বিষাক্ত ছোবলে ক্ষতবিক্ষত আজ বাংলাদেশ। মানবতা, মনুষ্যত্ব, মানবাধিকার এখানে এখন কিতাবী ভাষা, বাস্তবে যার কোন মূল্য নেই। জীবন এখন মূল্যহীন এক বস্তু। সর্বত্র বিভীষিকা, আতংক, ভয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক গণহত্যা চলছে। সে গণহত্যার যাত্রা শুরু হয়েছে বি. ডি. আর. হত্যাকা-ের মাধ্যমে এরপর তাজরীন গার্মেন্টসে হত্যাকা-, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর গণহত্যা, সাভারের গণহত্যা এবং ৬ মে দেশবাসী অনুভব করলো মতিঝিলের গণহত্যা।
হেফাজতে ইসলামের অবরোধ ও অবস্থানকে প্রতিহত করার জন্য সরকার গণহত্যার এই নারকীয় পথ বেছে নেয়। সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপনসহ ১৩টি দাবিতে হেফাজতে ইসলাম ৫ মে ঢাকা অবরোধের ডাক দেয়। বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের সর্বাত্মক অবরোধ আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। অবরোধে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ঢাকা। ঢাকার প্রতিটি প্রবেশদ্বারে লাখ লাখ মানুষ শামিল হয়েছিল সেদিন। সরকার যখন বললো হেফাজতের কোন দাবি মানা হবে না, সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা ছাড়তে হবে। অন্যদিকে বেলা ৩টায় শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতিও দিল সরকার। দুপুর থেকেই বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে পুলিশ, র্যাব ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের অব্যাহত হামলা চলছিল যার কারণে হেফাজতের আমীর সমাবেশে আসতে পারেননি। সমাবেশে হামলা এবং সরকারের পক্ষ থেকে সকল দাবি প্রত্যাখ্যান করায় ও তাদের আমীর আল্লামা শফিকে সমাবেশে আসতে না দেয়ায় হেফাজতের পক্ষ থেকে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ অবস্থান কর্মসূচিতেই চলে ইতিহাসের ভয়াবহ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাযজ্ঞ ছড়িয়ে পরে কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং বাগেরহাট পর্যন্ত। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী তিন হাজার আলেম ওলামা এবং সাধারণ মানুষ সেদিন মতিঝিলে শহীদ হয়েছেন। অভিযোগ লাশ সরকার রাতের আঁধারে ময়লার ট্রাকে করে নিয়ে গুম করে ফেলেছে। বিরোধী মত দলন এবং বিরোধী মানুষকে হত্যা আওয়ামী লীগের চিরন্তন অভ্যেস। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়ের শাসনকালে তাদের গড়া রক্ষী বাহিনী ও লাল বাহিনীর হাতে চল্লিশ হাজার বিরোধী নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে। আজো সরকার সে পথেই হাঁটছে। একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের অবরোধকে সরকার যে ঘৃণ্য এবং পৈশাচিক কায়দায় দমন করলো, যেভাবে গণহত্যা চালালো তাতে শুধু দেশে নয় আজ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ গণহত্যার জনপদ হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। হেফাজতের শান্তিপূর্ণ অবস্থান এবং অবরোধের সংবাদ আজ সকল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে বিকৃতভাবে। দুটি টিভি চ্যানেলে হামলা চালিয়ে তা বন্ধ করে দেয়ার পর আর কার বুকের পাটা আছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করে? এখন সরকারের বাঁধা ছকেই সংবাদ প্রচার করছে। এরপরও আমাদের দেখা চোখে, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এবং দু’একটি সংবাদ বাধ্যমে যতটুকু সংবাদ পৌঁছেছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাত্মক অবরোধ : ফজরের নামাজের পর পরই ঢাকার সবক’টি প্রবেশদ্বার লাখ লাখ ঈমানদার তৌহিদী জনতার পদভার আর শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার কাঁচপুর এবং ডেমরা চৌরাস্তায় সকাল ৬টার মধ্যে কয়েক লাখ নবীপ্রেমিক মানুষ সমবেত হয়। কাঁচপুর থেকে শুরু করে কাঁচপুর ব্রীজ, শিমরাইল, চিটাগাং রোড, সানারপাড়, সাইনবোর্ড হয়ে এ জন¯্রােত পৌঁছে যায় শনির আখড়া পর্যন্ত। ডেমরা চৌরাস্তার অবরোধ মূলত শুরু হয়েছে তারাবো বিশ্ব রোড থেকে, তা’ ডেমরা ব্রীজ হয়ে ডেমরা চৌরাস্তা, স্টাফ কোয়ার্টার, বামৈল পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে বুড়িগঙ্গা ব্রীজ হয়ে অবরোধ চলে যায় ধলেশ্বরী ব্রীজ পর্যন্ত।
টঙ্গী থেকে অবরোধের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে মহাখালী পর্যন্ত। গাবতলী থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত। অবরোধে শুধু ঢাকা নয় মূলত সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। ঢাকার সাথে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অভিজ্ঞজনেরা সকলেই বলছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সর্বাত্মক অবরোধ আর কখনো হয়নি। এরপরও সরকার কেন এই লাখ লাখ জনতাকে অবজ্ঞা করছে, তাদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা বোধগম্য নয়। সরকারের বোঝা উচিৎ জনতার শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি। যেই জনগণের ওর্প তারা গুলী চালাচ্ছে তাদের দোহাই দিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে। গণহত্যা চালিয়ে জনতার এই ¯্রােতকে রোখা যাবে না।
অবরোধ প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল আওয়ামী লীগ : অবরোধ প্রতিহত করতে প্রস্তুত ছিল আওয়ামী লীগ। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অবরোধের ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তারা অবরোধকারীদের ঢাকায় প্রবেশ করতে দিবে না। অবরোধকারীদের প্রতিহত করার জন্য তাদের দলীয় ক্যাডাররা অস্ত্রশস্ত্রের মজুদও গড়ে তুলেছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল ঢাকার সবকয়টি প্রবেশদ্বারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বাধা দিবে। কিন্তু জনতার যে বাঁধভাঙ্গা ¯্রােতা, এবং স্মরণকালের সর্বাধিক উপস্থিতিতে যে অবরোধ সংঘটিত হয়েছে তাতে সরকারদলীয় ক্যাডারদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তাদের দলীয় অফিসের সামনে। এখান থেকে যিনি এসেছেন তিনিই আওয়ামী ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছেন। সারাদিন এভাবে গুপ্ত হামলার পর রাতের আঁধারে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সাথে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় দুর্ধর্ষ আওয়ামী ক্যাডাররা।
আওয়ামী লীগ অফিসে টর্চার সেল : অবরোধ চলাকালে আওয়ামী লীগের অফিসটি পরিণত হয় একটি টর্চার সেলে। যারা একাকী বা তিন চারজন করে গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়ার দিক থেকে হেফাজতের সমাবেশে এসেছেন তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ অফিসে। সেখানে নেয়ার পর বেশ কয়েকজনকে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে এমন অভিযোগ করেছেন অনেকেই। যারা আহত অবস্থায় ফেরত আসতে পেরেছেন তাদের ঘড়ি, মোবাইল, টাকা পয়সা সবই রেখে দিয়েছে আওয়ামী লুটেরা বাহিনী। এখানে নির্যাতন থেকে বেঁচে আসা বেশ কয়েকজন বলেছেন, যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের হাত, পা, মাথা চোখ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অনেককে চরম নির্যাতন করার পর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। আহত লোকগুলোর কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে আবার কাউকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।
বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে হামলা : বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে দিনভর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে। গুলী, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেডের হামলা চলে দিনভর। হামলার জন্য পুলিশ এবং আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী বায়তুল মোকাররম মসজিদকে বেছে নেয়। তারা মসজিদের ভিতর থেকে কিছুক্ষণ পর পর গুলী করেছে এবং টিয়ারশেল চার্জ করেছে। তাদের হামলায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট থেকে দৈনিক বাংলার মোড় পর্যন্ত এক বিভীষিকাময় পরিবেশ বিরাজ করে সারা দিন। দুপুর ১২টা থেকেই সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীর এ হামলা চলে। তাদের হামলায় ৫ মে রাত আটটার মধ্যে ৬ জন হেফাজত কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। কেন কি জন্য হামলা তার কোন জবাব সরকার দেয়নি।
ফুটপাতে আগুন লুটপাট-নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ : হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার পাশাপাশি আওয়ামী ক্যাডাররা ফুটপাতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখে। ‘দেবাশীস’ নামে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম এলাকায় বিভিন্ন দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। বিভিন্ন মিডিয়ায় দেবাশীসের কুরআন শরীফে আগুন দেয়ার ছবি প্রচার করেছে। অনুরূপভাবে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ব্যাংকের বুথে ভাংচুর, লুটপাট করে হেফাজতের নামে কলঙ্ক লেপনের অপচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের টার্গেট্ ছিল স্বর্ণের দোকান লুটপাট করা এ জন্য স্বর্ণের দোকানগুলোর সামনে তারা বেশ কয়েকবার আগুন দেয়। কিন্তু মিডিয়ার ক্যামেরা থাকার কারণে তারা তাদের জঘন্য মনোবৃত্তির শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যদিও সরকারের চাপে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো প্রচার করছে হেফাজতের কর্মীরা আগুন দিয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে এবং বিভিন্ন ফেইসবুক ও ব্লগে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতাদের গুলীরত ছবি, আগুন দেয়ার ছবি, লুটপাটের ছবি প্রকাশিত হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। যারা প্রচার করছে হেফাজতের কর্মীরা আগুন দিয়েছে ও লুটপাট করেছে তারা এর কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
আরো একটি বিষয় হচ্ছে হেফাজতের কর্মীদের সাথে সংঘর্ষ হয়েছে উত্তর গেটে। পুলিশ, র্যাব এবং আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী উত্তর গেটে গুলী করেছে, টিয়ারশেল চার্জ করেছে, গ্রেনেড মেরেছে। এ হামলা থেকে আত্মরক্ষার জন্য হেফাজতের নেতা-কর্মীরা সামান্য ইটের টুকরা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাদের হামলার মুখে হেফাজতের কোন নেতা-কর্মীর দক্ষিণ গেটে অথবা পশ্চিম গেটে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যাও দু’চারজন দক্ষিণ দিক থেকে সমাবেশে আসার চেষ্টা করেছে তারা আওয়ামী ক্যাডারদের হামলায় আহত হয়েছে। আওয়ামী ক্যাডারদের গুলীরত ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আগুন লাগানো এবং কুরআন পোড়ানোর সব ঘটনাই ঘটেছে দক্ষিণ গেটে এবং পশ্চিম গেটে। যার প্রতিটি ঘটনা ঘটিয়েছে আওয়ামী ক্যাডাররা। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর সবগুলো টিভি চ্যানেল একযোগে প্রচার চালাচ্ছে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা লুটপাট করেছে। দেশবাসী ভালোভাবে জানে যে, কারা অগ্নিসংযোগ, হামলা, লুটপাট এবং কুরআন শরীফে আগুন দেয়ার ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এই সরকারের আমলেও দেশের বহু জায়গায় হামলা, লুটপাট, আগুন দেয়া এবং কুরআন-হাদীসে আগুন দেয়ার মত জঘন্য কাজ করেছে। এটা তাদের চিরন্তন অভ্যেস। যারা নিয়মিত কুরআন পড়েন, কুরআনের প্রশিক্ষণ দেন, কুরআন অনুযায়ী নিজেরা জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করেন, অপরকে কুরআনের পথে আহ্বান করেন তারা কুরআনে অগ্নিসংযোগ করেছে এটা সম্ভবত পাগলেও বিশ্বাস করবে না। ইসলামের চির দুশমন ইবলিশ শয়তান ও সম্ভবত তাদের এ অপপ্রচার দেখে লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের রণপ্রস্তুতি : ক্ষমতা হারানোর ভয় এবং গণঅভ্যূত্থানের আতংকে দিশেহারা আওয়ামী লীগ নেতারা সারাদিন তাদের দলের পেশাদার সন্ত্রাসী, খুনী, মাস্তান ও ক্যাডারদের মতিঝিলের চারদিকে জড়ো করে। তাদের জন্য সরবরাহ করা হয় ভারী অস্ত্র। যারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে না তাদের দেয়া হয়, বোমা, পিস্তল, রামদা। তারা সারাদিন পরিকল্পনা করে কিভাবে হামলা করা যায় মতিঝিলের মূল সমাবেশে এবং এরপর রাতে ভয়াবহ হামলায় অংশগ্রহণ করে।
আওয়ামী নেতাদের হুঁশিয়ারি : আওয়ামী লীগের নেতারা অবরোধ শুরুর আগেই যেমন একদিকে রণহুংকার ছাড়েন হেফাজতের কর্মীদের ঢাকায় প্রবেশ করতে দিবেন না। অপরদিকে তাদের প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন। সবশেষে যখন হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে অবস্থান নিলেন তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা দিলেন সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকা না ছাড়লে ব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা যে এত ভয়ংকর, এত নারকীয়, এত পৈশাচিক হবে তা কেউ ভাবতেই পারেনি।
রাত বাড়ার সাথে সাথে শুরু গণহত্যার ভয়ংকর প্রস্তুতি : হেফাজতের নেতা-কর্মীরা যখন তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মতিঝিলে অবস্থান নিলেন তখন গণহত্যার নায়ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বললেন আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। তার এই প্রস্তুতি যে এত পৈশাচিক এবং নারকীয় তা বোঝা গেল মতিঝিলে হামলার পর। রাত বাড়ার সাথে সাথে প্রস্তুতি নেয়া হয় ভয়ংকর হামলার। ঢাকা শহরে অবস্থানরত আইন-শৃংখলা বাহিনীর সব সদস্যকে এনে জড়ো করা হয় মতিঝিলের চার পাশে। তাদের সজ্জিত করা হয় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে।
অপারেশন মিডনাইট : রাত দুইটা থেকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করা হয় মতিঝিলে। হামলার পূর্বে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় যৌথ বাহিনীর সাথে যোগ দেয় সাাড়ে তিন হাজার সরকারদলীয় ক্যাডার। সর্বমোট ১৫ হাজারের অধিক ফোর্স এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। যৌথ বাহিনীর অভিযানের এক ঘণ্টা অর্থাৎ রাত সাড়ে তিনটায় নিরস্ত্র হেফাজতের নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বর থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। যৌথ বাহিনীর সদস্যদের গুলী, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট থেকে বাঁচতে শাপলা চত্বরে অবস্থানরত হাজার হাজার হেফাজতের নেতা-কর্মী অলি-গলিতে ঢুকে পড়েন। রাত আড়াইটার দিকে যৌথ বাহিনী দৈনিক বাংলা, আরামবাগ ও দৈনিক ইত্তেফাক মোড় দিয়ে অভিযান শুরু করে। যৌথ বাহিনীর সদস্যদের অভিযানের পর হেফাজতের নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বরের আশপাশে বিভিন্ন ব্যাংক ও অফিসের ভেতরে লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। শাপলা চত্বর যৌথ বাহিনী দখলে নেয়ার পর সেখানে বিজিবির সদস্যরা সশস্ত্র পাহারা দেয়। অন্যদিকে পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা বিভিন্ন অলি-গলিতে অভিযান শুরু করে। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি এবং আওয়ামী ক্যাডার সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর হামলা, গুলী, রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে হেফাজতের তিন হাজার নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। গুলী আর গুলী, টিয়ারশেলের ঝাঁঝালো গন্ধ, রাবার বুলেট সব মিলিয়ে একটি বড় ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হয় মতিঝিলে, যেখানে একপক্ষ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অপর পক্ষ নিরস্ত্র-নিরুপায়। আহত এবং নিহত হওয়া ব্যতীত তাদের আর কিছু করার নেই। আহতদের শরীরের উপর দিয়ে চালানো হয়েছে ভারী যানবাহন এতেও নিহত হয়েছেন অসংখ্য বণিআদম। শাপলা চত্বর ও এর আশপাশে তখন টিয়ারশেলের ঝাঁঝে কেউ টিকতে পারেননি। এছাড়া সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দেও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। শাপলা চত্বরের আশপাশের বিভিন্ন ভবনে যেসব নেতা-কর্মী অবস্থান করেছেন তাদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছেন। যাদের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ারও ব্যবস্থা ছিল না। রাত সোয়া তিনটা পর্যন্ত এ এলাকার বিভিন্ন গলিতে লুকিয়ে থাকা হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে হামলা চালায় তথাকথিত যৌথবাহিনী যার অংশীদার আওয়ামী ক্যাডাররাও। গুলী, টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা। অভিযান শুরুর পরই মুহুর্মুহু গুলী, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডের আতঙ্কে হুড়োহুড়ি শুরু হলে নেতা-কর্মীরা শাপলা চত্বরের আশপাশে, মঞ্চের চারদিকে অবস্থান নেন। পুলিশের মতিঝিল জোনের এডিসি মেহেদী হাসান এ সময় হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন হেফাজত কর্মীদের সরে যাওয়ার জন্য। তারা কিছুটা পিছু হটলে কয়েকটি সাঁজোয়া যান নিয়ে পুলিশ শাপলা চত্বরের কাছে চলে যায়। তাদের পেছনে ছিল র্যাব ও বিজিবি। এ সময় আশপাশের উঁচু ভবনের উপর থেকে সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ করা হয়। গোটা এলাকা প্রকম্পিত ও আলোকিত হয়ে পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর তাদের মনোবলে আঘাত হানে হামলাকারীরা। এ সুযোগে যৌথবাহিনী ঢুকে পড়ে মূল সমাবেশস্থলে। তারা গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগুতে থাকে। এ সময় অসংখ্য নেতা-কর্মী গুলীবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকে। তাদের রক্তে রঞ্চিত হয় কালো পিচ ঢালা রাজপথ। অসংখ্য গুলীবিদ্ধ নেতা-কর্মীকে যৌথবাহিনী সিটি কর্পোরেশনের গার্ভেজ ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের আনা হয় এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করার জন্য। তারা হেফাজতের সমাবেশ ঘিরে গুলী চালায় পাইকারী হারে। রাত তিনটা ১০ মিনিটের দিকেই স্থল হামলা চালানো হয়। এ সময়ই অনেকে মারা যান বলে জানা গেছে। হেফাজত কর্মীদের দাঁড়ানোর সুযোগই দেয়া হয়নি তখন থেকে। নির্বিচারে গুলী চালায় যুবলীগ-ছাত্রলীগসহ সরকারের পেটুয়া বাহিনী। অনেককেই কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে মতিঝিলে। ৬ মে সূর্য ওঠার আগেই সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সব লাশ সরিয়ে নেয় গোপনে।
গণহত্যার পূর্ব মুহূর্তে মিডিয়া কর্মীদের সরিয়ে দেয়া হয় : গণহত্যার কোন ছবি এবং কোন সংবাদ যাতে কেউ প্রচার করতে না পারে এ জন্য হামলার পূর্বে সরিয়ে দেয়া হয় মিডিয়া কর্মীদের। সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয় দিগন্ত টেলিভিশন এবং ইসলামিক টিভির কার্যালয়ে। বন্ধ করে দেয়া হয় তাদের সম্প্রচার। এ কর্মকা- জার্মানীর হিটলার এবং ইটালীর মুসোলিনিকেও হার মানিয়েছে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ তাদের গণবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী এবং খুনি চরিত্র উন্মোচন করেছে।
গণহত্যায় নিহত তিন হাজার : হেফাজতের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয় মতিঝিলে সরকারের পরিচালিত গণহত্যায় তিন হাজার নেতা-কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। তারা বলেন, রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় ৫মে রোববার দিবাগত রাতে ঘুমন্ত, জিকিররত নিরীহ নিরস্ত্র লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামার ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মুসলমান নামধারী সরকার রাতের আঁধারে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, দলীয় সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বিশেষ অভিযানের নামে নৃশংস নির্মম, বর্বর, অমানবিক হত্যাকা- চালিয়েছে। সেখানে কত লোককে শহীদ করেছে সেই পরিসংখ্যান যাতে না পাওয়া যায়, সেজন্য সাথে সাথেই লাশ গুম করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ট্রাক ভর্তি করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই লাশের সংখ্যা আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার পর্যন্ত হতে পারে। সেখান থেকে আলামত দ্রুত সরিয়ে নেয়া বিনা উস্কানিতে পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা শাপলা চত্বরগামী মিছিলের ওপর হামলা ও সরাসরি খুঁজে খুঁজে গুলীবর্ষণ করে অসংখ্য লোককে হত্যা ও আহত করেছে। যা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের মানুষ সরাসরি দেখেছে। তারা সেখানে ব্যাপক ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পরে তা হেফাজতে ইসলামের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালায়। হেফাজত নেতৃবৃন্দ বলেন, যার সামান্যতম ঈমান আছে, পরকালে বিশ্বাস আছে, আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করার ভয় আছে, বিবেক ও মানবিক বোধ আছে, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ আছে, আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করার ভয় আছে, বিবেক ও মানবিক বোধ আছে, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ আছে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে- আলেমদের ওপর এমন নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকা-ের মতো কাজ সে করতে পারে না। আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষকে বিনা কারণে বিনা উস্কানিতে এভাবে ধ্বংস করার অধিকার কারো নেই। ক্ষমতাসীনদের যারা এই কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা অতি উৎসাহী হয়ে এই কাজটি করেছেন, যারা সমর্থন দিয়েছেন, আলেমদের বুককে ঝাঁঝরা করতে যাদের বুক একটুও কাঁপেনি, তাদের জন্য কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করছেই। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমান শাসকের হাতে অরাজনৈতিক ঈমানী আন্দোলনরত সংগঠনের একটি শান্তিপূর্ণ অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচিতে এভাবে পাখির মতো মানুষ হত্যার ঘটনা ইতিহাসে এক নজিরবিহীন কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়েই শুধু থাকবে না, বিনা কারণে এই গণহত্যা বিশ্ব রেকর্ড হিসেবেও ইতিহাসে লাল অক্ষরে লেখা থাকবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার অত্যন্ত ঠা-া মাথায় কয়েক ঘণ্টা ধরে পরিকল্পনা নিয়ে ভারী অস্ত্র নিয়ে রাস্তার আলো নিভিয়ে বর্বরতম এই কাজটি করেছে।
গাছ কাটার অভিযোগ : যেখানে হাজার হাজার আলেমকে শহীদ করে লাশ গুম করা হলো সে সংবাদ সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো আদৌ প্রচার করছে না বরং ভিকটিমদের বিরুদ্ধে কতভাবে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানো যায় এ জন্য তারা নানা কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা সরকারি গাছ কেটেছে। যারা ছিল ঘুমন্ত অবস্থায় এমনি মুহূর্তে গুলী করা হলো হাজার হাজার লাশ পড়লো, প্রায় দশ হাজার লোক আহত হলো। বারুদের গন্ধে যেখানে টেকা যায় না। সেখানে হেফাজতের কর্মীদের গাছ কাটার সময় কোথায়? আওয়ামী ওলামা লীগের লোকজন পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে ইলেক্ট্রিক কার্টার দিয়ে অল্প সময়েই শত শত গাছ কেটে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে হেফাজতের উপর দায়ভার চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। শোনা গেছে কাটা গাছগুলো আওয়ামী নেতারা নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। এতেই বোঝা যায় কারা গাছ কেটেছে। এর চেয়েও বড় কথা আওয়ামী বাম মিডিয়াগুলোর কাছে হাজার হাজার মানুষের জীবনের চেয়ে গাছের মূল্য অনেক বেশি। গাছের জন্য তাদের কত মায়াকান্না। কিন্তু হাজার হাজার আলেমের জন্য তাদের কোন সহানুভূতি নেই। যেন গাছের মানবাধিকার আছে কিন্তু মুসলমানের কোন মানবাধিকার নেই।
কুরআন পোড়ানোর অভিযোগ : যারা কুরআনের সৈনিক। যারা পুরো ত্রিশ পাড়া কুরআন বুকে ধারণ করেন। যারা রমযান মাসে তারাবীর নামাজে দাঁড়িয়ে পুরো কুরআন শরীফ পাঠ করেন। যারা কুরআনের মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন করছেন। যারা কুরআনের মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তারা কুরআন পুড়িয়েছেন এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে ন্ াকুরআন শরীফে আগুন লাগানোর কাজটি করেছে দেবাশীষের নেতৃত্বে একদল আওয়ামী সন্ত্রাসী। যাতে সাধারণ জনগণকে আলেমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা যায়।
হেফাজতের নেতাদের সিদ্ধান্ত ছিল সকালে সমাবেশ শেষ করা : এ ব্যাপারে হেফাজতের নেতৃবৃন্দ বলেন, ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি আমরা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে শুরু করি এবং ঢাকা অবরুদ্ধ হয়। ঢাকার ৬টি প্রবেশদ্বারে আমাদের লাখ লাখ নেতা-কর্মী সাধারণ মানুষকে নিয়ে ঢাকা অবরোধ করে। আমরা সরকারের কাছে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি চাই। সরকার বায়তুল মোকাররমের অনুমতি না দিয়ে শাপলা চত্বরে অনুমতি দেয়। আমাদের নেতা-কর্মীরা দুপুর থেকে শাপলা চত্বরে আসতে শুরু করেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ঢাকার প্রবেশের পথে সর্বপ্রথম সকালে গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চের কাছে আমাদের নেতা-কর্মীদের মিছিল নিয়ে আসতে বাধা দিয়ে তাদের ওপর গুলী চালায়। পরে দৈনিক বাংলার মোড় থেকে শুরু করে পল্টন, তোপখানা রোড, গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পর্যন্ত মিছিলে আক্রমণ করতে থাকে। তারা বলেন, রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে- একদিকে শাপলা চত্বরে আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ চলছিল, অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের সাথে নিয়ে সমাবেশে আসতে থাকা হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলা অব্যাহত রাখে এবং দুপুর থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত পুরো এলাকায় পুলিশ পাখির মতো গুলী করে হত্যা করতে থাকে। অন্যদিকে সরকারি দলের সন্ত্রাসী কখনো স্বরূপে, কখনো হেফাজত কর্মী সেজে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। তাদের হামলায় রাস্তায় সাধারণ মুসল্লিদের লাশ পড়ে থাকে। স্বাভাবিক কারণে সমাবেশে অংশ নেয়া লাখ লাখ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সমাবেশস্থলে কর্মসূচি ঘোষণা করে সন্ধ্যার মধ্যেই সমাবেশ শেষ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। তারা বলেন, ফলে বাধ্য হয়ে আমরা শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে অন্যপ্রান্তে হত্যাকা- বন্ধের আহ্বান জানাই। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি বাহিনী সন্ধ্যার পর আরো ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে শুরু করে। হেফাজত নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত ছিল, যে করেই হোক সকালে সমাবেশস্থলে গিয়ে দোয়ার মাধ্যমে সমাবেশ শেষ করে দেয়া। তাদের এই ইচ্ছের কথা প্রশাসনের লোকজনকেও বার বার অবহিত করা হয়। কিন্তু তাদের কোন কথায় কর্ণপাত না করে নজিরবিহীনভাবে আগ্রাসী তৎপরতা চালায় সরকার। যেন গণহত্যাতেই আনন্দ। গণহত্যাতেই সমাধান।
সরকার আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে : হেফাজতের প্রথম ও প্রধান দাবি সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করা। এই দাবির বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে সরকার প্রকারান্তরে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করা ব্যতীত কেউ নিজেকে মুসলমান দাবি করতে পারে না, মুসলমান হতে হলে তাকে আগে এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। যে বিষয়টি ইতিপূর্বে আমাদের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কতিপয় বাম কমিউনিস্ট এবং নাস্তিককে খুশী করার জন্য সরকার সেই ধারাটি বাদ দিয়ে একদিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঈমান আকীদায় আঘাত হেনেছে অপরদিকে তারা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
আহতদের ধরতে হাসপাতালে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা : মানুষ কতটা পৈশাচিক হলে ও কতটা অমানবিক হলে ও কতটা মানবতাবিরোধী হলে আহত লোকদের ওপর আবার হামলা করার জন্য হাসপাতালে যেতে পারে? অবশ্য পৃথিবীর এমন কোন জঘন্য কাজ নেই যা আওয়ামী লীগ করতে পারে না। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডাররা রাজধানীর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, আল বারাকা হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আহত হেফাজত কর্মীদের ওপর আবারো হামলা চালায়।
নিরপেক্ষ মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া : সরকারের জঘন্য গণহত্যার প্রচার বন্ধে সরকার জনপ্রিয় দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। ভিন্নমতের মিডিয়া দৈনিক আমার দেশ ও বেসরকারি চ্যানেল দিগন্ত এবং ইসলামিক টিভি বন্ধ। ছাপাখানায় তালা দিয়ে আমার দেশ প্রকাশনা বন্ধের প্রায় এক মাস পর এ দুটি টিভি চ্যানেলকেও রোববার দিবাগত রাতে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ভিন্নমতের এই তিনটি মিডিয়া বন্ধ করে দেয়ার কারণে সরকার আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নিরীহ নেতা-কর্মীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রোববার গভীর রাতে যে নৃশংস তা-ব চালায়, তার ছিটেফোঁটাও কোনো মিডিয়ায় তুলে ধারা হয়নি। তারা মনে করেন, এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দিগন্ত টেলিভিশনকে কীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় তার বর্ণনা দিয়ে এর প্রধান বার্তা সম্পাদক জিয়াউল কবির সুমন জানান, ভোরে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কর্মকর্তারা এসে সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধের নির্দেশ দেন এবং কিছু যন্ত্রপাতি জব্দ করে নিয়ে যান। তাদের সঙ্গে র্যাব-পুলিশও ছিল। সোমবার ভোর ৪টা ২৪ মিনিট থেকে সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। দিগন্ত টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার (ব্রডকাস্টিং) আবুল হাসান বলেন, ভোর সোয়া চারটায় র্যাব-পুলিশের একটি বাহিনী এসে বলে আমরা দিগন্তের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে চাই। আমরা সারা দিন-রাত দায়িত্ব পালন করে ক্লান্ত। আমাদেরকে সহযোগিতা করুন। তিনি জানান, সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধের কোনো লিখিত নির্দেশ আছে কি না জানতে চাইলে ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, উপরের নির্দেশে এসেছি। সময়মতো লিখিত নির্দেশ পেয়ে যাবেন। তারপর তারা সম্প্রচারের মডেমটি নিয়ে চলে যান। এর আগে রাত ২টার দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইসলামিক টিভি কার্যালয়ে গিয়ে সম্প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিয়ে তালা লাগিয়ে দেন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শামস এস্কেন্দার। রাত আড়াইটা থেকে তাদের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। শামস অভিযোগ করেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার কার্যালয়ে প্রবেশ করে ভাংচুরও চালিয়েছে।
বামপন্থী মিডিয়ার কুরআনের প্রতি দরদ এবং গণহত্যার সংবাদ প্রচার না করা : হেফাজতের নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ যুবলীগের হামলার একপর্যায়ে আওয়ামী ক্যাডাররা ফুটপাতের দোকানগুলোতে আগুন দেয়। উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো তারা এটাকে হেফাজতের কাজ বলে প্রচার করছে। এখন তাদের কুরআনের প্রতি দরদ উথলে উঠেছে। কিন্তু শাহবাগীরা যখন আল্লাহ, রাসূল (সাঃ), কুরআন-হাদীসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে তখন তাদের এ দরদ এবং ভালবাসা কোথায় ছিল? মূলত ইসলামপন্থী ব্যক্তি ও আলেমদের চরিত্র হনন এদের মূল কাজ। তারা আওয়ামী ধ্বংসযজ্ঞকে হেফাজতের কাজ বলে প্রচার করছে, অপরদিকে সরকারি বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালো তার কোনো সংবাদই তারা প্রচার করছে না। এর মাধ্যমে তারা তাদের ইসলামবিরোধী এবং দালাল চরিত্র উন্মোচন করেছে।
গণহত্যা জায়েয করতে ব্যাংক লুটের কল্পকাহিনী প্রচার : সরকার তার গণহত্যাকে জায়েয করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটের কাহিনী প্রচারের জন্য ডিএমপি কমিশনারকে দিয়ে প্রেস কনফারেন্স করিয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, যেন তিনি আর ডিএমপি কমিশনার নন সরকারি দলের কোনো নেতা। কিন্তু দেশের জনগণ এ দেশের আলেমদের চরিত্র সম্পর্কে জানেন। ব্যাংক লুটের ইতিহাস কার আছে আর কার নেই তাও জনগণ জানে। কোন সরকারের আমলে ব্যাংক লুট হলে তার পিতা আগে নিজের ছেলের খোঁজ নিতেন তাও দেশবাসী জানে। অতএব সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমদের বিরুদ্ধে ব্যাংক লুটের কল্পকাহিনী প্রচার করে সরকারের শেষ রক্ষা হবে না।
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গণহত্যার সংবাদ : আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রোববার গভীর রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযানের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। পুলিশী অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন মিডিয়ার তথ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। সিএনএন জানিয়েছে, এতে ঠিক কতজন নিহত হয়েছে, তা সম্ভবত কখনো জানা যাবে না। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চার দশক আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। এএফপির খবরটি হিন্দুস্তান টাইমসসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করে। শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে পাঁচ লক্ষাধিক লোক উপস্থিত ছিল বলে সিএনএনসহ কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করে। এএফপি বলেছে, স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। এএফপি বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, মতিঝিলে পুলিশ ও ইসলামপন্থীদের যুদ্ধে অন্তত ২৮ জন মারা গেছে। এছাড়া আহত হয়েছে শত শত লোক। চার দশক আগে স্বাধীনতার পর এটাই বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। সিএনএন বলেছে-ঢাকায় ভূতুড়ে নীরবতা। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে কোনো সোমবার ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে উপচে পড়া ভিড় আর রিকশা আর গাড়ির জটে প্রাণ যায় যায় অবস্থা থাকে। কিন্তু এই সোমবার ছিল ভিন্ন। মতিঝিল মনে হচ্ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, জনমানবশূন্য ও বিধ্বস্ত। এতে বলা হয়, রোববার সারাদিন এবং রাতে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সাথে ইসলামপন্থীদের সংঘর্ষ হয়। মিতিঝিল এলাকায় পাঁচ লাখের বেশি লোক উপস্থিত ছিল বলে অনেক হিসাবে দেখা গেছে। এতে বলা হয়, রোববার গভীর রাতে এসব লোককে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য অংশ নেয়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) মৃতের সংখ্যা ১৪ বলে জানিয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন পুলিশ, একজন বিজিবি ও একটি ১২ বছরের বালক। আল-জাজিরা বলেছে, অভিযানে অংশ নিয়েছে ১০ হাজারের বেশি সদস্য। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, রোববার মতিঝিলে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে। এতে বলা হয়, রোববার রাতে মতিঝিল এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির ১০ হাজারের বেশি সদস্য অংশ নেয়। এপির সংবাদে বলা হয়- মোট নিহত ১৫ : বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে রোববার রাত ও সোমবার ইসলামপন্থী ও পুলিশের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে। এতে বলা হয়, মতিঝিল এলাকায় রোববার রাতে সাতজন নিহত হয়েছে। আর সোমবার কাঁচপুরে নিহত হয়েছে অন্তত আটজন। টেলিগ্রাফের নিউজ ঢাকায় নিহত ২২। যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় মিতিঝিলের ঘটনায় ২২ জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১১টি লাশ আনা হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন। এছাড়া আল বারাকা হাসপাতালে চারজন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আরো সাতজন নেয়া হয়। যদিও বিদেশী সংবাদমাধ্যমগুলো নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান জানতে এবং জানাতে পারেনি, তবে তাদের কাছে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গণহত্যা চলে পরের দিনও : রোববার দিবাগত রাতে মতিঝিলে গণহত্যা চালানোর পরও সরকারের খুনের নেশা মেটেনি। তারা হত্যাযজ্ঞ চালায় নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং বাগেরহাটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের কাঁচপুর, সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় ও শিমরাইল এলাকায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী এবং বাগেরহাটে র্যাব, পুলিশ এবং বিজিবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সংঘর্ষে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যসহ অন্তত ২৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে না.গঞ্জে ২০ জন হাটহাজারীতে ৭ ও বাগেরহাটে ২ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন আড়াই শতাধিক। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে দাবি করছেন হেফাজতে ইসলাম ও স্থানীয়রা। আহত হয়েছেন সাংবাদিক, পুলিশ, বিজিবি ও পথচারীসহ দুই শতাধিক। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। রোববার মধ্যরাতে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পর হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা সোমবার ভোরে যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়, শিমরাইল, কাঁচপুর এলাকার বেশ কয়েকটি মাদরাসায় আশ্রয় নেয়। পরে ভোর পাঁচটার দিকে হেফাজতের কর্মীরা মাদরাসার ভেতরে সংগঠিত হলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এসময় হেফাজতের কর্মীরা মাদরাসার মাইকে ঘোষণা দিয়ে অন্যান্য মাদরাসা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানালে ধর্মপ্রাণ স্থানীয় লোকজন সংগঠিত হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। সকাল সোয়া ৮টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মাদানীনগর মাদরাসায় প্রবেশের চেষ্টা করে। ওই সময় ঢাকা থেকে আনা হয় একটি সাঁজোয়া যান। ডেমরা রোড দিয়ে আসা সাঁজোয়া যানের পেছনে ছিল বিপুলসংখ্যক র্যাব ও পুলিশ। সাঁজোয়া যান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেলা পৌনে ১২টা পর্যন্ত কয়েক দফা মাদানীনগর মাদরাসায় যাওয়ার চেষ্টা করে। এ হামলায় ১৬ জন ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রাণ হারান। হাটহাজারীতে র্যাব পুলিশ, বিজিবির গুলীতে নিহত হয়েছেন সাতজন। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া গুলীতে হেফাজতে ইসলামের সাত কর্মী নিহত ও অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন। আহতদের বেশিরভাগই গুলীবিদ্ধ। বাগেরহাটে পুলিশের গুলীতে নিহত হয়েছেন ২ জন। আহত হয়েছেন ২০ জন। বাগেরহাটে সোমবার দুপুরে কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এসময় পুলিশের গুলীতে ঘটনাস্থলে একজন ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও একজন নিহত হয়েছেন।
পথে পথে আক্রমণ : মতিঝিলে সরকারি বাহিনীর হামলা এবং গণহত্যার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ পথে পথে আওয়ামী ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছেন। আওয়ামী ক্যাডাররা যাত্রাবাড়ী, মানিকনগর, ডেমরার কোনাপাড়া, শনিরআখড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করেছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাটে হামলার শিকার হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর রণহুঙ্কার : হেফাজতকে আর কোনো ছাড় দেবে না সরকার। যেখানে যেখানে হেফাজতের শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে, সেখানেই অভিযান চালাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকার এদের ব্যাপারে কোনো নমনীয়তা দেখাবে না বলে জানা গেছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সরকারের এ অবস্থানের কথা জানিয়েছেন বলে সভা শেষে একাধিক মন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেন। তার মানে এখন থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশের সব বড় বড় কওমী মাদরাসাগুলোতে হামলা চালানো হবে। এতে বোঝা যায় রক্তের নেশায় উন্মাদ সরকার। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে আর কত লাশ চাই প্রধানমন্ত্রীর?
গণহত্যা, গণগ্রেফতার, গণমামলা সরকারের একমাত্র হাতিয়ার : সরকারের এখন প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে গণহত্যা, গণগ্রেফতার এবং গণমামলা। হেফাজতের ওপর ভয়াবহ হামলার পর সরকার এখন বেছে নিয়েছে গণমামলা এবং গণগ্রেফতারের পথ। রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের সদস্যদের সাথে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পাঁচ থানায় ১৬টি মামলায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতাসহ লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামী করা হয়েছে। হত্যাকা-, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বিস্ফোরক দ্রব্য বহন, সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এসব মামলা করা হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের সদস্য ছাড়াও জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদেরও এসব মামলায় আসামী কর হয়েছে। গত সোমবার রাতে রাজধানীর শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল, পল্টন ও শ্যামপুর থানায় মামলাগুলো করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় বাদী হয়েছে পুলিশ। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে ৯ দিন ও অপর ৪০ সদস্যকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। রমনা থানায় গ্রেফতারকৃত ২০ নেতাকর্মীকে সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্য দিকে শাহবাগ থানায় গ্রেফতার হওয়া অপর ২০ জনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের পক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত সেই আবেদন আমলে না নিয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে কত লোক হতাহত হয়েছেন, সে সম্পর্কে সরকারিভাবে কোনো তথ্য নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো থেকে বলা হচ্ছে, এ সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। হেফাজতে ইসলামের যে সব সদস্য নিহত হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে কোনো থানায় মামলাও নেয়া হচ্ছে না। বরং যাদের লোক মারা গেছে, যারা আহত হয়েছে তাদেরই আসামী করে গণমামলা দেয়া হচ্ছে।
ভিনদেশী ক্লিনিং স্কোয়াড : মতিঝিলের নারকীয় হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করে ভিনদেশী কিলিং স্কোয়াড এমন সংবাদ বেশ কয়েকটি দৈনিকে যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটেও বিভিন্ন ছবি দেয়া হয়েছে, যাদের সাথে বাংলাদেশী কোন বাহিনীর পোশাকের মিল নেই। কারণ হিসেবে অনেকেই বলেছেন বাংলাদেশের কোন বাহিনীর লোকই এভাবে গণহত্যায় মেতে উঠতে পারে না, তারা আলেমদের গণহারে হত্যা করতে রাজি না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই অনেকেই বলছেন পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিলিং স্কোয়াড এনে ইতিহাসের এ ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয়েছে।
সরকার এবং পুলিশের মিথ্যাচার : সরকারের মুখপাত্র মাহবুব-উল আলম হানিফ সাহেব বলেছেন মতিঝিলে কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন মতিঝিলে কোন ধাতব বুলেট ব্যবহার করা হয়নি। পুলিশের আইজিপি বলেছেন আমরা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অভিযান সফল করেছি যাতে কোন প্রাণহানী হয়নি। সর্বশেষ বুধভার পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন মতিঝিলে কোন মানুষ মারা যায়নি। তাদের এ সকল কথার প্রেক্ষিতে স্বাভাবতই প্রশ্ন আসে রোববার বেলা ১২টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট এবং দৈনিক বাংলার মোড়ে গুলী, ঘটিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে যাদের সরানো গেল না। রাত দু’টার পরে কোন যাদু বলে মাত্র ১০ মিনিটে লাখ লাখ ঘুমন্ত মানুষকে পুলিশ এলাকা ছাড়া করল। যদি অস্ত্রই ব্যবহার না করা হয় তবে কেন ১৫ হাজারের বিশাল বাহিনীকে অভিযানে নামানো হলো? কেন অভিযানের পূর্ব মুহূর্তে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হলো? কেন হাজার হাজার মানুষ আজ নিখোঁজ? তুমুল বৃষ্টির পরেও কেন পরের দিন মতিঝিলের রাস্তা রক্তে লাল হয়েছিল? এর জবাব একটাই সরকার তাদের জঘন্য হামলা এবং গণহত্যাকে আড়াল করার জন্য একের পর এক গল্প তৈরি করছে। সাকার যাই বলুক, তাদের সমর্থক মিডিয়াগুলো যাই প্রচার করুক জনগণের বুঝতে বাকি নেই সরকার রাতের আঁধারে কি করেছে।
২৫ মার্চের কালো রাতকে হার হানিয়েছে : ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার কর্তৃক পরিচালিত সোমবারের গণহত্যাকে অভিজ্ঞমহলসহ দেশের চিন্তাশীল মানুষরা একদিকে যেমন শতাব্দীর ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন অপরদিকে তারা বলেছেন এ হামলা ৭১-এর কালো পঁচিশের পাকিস্তানী বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। সোমবারের শহীদদের গায়েবানা জানাযায় শরিক হতে এসে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, এ ধরনের গণহত্যা জীবনে আর একবারই দেখেছি তা হচ্ছে-১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। একই ভাষায় কথা বলেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ১৮ দলীয় জোটের বিবৃতি এবং জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতিতেও একই কথা বলা হয়েছে।
গণহত্যার ফল শুভ হয় না : সরকারের খুব ভালভাবে উপলব্ধি করা উচিত গণহত্যার ফল কখনো শুভ হয় না। বিরোধী মতকে দমন করে, বিরোধী আদর্শের লোকজনকে হতা করে সাময়িক বিজয়ের তৃপ্তি অনুভব করা যায়। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কখনোই শাসকগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। সরকার আজ গায়ের জোরে মিডিয়া বন্ধ করে দিয়ে মিডিয়াকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে গণহত্যা, জুলুম-নির্যাতনের সংবাদ গোপন করছে। উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বিরোধী মতের লোকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ান হচ্ছে। কিন্তু সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবেই এবং গণহত্যার বিচার একদিন হবেই। কারণ ক্ষমতা কারো জন্যই স্থায়ী সম্পদ নয়। ক্ষমতার পালাবদলে আজকে যারা আসামীর কাঠগড়ায় তারাই হবে বাদী আর বর্তমানের শাসকরা হবেন আসামী।
ওমর মোখতার থেকে আহমদ শফী : ইটালীর মুসোলিনী যখন লিবিয়ার ত্রিপোলী বন্দরে তার যুদ্ধ জাহাজ ভিড়ান তখন আশি বছর বয়স্ক ওমর মোখতার গ্রামের একটি মক্তবের শিক্ষক। ইতালীয় সৈন্যরা যখন লিবিয়ার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বাড়ি-ঘর দখল করতে শুরু করল। অস্ত্রের জোরে, অর্থের জোরে মুসলমানদের ঈমানহীন বানানোর অভিযান শুরু করলো, তাদের যুবকদের পাইকারীভাবে হত্যা করা শুরু করল তখন আমি বছর বয়সের ওমর মোখতার ইতালীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিলেন। আরামের জীবন ছেড়ে বনে জঙ্গলে কঠিন এবং কষ্টকর জীবন বেছে নিলেন। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। ইতালীয় বাহিনী বিপ্লবী বীর ওমর মোখতারকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দিল।
ফাঁসির মঞ্চেও ওমর মোখতারের মুখে ছিল হাসি। কিন্তু ওমর মোখতারের ফাঁসি দিয়ে ইতালীর আগ্রাসী বাহিনী লিবিয়ায় টিকতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর এ আন্দোলন দাবানলের মতো জ্বলে উঠলো পরিণতিতে মুসোলিনীর বাহিনী লিবিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়। আজ একইভাবে আশি বছর বয়সে আহমদ শফী ইসলামের দুশমন সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তা বিজয়ী হবেই।
বালাকোট থেকে মতিঝিল : সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বে ভারতের একটি প্রদেশে যে ছোট একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল তাকে ধ্বংস করার জন্য ইংরেজ এবং শিখ সৈন্যরা যে সাঁড়াশি আক্রমণ করে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর সকল কর্মী বাহিনীসহ তাকে শহীদ করেছিল ৬ মে। তিনশ’ বছর পরে আবার সেই ৬ মে বাংলার মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করল ধর্মনিরপেক্ষ ইসলাম বিদ্বেষী সরকার। সেখানে ছিল ভিনদেশী ইংরেজরা আর এখন দেশীয় ইসলামের দুশমন ক্ষমতাসীন মহল এবং তাদের সহযোগিতা।
জনতার আন্দোলন বিজয়ী হবে : জনতা ঈমানের দাবিতে যে আন্দোলনে নেমেছে সে আন্দোলন বিজয়ী হবেই। শাসকগোষ্ঠী আজ অস্ত্রের জোরে, ক্ষমতার জোরে তাদের দমন করার যতই চেষ্টা করুক না কেন এই শক্তি এক সময় নিষ্ক্রিয় হবে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা কখনো বৃথা যায় না। আল্লামা আহমদ শফী যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তাও বৃথা যাবে না। যে আন্দোলনে নিঃস্বার্থপ্রাণ লাখো জনতার অংশগ্রহণ, সমর্থন এবং ভালবাসা রয়েছে সে আন্দোলন বিজয়ী হবেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন