গত ১৯ মে ২০১৩, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসানের ‘গভীর সঙ্কটে বিএনপি’ শীর্ষক একটি লেখা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। লেখাটি লেখা
হয়েছে বিএনপিকে হেয়প্রতিপন্ন ও বর্তমান সরকারের চরম ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশে আপামর সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থনপুষ্ট
একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয়
গণতন্ত্রের প্রবর্তক, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি, রণাঙ্গনের বীরসেনানি শহীদ
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। দলটির জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ নামে
দেশটি স্বাধীনতার পর থেকে ৪২ বছরের মধ্যে সর্বাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য
আল্লাহর রহমতে এবং দেশের মানুষের সমর্থনে বিএনপি নির্বাচিত হয়েছে। সব থেকে লণীয়
বিষয় হলো, বিএনপি একটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক দল এবং এটি যতবার মতায় এসেছে
প্রতিবারই সামনের দরজা দিয়েই এসেছে, অর্থাৎ সরাসরি জনসমর্থন নিয়ে।
কোনো ষড়যন্ত্র করে বা কারো কাছে কখনোই দাসখত দিয়ে নয়। অর্থাৎ বিএনপি শুধু তাদের
ভোটদাতাদের কাছে দায়বদ্ধ। সারা দেশে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী এ দলের প্রাণ।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তনকারী সংগঠনের দু’টি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, পররাষ্ট্রনীতির
েেত্র ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই’, ধর্মীয় নীতিতে ‘দলটি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী’ অর্থাৎ সব ধর্মের
মানুষ স্ব স্ব ধর্মীয় বিধান মেনে চলবে, কেউ কারো ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে
বাধা প্রদান করবে না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যাপক
জনপ্রিয়তার কারণে দলটি ধ্বংস করা বা ভেঙে ফেলার জন্য দলের বাইরে থেকে প্রাণান্তকর
প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে, যা চলতেই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
দলটি যেহেতু উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সংগঠন, সেহেতু এখানে নানা মত নানা
চিন্তাভাবনার মানুষের সম্মিলন ঘটেছে। নিজস্ব মতামত প্রকাশের েেত্র দলের প্রত্যেক
নেতাকর্মী গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করে থাকে, যা কোনো একনায়কতান্ত্রিক ঘরানার
চিন্তাধারার বাহক রাজনৈতিক সংগঠনে একেবারেই অনুপস্থিত। শহীদ জিয়া বিএনপির
প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শিক নেতা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজন গৃহবধূ হয়েও দীর্ঘ ৯ বছর
স্বৈরাচারবিরোধী গণ-আন্দোলনে আপসহীন-দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে
প্রমাণ করতে পেরেছেন বলেই গত ২০-২২ বছরের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী ও দুইবার
বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলঙ্কৃত করেছেন।
শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়া যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেতা যে জননেতা তারেক রহমান, এ বিষয়ে দলের
ভেতর তো নয়ই, এমনকি দেশের ভেতরেও কোনো প্রশ্ন নেই। তারেক রহমানের ব্যাপক
জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিদেশীদের পোষ্য দালালচক্র ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে
যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। বিএনপিই বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব
ইতোমধ্যে নির্বাচিত হয়ে রয়েছে। এ জন্য অনেকের গাত্রদাহ হতেই পারে।
তারেক রহমান দলের বিকল্প নেতা নন, তিনি ভবিষ্যৎ নেতা। তিনি কখনোই
মৌলবাদী বা জঙ্গি গোষ্ঠীকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেননি বরং আওয়ামী
লীগই দেশের মানুষকে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের জুজুর ভয় দেখাচ্ছে বিনা বাধায় অকারণে, যার ফলে দেশের
ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের কোনো সমস্যা না
থাকলেও আওয়ামী বাকশালী সন্ত্রাসবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
যারাই ‘আওয়ামী লীগের বিরোধী তারাই বিএনপির বন্ধু’ তারেক রহমান এ নীতিতে বিশ্বাস করেন না আদৌ। বরং আজ দিবালোকের মতো
সত্য, বাকশাল প্রতিষ্ঠাতার গায়ের চামড়া ও হাড্ডি দিয়ে যারা নানারকম
উপকরণ বানাতে চেয়েছিলেন, যারা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কথিত গণবাহিনী বানিয়ে হাজার হাজার
যুবককে হয় হত্যা নয় তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, তারাই আজ নৌকায়
উঠে মন্ত্রী-এমপি মাঝিমাল্লা সেজেছেন।
কথিত এক-এগারোর সময় দেশনেত্রী যার কাঁধে দল ও দেশের গণতন্ত্র রার
দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, সেই মরহুম মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে যারা প্রায় অচল বলতে
কুণ্ঠাবোধ করেন না, তাদের জেনে রাখা ভালো সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তিনিই কিন্তু শেখ
হাসিনার আন্দোলনের ফসল মইন, ফখরুদ্দীনদের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে ছেড়েছেন। পরবর্তী সময়ে দেশের
সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদে দেলোয়ারের থেকেও অচল ব্যক্তিকে বসাতে দেখে জাতি অবাক
হয়নি।
বিএনপির চেয়ারপারসন আন্দোলন-সংগ্রামে প্রতিটি বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ
নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সাথে পরামর্শক্রমেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেন। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর সভায় গভীরভাবে মনোনিবেশের জন্য সেখানে
বিভিন্ন কারণে মোবাইলের ব্যবহার বন্ধ থাকতেই পারে এ নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে লেখার
কিছুই নেই। জাতীয় সংসদ অধিবেশন, মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক বা বিচারালয়ের কার্যক্রম চলার সময় মোবাইল
ব্যবহার করা যদি অনুচিত হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং
সব থেকে বেশিবার রাষ্ট্রমতায় অধিষ্ঠিত এবং বর্তমানে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার
সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সভায় মোবাইলের ব্যবহার কি কারো কাছে
কাম্য হতে পারে? বিষয়টিকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস্য ভেবে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা একেবারেই
নেই। এর বাইরে নিরাপত্তার বিষয়টি যদি প্রাধান্যে এনে মোবাইল ফোনের ব্যাপারে কোনো
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে কি তা অন্যায় হবে?
সত্য-মিথ্যা বা সাদা-কালোর পার্থক্য করার জন্য পণ্ডিত হওয়ার
প্রয়োজন পড়ে না। দেশব্যাপী শত শত নিরস্ত্র প্রতিবাদী মানুষকে নির্বিচারে
প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি ও সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা হত্যা
করলে তাকে গণহত্যা বলা কি অপরাধ? দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা’ সংবিধান তাকে
সরকারের সব অপকর্মের প্রতিবাদ করার মতা দিয়েছে। দেশে বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে
তা তো কথিত মহাজোট সরকারেরই সৃষ্ট মহাজট। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল এবং
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে ১৫তম সংশোধনীর কোনো প্রয়োজন দেশে ছিল না।
হেফাজতের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রাতের আঁধারে পৈশাচিকভাবে যে হত্যাকাণ্ড চালানো হলো, এর দায় কার? এর দায় প্রথমত
সরকারের এবং দ্বিতীয়ত তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চওয়ালাদের।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা বিএনপি অথবা এর নেত্রী বেগম খালেদা
জিয়া কখনোই করেননি। তিনি বা তার দল আগে যা বলেছেন এখনো তাই বলছেন, একই কথা বলবেন
ভবিষ্যতেও তা হলো, ‘বিচার হতে হবে স্বচ্ছ এবং
আন্তর্জাতিক মানের এটা যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক না হয়’। এখানে একটি প্রশ্ন করা যায়
কি না দেশের মানুষ জানতে চায়। সরকার বলছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে’ অথচ কাগজে-কলমে
হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো অপরাধ কি মানবতার পে হয়
নাকি সব অপরাধই মানবতাবিরোধী? একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বা
বেসামরিক কর্মকর্তারা বিএনপি করলে একশ্রেণীর লেখক, বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টদের গা
জ্বালা করলেও আমলারা ও সামরিক কর্মকর্তারা যখন আওয়ামী লীগ করতে যান তখন এরাই
আহাদে গদগদ হয়ে যান।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হেফাজতে ইসলামের বিুব্ধ কর্মীদের পাশে
দাঁড়ানোর জন্য বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেননি। তিনি যা বলেছেন তা হলো
হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে যারা ঢাকায় এসেছেন তারা
মুসাফির ও ঢাকাবাসীর মেহমান। অতিথিপরায়ণ ঢাকাবাসী ও দলীয় নেতাকর্মীরা যেন এসব
মুসাফির ও মেহমানদের খাদ্য-পানীয় দিয়ে সহায়তার জন্য তাদের পাশে থাকেন।
বিএনপি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী সর্ববৃহৎ দল। এ
দলের মতায় যাওয়া-আসা হয়েছে প্রত্য ভোটের মাধ্যমে। তাই তো রাজপথে প্রধান দাবি, ‘নির্দলীয়-নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ
নির্বাচন’। দেশের সব সামরিক শাসকের পরম বন্ধু হচ্ছে বর্তমান মতাসীনদের বড়
শরিকেরা।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের একটি রাজনৈতিক কার্যালয় রয়েছে, এ ছাড়া
নয়াপল্টনে রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। কোন কার্যালয়ের কী কাজ, কে কোথায় বসবে এ
বিষয়ে দলের সব দায়িত্বশীল নেতাকর্মী অবগত রয়েছেন। অবগত রয়েছেন সরকার ও
সরকারদলীয় লোকজনও। গুলশান কার্যালয় থেকে দলের নীতি নির্ধারিত হয় বিধায় এ
কার্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার ধরন একটু আলাদা হওয়া কি অন্যায়? বিএনপি
চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সততার সাথে যথাযথভাবে কাজ করেন। এতে
বিএনপির যারা মুখোশধারী বন্ধু, তাদের একটু খারাপ লাগতে পারে। এতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ওপর রাগও করতে
পারেন। তাতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের খুব বেশি কিছু যায়-আসে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ
জিয়ার ১৯ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দল বিএনপির প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের প্রোপটে
চিরদিনের, আদর্শ একটাই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। এ দলের প্রত্যেক নেতাকর্মী আদর্শ কর্মসূচির প্রতি অবিচল। বিএনপির
বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে, হয়তো বা আরো চলবে। তাই বলে
গণতন্ত্রের সৈনিকেরা কি চুপটি করে বসে থাকবে!
দেশবিরোধী গোষ্ঠী দেশকে নিয়ে যে সর্বনাশা খেলায় মেতেছে, এর পরিণতি হবে
অত্যন্ত ভয়াবহ। বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। তাদের
সর্বাঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের রক্ত। শহীদদের রক্তে রাজপথ আজ বড়ই পিচ্ছিল। পদ্মা
সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্র“প, শেয়ারবাজার, রেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ভিওআইপিসহ লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি করে সরকার গভীর খাদের তলায়
চলে গেছে, যেখান থেকে তাদের আর উঠে আসার কোনোই সম্ভাবনা নেই। ফ্যাসিবাদী সরকার
নিজেদের দিকে না তাকিয়ে তাদের তল্পিবাহকদের দিয়ে বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের
মনোবল ভেঙে দেয়ার খায়েশ পোষণ করছে; যারা অপপ্রচার চালিয়ে মজা
পাচ্ছেন যে, ‘বিএনপি গভীর সঙ্কটে’ তাদের জেনে রাখা
উচিত, সঙ্কটে বিএনপি নয় বরং মহাসঙ্কটে রয়েছে বর্তমান মতাসীন দল ও সরকার।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন