শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৩

বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে

জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বনামধন্য একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব। লেফটেন্যান্ট থেকে শুরু করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবির অধিকারী হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান মনে করতেন দেশ জয় বা দেশ রক্ষায় সামরিক প্রশাসন জরুরি। কিন্তু দেশ পরিচালনায় গণতান্ত্রিক বেসামরিক প্রশাসন প্রয়োজন। রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে বেসামরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সামরিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের অবদান যুগান্তকারী।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তন, ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান, ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের পর রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর স্বার্থে সিপাহিরা সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে এনে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসান। জিয়া প্রথমে ডেপুটি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন। পরে ২১ এপ্রিল ১৯৭৬ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এস এম সায়েম জিয়ার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিয়ে নিজে সরে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ২১ এপ্রিল থেকেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে বাংলাদেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর ৭৫-এ দেশে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা, বাকশালবিরোধী সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানে সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক ও বেসামরিক অঙ্গন তছনছ হয়ে যায়। জিয়া সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দূর করে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ, সে বহুদলীয় গণতন্ত্র দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন রাষ্ট্রনেতা জিয়া।
জনগণই ক্ষমতার উৎস। জনগণ ক্ষমতায় বসান। জনগণ ক্ষমতা থেকে নামান। সিপাহি-জনতাই দেশপ্রেমিক জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া পর্যায়ক্রমে জাতিকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে নিবেদিত হন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশবাসী তাকে মানেন কি না, হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে জাতির কাছে প্রশ্ন রাখেন। ৩০ নভেম্বর ১৯৭৭ অনুষ্ঠিত গণভোটে জাতি ৯৮ শতাংশ হ্যাঁ ভোট দিয়ে জিয়ার প্রতি সমর্থন জানায়।
উচ্চপর্যায় থেকে যে রাজনৈতিক সেবাকার্যক্রম শুরু হয় স্থানীয় সরকারই তা গ্রামগঞ্জের জনগণের হাতে পৌঁছে দেয়। হ্যাঁ-না ভোটে বিজয়ী হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্মুখে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আবশ্যক হয়ে পড়ে। প্রয়োজনের তাগিদে জিয়া সরকার ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে চার হাজার ৩৫২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও আগস্ট মাসে ৭৮টি পৌরসভা নির্বাচন সম্পন্ন করেন। এরপর উন্নয়নের রাজনীতি নামে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে দলবল নিয়ে ছুটে যান গ্রামগঞ্জে। শুষ্ক মওসুমে ক্ষেতে পানি সেচের সুবিধার জন্য শুরু করেন খাল খনন কার্যক্রম। উৎসাহ প্রদানে কোথাও কোথাও নিজেও কোদাল ধরেন। গ্রাম থেকে গ্রামে, বাড়ি থেকে বাড়িতে হেঁটে গিয়ে কৃষকসমাজকে জাগিয়ে তোলেন স্বনির্ভরতা অর্জন করতে। একই সাথে কলের লাঙ্গল, সার, কীটনাশকও পৌঁছে দেন গ্রামগঞ্জে। পাশাপাশি জিয়া মিল-কারখানায় ছুটে গিয়ে সমস্যা সমাধান করে দিয়ে মিল-কারখানায় উৎপাদনের চাকা সচল করে দেন। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন নতুন মিল-ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে তুলেন বিপ্লবী জিয়া।
উৎপাদনহীন শুধু রাজনীতি, শুধু নির্বাচন  জিয়ার পছন্দ ছিলোনা । তাই তিনি রাজনীতিকে শহর থেকে নিয়ে আসেন গ্রামগঞ্জে, মাঠে-ঘাটে, কলে-মিলে। দেশব্যাপী উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি করেন রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান। এর ফাঁকে ফাঁকে গণতান্ত্রিক ধাপগুলোকে পূর্ণ করে তুলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি জিয়া তৃণমূল নির্বাচন শেষে হাতে ধরে জাতিকে উৎপাদনে লাগিয়ে দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে পা  বাড়ান ৭৫ থেকে লাগানো রাজনৈতিক জট একে একে খুলে দেন তিনি।
জিয়া সরকার ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি (পিপিআর) জারি করেন। পিপিআর জারির ফলে প্রথমে ২১টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন লাভ করে। পরে আরো নতুন পুরাতন দল ছাড়পত্র পায়। এ সুযোগে  আওয়ামী লীগও পুনর্জন্ম লাভ করে। জিয়ার হাতের ছোঁয়ায় আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম ইতিহাসের একটি মাইলফলক ঘটনা। জিয়ার চিন্তাচেতনায় গঠিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলও  আত্মপ্রকাশ করে। জিয়া সরকার এসব রাজনৈতিক দলকে প্রাথমিকভাবে ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেন। ১৯৭৮ সালের ১ মে থেকে পিপিআর উঠিয়ে দেয়া হয়। এর দরুন দেশব্যাপী ঘরে-বাইরে মাঠে-ময়দানে অবাধ রাজনীতির দুয়ার খুলে যায়। এভাবে বাকশালী আইনে কেড়ে নেয়া বহুদলীয় গণতান্ত্রিক অধিকার রাষ্ট্রপতি জিয়া আবার জাতিকে ফিরিয়ে দেন। এ ধারাবাহিকতায় জিয়া সরকার দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে জাগদলকে কেন্দ্র করে (ন্যাপ ভাসানী)সহ ছয়টি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। জিয়া ছিলেন ফ্রন্ট মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। অপর দিকে জেনারেল ওসমানীর উদ্যোগে জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন লাভ করে। আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে জনতা পার্টিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগসহ ছয়টি পার্টির সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠিত হয়। ঐক্যজোট মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্র্থী হন জেনারেল এম এ জি ওসমানী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট ছাড়াও আরো কয়েকটি দল অংশ নেয়। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় জেনারেল ওসমানী ও লে. জেনারেল জিয়ার মধ্যে। জিয়া ছিলেন আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষক। তদুপরি তিনি ছিলেন এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার, পরে জেড ফোর্সের অধিনায়ক। আর ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের Commander in Chief (C In C),  দুজনই জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে ৩ জুন ১৯৭৮-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতি বিপুলভাবে ভোট দিয়ে জিয়াকেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। জেনারেল ওসমানীও নির্বাচনের এ রায় শ্রদ্ধাভরে মেনে নেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরই আসে সংসদ নির্বাচনের পালা। দেশজুড়ে শুরু হয় সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়।
এবার রাষ্ট্রপতি জিয়া জাগদলের পরিবর্তে নিজস্ব চিন্তাচেতনার রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হন। জিয়া ছিলেন ৭০-এর দশক থেকে মওলানা ভাসানীর ভক্ত। পরিস্থিতির প্রয়োজনে রাজনীতিতে আসার পর থেকে জিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান মওলানা ভাসানী। জিয়াকে সুপরামর্শ দিয়েও মওলানা ভাসানী দেশকে এগিয়ে নিতে চান। ১৯৭৬-এ জিয়া হাসপাতালে অসুস্থ ভাসানীকে দেখতে গেলে মওলানা ভাসানী জিয়াকে রাজনৈতিক দল গঠন করলে, দলের নামের মাঝে Nationalist  শব্দটি রাখলে দলীয় সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। জিয়াউর রহমান ঘনিষ্ঠজনদের সাথে পরামর্শ করে জাগদলের চেয়েও আধুনিক এবং নিজস্ব নেতৃত্বাধীন Bangladesh Nationalist Party (BNP) নামে দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। উচ্চপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ভাসানীর গড়া সংগ্রামী দেশপ্রেমিক মানুষগুলো এসে বিএনপিতে যোগদান করেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী কয়েকজন নেতাকেও জিয়া টেনে আনেন বিএনপিতে। তদুপরি জিয়াউর রহমান সাবেক সেনা অফিসার সাবেক আমলা-কূটনীতিক, ঝানু আইনজ্ঞ, ঝানু অর্থনীতিবিদ, এমনি অন্যান্য অঙ্গন থেকেও দেশপ্রেমিক বিজ্ঞজন বেছে বেছে এনে বিএনপির পতাকা তলে শরিক করেন। জিয়ার প্রচেষ্টায় দেশপ্রেমিক, ইসলামপ্রিয়,  জাতীয়তাবাদী এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার শক্তি হিসেবে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ থেকে আত্মপ্রকাশ করে  বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
রাষ্ট্রপতি জিয়া চূড়ান্তভাবে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ৩১টি দল অংশ নেয়।  এ থেকে ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি লাভ করে ২০৭টি আসন। আওয়ামী লীগ দুই  গ্রুপ মিলে পায় ৩৯+২+৪১টি আসন, মুসলিম লীগ ও আইডিয়েল মিলে পায় ২০টি আসন, জাসদ পায় আটটি  আসন, ন্যাপ (মোজাফফর) পায় একটি আসন, অন্যান্য দল পায় সাতটি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দখল করে ১৬টি আসন। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসন  লাভ করতে পারেনি।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে।  এ সংসদ নির্বাচনের পর ২ এপ্রিল ৭৯ থেকে প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। এ প্রথম সংসদ অধিবেশনে ৬ এপ্রিল ৭৯ তারিখে দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। দীর্ঘ চড়াই উৎরাইয়ের পর দেশে শুরু হয় বেসামরিক শাসনব্যবস্থা।
রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমদের জারি করা মার্শাল ল ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া দেশ থেকে উঠিয়ে দেন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাত ধরে ৬ এপ্রিল ১৯৭৮ থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। তাই বলা হয়, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পূর্ব প্রবর্তক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads