সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

চাপের মুখে নতজানু মিডিয়া



প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের মিডিয়া সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, শাপলা চত্বরের ঘটনায় বাংলাদেশের মিডিয়া নতজানু।
কেবল শাপলা  চত্বরের ঘটনা নয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার শুরু থেকেই মিডিয়াকে নতজানু করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তারা স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। সামান্যতম ভিন্নমত প্রকাশকারী সামান্য যে কয়টি মিডিয়া সরকারের কার্যক্রম সমালোচনা করেছে, তাদের ওপর নেমে এসেছে অত্যাচারের স্টিম রোলার। যেসব সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া হয়েছে আনুকূল্য, ঋণ পরিশোধে এসব মিডিয়া ক্রমাগত মিথ্যাকে সত্য করার চেষ্টায় রয়েছে লিপ্ত। ফল যেটা হয়েছে তা হলো, যে মিডিয়াকে পশ্চিমা জগৎ এক সময়ে Vibrant মিডিয়া বলে সম্মান দেখাত, সেগুলো আজ বলছে বাংলাদেশের মিডিয়া নতজানু। আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত গলা ফাটিয়ে দাবি করা হয়, এরা মিডিয়া-বান্ধব। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, শুধু বিদেশীরাই নয়, দেশের সাধারণ মানুষ এখন দেশী সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। গুজবে গুজবে দেশ ছেয়ে গেছে এবং তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাসও করছে।
মুখে রাম নাম বগলে ইট তন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এ দলটি কখনোই সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেনি এবং এখনো করছে না। গণতন্ত্রের মূল শর্ত হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা। এ দুটোর কোনোটাতেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে না।
আওয়ামী লীগ যে মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, তা তারা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রমাণ করে চলেছে; যেমনÑ
এক. ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বর : সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ তার পদ থেকে উস্তফা দিতে বাধ্য হন। কারণ তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল একজন রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তিনি মিথ্যা রিপোর্ট লিখেছেন। কিন্তু ফয়েজ আহমেদ রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। কারণ রিপোর্টটি সঠিক ছিল। উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহমেদ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা পুনর্গঠিত করেন। পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল অ্যাসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তান।
দুই. ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি : সরকার নিয়ন্ত্রিত দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান হাসান হাফিজুর রহমান এবং সম্পাদক তোয়াব খানকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করে ওএসডি করা হয়। কারণ ওই দিন মতিয়া চৌধুরীসহ (বর্তমানে কৃষিমন্ত্রী) অন্যদের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং এতে দুজন নিহত হন। এ ঘটনায় দৈনিক বাংলা বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে। এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধা হাসান হাফিজুর রহমান ও তোয়াব খানকে ওএসডি করা হয়। (পরবর্তীকালে তোয়াব খান বঙ্গবন্ধু এবং তারও পরে এরশাদের সেক্রেটারি হন। হাসান হাফিজুর রহমানকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র প্রকল্পের পরিচালক পদে নিয়োগ দেন)।
তিন. ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মুখপাত্র গণকণ্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় জাসদ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ছিলেন জাসদের অন্যতম প্রধান নেতা। সরকারের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে গণকণ্ঠে ক্রমাগত রিপোর্ট প্রকাশ হতে থাকে। আওয়ামী সরকার তাই পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
চার. ১৯৭৩ সালের ১১ আগস্ট : চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দেশবাংলার অফিসে অভিযান চালানো হয় এবং পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
পাঁচ. ১৯৭৩ সাল : মুক্তপত্র, স্পোকসম্যান, লাল পতাকা, হককথা, চরমপত্র, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও নয়াযুগ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। হককথার প্রকাশক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানী। তার পত্রিকাটিও আওয়ামী সরকারের রোষানল থেকে মুক্তি পায়নি।
ছয়. ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ : সরকারি মালিনাকাধীন ইংরেজি পত্রিকা মর্নিং নিউজে কর্মরত ছিলেন দেশের প্রথম মহিলা সাংবাদিক বিলকিস রহমান। তিনি পত্রিকাটির মহিলা পাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শামসুন্নাহার হলের সামনে চারজন যুবকের নিহত হওয়ার ঘটনার ওপর একটি মর্মস্পর্শী আর্টিক্যাল লেখেন। তাকে সাথে সাথে কর্মচ্যুত করা হয়। তার জীবনের ওপরও হুমকি আসে। ড. কামাল হোসেনের আত্মীয় হওয়ার সুবাদে বিলকিস প্রাণে বেঁচে যান। (পরবর্তীকালে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান)।
সাত. ৬ এপ্রিল ১৯৭৪ : প্রাচ্যবার্তা পত্রিকার সম্পাদক ফজলে লোহানীকে গ্রেফতার করা হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয় প্রাচ্যবার্তার প্রকাশনা। পত্রিকাটি প্রকাশ করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। (জনাব লোহানী মুক্তি পাওয়ার পরে বিদেশে চলে যান। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে যদি কিছু মনে না করেন নামে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালনা করেন।)
আট. ১ এপ্রিল ১৯৭৪ : হংকং থেকে প্রকাশিত ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকার বাংলাদেশে খণ্ডকালীন সংবাদদাতা ছিলেন সৈয়দ কামাল উদ্দিন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় পূর্ণকালীন পদে কর্মরত ছিলেন। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকায় সৈয়দ কামাল উদ্দিনের শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই অপরাধে তাকে বাসস থেকে বরখাস্ত করার তোড়জোড় শুরু হয়। তিনি অবশ্য পদত্যাগ করে নিজের সম্মান রক্ষা করেন। (পরবর্তীকালে সৈয়দ কামাল উদ্দিন ফার ইস্টার্ন রিভিউ পত্রিকার হংকংয়ের হেড অফিসে যোগ দেন এবং তেহরানসহ বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
নয়. ১৯৭৪ সাল : পূর্বদেশ পত্রিকার নিউজ এডিটর মীর নুরুল ইসলাম এবং সিনিয়র রিপোর্টার হাসান তৌফিক চৌধুরীকে সরকারের নির্দেশে বরখাস্ত করা হয়। তিনি লন্ডনের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, দুর্লভ্যতা ও দুর্নীতি নিয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট লেখেন এবং পূর্বদেশে তা ছাপা হয়। এ কারণে তাদের দুজনকে বরখাস্ত করা হয়।
ভয়ভীতি দেখিয়ে, পত্রিকা বন্ধ এবং সাংবাদিক নির্যাতন করেও যখন আওয়ামী লীগ সরকার স্বস্তি পাচ্ছিল না তখন তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সংবাদপত্র বন্ধ করার। ১৯৭৫ সালের শুরু থেকেই তারা গ্রাউন্ড ওয়ার্ক শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশে এত সংবাদপত্র এবং সাময়িকী থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ২৭ এপ্রিল তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত নিউজপ্রিন্টের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশে এর অপচয় না করে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হবে।
দশ. ১৬ জুন ১৯৭৫ : এই দিন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্বের চূড়ান্ত ঘোষণা আসে। জারি করা হয় সংবাদপত্র ডিকারেশন বাতিল আইন। ১৭ জুন এটি কার্যকর হয়। দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র এই আইনের বলে বাতিল হয়ে যায়। যে চারটি বাতিলের হাত থেকে বেঁচে যায়, সেগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। (১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এই আইনটি বাতিল করা হয় এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলো পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একে শত ফুল ফুটতে দাও-এর নীতি বলে অভিহিত করেছিলেন)।
১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার পরে ধারণা করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ তার পূর্বেকার সংবাদপত্র দখল, সাংবাদিক নির্যাতন এবং ভিন্নমত প্রচারের কণ্ঠ রোধ করার নীতি থেকে বের হয়ে আসবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে তারা এ ধরনের ওয়াদাও করেছিল। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ১৯৯৭ সালে সরকারি মালিকানাধীন টাইমস-বাংলা ট্রাস্ট পরিচালিত বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা এবং আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে বেকার হয়ে পড়েন কয়েক হাজার সাংবাদিক-কর্মচারী এবং দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলে নিয়োজিত সংবাদদাতারা। টাইমস-বাংলা ট্রাস্ট বিলুপ্ত করার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকার অজুহাত দেখায়, সরকার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কোনো পত্রিকা রাখতে চায় না। কিন্তু এটা ছিল একটা খোঁড়া অজুহাত। আসল কারণ ছিল, টাইমস-বাংলা ট্রাস্ট পরিচালিত চারটি পত্রিকায় যারা কর্মরত ছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। তাদের কর্মচ্যুত করার জন্যই পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ট্রাস্টের সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রা ছিল দেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, প্রচার সংখ্যায় যার অবস্থান ছিল শীর্ষে। পত্রিকাটি পরে শেখ রেহানার মালিকানায় নেয়া হয়। কিন্তু এটি আর কখনোই পাঠকপ্রিয় হয়নি। টাইমস-বাংলা ট্রাস্ট ভবনটি দিয়ে দেয়া হয় কর্মসংস্থান ব্যাংককে, যাতে ক্ষমতা বদল হলেও এটি আর সাবেক মালিকানায় যেতে না পারে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ দলটি মুখে গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বললেও কার্যত তারা মিডিয়া দলনে বিশ্বাসী। তারা যখন বিরোধী দলে থাকে তখন তারা মিডিয়া-বান্ধব হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় গেলে তাদের আসল চেহারা দেখা যায়। বর্তমান সময়েও তা-ই হয়েছে। এ সরকারের আমলে জনপ্রিয় পত্রিকা আমার দেশ বন্ধ করা হয়েছে, সম্পাদককে নেয়া হয়েছে জেলে আর প্রেসে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তালা। সম্প্রতি টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত এবং ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব করা হয়েছে প্রকাশ্যে। পর্দার অন্তরালে মিডিয়া দলন হয়েছে হুমকি-ধমকির মাধ্যমে। এ রকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক যে ইকোনমিস্ট বলেছে, বাংলাদেশের মিডিয়া এখন নতজানু

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads