জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের পর বহু রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান জিয়াউর
রহমানের বিভিন্ন গুণাবলির প্রশংসা করে শোকবার্তা পাঠান। এর মধ্যে ভারতের তদানীন্তন
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাণীই ছিল সত্যের কাছাকাছি। তিনি বলেছিলেনÑ জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক (farsighted statesman)। রাষ্ট্র-দার্শনিকেরা
বলেন, একজন রাজনীতিবিদ ব্যস্ত থাকেন বর্তমান নিয়ে আর একজন রাষ্ট্রনায়ক
নিয়োজিত থাকেন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে। জিয়াউর রহমানের
রাজনৈতিক দর্শন ও কার্যকলাপ সবই ছিল তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা নিয়ে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে
ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার মূল ভিত্তি ছিল ভাষা, ভৌগোলিক এলাকা ও জধপব বংশ বা
কুল। পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে শেখ সাহেবের
এ বাঙালি জাতীয়তাবাদের তখন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির পর
জাতীয়তাবাদের এ ব্যাখ্যা ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ শেখ সাহেবের ব্যাখ্যা অনুযায়ী
পশ্চিম বাংলাও ছিল জাতির অংশ। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের ুদ্র ুদ্র নৃগোষ্ঠী
তাদের বাঙালি হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
জিয়াউর রহমান সব ধরনের আধিপত্যবিরোধী এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের সাথে
সঙ্গতিপূর্ণ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অবতারণা করেন। একটি রচনায় তিনি নিজেই
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন : আমরা বলতে পারি
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য রয়েছে যা হচ্ছেÑ ১. বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের
ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা, ২. ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে আমাদের জনগণ, ৩. আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা, ৪. আমাদের
সংস্কৃতিÑ জনগণের আশা-আকাক্সা, উদ্দীপনা ও
আন্তরিকতার ধারক, আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ৫. ২০০ বছরের উপনিবেশ থাকার
প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক, ৬. আমাদের ধর্মÑ প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন
রীতিনীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা, ৭. সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে
আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এই ব্যাখ্যা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিপুল
সাড়া জাগায় এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর
রহমান রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সর্বক্ষেত্রেই সফলতা দেখিয়েছিলেন। সামরিক
ব্যক্তিত্ব হয়েও তিনি রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সব মতের মানুষের
সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপরিবর্তন করেন। একটি সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ প্রেসিডেন্সিয়াল এবং একটি অবাধ আইন পরিষদ সভার নির্বাচন অনুষ্ঠান করে
দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন।
জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি জাতীয় সেনাবাহিনী
হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা
দিয়ে অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে
অসাধারণ অবদান রাখেন।
সেনাবাহিনীর একটা ুদ্র গ্রুপ কর্তৃক নিহত হলেও তিনিই সামরিক বাহিনীতে
ঐক্য সংহতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা
অবদান হলো নাগরিক বাহিনীর (Citizen Army) চিন্তা কিছুটা
বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষের সাধারণ প্রশিক্ষণদানের মধ্যে গ্রাম
প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর
গঠনের মাধ্যমে দেশ গঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীর ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন।
জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল
বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন
প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল।
নারীর ক্ষমতায়ন ও শিশুদের কল্যাণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি
জিয়াউর রহমানই শুরু করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ রাষ্ট্রপতি ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার
সাথে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদার উন্নয়ন ঘটান।
এর ফলেই বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাপানকে পরাজিত করে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা
পরিষদের অস্থায়ী পদে নির্বাচিত হয়।
জিয়াউর রহমান ফারাক্কা সমস্যা ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন, ৮২-দেশ Non-Aligned Summit Conference ও সবশেষ UN General
Assembly উত্থাপন করেন। এসব আন্তর্জাতিক
সংস্থার চাপে ভারত বাংলাদেশের সাথে পাঁচ বছরমেয়াদি একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই
চুক্তি অনুযায়ী ভারত গঙ্গার পানির ৬০ ভাগ বাংলাদেশকে দিতে সম্মত হয়।
এভাবে সার্বভৌম বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে আপসহীন ভূমিকা রাখেন জিয়াউর
রহমান। ট্রানজিট, করিডোর ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ভারতের এককেন্দ্রিক সুবিধা নেয়া এবং
সীমান্ত হত্যাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শহীদ রাষ্ট্রপতির
চিন্তাদর্শন ও কার্যসূচি বাস্তবায়ন জরুরি। এখনকার রাজনীতিবিদদের উচিত হবে শহীদ
জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের যথাযথ মূল্যায়ন করে জুৎসই কৌশল ও করণীয় নির্ধারণ করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন