সমাজতন্ত্রের পতনের পর পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পদ
উৎপাদনের উত্তম ব্যবস্থা বলে আধুনিক যুগের মানুষ মেনে নিয়েছে। কিন্তু আগের চেয়ে
বর্তমানে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ কমেছে। তাই সম্পদ উৎপাদনের পরিবর্তে সুকৌশলে
অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার দিকে অধিক ঝুঁকে পড়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদি
অনৈতিক উপায়ে অর্থোপার্জনের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ের অন্তরালে চলেছে লোভের উন্মাদনা। অস্ত্র-ব্যবসায়, মাদক-ব্যবসায়, জালিয়াতি বা
ফটকাবাজারি ব্যবসায় ইত্যাদি অনৈতিক ব্যবসায় চলেছে রমরমা। এ থেকে বোঝা যায়
নিয়ন্ত্রণহীন লোভ বর্তমানে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
সম্পদের ন্যায্য বণ্টন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পৃথিবীতে সম্পদের অভাব না থাকলেও বেশির
ভাগ মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন
বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ৬ শতাংশ মানুষ ৯০ শতাংশ সম্পদের মালিক, বাকি ৯৪ শতাংশ
মানুষের কাছে রয়েছে ১০ শতাংশ সম্পদ। জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সম্পদগুলো সাধারণ
মানুষের ক্রয়মতার বাইরে। এ কারণে পুুুুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক-বাহক যুক্তরাষ্ট্রে
২০০৮ সালের শেষের দিকে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা বা ধস এবং বর্তমানে তা
ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী, অর্থাৎ যারা
নীতিহীন বা বিবেকহীনভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ ও অধিক ভোগের কারণে এ মন্দা সৃষ্টি
হলো, তারাই আবার জনগণের ট্যাক্স বা করের অর্থ ঢেলে এগুলো সমাধানের চেষ্টা
করছে। এভাবেই কিছু লোভী, সুবিধাবাদী, নীতিহীন সুচতুর মানুষেরা সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে, আর সাধারণ মানুষ
দিন দিন গরিব হতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে
অনেক ুধার্ত ও গৃহহীন মানুষ এবং দিন দিন এর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
সমাজকর্মে নিবেদিত বলে পরিচিত সমাজকর্মীরাও এ নিয়ন্ত্রণহীন লোভ থেকে
মুক্ত নন। বিবেকহীন, নৈতিক মূল্যবোধহীন লোভের কারণেই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের দরিদ্র
ও অবহেলিত জনসাধারণের সমস্যাকে পুঁজি করে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন দাতা
সংস্থার কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে এবং সে অর্থ জনকল্যাণে কাজে না লাগিয়ে তার বেশির
ভাগই আত্মসাৎ করছে। আবার দাতা সংস্থাও এই আত্মসাতের কথা জেনেশুনে বিশেষ স্বার্থে
বা উদ্দেশ্যে এ অর্থ দিচ্ছে। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসে তিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ; আর এ সুযোগে ধনী
হয় অসৎ, লোভী, সুচতুরতায় দ কিছু মানুষ। এসব অসৎ মানুষের কাছে ধনসম্পদ চলে যাওয়ার
কারণে এই ধনসম্পদ ব্যবহৃত হচ্ছে অনৈতিক ও অসামাজিক কাজে। ফলে সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা, সুবিচার, সুশাসন ইত্যাদি
নষ্ট হচ্ছে। বিবেকবান শিল্পোদ্যোক্তা, জনকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ
সমাজকর্মী, সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, মহান নেতা, জ্ঞানী-গুণী
হৃদয়বান ব্যক্তিরা সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবী দিন দিন অসৎ, লোভী, সুচতুর কিছু দ
মানুষের পৃথিবীতে পরিণত হচ্ছে। তাই বেশির ভাগ মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার
থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী চলছে নিয়ন্ত্রণহীন লোভ, যৌনতা, অহঙ্কার, প্রতিহিংসা
ইত্যাদি আবেগ-প্রবৃত্তি চরিতার্থের খেলা। নৈতিক মূল্যবোধ, বিবেক, প্রজ্ঞা, সৃষ্টিশীলতা
ইত্যাদি ‘আত্মিক প্রেরণা’ মানুষের জীবন
থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সমাজের মেধাবী ও দ মানুষদের মূল্যায়ন করে থাকি। অথচ এই দ ও
মেধাবী মানুষেরা সমাজের যত বেশি তি করতে পারে, অদ ও মেধাহীন মানুষেরা তত তি
করতে পারে না। আসলে দতা ও মেধা এমনই একধরনের শক্তি, যা ভালো-মন্দ দুইভাবেই ব্যবহার
করা যায়। নৈতিক মূল্যবোধ বা ঈমানি শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে দতা ও মেধা হয়
এক সৃষ্টিশীল শক্তি, যা মানুষের বা সমাজের কল্যাণ করে। আবার অনিয়ন্ত্রিত আবেগ-প্রবৃত্তির
শক্তি দ্বারা চালিত হলে দতা বা মেধা হয় একটি অশুভ শক্তি, যা সমাজের
অকল্যাণ করে। ঈমান তথা বিবেক, নৈতিক মূল্যবোধ, নিঃশর্ত প্রেম ইত্যাদি আত্মিক গুণাবলিকে যে সমাজের মানুষ মূল্যায়ন
করে না, সে সমাজের বেশির ভাগ মানুষ সামান্য কিছু সুচতুর, দ ও মেধাবী
মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে যায়। যে সমাজে গুণের কদর থাকে না, সে সমাজে গুণী
জন্মাতে পারে না। গুণীজনের নিয়ন্ত্রণের অভাবে তখন ওই সব মেধাবী ও দ মানুষেরা
নিজেদের স্বার্থ তথা নিজেদের লোভের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করে থাকে। মুখে তারা ভালো
কথা বলে; কিন্তু কাজকর্মে সুচতুরতা ও মেধা দিয়ে অত্যন্ত দতার সাথে সুকৌশলে
অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে থাকে। নিয়ম-নীতির ও নৈতিকতার কথা বলে গোপনে অনিয়মের ও
অনৈতিকতার কাজ করতে থাকে। তাদের চিহ্নিত করা বা আইন দিয়ে ধরা বা শাস্তি দেয়া
কঠিন। কারণ, যারা আইন ভেঙে অপরাধ করে তাদের চিহ্নিত করা সহজ, কিন্তু যারা
আইনের মধ্যে থেকে অপরাধ করে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। যারা চুরি-ডাকাতির মাধ্যমে
অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে তাদের চিহ্নিত করা সহজ; কিন্তু যারা জনসেবা, গবেষণা, ব্যবসায় ইত্যাদি
ভালো কাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ করে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। একজন ধর্ষণকারীকে
চিহ্নিত করা সহজ, কিন্তু যে প্রেম বা বন্ধুত্বের মাধ্যমে মিষ্টি কথা বলে, উপহার দিয়ে
ব্যভিচার করে, তাকে চিহ্নিত করা কঠিন। অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় এদের White Colour Criminal বলে। আত্মিক শক্তি বা ঈমানি গুণের অভাবে পৃথিবী এখন এজাতীয় অপরাধী
দ্বারা ভরে গেছে।
লোভই সম্পদ সৃষ্টি তথা অর্থনীতি বিকাশের প্রেরণা বা শক্তি বা
অন্তর্চেতনা। বর্তমান সমাজে বেশির ভাগ ধর্মীয় নেতা বা নীতিবাদীরা লোভ দমন করতে
শিা দেন। এ কারণে তারা সম্পদ সৃষ্টির প্রেরণা হারিয়ে অর্থ-সম্পদ সৃষ্টিতে তেমন
কোনো অবদান রাখতে পারেননি। জীবনধারণের জন্য অনেক েেত্র তাদের পরনির্ভরশীল হতে
হয়েছে। নীতিবাদীদের মতো সমাজতন্ত্রও সম্পদের সুষম বণ্টন করতে গিয়ে
ব্যক্তিমালিকানার সুযোগ দেয়নি। এ সুযোগ না দিয়ে তারা লোভকে দমন করেছে, তাই তারা সম্পদ
সৃষ্টিতে তেমন অবদান রাখতে পারেনি। পুঁজিবাদ লোভের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল
সম্পদ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু লোভকে ঈমানি শক্তি বা নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা
নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন হয়নি। স্বল্প কিছু মানুষের
কাছে রাষ্ট্রের বেশির ভাগ সম্পদ কুগিত হয়েছে। জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের অর্থ-সম্পদও
সাধারণ মানুষ পায়নি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নেমেছে মন্দা বা ধস। লোভ হচ্ছে
আগুনের মতো একটা শক্তি, যে আগুনের সৃষ্টিশীল প্রয়োগের ফলে সম্পদ তথা সভ্যতা সৃষ্টি হয়, আবার
নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহারের ফলে অর্থনীতি তথা সভ্যতা ধ্বংস হয়। সুতরাং, অর্থনীতি তথা
সভ্যতার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন লোভের সুনিয়ন্ত্রণ তথা সৃষ্টিশীল প্রয়োগ।
কিন্তু লোভের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে লোভকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বিবেক, বুদ্ধি ও নৈতিক
মূল্যবোধ তথা আত্মিক প্রেরণার স্তরে অবস্থান করেই লোভকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্ব¡পূর্ণ যে কাজটি প্রথমেই
প্রয়োজন, তা হলো কাক্সিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা। যে মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য
শুধু জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দতাই যথেষ্ট নয়, এর সাথে আত্মবিশ্বাস, উদ্যম, ঝুঁকি নেয়ার
মানসিকতা, ধৈর্য, বিশ্বস্ততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি ঈমানি গুণাবলি উন্নয়নেরও প্রয়োজন। নবেল
পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্বে, উন্নয়নের মূল
শক্তি হিসেবে তার ভাষায়Ñ ‘গণতান্ত্রিক মানুষ’ তথা এমনই
মানবসম্পদের কথা বলেছেন। মনের মধ্যে ঈমানি শক্তির জাগরণ এবং বাস্তব জীবনে নৈতিক
মূল্যবোধ বিকাশের মাধ্যমে আমরা এই কাক্সিত মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারি।
কিন্তু বড় সমস্যা হলো, বাংলাদেশে নৈতিক
মূল্যবোধসম্পন্ন গুণী কর্মী বা মানবসম্পদকে মূল্যায়ন করা হয় না। তাই এ দেশে গুণী
কর্মী জš§াতে বা আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। মতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘুষ বা দুর্নীতির কারণে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন গুণী
কর্মীরা কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বা চাকরি পায় না; নিয়োগ পায় অযোগ্য নীতিহীন
কর্মীরাÑ যারা ঘুষ দিতে পারে, দুর্নীতি করতে
পারে এবং রাজনৈতিক দলের ক্যাডার হয়ে কাজ করতে পারে। এজাতীয় কর্মীদের দিয়ে
বর্তমানে বাংলাদেশের, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভরে গেছে। তাই দেশটা ঘুষ ও অন্যান্য
দুর্নীতিতে ভরে গেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তারা বেতন পায়, অথচ জনগণকে সেবা
করে না। সেবা করে বা ঘুষের ভাগ দেয় ওপরওয়ালাদের। আর ওপরওয়ালারা সেবা করে বা
ঘুষের ভাগ দেয় মতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের। দিন বদলের অঙ্গীকার করে বর্তমান সরকার
মতায় এলেও দিন বদল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হয়নি; দিন বদল হয়েছে এ
দলের নেতাদের, তাদের সহযোগী সরকারি কর্মকর্তাদের এবং সহযোগী বড় বড় ব্যবসায়ীদের।
আমরা জানি, কর্মকর্তাদের চাকরিতে নিয়োগ দেন মতাসীন রাজনৈতিক নেতারা তথা
মন্ত্রীরা। আর মতাসীন নেতাদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করে জনগণ। এ অবস্থার
পরিবর্তন করতে হলে আমাদের বিবেকবান, নীতিবান বা ঈমানদার নেতাকে
সমর্থন করতে হবে বা ভোট দিতে হবে। দুর্নীতিবাজ নেতার চটকদারি কথা, মিথ্যা আশ্বাস বা
পাহাড়সমান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভুললে চলবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন