বাংলাদেশের কয়েকজন সম্পাদক গত ১৮ তারিখে মাহমুদুর রহমানের মুক্তি, বন্ধ টিভি
চ্যানেল ও আমার দেশ ছাপাখানা খুলে দেবার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান
গ্রেফতার হবার প্রায় ৪০ দিন পর এই বিবৃতি এলো। এই ৪০ দিনে অবশ্য বাংলাদেশের
ইতিহাসে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে। তবুও একদমই কোন বিবৃতি না আসার চেয়েও দেরিতে
আসাকে মন্দ বলা ঠিক না। সাহেবরা যেভাবে বলেন, ‘বেটার লেইট দেন নেভার’ আমরাও তাই বলি। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
১১ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ লংমার্চ ও সমাবেশের পাঁচ দিন
পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর
রহমানকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করে সাদা পোশাক পরা
পুলিশ। সে অনেক দিন হয়ে গেল, মাহমুদুর রহমানকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এই প্রথম তিনি
গ্রেফতার হন নি, নির্যাতনও প্রথমবার নয়। এই নিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হলেন।
আইনি অনুমতি নিয়ে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন
দেখতে পেয়েছিলাম। ‘নাগরিক অধিকার রা কমিটি’র পে প্রত্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে উদ্বেগ
জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম আমরা। এ কথাও বারবার আমরা বলেছি যে মাহমুদুর
রহমানের মতাদর্শ, রাজনীতি, কিম্বা সম্পাদকীয় চর্চার প্রশ্নে অনেকের সমালোচনা থাকতে পারে।
কিন্তু আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে এমন একটি সরকার ও রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে যারা চিন্তা, বিবেক, মত এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। যারা সরকারের পে
যেকোন কারণে হোক অবস্থান নিচ্ছেন কিম্বা যারা একটি উদারনৈতিক মধ্যপন্থা অনুসরণ
করেন তাঁদের দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির হদিস আমরা পাবো না। বরং যাঁরা
বিরুদ্ধ মত, চিন্তা ও রাজনীতি ধারণ করেন তাদের ওপর সরকারের দমন-পীড়নের মাত্রা ও
চরিত্র দিয়ে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রিক নীতিনৈতিকতার অবস্থা আমাদের বুঝতে
হবে। সেই েেত্র ব্যক্তি মাহবুবুর রহমানকে নয়, বরং যে নীতিনৈতিকতার ত্রে সুরা
ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব সেই
নীতিনৈতিকতা রার জন্য গণমাধ্যমগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ভূমিকা দরকার।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশের সমাজ বিভক্ত। যতণ না নিজের নাক কাটা যায় ততণ অন্যের রক্তরণ
দেখে আমরা উল্লাস বোধ করি। সমূহ বিপদের চিহ্ন দেখার পরেও তার অর্থ উদ্ধার করতে অম
হয়ে যাই। নিজেদের চিন্তাচেতনার বিকৃতি অনুভব করবার শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলি।
তার পরেও দেখেছি ঐক্যবদ্ধ ভাবে না হলেও মাহমুদুর রহমানের রাজনীতির
সঙ্গে যাঁরা ভিন্ন মত পোষণ করেন, কিম্বা তার সম্পাদকীয় নীতির সমালোচনা করেন তাদের অনেককেই মাহমুদুর
রহমান ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ওপর সরকারের দমন-পীড়নকে নিন্দা করেছেন। অনেকে
এটাও বলেছেন, মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে মামলা করেছে সরকার, তার সবগুলোই
বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায় যে সরকারের হস্তপে থেকে
মুক্ত থেকে যদি আদালত বিচার সম্পন্ন করতে সম হয়, তাহলে তিনি বেকসুর খালাস
পাবেন। তাঁদের এই ভূমিকার প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের
সমর্থন নীতিগত মনে হয় নি। মনে হয়েছে, তাঁরা মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে
সরকারের দমন-পীড়ন, বিশেষত পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া এবং অবৈধভাবে ছাপাখানা সিলগালা করা
ইত্যাদির বিরুদ্ধে যেন বাধ্য হয়েই সমালোচনা করছেন। না করতে পারলেই বুঝি বেঁচে
যেতেন। এই অস্বস্তিকর কাজটি করতে গিয়েই নিজেদের সাফাই গাওয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে
করেছেন এবং বারবার, অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে মাহমুদুর রহমানের রাজনীতি ও সম্পাদকীয়
নীতির সমালোচনা করেছেন। এটাই যেন প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে অনেক দোষ থাকা
সত্ত্বেও নিছকই করুণাবশত এবং নিজেদের ব্যক্তিগত মহত্ত্ব ও ঔদার্য প্রদর্শন করবার
জন্য তারা মাহমুদুর রহমান ও দৈনিক আমার দেশের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের বিরোধিতা করছেন।
চিন্তা, বিবেক, মত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পে দাঁড়াবার আগে নিজেদের সাফাই হিশাবে
মাহমুদুর রহমানকে সমালোচনা করতে হয় কেন? আমি সমালোচনার বিপে নই মোটেও।
সমাজে যখন বিভিন্ন শ্রেণি ও মতাদর্শ আছে তখন প্রত্যেকেই যার যার শ্রেণি ও
মতাদর্শের জায়গা থেকে সমালোচনা করবেই। মাহমুদুর রহমানের কাছে ইসলাম শুধু ধর্ম বা
বিশ্বাসই নয়, তিনি মনে করেন এর একটা সাংস্কৃতিক দিক আছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই
বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না। কিম্বা কলকাতায় গড়ে
ওঠা ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিই বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির একমাত্র নির্ণায়ক নয়। এই
উপমহাদেশে, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের গভীর ও সুদূরপ্রসারী
সাংস্কৃতিক ভূমিকা আছে। তাকে আমলে না নিলে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না, পিছিয়ে পড়বে।
একে আমলে নিয়েই নতুন গণশক্তি গঠন করতে হবে। এক দিকে ভাষা ও সংস্কৃতি আর তার
বিপরীতে ইসলামকে শত্রু হিশাবে তারাই রাখতে চায় যারা একটি অবিভাজ্য ও অখণ্ড
শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশ বিকশিত হোক চায় না, বাংলাদেশের
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে যারা বিশ্বাস করে না। বরং যারা বাংলাদেশের জনগণকে
সাম্রাজ্যবাদের গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। এর বিরুদ্ধে তিনি একটি একটি সাংস্কৃতিক
বিপ্লব চান। তাঁর লেখাগুলোর মধ্যে এই কথাগুলো বারবারই এসেছে।
তাঁর এই অবস্থানের একটা সমালোচনা কিম্বা পর্যালোচনা হতেই পারে। তাকে
সংকীর্ণ অর্থে ইসলামপন্থী বলে নাকচ করাই যায়। কিন্তু কোন অবস্থান থেকে নাকচ করা
হচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবস্থান
থেকে নাকচ করার অর্থ হচ্ছে বর্ণবাদিতা ও সাম্প্রদায়িকতার পইে অবস্থান নেওয়া।
এটাই অধিকাংশ সময় হয়েছে। যদি পাশ্চাত্য চিন্তা ও সংস্কৃতির কাঠামোর মধ্যে
দাঁড়িয়ে করা হয়, তখন এই অনুমানই সক্রিয় থাকে যে পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং পাশ্চাত্যে
গড়ে ওঠা সমাজ ও রাষ্ট্রই একমাত্র আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র। এই েেত্র ইসলাম বা
ইসলামের ইতিহাসের কাছ থেকে কিছুই শিা নেবার নাই, তখন তাকে ঔপনিবেশিক চিন্তা
ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পাশ্চাত্যের বাইরে ভিন্ন ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের
চিন্তাও বুঝি অন্যায়। ইউরোপের ইতিহাসের একটি বিশেষপর্যায়কে মানুষের সার্বজনীন
ইতিহাস গণ্য করবার পেছনে দীর্ঘ বছরের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে তৈয়ার
হওয়া মনমানসিকতাই শুধু কাজ করে না, এর পেছনে বর্ণবাদী
দৃষ্টিভঙ্গিও গভীর ভাবে কাজ করে। যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ নয়। বিশেষত
পাশ্চাত্য শিা, পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামো এবং সাম্রাজ্যবাদী মতার বলয়ের বাইরে
দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে পর্যালোচনা করবার হিম্মতের প্রয়োজন হয়। সেটা নিজের সঙ্গে
নিজের দীর্ঘ লড়াইয়ের ব্যাপার। বলাবাহুল্য, সমাজে মাহমুদুর রহমানের
চিন্তার সঙ্গে এই বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক চিন্তাকাঠামোর সংঘাত আছে। সেটা থাকা অন্যায়
কিছু নয়। কিন্তু তাকে মোকাবিলার পথ হচ্ছে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অুণœ রেখে তর্কবিতর্কের পরিমণ্ডলকে সজীব ও সক্রিয় রাখা। উভয় পকেই এ
ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এত পত্রিকা থাকা
সত্ত্বেও বল প্রয়োগ করে মাহমুদুর রহমানের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। এতে মাহমুদুর
রহমান জিতেছেন, হারেন নি। তার দমন-পীড়নে যারা উল্লসিত হয়েছেন, বরং হার হয়েছে
তাদের। তির দিকটা হোল এই সকল বিষয়ে সমাজে আন্তরিক পর্যালোচনার পরিবেশ আমরা
হারিয়েছে। যা থাকার কথা চিন্তা ও মতপ্রকাশের পরিমণ্ডলে, তাকে নিয়ে
যাওয়া হয়েছে পুলিশের পুলিশি তৎপরতার মধ্যে, আদালতে, কারাগারে এবং
শারীরিক নির্যাতনে। এটা সমাধানের পথ নয়। চিন্তার ওপর আস্থা হারিয়ে মাহমুদুর
রহমানের ওপর বল প্রয়োগ করে যারা সমাধান খুঁজছেন তারা ভুল পথে গিয়েছেন।
যাঁদের হাতে পত্রিকা আছে তাঁরা যেকোন সময়ই মাহমুদুর রহমানের
সমালোচনা করতে পারেন। করেনও। মতাদর্শিক বিরোধ ও তর্কবিতর্ক সামাজিক চিন্তার বিকাশে
ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যদিও মিথ্যা প্রচার করতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। সারকথা
হচ্ছে বল প্রয়োগ করে অন্যায় ও বে-আইনি ভাবে একটি পত্রিকা বন্ধ করা এবং সম্পাদককে
ধরে নিয়ে গিয়ে অকথ্য নির্যাতন করার বিরুদ্ধে নিঃশর্ত ভাবে দাঁড়াবার নৈতিক
হিম্মত তারা দেখাতে পারেন না কেন? কেন একই সঙ্গে শর্ত হিশাবে তাঁদের ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানকে সমালোচনা
করে তার সঙ্গে তাদের নিজেদের পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়? জনগণকে তারা এতো
বোকা ও অজ্ঞান ভাবেন কেন? অন্যের মতাদর্শ বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা এবং নিঃশর্ত ভাবে মানবাধিকার
ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পে দাঁড়াবার মধ্যে গুরুতর পার্থক্য আছে। মানবাধিকার এবং
গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পে দাঁড়ানো এবং কোন বিশেষ ব্যক্তির পে দাঁড়ানো এক কথা
নয়। কিন্তু রীতিনীতির পে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁরা মনে করেন এই পপাত বুঝি ব্যক্তির
পাবলম্বন। কিম্বা কোন ব্যক্তির নাগরিক অধিকারের প্রতি পপাত বুঝি তার মতাদর্শের
প্রতিও পপাত। এই পপাত বিশেষ কোন ব্যক্তির পে চলে গেল কি না সেই ভয়েই সেই
ব্যক্তিটিকে একই সময়ে এবং একই কণ্ঠে নিন্দা ও সমালোচনা করেন তারা। এটা আসলে নৈতিক
হীনম্মন্যতার লণ। কেন এই হীনম্মন্যতা?
আসলে বাংলাদেশের উচ্চকোটি সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বার্থ যারা রা করে
তারা আজও ন্যূনতম সুশীল নৈতিক আচরণ রপ্ত করতে পারে নি। যাকে আমরা আরো সহজ ভাবে
বুঝতে চাইলে বুর্জোয়া সংস্কৃতিও বলতে পারি। বাংলাদেশ (বুর্জোয়া) গণতান্ত্রিক
রাষ্ট্র হিশাবে কেন গড়ে উঠতে পারছে না, এটা তার একটি কারণ অবশ্যই। এই
ব্যর্থতার জন্য বেগম খালেদা জিয়া কিম্বা শেখ হাসিনাই একমাত্র বাধা নয়।
হীনম্মন্যতা ও নীতিনৈতিকতার ঘাটতি থেকে তৈয়ার হওয়া সুবিধাবাদী এবং সদা
দোদুল্যমান পেটিবুর্জোয়া আচরণ ও সংস্কৃতিও সমান ভাবে দায়ী। সমাজের সবচেয়ে
শক্তিশালী ও অগ্রসর অংশ হচ্ছে সাংবাদিকেরা। বিশেষত পত্রিকার সম্পাদকেরা। দুই-একজন
ব্যতিক্রম থাকলেও এমনকি পাশ্চাত্য অর্থেও অধিকাংশের মধ্যে বুর্জোয়া চিন্তাভাবনার
ঘাটতি বিস্মিতই করে।
মনে রাখা দরকার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের
স্বাধীনতা ইত্যাদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হিশাবে যে শ্রেণি দাবি করে ও
কার্যকর দেখতে চায় তাদেরকে শ্রেণি হিশাবে ইউরোপীয় ইতিহাসের অভিজ্ঞতার আলোকে ‘বুর্জোয়া’ বলা হয়। এটা গালি নয়। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষা। সমাজ ও
রাজনীতি বুঝতে পরিভাষাগুলো কাজে লাগে। বাংলাদেশে এই দাবির পে শক্তিশালী জনমত না
থাকা এবং চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পে শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন
গড়ে না ওঠাকে সমাজতাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির দুর্বল উপস্থিতির লণ
বলে অনায়াসেই গণ্য করতে পারেন। বাংলাদেশে চুরি-ডাকাতি লুটপাটের মধ্য দিয়ে গড়ে
ওঠা ধনি মানেই রাজনৈতিক অর্থে ‘বুর্জোয়া’ নয়। তাকে সামন্ত শ্রেণির
বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে লড়াই করে ও জয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হয় নি। সাংস্কৃতিক
ও রাজনৈতিক ভাবে এদের সামন্তীয় বা আধা সামন্তীয় বলা যায়। বাংলাদেশের
পত্রপত্রিকা গণমাধ্যমের মালিকানা এই শ্রেণিরই হাতে। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও
রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে হঠাৎ ধনি হয়ে যাওয়া ধনপতিরাই বিভিন্ন গণমাধ্যমের
মালিক। ব্যতিক্রম খুব কম। এই ধনপতিরা তাদের স্বার্থের গোলামি করবার জন্য বিভিন্ন
গণমাধ্যমে সংবাদকর্মী নিয়োগ দেয়। পুঁজিতান্ত্রিক বাজারব্যবস্থার নিয়ম অনুযায়ী
শিতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির শ্রমবাজার থেকেই বেতনভোগী কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
গণতান্ত্রিক রীতিনীতির নিঃশর্ত সমর্থন ও তার পে প্রচার এই শ্রেণির কাছ থেকে আশা
করা যায় না। বরং রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে এদের কাজ হয়ে ওঠে যে ব্যবস্থা
নব্য ধনিদের দ্রুত ধনি করেছে সেই ব্যবস্থাকে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক ভাবে টিকিয়ে রাখা। এই সম্পর্কের অধীন হয়ে যে সকল সংবাদকর্মী কাজ করেন
তাদের পে ন্যূনতম বুর্জোয়া নৈতিকতা ও সংস্কৃতি রপ্ত করা কঠিন। যদি সেটা সম্ভবও
হয় তবে তা চর্চা করা আরো অসম্ভব। এই সকল পত্রিকার সম্পাদকদের পে সেটা আরো কঠিন।
এদেরই স্বার্থ ও চিন্তাচেতনার যারা প্রতিভূ তারা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে
মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও শাস্তি দেওয়ার পে নানান যুক্তি খাড়া করছে।
অর্থাৎ যে নৈতিক হীনম্মন্যতার কথা বলছি কথা বলছি তা শ্রেণিগত। এর
আর্থ-সামাজিক কারণ রয়েছে। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই যে এই শ্রেণির কাজ সেটা
অবশ্য অনায়াসেই বোঝা যায়। কিভাবে? এই শ্রেণি মনে করে বাংলাদেশের
রাজনীতির প্রধান সমস্যা হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে কথা না বলা।
এদের পত্রিকা পড়লে মনে হয় এই দুইজনকে কোন ভাবে সংলাপে বসিয়ে দিতে পারলেই
বাংলাদেশের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, কিম্বা সমাধানের সূত্র খুঁজে
পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকার গণমাধ্যম এবং নানান টকশোর মর্মবাণী এটাই।
অথচ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে এবং পঞ্চদশ
সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিশাবে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক মতা ও
ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ও পরিগঠিত রূপ নিয়েছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার নৈতিক, রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক বৈধতা অর্জনের জন্য শাহবাগের সমাবেশকে সফল ভাবে ব্যবহার করেছে এবং তারই
প্রতিক্রিয়া হিশাবে বাংলাদেশে সামাজিক শক্তি হিশাবে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাব
ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের তত্ত্বগত ও সাংস্কৃতিক বয়ান হিশাবে যে বর্ণবাদী ও
সাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খাড়া করা হয়েছিল তার বিপরীতে শক্তিশালী
ইসলামি রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। গণহত্যা, দমন-পীড়ন ও জেলজুলুম দিয়ে
একে মোকাবিলা করা অসম্ভব। ফ্যাসিবাদ তার চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের
পে একে চেনা এখন আর কঠিন নয়। ইসলামি রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে
ধর্মনিরপেতার নামে বর্ণবাদী, সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পে যারা দাঁড়াচ্ছে তাদের জনগণ
সহজেই চিনতে পারছে এখন। বাংলাদেশ ইসলাম প্রশ্ন একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার
বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। এই
পরিপ্রেেিত এক দিকে ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিপরীতে ধর্মকে প্রতিস্থাপন করে গত ৪২ বছর যে রাজনীতি
গড়ে উঠেছে তাকে নতুন ভাবে ও খোলা মনে প্রশ্ন না করলে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে
যাবার কোন সম্ভাবনা নাই।
‘বাঙালি’ হিটলারের জর্মন জাতির মতো বিশুদ্ধ ‘আর্য’ জাতি নয়, এই অভাবের কারণে
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র ধরা পড়ে জাতীয়তাবাদের
ভাষাভিত্তিক ও সাংস্কৃতিক বয়ানের মধ্যে, যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়
মুক্তযুদ্ধকে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরে ফ্যাসিবাদের জন্য সংগ্রাম করে নি, মুক্তিযুদ্ধের
ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণ লড়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক
ন্যায়বিচারের জন্য। যে ফ্যাসিবাদী চার নীতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আকারে হাজির
করা হয় তার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা ও বৈধতা নাই। সেটা আওয়ামী লীগের দলীয় নীতি হতে
পারে, কিন্তু তার জন্য একাত্তরে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে নি। যে
নীতির জন্য লড়াই হয়েছে তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই আছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণায়
ফ্যাসিস্টদের কোন নীতিই অন্তর্ভুক্ত নয়। মাহমুদুর রহমানের চিন্তাচেতনা এবং
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে ইসলামের শক্তিশালী আবির্ভাবকে ফ্যাসিবাদের
পর্যালোচনার আলোকেই বুঝতে হবে।
যারা বলছেন, মাহমুদুর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন, কোন সংবাদ
সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সংবাদ ছেপেছেন, কিম্বা বিদ্বেষপূর্ণ রিপোর্ট
ছেপেছেন তাদের সঙ্গে এই সময় তর্ক অর্থহীন। সাংবাদিকতার দিক থেকে এই সকল কর্মকাণ্ড
শনাক্ত করবার মানদণ্ড নির্ধারণ খুবই পুরানা একটি তর্ক। সমাজ যখন রাজনৈতিক ভাবে
দ্বিধাবিভক্ত তখন কোন নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ড নির্ধারণ করা সম্ভব কি না সেটাও তর্কের
বিষয়। শাহবাগের সমাবেশ নিয়ে যারা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছেন, একে বাংলাদেশে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে ক্রমাগত গৃহযুদ্ধের উসকানি দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে উসকানির অভিযোগ শোনা একটু হাস্যকরই শোনায়। তারা যদি
দাবি করে উসকানির জন্য মাহমুদুর রহমানের শাস্তি হতে পারে, ঠিক একই ভাবে
উসকানির জন্মদাতাদের রাজনৈতিক প্রতিপ তাদেরও শাস্তির দাবি করতে পারে। এই কুতর্ক ও
কূটতর্কগুলো বালখিল্যতা ছাড়া কিছু নয়। নিজেদের ভূমিকা তাদের নিজেদের কাছে অবশ্য ‘উসকানি’ মনে না হতে পারে, তবে এই উসকানির ফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী হতে পারে সেটা আর এখন
অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। এই কুতর্ক ও কূটতর্ক বাদ দিয়ে বাদ দিয়ে আমাদের উচিত
সমাজে আলাপ-আলোচনা তর্কবিতর্ককে ইতিবাচক অভিমুখে নেবার চেষ্টা করা।
যেসব পত্রিকার সম্পাদকেরা বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের দ্বিতীয়বার
ধন্যবাদ জানাতে আমাদের আপত্তি থাকবার কথা নয়। তবে তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা
এখন নৈতিক অবস্থান থেকে থেকে এই বিবৃতি দিয়েছেন সেটা ভাবা কঠিন। এপ্রিলের ২০ তারিখে
দৈনিক প্রথম আলো ‘দৈনিক আমার দেশ ও প্যান্ডোরার
বাক্স’ পড়ে সেটা আরো বেশি মনে হয়।
সেখানে বলা হয়েছে, “আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে
যে মতাসীন দলের এই সংবাদত্রে দলন কেবল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক এক
প্রচারপ্রিয় ব্যক্তির সম্পাদিত প্রচারধর্মী দৈনিকের টুঁটি চেপে ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ
থাকবে না। ভবিষ্যতের সরকারগুলো আর দশটা অপকর্ম অনুসরণের মতো সংবাদপত্র দলনের এই
হাতিয়ারটিও ব্যবহার করতে চাইবে।” মাহমুদুর রহমানের
প্রতি লেখকের বিষ তাঁর নামের আগে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিষাক্ত বিশেষণেই স্পষ্ট। ‘প্রচারপ্রিয় ব্যক্তির
প্রচারধর্মী দৈনিক’ বেশ বিশেষণ। বাংলাদেশের
রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাংবাদিকতার রুচি নিয়ে তর্ক করব না। কিন্তু লেখাটির গুরুত্ব
হচ্ছে এই সংবাদপত্রটি মনে করে যেভাবে দৈনিক আমার দেশ বন্ধ হয়েছে, ঠিক একই ভাবে
ভিন্ন সরকার মতায় এলে একই কায়দায় দৈনিক প্রথম আলোও বন্ধ করে দিতে পারে। যদি
তাদের মতের সঙ্গে সরকারের না মেলে, কিম্বা পত্রিকাটির উসকানি
সরকারের পছন্দ না হয় তাহলে একই হাতিয়ার সেই সরকারও ব্যবহার করতে চাইবে।
এই আশঙ্কা তো আসলেই আছে। এই সরকার তো চিরকাল থাকবে না। নাকি? এই ভয়েও যদি কোন
সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে থাকেন তাঁকেও ধন্যবাদ জানাতে আমাদের আপত্তি থাকবার কথা নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন