সাবেক প্রধান বিচারপতি জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থা থাকবে কি থাকবে না, এ ব্যাপারে প্রথমে হ্যাঁ ও পরে না বলে বিভ্রান্তিকর রায় দিয়ে পুরো
জাতিকে একটা অগ্নিগহ্বরে ফেলে দিয়ে গেছেন।
খবরের কাগজ ও বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল খুললে আমরা প্রায়ই দেখতে
পাচ্ছি হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, গাড়ি ভাঙচুর, গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাস, মরিচের গুঁড়ার স্প্রে, লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, পরিশেষে গুলি
এরপর মিছিলকারী ও সাধারণ নাগরিকদের মৃত্যু। পুলিশ আহত ও নিহত হওয়ার খবরও পাওয়া
যায়। সরকারি দলের ক্যাডাররাও বসে নেই। তারাও পুলিশের পাশাপাশি তাদের শক্তি
প্রদর্শন করে চলেছে।
বিতর্কিত ও বিভ্রান্তিমূলক রায় দিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি পরিবারপরিজন
নিয়ে সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন আর বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ ও
বিরোধী দলের কর্মীরা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আজ থেকে ৫০ বছর আগে শোনা একটা গল্পের কথা
মনে পড়ে যায়। কাউকে হেয় করার জন্য বা খাটো করার জন্য এই গল্পটা বলছি না। কেন
যেন মনে হয় গল্পটার আমাদের দেশের বর্তমান চলমান অবস্থার সাথে অনেক মিল রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সবার কাছে শর্তহীন ক্ষমা চেয়ে গল্পটা একটু পরিমার্জিতভাবে বর্ণনা করার
চেষ্টা করছি।
একজন ছা-পোষা ধরনের সাদাসিধে লোক যে সাত-পাঁচ ঘোর প্যাঁচ কিছুই বোঝে
না। তার সাথে ভাব এমন একজনের সাথে যার কাজ হলো সহজ ব্যাপারটাকে কঠিন করে ফেলা।
সমাজে গণ্ডগোল বাধাতে তার দ্বিতীয় নেই। সোজা বাংলায় শয়তানিতে তার জুড়ি নেই।
বোকা লোকটা তার কাছে কূটবুদ্ধির চাল দেখতে চায়। সে রাজি হয় এবং কথামতো একদিন
তাকে নিয়ে গ্রামের হাটে যায়। হাটের এক মুদি দোকানে গিয়ে চতুর লোকটা সামান্য এক
চিমটি গুড় দোকানের একটা বাঁশের খুঁটিতে লাগিয়ে দিলো। ব্যাস শুরু হয়ে গেল কারবার।
গুড় খেতে এলো পিঁপড়া। পিঁপড়া খেতে এলো টিকটিকি। টিকটিকি খেতে এলো
দোকানদারের পোষা বিড়াল। স্থানীয় থানার দারোগা বাবুর কুকুর নিয়ে একজন সিপাই ওই
দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিড়াল কুকুর দেখে ফোঁস করে উঠল। কুকুরও বিড়ালকে
তেড়ে উঠে তর্জন গর্জন শুরু করল। একপর্যায়ে কুকুর লাফ দিয়ে দোকানের ভেতর
বিড়ালকে আক্রমণ করে বসল। শুরু হয়ে গেল বিড়াল-কুকুরের মারামারি। ফলে দোকানের চাল, ডাল, লবণ, মরিচ, তেল, গুড় প্রভৃতি লণ্ডভণ্ড
হয়ে গেল। দোকানদার তার মাথা ঠিক রাখতে না পেরে একটা লাঠি দিয়ে কুকুরটাকে পেটাতে
শুরু করল। কুকুর লাঠির আঘাতে আহত হলে সিপাই দৌড়ে গিয়ে থানায় খবর দেয়। ফলে
দারোগা বাবু একদল পুলিশ নিয়ে হাট আক্রমণ করে। শুরু হয়ে যায় দোকানদার, খরিদদার ও
পুলিশের মারামারি। ফলে শুরু হলো ধরপাকড়, মামলা-মোকদ্দমা। পুরো হাট হয়
দোকানিশূন্য। আশপাশের গ্রামের পুরুষেরা চলে যায় আত্মগোপনে, কারণ পুলিশ যাকে
পায় তাকেই গ্রেফতার করে।
ওই ঘটনার পর ঘটনার নায়ক আস্তে করে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে
যায়। বোকা লোকটি অসহায়ের মতো তার গমনপথে চেয়ে থাকে।
দেশ যখন মোটামুটি শান্তির পথে এগোচ্ছিল, রাজনৈতিক বাতাস
যখন ভালোর দিকে। রাজনীতিবিদেরা যখন আবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের পথে চলা
শুরু করেছিল, ঠিক তখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরো দুইবার থাকতে পারার রায়
বাতিল করে দিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সারা দেশ ও জাতিকে আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে
ফেলে দিয়ে গেলেন। আমরা না থাকলাম বাঙালি আর না থাকলাম বাংলাদেশী। আমরা যেন হয়ে
গেলাম একে অপরের শত্রু। কিন্তু কেন? এই রায়ে কার কতটুকু লাভ হলো? কেউ তার অঙ্ক
মেলাতে পারছে না।
এক দল বলছে, দেশে আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আসতে দেয়া হবে না।
কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তা বাতিল হয়ে গেছে। আর অন্য দল ও আমজনতার দাবি সুষ্ঠু
ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবশ্যই হতে হবে, অন্যথায় বিরোধী
দল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিশ্বের সব গণতন্ত্রচর্চাকারী দেশও
একদলীয় ও একতরফা নির্বাচন মেনে নেবে না বলে আকার ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও জ্ঞানীজন মনে করেন নির্দলীয় ও
তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুবই জরুরি। বিকল্পধারার সভাপতি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি
অধ্যাপক বি চৌধুরী বলেছেন : ‘তত্ত্বাবধায়ক দিন, সমস্যর সমাধান হয়ে যাবে, না হলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো।’
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, সর্বজনশ্রদ্ধেয় আইনবিদ
ব্যারিস্টার রফিকুল হক আগাগোড়াই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে আসছেন।
সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন : ‘দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশের আরো বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব যারা দেশের জন্য ভাবেন
তাদের কোনো কথাই সরকারি দল গ্রাহ্য করছে না বরং তাচ্ছিল্যের সাথে প্রধানমন্ত্রী
বলেছেন : ‘অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের পর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতে একশ্রেণীর
মানুষ অপেক্ষায় থাকে।’ কী দুর্ভাগ্য দেশের জনগণের! দেশটা
যেন একটা দলের, একটা গোত্রের, একটা পরিবারের বা একজন ব্যক্তির।
একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করার জন্য এই সরকারি দলই
আন্দোলন করেছিল। তারাও রাজপথ দখল করে জ্বালাও পোড়াও, জানমালের
ক্ষয়ক্ষতি কম করেনি। এখন সব ভুলে গেছে। তারাই এখন বলছেÑ ‘কোনো সভ্য দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই’। আওয়ামী লীগে যখন নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির জন্য আন্দোলন করেছিল তখন বাংলাদেশ কী ছিল? সভ্য না অসভ্য?
প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, জনগণ ক্ষমতার উৎস। সম্প্রতি
একটি দৈনিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির ওপর জরিপ চালানো হয়। সেই জরিপে
৯০ ভাগ লোক এর পক্ষে মত প্রকাশ করে। এই রায়কে প্রধানমন্ত্রী তাচ্ছিল্যের সাথের
প্রত্যাখ্যান করেন। এই রায় যদি তার পক্ষে হতো তবেও কি তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন? না করতেন না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের
এত ভয় কেন? নির্বাচন যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, ফলাফল নির্ভর করে রাজনৈতিক
দলগুলোর অতীত কর্মকাণ্ডের ওপর। একটা কথা আছে, ‘সাচ্চা গুড় আঁধারেও মিঠা’।
সংবিধান তো আর কুরআনও নয় বাইবেলও নয়। সংবিধান মানুষের তৈরি দেশের
জনগণের জন্য। দেশের ও সময়ের প্রয়োজনে এর পরিমার্জন, পরিবর্তন বা
সংশোধন করলে দেশে আল্লাহর গজব নেমে আসবে না।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন কেন? কেউ ভাবেন, এই পদ্ধতিতে
নির্বাচন হবে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য। আবার কেউ ভেবে থাকতে পারেন, এই ব্যবস্থায়
নির্ঘাত হেরে যেতে হবে। আবার কেউ ভেবে থাকেন, এই ব্যবস্থায় বিজয়
সুনিশ্চিত। দেশের সাধারণ মানুষ কী চায়? সে কথা আমাদের মাথায় কেন নেই?
নির্বাচনে হারজিত আছেই। সবাই জিতবে, তা হবে কেমন করে? কেউ হারবে আর কেউ
জিতবে। হারজিত রাজনীতিবিদদের হাতে না। হারজিত জনগণের হাতে। যদি তা মানতে না চান
তবে নির্বাচনের প্রয়োজন কী? কিছু ষণ্ডা-পাণ্ডা দিয়ে ব্যালট বাক্স বোঝাই করলেই তো লেঠা চুকে যায়।
সরকারি দলের মতে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে অনির্বাচিত সরকার। অনির্বাচিত
ব্যক্তি দিয়ে গঠিত হয়েছে নির্বাচন কমিশন আর তারাই তো পরিচালনা করবে জাতীয়
নির্বাচন। তারাও তো অনির্বাচিত ব্যক্তি। অনির্বাচিত গুটি কয়েক লোক যদি একটি
সুষ্ঠু (?) নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে তাহলে অনির্বাচিত ব্যক্তি সমন্বয়ে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে বাধা কোথায়?
সংসদে অনির্বাচিত সদস্য রয়েছেন, একজন তো স্পিকারই হলে গেলেন।
মন্ত্রিসভায় আছেন অনির্বাচিত মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন উপদেষ্টামণ্ডলী, কই তাতে তো
আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের
স্বার্থে সর্বোপরি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য। যত দিন আমরা
গণতন্ত্রচর্চায় অভ্যস্ত হতে না পারব তত দিন এ ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। এই
মুহূর্তে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশের জন্য কোনো বিকল্প নেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন