আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে এবং কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ এখন পর্যন্ত দেশের মানুষকে আশার বাণী শোনাতে পারেননি। স্ব-স্ব পক্ষ নিজ নিজ অবস্থানেই অটল রয়েছেন। সরকার পক্ষে আদালতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল ঘোষণার পর তাদের পক্ষে বিরোধী পক্ষের কেয়ারটেকার সরকারের দাবী মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বিরোধী পক্ষের দাবী হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায় সরকারের ফরমায়েসী রায় তাই তারা সে রায় মানতে কোন ভাবেই বাধ্য নন এবং সুশীল সমাজেও আদালতের রায় নিয়ে চরম বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ঘোষিত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে যা বলা হয়েছিল তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে সম্পূূর্ণ অনুপস্থিত। আবার পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা হয়েছিল প্রধান বিচারপতির অবসরকালীন সময়ে। উল্লেখ্য যে, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একবার রায় লিখে জমা দেয়ার পর তা আবার ফেরৎ নিয়ে সংশোধন করে তা আবার জমা দিয়েছেন। বিষয়টি বিরোধী দল ও অভিজ্ঞ মহল ভালো চোখে দেখেননি। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের রায় দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বরং দেশে অনাকাংখিত বিতর্ক সৃষ্টি করে নতুন রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এমতাবস্থায় বিরোধী দলের পক্ষে সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে সাজানো ও পাতানো নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা কোন ভাবে দূরদর্শিতার পরিচয় হবে না বলেই অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
সৃষ্ট এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল সব সময়ই আওয়ামী লীগের অধীনে যেকোন নির্বাচন বরাবরই অস্বীকার করে আসছে এবং ঘটনার ধারাবাহিকতায় তার যথেষ্ট কারণ ও যৌক্তিকতাও রয়েছে। আদালতের রায়কে উদ্ধৃত করে সরকারের বক্তব্য হলো কোন অনির্বাচিত সরকার নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্মরণ থাকা উচিত তারা একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। অনেক প্রাণহানিসহ ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসও হয়েছিল এবং তারা যে সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে এসব আপ্তবাক্য জাহির করছেন সে সরকারও ছিল অনির্বাচিত। মজার ব্যাপার হলো বিচারপতি কে এম হাসানের দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাকে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল এবং সারাদেশে ব্যাপক নৈরাজ্য চালিয়ে ১/১১ প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল তারা কোন মুখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দিবা স্বপ্ন দেখেন তা দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। আর সরকার যে আদালতের রায় ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলছে তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিযাত্রা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়নি। ১৯৯০ সালের বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরাসরি সংবিধান লংঘন করে। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের লাভজনক পদে বা সরকারি চাকুরিতে বহাল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্টের মত সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। কিন্তু ডকট্রিন অব নেসেসিটি হিসাবে বিচারপতি শাহাবুদ্দীনকে এই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। পরে জাতীয় সংসদে বিষয়টিকে অনুমোদন করে নিতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে যে কেয়ারটেকার সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজন করেছিল দেশের উচ্চ আদালত তো সেটিকেও অসাংবিধানিক বলেছে। সর্বশেষ সেনা সমর্থিত যে জরুরি সরকার দেশে ২ বছর শাসন ক্ষমতা চালিয়েছিল তা তো সরাসরি সংবিধান লংঘন করে। মোদ্দা কথা এ পর্যন্ত যে কয়টি কেয়ারটেকার সরকার এসেছে তার সবকটিই অসাংবিধানিক পন্থায়; ডকট্রিন অব নেসেসিটি হিসাবে এবং সেসব নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সব সরকারই মেয়াদ পূর্ণ করেছে। তাহলে দেশের চলমান সংকট নিরসনে সংবিধানে সংশোধনী আনতে বাধা কোথায় ?
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আওয়ামী সরকার কর্তৃক সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধন ও উচ্চ আদালতের রায়ে দেশে এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয় গণমানুষের কল্যাণে এবং দেশের আদালতগুলোর দায়িত্ব হলো গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণের। তাই সংবিধানে কোন ধারা যখন গণমানুষের জন্য অকল্যাণকর মনে হয় তখনই সংবিধানে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আর সে জন্যই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের সংবিধান ১৫ বার সংশোধন করা হয়েছে। দেশের সংবিধান ও আদালতের রায় মোতাবেক যদি আগামী নির্বাচন হয় তাহলে দেশে সংঘাত অনিবার্য এবং দেশে মারাত্মক গৃহযুদ্ধেরও সম্ভাবনা অভিজ্ঞ মহল উড়িয়ে দিচ্ছেন না। যে সংবিধান ও উচ্চ আদালতের রায় দেশে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে তা দেশের মানুষ মানতে বাধ্য নয়। আদালতকে এ অধিকার কেউ দেয়নি। আর সে সংবিধান দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, সে সংবিধান শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই সংশোধন হওয়া উচিত।
দেশে এই ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সমাধান বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমেই খুঁজছে। কিন্তু সরকারি মহল থেকে একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে। তারা ইতোপূর্বে বলে এসেছে সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। গত কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার প্রধান বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। কয়েক দিন আগে এক টিভি টক-শো আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ রাষ্ট্রপতির অধীনে অন্তর্বর্তী সরকারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কী রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করে ছেড়েছে? ২০০৬ সালে তো রাষ্ট্রপতির অধীনেই কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হয়েছিল। সে সরকার কী আওয়ামী লীগ মেনে নিয়েছিল? তারা তো রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দীনকে ‘ইয়েস উদ্দীন’ এবং ‘ইয়াজিদ্দা’ আখ্যা দিয়ে অপদস্থ করেছিলেন। একজন রাষ্ট্র প্রধানকে এভাবে যারা অপদস্থ করতে পারে তাদের বিবেক-বুদ্ধি কতখানি প্রসন্ন তা বিচারের ভার দেশের মানুষের কাছেই ছেড়ে দেয়া হলো। এখানেই শেষ নয় তারা বঙ্গভবনে অক্সিজেন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ যদি সে সময় রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত না করতো তাহলে বর্তমান সংকট উত্তরণ খুবই সহজ হতো। কিন্তু সে সুযোগটা নষ্ট আওয়ামী লীগই করেছে। তাই বিরোধী দলের পক্ষে তা মেনে নেয়া কোন ভাবেই সম্ভব বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার নাকি নির্বাচনকালীন সময়ে স্পিকারকে সরকার প্রধান করতে চায়। কিন্তু বিরোধী দলের দাবি হলো দল নিরপেক্ষ লোককে সরকার প্রধান করতে হবে। যেহেতু স্পীকার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংরক্ষিত কোটায় নির্বাচিত তাই এর মাধ্যমে বিরোধী দলের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ হয় না। বিরোধী দলীয় নেতারা স্পষ্টতই বলে দিয়েছেন যে আওয়ামী লীগের কোন নেতাকে সরকার প্রধান করে তারা কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তাহলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেল। বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পীকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর মধ্যে পার্থক্য দেখবে বলে মনে হয় না। তাই সরকারের এ ফর্মূলাও বিরোধী দল মেনে নেবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। তবে সংকট সমাধানের একটা মোক্ষম সুযোগ তৈরি হয়েছিল। সরকারের অহমিকার কারণে সে সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করতে পারলে রাষ্ট্রপতির অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারতো। আবার স্পীকার নির্বাচনেও যদি সরকার বিরোধী দলের সাথে আলোচনা করতো এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে সে পদে আনা হতো তাহলে সংবিধানও রক্ষা হতো এবং বিরোধী দলও তা গ্রহণ করতো। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এই মহাসুযোগটা কাজে লাগানো হয়নি। কারণ, আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য সংবিধান বা আদালতের রায় মান্য করা নয় বরং নির্বাচনকালীন সরকারে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন