দেখানোর বিষয় স্পিকার নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করলেন না। কী উপভোগ্য ক্ষমতা। ক্ষমতার একচ্ছত্র চমক দেখানোর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকেও যেন পেছনে ফেলে দিলেন। এই চমক দেখে আমাদের গণতন্ত্র প্রেমের তাজমহল খ্যাত সংসদ ভবনের লাল ইটগুলোও বিদ্রƒপের হাসি হাসল। সরকার এসব গায়ে না মেখে ১৩ দফাকেই টার্গেট বানিয়ে গুলি ছুড়ল। এখন ১৪ দল বলছে, মতিঝিলে আগ্নেয়াস্ত্রই ব্যবহার হয়নি। তাহলে জনগণ গভীর রাতে ফুল ছিটানোর শব্দ শুনেছে। হায়রে ক্ষমতার রাজনীতি! হায়রে রাজনীতিবিদ!
স্পিকার বিষয়ক চমকের নাম নাকি নারীর ক্ষমতায়ন। এর ফলোআপ শেষ চমক হবে যখন হাউজ অব দ্য লিডার, অপজিশন অব দ্য লিডার ও নারী স্পিকার একটা ছবি তুলে ইতিহাস হয়ে যাবেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীর উচিত এই ডিজায়ারকে বাস্তবতা দিতে হাঁকে জয়যুক্ত করা। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা ফটিকছড়িতে চমক দেখাতে চেয়েছে। যেমন পুলিশ বিএনপি অফিসে তাণ্ডব চালিয়ে প্রমোশন নিশ্চিত করতে চমক দেখাতে চেয়েছে। ছায়াশত্রুকে তাড়া করে মুক্তিযোদ্ধা সাজার খায়েশ পূরণ করেছে। বাস্তবে ফল হলো উল্টো, এক দিকে লাশের স্তূপ বড় হতে লাগল, অন্য দিকে সব কিছু বুমেরাং হয়ে আসতে শুরু করল। যেমনটি আড়িয়াল বিলে ঘটেছিল। উত্তর ও দক্ষিণ জনপদে একটি ফাঁসির ঘটনায় জনগণ কিভাবে পিঠ না দেখিয়ে বুক দেখায় তাও চমকের দেশে দেখা সম্ভব হলো। শোলাকিয়ার ইমাম একজন দরবারি মাওলানা, যারা কি না দ্বীনদার আলেমদের ভাষায় ওলামায়ে ছু’, এর অর্থ নাকি দুনিয়াদার আলেম। তার সাথে আরো ক’জন ওলামায়ে ছু’কে দিয়ে যে চমক দেখানোর কসরত জাতি প্রত্যক্ষ করল, তাও উপভোগ্য। এত বাঁধ দিয়েও হেফাজত ঠেকানো যাচ্ছিল না তাই কি এতসব নিষ্ঠুরতা। সব ক্ষোভ ঢেলে দিয়ে হেফাজতের ওপর মরণ কামড় বসিয়ে দেয়া হলো।
৬ এপ্রিলের মোকাবেলায় শাহবাগ মঞ্চকে দাঁড় করানো হলো, রঙ-বেরঙের দরবারিদের নামানো হলো। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে শিখণ্ডি বানানো হলো, নারী ঢাল বা প্রাচীর সৃষ্টির চমক হরিষে বিষাদ হয়ে এলো। তার পরও নালায়েকদের হুঁশ হয় না। বরং হেফাজতকে আদর্শিক শত্রু ভেবে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা হলো। ব্যর্থতার জ্বালা ও ক্ষোভ গিয়ে পড়ল লাখো আলেমের ওপর। আলেমসমাজ হয়ে গেল রাজনৈতিক তামাশার বলির পাঁঠা।
চমকের দেশে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদকে দিয়েও চমক দেখানো হলো। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার সঠিক, না একজন বিতর্কিত বিচারক ঠিকÑ এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি। বিচারক ঠিক হলে রাষ্ট্রপতির আইনি অবস্থানের ভাগ্য কী হবেÑ সেই তামাশার শেষ চমক দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। শাহবাগকে দিয়ে যে চমক দেখানো শুরু হলো, সেই চমক আজো নানা চমক দেখিয়ে যাচ্ছে। এরই শেষ চমকে ঝরে গেল অসংখ্য প্রাণ। রক্তস্নাত হলো বাংলার জমিন। বিপরীতে আলেম-ওলামাদের সাজানো হলো তাণ্ডবের হোতা। জানি না হয়তো সেই চমকই শেষ বিপর্যয় ডেকে আনবে। অন্যের জন্য কবর খুঁড়তে গিয়ে নিজেই সেই কবরে পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। কারণ ইতিহাস এ ধরনের রক্তের দায় ক্ষমা করে দেয় না। এ দায় থেকে ঢাকাবাসীও মুক্তি পাবে না, কারণ তারা ঘুমিয়েছে। সময়মতো প্রতিবাদ করেনি।
রেলের কালো বিড়াল বের হয়ে আসার পরও যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে দফতরবিহীন করে রাখার গরজ থাকে, সেই সরকার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও বিশ্বাসী তরুণদের হত্যা উৎসবে মেতে নৈতিক শক্তির উত্থান ঠেকাবে কিভাবে। ইতিহাসের জঘন্যতম ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়ে হেফাজতের পথ রোধ করবে কোন নৈতিক শক্তিবলে। ফুঁসে ওঠা জনমতকে নরম সুরের সংলাপ প্রস্তাব কিংবা হুমকি, এক দিকে উসকানি অন্য দিকে হেফাজতে ইসলামকে ঘরে ফিরে যাওয়ার খবরদারি ও নসিহতের নেপথ্যে কী ছিল জানি না, শেষ পর্যন্ত জাতি কী প্রত্যক্ষ করল সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়? দেশের প্রকৃত দ্বীনের সমঝদার আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের ইসলাম শেখানোর আরেকটি চমক জাতি প্রত্যক্ষ করল। এখন কুরআন পোড়ানোর দুঃখে তারাই মাতম করছে, যারা কুরআনের হেফাজতকারীদের অসহ্য ভেবেছে। অথচ বঙ্গবন্ধু এমন সমস্যায় পড়লে জ্ঞানী-গুণী আবুল ফজল ও মাওলানা তর্কবাগীশের মতো লোকদের শরণাপন্ন হতেন। স্মরণে পড়ে স্বাধীনতার পর কিছু মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট ও ভারতপন্থী বজ্জাত বঙ্গবন্ধুকে মাদরাসা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের মুখে থু থু ছিটিয়ে মাদরাসা বোর্ডের তরক্কি দিয়েছেন, ইসলামিক অ্যাকাডেমিকে মিলিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো এত আলেমের রক্ত মেখে সরকার বাহাদুরি ফলাত না। বঙ্গবন্ধুর গুণ ছিল ইতিহাস স্মরণে রাখতেন, শত্রু-বন্ধু চিনতে চাইতেন, নিজে যা জানতেন না তা জানার ভান করতেন না। তার অধস্তনরা সবজান্তা ভাব দেখান। কাজকর্মও করেন সেই মতো। ভাবেন ফেরেশতা সেজেছেন, বাস্তবে জনগণ শয়তানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
আরো কত চমক দেখবে জনগণ জানি না; তবে শেষ চমক সম্ভবত জনগণই দেখাবে। চার দিক থেকে ধেয়ে আসছে জনতার রুদ্ররোষের মিছিলÑ কবর ও ভাগাড় থেকে অসংখ্য আলেমে দ্বীনের হাড়গোড়, রানা প্লাজার তলে চাপাপড়া মৃত আত্মা এবং শত মজলুমের আহাজারি বাতাসকে ভারী করে রেখেছে। তারা যে অসংখ্য কফিন হয়ে মিছিলে যোগ দিচ্ছেÑ সে মিছিল ঠেকানোর সাধ্য সরকারের আছে কি না, ভেবে দেখা জরুরি। সরকার ভাবছে, তারা সফল অপারেশন চালিয়ে সঙ্কটমুক্ত হয়েছে। কার্যত সঙ্কট বাড়ল। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো ফিকে হয়ে গেছে। সরকার যুদ্ধ করছে ছায়াশত্রুর বিরুদ্ধে। যে যুদ্ধে আপাত সাফল্য দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে আমরা দুই নেত্রীর মুক্তি, গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করা ও ছদ্মবেশী মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের বিদায় চেয়ে শক্ত হাতে কলম ধরেছি। আজ দুই জোটের রাজনীতিবিদেরা পাশা খেলছেন, গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। মাঝখানে সরকার ঝাল মিটাতে আলেম-ওলামাদের ওপর চরম নিষ্ঠুরতা চাপিয়ে দিলো। এক নেত্রী খেলছেন, অন্যজন দেখছেন; জনগণ বোবা হয়ে সব কিছু প্রত্যক্ষ করছে। এমন সময় ও পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য। জনগণ ঘুমিয়েছিল এই বিশ্বাসে যে সরকার নিষ্ঠুর হবে না, বিরোধী দল পাশে থাকবে। বিশ্বাস ভঙ্গের এই নোংরা রাজনীতি জনগণ থু থু ছিটিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন সরকার ও বিরোধী দলের সব ব্যর্থতার দায় বর্তানো হচ্ছে আলেমদের ওপর। অথচ জনগণ ও আলেমরা সরকার ও বিরোধী দলকে বিশ্বাস করেছিল।
আলেমরা লক্ষাধিক আসামি হয়ে অসংখ্য মামলায় ফেরারি হয়ে ঘুরবেন, জেলে বন্দী জীবন যাপন করবেন, স্তম্ভিত জাতি চেয়ে চেয়ে দেখবেÑ আক্রমণ ভাগের এ খেলা বেশি দিন চলার কথা নয়। আজ আলেমসমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় আকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতির কাছে জিম্মি হয়েছেন, সময় পাল্টাবে। যারা আলেমদের ব্যবহার করতে চেয়েছেন তারা যেমন খেসারত গুনবেন, আলেমদের যারা বেইজ্জত করেছেন তারাও ক্ষমা পাবেন না। অবশিষ্ট যারা দর্শক সেজেছেন তাদের অন্ধত্ব প্রলয় ঠেকাবে না। সবাই আত্মসমালোচনা করে দায় নিয়ে জাতি ও আলেমসমাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন পথ রচনা করুন। নতুন রাজনীতি উপহার দিন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads