৫ মে ও ৬ মে’র মধ্যবর্তী গভীর রাতটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানুষ কিভাবে দেখবে জানি না। তবে এটুকু মনে হয়, এই রাত যে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালরাত হিসেবে লেপ্টে গেছে সেটুকু নিশ্চিত হয়ে গেছে। ৫ মে রোববার সকাল থেকে হেফাজতে ইসলাম তাদের ঘোষিত ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি পালন শেষে বিকেল থেকে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশ করে। তাদের দাবি সরকার না মানায় দিনশেষে ঘোষণা দেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা শাপলা চত্বর ছাড়বেন না। তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান অব্যাহত থাকবে। অপর দিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাদেরকে সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম তা মানেনি। এমনই প্রেক্ষাপটে গত রোববার গভীর রাতে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের মতিঝিল থেকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্মম অভিযান চালায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। এই বাহিনীতে ছিল ১০ হাজার সদস্য। অভিযানের সময় হাজার হাজার রাউন্ড গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। অভিযান চলার সময় সরকারবিরোধী বলে চিহ্নিত দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত এ দু’টি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রেখেছে সরকার। অভিযান চলার সময় পুরো এলাকার বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ অভিযানের যৌক্তিকতা ও হতাহতের সংখ্যা নিয়ে এখন দেশ-বিদেশে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। চলছে ঘটনার নানাধর্মী বিশ্লেষণ।
হতাহতের সংখ্যা কত?
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রশ্ন : এ অভিযানে হতাহতের সংখ্যা কত? ৭ মে মঙ্গলবার প্রথম আলোর নিজস্ব সংবাদদাতা তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত এক পুলিশসহ ২২ জন নিহত হওয়ার প্রাথমিক হিসাব পাওয়া গেছে। রাজধানীর হাসপাতালে খেঁাঁজ নিয়ে এ ২২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ১৯ জন গুলিবিদ্ধ ও দু’জন ছুরিকাহত হয়ে মারা যান। প্রথম আলো আরো জানায়, ৬ মে সোমবার ২৭ জন নিহত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ, হাটহাজারী ও বাগেরহাটে। তাদের মধ্যে দু’জন পুলিশ ও একজন বিজিবি সদস্য রয়েছেন। দৈনিক ইত্তেফাক ৯ মে জানায়, গভীর রাতের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে পুলিশ ও বুয়েটের ছাত্রসহ নিহত ১২। কাঁচপুরে নিহত ১৭। বাগেরহাটে নিহত ৯। দৈনিক যুগান্তর লিখেছে, ৫ মে’র অপারেশনে প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ খরচ হয়। এর বেশির ভাগই খরচ হয় অপারেশন সিকিউরড শাপলা’য়। অভিযানের সময় আহত অবস্থায় হেফাজতের অনেক নেতাকর্মীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ মাথা, বুক ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। অপারেশন থেমে গেলে দেখা যায়Ñ সোনালী ব্যাংক ভবনের ছাদের ভেতর ও পাশের গলির টিনশেড বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নেয়া নেতাকর্মীদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তবে বেশির ভাগ আহত কর্মীকে হেফাজত কর্মীদের নিয়ে যেতে দেখা গেছে। এভাবে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় এ ঘটনায় নিহতের বিভিন্ন সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। কোনো পত্রিকা বলেনি, শাপলা চত্বর অভিযানে কেউ হতাহত হয়নি।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘটনার পরদিন এক বিবৃতিতে দাবি করে, সরকার নজিরবিহীনভাবে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ছাড়াও প্রচুরসংখ্যক বিদেশী সশস্ত্র লোক দিয়ে আচমকা সমাবেশস্থলে ব্রাশফায়ার শুরু করে। তাতে হেফাজতের দুই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আহতের সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। একইভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের দাবি, গভীর রাতে শাপলা চত্বরে বাতি নিভিয়ে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও ছাত্রলীগের ক্যাডারেরা হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে। গণহত্যার পর শত শত লাশ গুম করা হয়েছে। একই দিনে (সোমবার) বিকেলে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব-উল আলম হানিফ দলের পক্ষে দাবি করেন, শাপলা চত্¡রে অবস্থান নেয়া হেফাজতকে সরাতে পরিচালিত যৌথ অভিযানে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোনো প্রাণহানি ছাড়াই হেফাজতকে ঢাকা ছাড়িয়ে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। এ ব্যাপারে বিএনপির শত শত লাশ গুম করার কথাও তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়। একইভাবে ১৪ দলও দাবি করেছে, এ অভিযানে কোনো হতাহত হয়নি। এ দিকে বিষয়টি নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে শাপলা চত্বর অভিযানের দু’দিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ৫ মে সকাল থেকে রাতের অভিযান চালানো পর্যন্ত সময়ে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হলেও বলা হয়, এরা মারা গেছেন সহিংসতায়। বেনজীর আহমেদ বলেন, এ অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শাপলা চত্বর অভিযানে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলে প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাকসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে নিহতের ও আহতের কমবেশি সে সংখ্যার কথা ছাপা হয়েছে, তা কি একেবারেই মিথ্যা? প্রশ্ন হচ্ছেÑ বিরোধী দলগুলো ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল যেসব কথা বলছে সেগুলোরও কি কোনো ভিত্তি নেই? বিভিন্ন মহল থেকে শাপলা চত্বর অভিযান সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করা হচ্ছে, সে দাবির প্রতি সরকারের কোনো সাড়া নেই কেন?
কী বলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো?
৫ ও ৬ মে হেফাজতের সমাবেশকে ঘিরে যে ঘটনা ঘটে গেল, অবিলম্বে সে সম্পর্কে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ৭ মে এই সংগঠন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই সহিংসতায় ৪৪ জন নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে অবশ্যই আইন প্রয়োগের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চলতে হবে এবং বিক্ষোভ মোকাবেলায় কোনো ধরনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপপরিচালক পলি ট্রাস্কট বলেন, ‘ঠিক কী ঘটেছে এবং কেন মৃত্যুর ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি রয়েছে। অবশ্যই এ ব্যাপারে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) শাপলা চত্বরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানকে ‘নির্বিচার হত্যাকাণ্ড’ (ম্যাসাকার) বলে আখ্যায়িত করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসঙ্ঘকে এ হত্যাকাণ্ড বন্ধে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংস্থা। এই কমিশন এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রচার করায় গণমাধ্যমের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটি একটি ইংরেজি দৈনিকে নিহতের সংখ্যা পাঁচজন বলে জানায়। তবে ইন্টারনেটে নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৫০০ বলে প্রচার করা হচ্ছে এবং অনেক লাশের ছবিও প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী মিশনগুলোর নীরবতার সমালোচনা করে এএইচআরসি বলেছে, মনে হচ্ছে ঢাকা ও এর আশপাশে ঘটে চলা এ বর্বর হামলা এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এরা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিল। মানবাধিকার সংস্থাটি অভিযোগ করে বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী এমন সব ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা সাধারণত কোনো বড় ধরনের যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। এএইচআরসি মনে করে, সরকার হেফাজতের দাবির প্রতি একমত নাও হতে পারে, কিন্তু তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরকারকে দিতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবারই অধিকার আছে বিক্ষোভ প্রদর্শনের। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নাগরিকের ও সর্বোপরি যেকোনো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের প্রতি অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে এএইচআরসি বলে, এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব।
মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ বলেছে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ৬ মে মধ্যরাতে শত শত নিরস্ত্র হেফাজতে ইসলামের কর্মীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এই ব্যাপকসংখ্যক নিহতের লাশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরিয়ে নেয়। ৭ মে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে অধিকার এই অভিযোগ করে। অধিকার দাবি করে, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাত্রির পর গত ৪২ বছরে ঢাকায় এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর ঘটেনি। অধিকারের দাবি, গভীর রাতে ঘুমিয়ে থাকা হেফাজত নেতাকর্মীদের হত্যা করার এ অভিযানে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির ১০ হাজার সদস্যের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা অংশ নেয়। এ হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি, রাবারে ঢাকা স্টিলের বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। মিডিয়া-কর্মীদের সরিয়ে নেয়ার পর পরিপূর্ণ অন্ধকারে এই হামলা চালায় বর্বরতা ও হতাহতের সংখ্যা লুকানোর জন্য।
এভাবে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা স্পষ্ট করে বলেছে, শাপলা চত্বরে বর্বর হত্যাকাণ্ড চলেছে। এ অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য কী জবাব আছে সরকারের হাতে? একমাত্র জবাবের পথ ছিল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দেশী ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা। কিন্তু সেই সৎ সাহস দেখাতে এখন পর্যন্ত সরকার পুরেপুরি ব্যর্থ নয় কি?
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবর কি মিথ্যা?
শাপলা চত্বরের ক্র্যাকডাউনের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এ ঘটনায় বিভিন্ন মিডিয়ায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতা দেখা যায়। সিএনএন জানিয়েছে, ঠিক কতজন নিহত হয়েছে, তা সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, চার দশক আগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। এএফপি সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, মতিঝিলে পুলিশ ও ইসলামপন্থীদের যুদ্ধে ২৮ জন মারা গেছে। এ ছাড়া আহত হয়েছে শত শত। এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। এএফপির রিপোর্টে বলা হয়, গভীর রাতে এসব লোককে ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য অংশ নেয়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস) মৃতের সংখ্যা ১৪ বলে জানিয়েছে। এদের মধ্যে তিজন পুলিশ, একজন বিজিবি ও একটি ১২ বছরের বালক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেÑ মৃতের চূড়ান্ত সংখ্যা অনেক বেশি হবে, যা সরকার না-ও মেনে নিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, রোববার মতিঝিলে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি জানায়, রোববার রাত ও সোমবার ইসলামপন্থী ও পুলিশের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছে। আর সোমবার কাঁচপুরে নিহত হয়েছে অন্তত আটজন। যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় মতিঝিলের ঘটনায় ২২ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ১১টি লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হয়। এ ছাড়া আল বারাকা হাসপাতালে চারজন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আরো সাতজন নেয়া হয়।
বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট বলেছেÑ গত ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে সরাতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ গোটা বিশ্বকে হতবাক করেছে। ইকোনমিস্ট মন্তব্য করে, এটি আরেকটি গণহত্যা। যদিও দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম বিষয়টি ব্ল্যাক আউট করার চেষ্টা করেছে। এ হত্যাযজ্ঞে নিহতের সংখ্যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে আরো অনেক বেশি হতে পারে। শাপলা চত্বরের গণহত্যার উদ্ধৃতি দিয়ে ইকোনমিস্ট বলেছে, ৬ মে আসলে কী ঘটেছে, তার বিস্তারিত এখনো অস্পষ্ট। সহিংসতার গ্রাফিক ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে বাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে রক্তাক্ত মৃতদেহ। এ ঘটনা সম্প্রচার করেছিল দু’টি ইসলামপন্থী টেলিভিশন চ্যানেল। সরকার চ্যানেল দু’টি বন্ধ করে দিয়েছে।
লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিটি খবরই বলছে, শাপলা চত্বরে এক ধরনের নির্বিচার ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলেছে। সেখানে কী করে সাধারণ মানুষকে সরকার ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই বলে বিশ্বাস করাবে যে, সে দিন কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি? কী করে মানুষ বিশ্বাস করবে, সে দিনের অভিযানে কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি? সেখানে কোনো গণহত্যা ঘটেনি?
কেন নতজানু মিডিয়া?
শাপলা চত্বরের ঘটনা প্রশ্নে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর নতজানু ভূমিকা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে আগামী দিনগুলোতে আরো রক্তক্ষয়ী অস্থিরতার আশঙ্কা করে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট গত শুক্রবারের অনলাইন সংস্করণে ‘পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ : ইন হট ব্লাড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত রোববার মতিঝিলে কী ঘটেছিল তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের ভীত সংবাদমাধ্যম ঘটনাটি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে নীরব থাকা এবং অভিযান শুরুর আগে সেখানকার বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করে দেয়ায় সেখানকার প্রকৃত ঘটনা জানা যাচ্ছে না। ইকোনমিস্টের অভিযোগ, শাপলা চত্বরের ঘটনায় বাংলাদেশের সব মিডিয়াই নতজানু ভূমিকা পালন করছে।
একই সত্যের প্রতিফলন রয়েছে, গত ১০ মে দৈনিক ইনকিলাবের ‘সব চ্যানেলই বিটিভি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশর সব বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো এখন কার্যত বিটিভিকরণ হয়ে গেছে। সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি যেমন সরকারের তোয়াজ করে এবং সরকারের পছন্দের খবর প্রকাশ করে থাকে, বর্তমানে প্রায় সব ক’টি চ্যানেল তা-ই করছে। সরকারকে খুশি করতে ‘অতি তোষামোদী’ নীতি গ্রহণ করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। সরকারকে খুশি করতে অনেক সময় বিটিভিকে হার মানাচ্ছে এসব চ্যানেলÑ যেন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। দর্শক প্রত্যাশিত খবর না পাওয়ায় বিটিভির মতো এসব চ্যানেলগুলোও আর মানুষ দেখছে না।
আমরা লক্ষ করেছি, ইদানীং এসব চ্যানেলে ফলাও করে বলা হচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম ওই দিন ঢাকায় ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে। এরা দোকানপাট লুট করেছে। আগুন লাগিয়েছে। এরা কুরআন শরিফ পুড়িয়েছে। এরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। এরা বাংলাদেশ ব্যাংক লুট করতে চেয়েছিল। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম স্পষ্ট করে জানিয়েছে, কোনো ধরনের ধ্বংসযজ্ঞে ও কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় তাদের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সে কথা প্রচারে আমাদের চ্যানেলগুলো কুণ্ঠিত। বরং তাদের প্রচারে এমনটিই প্রমাণ করতে চেষ্টা চলানো হয়েছে যে, হেফাজতে ইসলামই কুরআন পুড়িয়েছে। তাদের সাথে কোরাসে মিলিত হয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেছেÑ ‘হেফাজতে ইসলাম কুরআন পুড়িয়ে কোন ইসলাম কায়েম করতে চায়?’ অথচ এর বিপরীতে আমরা পরদিন দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানালাম, বায়তুল মোকাররমের দোকানপাটে হামলাকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন যুবলীগ নেতা দেবাশিস। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো এ দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস মাদরাসার ছাত্ররা কখনোই কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত হতে পারে না। কারণ, তাদের শেখানো হয় কুরআনকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। আমরা লক্ষ করেছি, কিছু চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকা বারবার একটা কথা প্রচার করছেÑ হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মাদরাসার ছাত্রদের, অর্থাৎ শিশুদের ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এমনটি প্রমাণের জন্য একটি চ্যানেলকে টকশো আয়োজন করতেও দেখা গেছে। কিন্তু এই টকশো উপস্থাপক কিংবা আলোচক একটিবারও উল্লেখ করেনি, গণজাগরণ মঞ্চে স্কুলের শিশুদের ব্যবহারের বিষয়টি। প্রশ্ন তোলা হয়নি সেখানে শিশুদের ঘৃণাসূচক স্লোগানে ব্যবহার মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় কি না। তবে উল্লিখিত টকশোতে একজন আলোচক উপস্থাপকের মুখের ওপর বললেন, ‘আপনি বলছেন হেফাজতে ইসলাম শিশুদের সমাবেশে এনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু বলেননি এসব কোমলমতি শিশুর ওপর সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে কি না। তিনি সরকারের অন্যান্য ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরার সময় ওই উপস্থাপককে কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে দেখা গেল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যেকোনো দেশে সুশাসন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা সুবিদিত। সেখানে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নতজানু ভূমিকাকে আজ যারা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কি তাদের জবাবদিহি করতে হবে না? এর সুস্পষ্ট জবাব আজ ও আগামী দিনে তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। কারণ যারা আজ মতিঝিলের ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কুরআন পোড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তুলে আল্লামা আহমদ শফী ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ফাঁসির আসামি করতে চায়, আর বাঁচাতে চায় শাপলা চত্বরের হত্যাযজ্ঞের সব জড়িতদের, তারা বরাবরই আসামি বিবেকবান মানুষের কাছে।
মাদরাসা কেন হবে টার্গেট?
এ দেশের সেকুলারপন্থীদের প্রধান টার্গেট মাদরাসা। সেই সাথে এরা মদদ পায় বাইরের সেকুলারপন্থীদের কাছ থেকেও। উইকিলিকসের ফাঁস করা এক তথ্যে জানা যায়, কওমি মাদরাসায় সেকুলার শিক্ষা চালু ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এরা চায় জঙ্গিবাদের লাগাম টেনে ধরতে। কারণ এরা মনে করে, মাদরাসাছাত্ররাই সেকুলারপন্থীদের শত্রু। আমাদের দেশের সরকারের এটি একটি বদ্ধমূল ধারণা। সরকার বামপন্থীদের মতোই মনে করে, মাদরাসা শিক্ষিতরাই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হয় ও এরা সেকুলার রাজনীতির বিরোধী। কিন্তু ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ সা:-এর অবলম্বিত নীতি-আদর্শের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন কার্লাইল, মহাত্মা গান্ধী, বার্নাড শ’, কারেন আর্মস্ট্রং ও আরো অনেক বিখ্যাত মনীষী। এ ক্ষেত্রে কমরেড এম এন রায়ের লেখা দ্য হিস্ট্রিক্যাল রুল অব ইসলাম একটি সুখপাঠ্য বই। ২০০৯ সালের এপ্রিলে ‘ন্যাশন ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্চ প্রজেক্টে’র ‘মাদরাসা : ইসলামিক এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক রিপোর্টে উল্লেখ আছে, ২০০৫ সালের জঙ্গি তৎপরতায় জড়িতদের মধ্যে মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা স্নাতকেরা রয়েছেন, কিন্তু শুধু মাদরাসাকে টার্গেট করে বলা হয়, মাদরসাগুলো জঙ্গি তৈরির আস্তানা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনগুলোর সন্ত্রাসীরা কি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা না? এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে সন্ত্রাস দমনের টার্গেট হবে কেন মাদরাসা ছাত্ররা?
কেন বন্ধ হচ্ছে ভিন্নমতের গণমাধ্যম?
এ দেশের বিবেকবান সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সরকার এক-এক করে বন্ধ করছে ভিন্নমতের গণমাধ্যমকে। আমার দেশ কেন বন্ধ করা হলো? এরপর বন্ধ করা হলো দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি । এরপর কোনটা যোগ হবে সে তালিকায়? সেই সাথে প্রশ্নÑ সরকার কি ফিরে যেতে চাইছে বাকশালী নীতিতে? তখন মাত্র চারটি দৈনিক সরকারি মালিকানাধীন রেখে, বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। দেশ কি আবারো সেই জায়গায়ই ফিরে যাচ্ছে? কে দেবে এর উত্তর?
এর রাজনৈতিক পরিণতি কী?
শাপলা চত্বর অভিযানের কি এখানেই সমাপ্তি? এর কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কি নেই? এর জবাবে বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো নতুন আরেক সঙ্কটের। সময়ের সাথে সঙ্কট আরো গভীরতর হচ্ছে। শাপলা চত্বরের হত্যাযজ্ঞ ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন রাজনৈতিক মেরুকরণকে ত্বরান্বিত করবে। এর মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক বিভাজন আরো বাড়বে। এ বিভাজন সরকারকে মুখোমুখি করবে ভয়ানক এক চ্যালেঞ্জের। এ বিভাজনে বিরোধী দলের পাল্লাই ভারী হবে তেমনটি দেখা যায়। সাধারণ মানুষ মনে করে, শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে সরকার সত্য বলছে না। এখানে সরকার এক ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নিয়েছে। নইলে কেন বলা হচ্ছে, এ ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি। কেন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে রাতের আঁধারে চালানো হলো এই অভিযান। কেন ঠিক ওই সময় বন্ধ করে দেয়া হলো দু’টি ভিন্নমতের টেলিভিশন চ্যানেল। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, এরশাদের জাতীয় পার্টি, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল (সরকারের ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ছাড়া) এ ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আগামী নির্বাচনে এর প্রতিফলন যে পড়বে, তা বলে দেয়া যায়্
আর কী অপেক্ষা করছে?
শাপলা চত্বরের ঘটনার প্রতিবাদ এখানেই থেমে যাবে, এমনটি ভাবা বোকামি। এর সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যোগ হলে আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার হবে। আর প্রথম আলোর সাম্প্রতিক জনমত জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। ৮৫ শতাংশ মানুষ মনে করে দেশের অবস্থা খারাপ। ৮১ শতাংশ মানুষ মনে করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ের পর পরিস্থিতি সামলাতে পারেনি সরকার।
ইকোনমিস্ট বলছে, বাংলাদেশে আরো রক্তপাত হবে। বাংলাদেশে রানা প্লøাজা ধসে ৯০০ জনের মৃত্যু যথেষ্ট নয়। দেশটিতে এখন রাজনৈতিক সহিংসতায় নতুন করে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ৬ মে ঢাকায় যা ঘটেছে তা গণহত্যার মতোই।
তাই সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, সামনে আমাদের জন্য আর কী অপেক্ষা করছে? হলমার্ক, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে নিয়োগবাণিজ্য, রানা প্লাজা, ফেব্রুয়ারির শতাধিক বিক্ষোভকারী হত্যা, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের মতো এক-এক করে এমনই আরো কত তিলক যোগ হবে জাতির কপালে?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন